এ গ্রহের বাসিন্দা ৮০ লক্ষ প্রজাতির মধ্যে ১০ লক্ষ প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হওয়ার মুখে। আর এর জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে দায়ী মানুষই। আজ রাষ্ট্রপুঞ্জের একটি রিপোর্টে এমনটাই দাবি করা হল।
মাস ছয়েক আগে রাষ্ট্রপুঞ্জেরই অন্য একটি রিপোর্টে কপালে ভাঁজ পড়েছিল গোটা বিশ্বের। বলা হয়েছিল, হাতে আর মাত্র বারোটা বছর। এ ভাবে চললে এক যুগ পরে বিশ্ব উষ্ণায়ন অসহনীয় হয়ে উঠবে। সেই ধাক্কা সামলাতে না সামলাতেই নয়া রিপোর্ট।
রিপোর্টটি প্রকাশ করেছে রাষ্ট্রপুঞ্জের ‘ইন্টারগভর্নমেন্টাল সায়েন্স-পলিসি প্ল্যাটফর্ম অন বায়োডাইভার্সিটি অ্যান্ড ইকোসিস্টেম সার্ভিসেস’ (আইপিবিইএস)। ৫০টি দেশের ১৪৫ জন বিশেষজ্ঞকে নিয়ে তৈরি কমিটি এই রিপোর্ট তৈরি করেছে, যেখানে দাবি করা হয়েছে— জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং বেপরোয়া ভাবে প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংসের ফলে বিপন্ন ওই সব প্রজাতি। আগের তুলনায় দশ থেকে একশো গুণ দ্রুত গতিতে নিশ্চিহ্ন হচ্ছে এরা। মূল কারণগুলি হল— বাসস্থান কমছে, অপব্যবহার হচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদের, সেই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন এবং দূষণ। আর এই সব কিছুর পিছনে মানুষ। বিপদে ৪০ শতাংশেরও বেশি উভচর, ৩৩ শতাংশেরও বেশি প্রবাল প্রাচীর। নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীদের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি। আইপিবিইএস-এর অন্যতম বিশেষজ্ঞ রবার্ট ওয়াটসন বলেন, ‘‘বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে দ্রুত গতিতে। আমরা বাস্তুতন্ত্রের উপরে নির্ভরশীল। ফলে ভুগতে হবে আমাদেরও।’’
হাতের সামনে উদাহরণ অগুনতি— চোরাশিকারিদের তাণ্ডবে শেষ হতে বসেছে কালো গন্ডার (ব্ল্যাক রাইনো)। ২০১৪ সালে ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর নেচার’-এর রিপোর্ট অনুযায়ী গত ৪০ বছরে পৃথিবীতে এদের সংখ্যা কমে অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। ভয়াবহ ভাবে বিপন্ন ‘হকসবিল সি টার্টল’। জঙ্গলের গভীরে মানুষের অনুপ্রবেশে মৃতপ্রায় দশা পাহাড়ি গোরিলাদের। রাশিয়া ও চিন সীমান্তে বাস আমুর লেপার্ড (বিরল প্রজাতির চিতাবাঘ)-এর। সংখ্যায় খুবই কমে গিয়েছে এরা। খননকাজ, পাম ও গোলমরিচ চাষের জন্য ক্রমশ বাসস্থান হারাচ্ছে সুমাত্রার ওরাংওটাং। ‘সাউথ চায়না টাইগার’কে অবলুপ্ত প্রজাতি বলেই ধরা হয়। গত ২৫ বছরে তাদের দেখা মেলেনি।
জলবায়ু পরিবর্তনের মতো জীব বৈচিত্র ধ্বংসেও ‘খলনায়ক’ মানুষই। ভূখণ্ডের ৭৫ শতাংশের প্রকৃতি বদলে গিয়েছে। সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রের ৬৬ শতাংশ ভেঙে পড়েছে। আর এই সবটা হয়েছে শিল্পবিপ্লবের পরে। এর পিছনেও একটা বড় কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি। রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, ‘‘গত ৫০ বছরে জনসংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে গিয়েছে। ৩৭০ কোটি থেকে ৭৬০ কোটি হয়ে গিয়েছে। উল্লেখ্য, এর মধ্যে ভারতে জনসংখ্যা ১২৮ কোটি। চিন প্রথম স্থানে, ১৪২ কোটি। চাষবাস ও পশুপালনের জন্যই ভূখণ্ডের এক-তৃতীয়াংশ এবং স্বচ্ছ জলের ৭৫ শতাংশ ব্যবহার হয়ে যায়। রিপোর্টের সহ-লেখক স্যান্ড্রা ডিয়াজ়ের কথায়, ‘‘এ গ্রহের সামান্য কিছু অংশ এখনও মানুষের হাতে পড়েনি। তাই অক্ষত রয়েছে।’’
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, ২০১৫ সালের মধ্যে সামুদ্রিক খাদ্য উৎসের এক-তৃতীয়াংশ শেষ করে ফেলেছে মানুষ। গাছ কাটা দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে, এর মধ্যে বেশিটাই বেআইনি ভাবে। ১৯৮০ সালের পর থেকে সমুদ্রে প্লাস্টিক দূষণ দশ গুণ বেড়েছে। প্রতি বছর ৩০ থেকে ৪০ কোটি টন বর্জ্য মিশছে জলে। সমুদ্রে তৈরি হয়েছে ৪০০ ‘মৃত্যু এলাকা’। বিজ্ঞানীরা বলছেন, সবটা জুড়লে ব্রিটেনের থেকেও বড়।
ছবিটা এতটাই ভয়াবহ। তবু হাল ছাড়তে রাজি নন বিজ্ঞানীরা। ওয়াটসনের কথায়, ‘‘এখনও সময় আছে।’’ তবে তাঁর দাওয়াই, অবিলম্বে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সর্বোপরি সামাজিক চিন্তাধারা বদলাতে হবে। জোরদার পদক্ষেপ করতে হবে রাষ্ট্রগুলোকে। সবুজ এমন ভাবে বাড়াতে হবে, যাতে তা বিভিন্ন প্রাণীর বাসস্থানের ব্যবস্থা করে। একই সঙ্গে মানুষকে খাদ্যের জোগান দেয়। দূষণ থেকে বাঁচাতে হবে সমুদ্রকে। ‘‘ক্ষতিগ্রস্ত বাস্তুতন্ত্র বাঁচাতে সরকারকেই দায়িত্ব নিতে হবে,’’ বলছেন প্রকৃতিবিজ্ঞানী রেচেল ওয়ারেন। বলেন, ‘‘বন্যা রুখতে হবে, জল এবং বায়ুদূষণ বন্ধ করতে হবে। এগুলো তো মানুষের হাতেই।’’ ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড’-এর আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র নীতির ডিরেক্টর গুন্টার মিটলাচের বলেন, ‘‘আমরাই বোধ হয় প্রথম প্রজন্ম, যাঁরা যন্ত্রনির্ভর হয়ে পড়েছি। আবার আমরাই শেষ প্রজন্ম, যাঁরা এখনও চাইলে সব কিছু ঠিক করে দিতে পারি। খলনায়কই হোক নায়ক!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy