আম নিয়ে বাঙালির এই আবেগ আর আদিখ্যেতার শেষ নেই। ছবি: সায়ন্তনী মহাপাত্র
বাংলার আম, বাঙালির আমপ্রীতি আর আম দিয়ে বাংলার নিজস্ব বিবিধ পদ সম্পর্কে লিখতে গেলে কিছু না হোক, একখানি ছোটখাটো মহাকাব্য লেখা হয়ে যাবে। প্রায় তিন হাজার বছর আগের ‘বৃহদারণ্যক উপনিষদ’-এ প্রথম যে ফলের উল্লেখ পাওয়া যায় তা কালে কালে শুধু খাদ্য হিসেবে বাঙালির রসনাকেই দ্রবীভূত করেনি বরং আমাদের দৈনন্দিন রীতিনীতি, শাস্ত্রাচার, লোকাচার, শিল্পতেও মিশে গিয়েছে প্রগাঢ় ভাবে। পুজোর মঙ্গলঘট যেমন আম্রপল্লব ছাড়া অসম্পূর্ণ, তেমনই ফুলিয়া থেকে বিষ্ণুপুর পুজোর শাড়ি মানেই রংবাহারি আমকলকার নকশা।
বিদ্যাসাগর থেকে আমাদের প্রাণের ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ— আম খাওয়া এবং খাওয়ানো নিয়ে শৌখিনতায় এঁদের জুড়ি মেলা ভার। শোনা যায়, ভাল জাতের আম এনে পাতার বিছানায় ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সেই আম পাকিয়ে, নিজে হাতে বঁটিতে কেটে আম খাওয়াতেন বিদ্যাসাগর মশাই। রবি ঠাকুর আবার পাতলা বালদোর ছুরি দিয়ে নিজের হাতে আমের খোসা ছাড়িয়ে অতিথিকে পরিবেশন করতেন।
আম নিয়ে বাঙালির এই আবেগ আর আদিখ্যেতার খবর আমরা কমবেশি জানি। কিন্তু যা জানি না তা হল,খোদ এই বাংলার বুকে, আমের জেলা মুর্শিদাবাদেই রয়েছে এক বিশেষ সম্প্রদায়, আম নিয়ে যাদের আবেগ আর শৌখিনতা হার মানাবে সারা পৃথিবীর আমপাগল মানুষদের।
শহরওয়ালি নামে পরিচিত এই সম্প্রদায় মূলত রাজস্থানের ওসোয়াল জৈন বংশোদ্ভূত বণিক। ১৮ শতকের গোড়ার দিকে বাংলার মসনদের এক গুরুত্বপূর্ণ পালাবাদলের সময় এদেরই একটি দল ভাগ্যান্বেষণে চলে আসে তদানীন্তন বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদে। মুর্শিদাবাদ তখন সারা ভারতের বিত্তশালী শহরগুলির মধ্যে অন্যতম। বলা হত সব ব্রিটিশ অভিজাতদের সম্মিলিত সম্পদের চেয়ে বেশি সম্পদ তখন ছিল মুর্শিদাবাদে। এমনকি, বিশ্বব্যাপী ব্যবসার ৫% ব্যবসা আসত বাংলার এই ভূখণ্ড থেকে।
খুব কম সময়ের মধ্যেই ভাগীরথীর তীরে আজিমগঞ্জ ও জিয়াগঞ্জে বসতি স্থাপন করে এরা হয়ে ওঠে দেশের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। বিপুল ধনসম্পত্তির অধিকারী ও প্রবল প্রতাপশালী জগৎ শেঠ যাঁকে এক সময় ‘বিশ্বের ব্যাঙ্কার’ বলা হত, তিনিও এই সম্প্রদায়ের মানুষ। বাংলার মাটিতে থাকার সূত্রে এবং ব্রিটিশ ও মুঘলদের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্কের সুবাদে এই তিনটি সংস্কৃতিকেই এরা দেখেছিল খুব কাছ থেকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই তিনটি সম্প্রদায়ের প্রভাবেই তৈরি হয়েছে এখনকার শহরওয়ালি সম্প্রদায়ের এই অনন্য জীবনশৈলী ও সংস্কৃতি।
আম নিয়ে মুঘল সম্রাট এবং নবাবদের ছিল অপার বিস্ময় আর মুগ্ধতা। শুধুমাত্র আকবরের জমানাতেই মুর্শিদাবাদের আমবাগানে ছিল দুষ্প্রাপ্য ২০০ রকমের আমের প্রজাতি। নবাব সিরাজদৌল্লা এবং মুর্শিদ কুলি খাঁ দু’জনেই সারা ভারত থেকে দুষ্প্রাপ্য প্রজাতির চারা আনিয়ে গড়ে তুলেছিলেন বিশাল আমের বাগান। রাজস্থানের রুক্ষ, শুষ্ক মাটিতে আমের স্বাদে বঞ্চিত শহরওয়ালি সম্প্রদায়ও বাংলায় এসে প্রেমে পড়েছিলেন এখানকার আমের। নবাবদের শুরু করা পদ্ধতি অনুসরণ করে বিভিন্ন সুগন্ধি ফুল ও ফলের সঙ্গে আমের সংকর ঘটিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় আমের অনেক নতুন প্রজাতি। কোহিতুর, বিমলি, কালাপাহাড়, রানিপসন্দ, সারাঙ্গা, দমদমমিসরি, শাহদুল্লা— এখানকার বিখ্যাত কিছু প্রজাতি। বহু দিন পর্যন্ত এই আমের সম্ভার সংরক্ষিত ছিল শুধু মাত্র নবাব ও বিত্তশালী মানুষদের জন্য। এমনকি, জিয়াগঞ্জের দুগ্গার পরিবারের বাগানের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট আমের ভেট প্রতি বছর যেত বাকিংহাম প্যালেসে, রানি ভিক্টোরিয়ার জন্য। অশীতিপর বিক্রম দুগ্গার এখনও সংরক্ষণ করছেন স্মৃতিবিজড়িত সেই চিঠিগুলি। ১৯০০ সনের এমনই একটি চিঠিতে উল্লিখিত আছে রানিমায়ের সেই আম খেয়ে খুশি জ্ঞাপনের ঘটনার কথাও।
আম নিয়ে এই সম্প্রদায়ের আসক্তি এবং শৌখিনতা চিরকালই মাত্রা ছাড়া। কোন আম কখন পাকবে এবং কোন সময় এর স্বাদ সবচেয়ে ভাল হবে, এ সব তথ্য এদের নখদর্পণে। ‘মোলামজাম’ আম পাকার সময় বাগানে নিয়োগ করা হয় বিশেষ লোক, যাঁর কাজ আম পাকা মাত্রই ভেতরমহলে খবর দেওয়া, কারণ এই আমের সবচেয়ে ভাল স্বাদ পাওয়া যায় গাছ পাকার মুহূর্তে। ‘কোহিতুর’ আম আবার পাকার আগেই তুলে এনে তুলোর বিছানায় রেখে ১২ ঘণ্টা অন্তর ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে রাখতে হয় যাতে সবটা সম্পূর্ণ রূপে পাকে। আনানাস, চম্পা, গোলাপখাস অথবা চন্দনকোসা— নামের সঙ্গে মিলিয়ে এ সব আম সুঘ্রাণ ছড়ায় অপার। রানি ভবানীর নামাঙ্কিত ‘ভবানী’ আমের খোসা নাকি রানির ত্বকের মতোই মসৃণ আর উজ্জ্বল। ‘মোহনভোগ’ আমের স্বাদ আবার পরিতৃপ্ত করে মানুষের সমস্ত স্বাদকোরক, শহরওয়ালি সম্প্রদায়ের রাজকীয়তার আর বিত্তের মতো এদের আমের গল্পও গুনে শেষ করা যায় না।
স্বাভাবিক ভাবেই গরমের মরসুম এলেই এঁদের বাড়িতে প্রতি দিন চলে আমের উৎসব। সকালের জলখাবার থেকে শুরু করে রাতের খাবার, কিংবা বিকেলের ঠান্ডা পানীয়— সবেতেই থাকে আম। রাজস্থানি, জৈন, বাঙালি , মুঘলাই আর ব্রিটিশ প্রভাবের এই অসামান্য মেনুতে কাঁচা এবং পাকা আমের ব্যবহার হয় বিভিন্ন ভাবে, বিভিন্ন স্বাদে। কাঁচা আম আর ছোলার পুর ভরা পটলের চটপটা ‘আম কি কুট্টি’, পাঁচফোড়নের ছোঁক দেওয়া ভাতের ফ্যান আর পাকা আমের ঝোল ‘মাড়িয়া’, সাজিরা আর সর্ষে ফোড়নে টক আম আর ভেজানো ছোলার কাঁচা আচার ‘আম চনে কি কুট্টি’, জিভে জল আনা টক-ঝাল-মিষ্টি ‘আম কি লৌনজি’, ‘আম পাপড়’, ‘আমের প্যাড়া’, শরবতের মতো পাতলা ‘আমরস’ অথবা ‘কাঁচা আমের পায়েস’— অভিনব এই পদগুলি বানানো হয় জৈন ধর্মের কঠোর নিয়মাবলী মেনেই।
আম নিয়ে এদের অনুরাগ যেমন অগাধ, খুঁতখুঁতুনিও কিন্তু কম নয়। সযত্নে খোসা ছাড়িয়ে এই মহার্ঘ আম কাটা এবং রুচিসম্মত ভাবে তার পরিবেশনকে শহরওয়ালি মহিলারা উন্নীত করেছেন প্রায় শিল্পের পর্যায়ে। বিশেষ ভাবে তৈরি ভীষণ পাতলা ছুরির সাহায্যে, কোমল হাতে, এক টানে এমন করে খোসা ছাড়ানো হয় যাতে আমের গায়ে কোনো দাগ না লাগে বা নষ্ট না হয় এক ফোঁটাও রস। খুব নরম আম কাটার জন্য আবার ছুরির পরিবর্তে ব্যবহার করা হয় বাঁশের পাতলা বাখারি। আমের রূপ, রস, গন্ধ সম্পূর্ণ ভাবে গ্রহণ করার জন্য এঁরা এতটাই যত্নবান যে গরমের সময়ে সোনা রঙা কাঁসার রেকাবে চার টুকরোয় কেটে, এই আম পরিবেশন করা বরফে রেখে ঠান্ডা করে।
সুকুমার সেন তাঁর বঙ্গ ভূমিকা গ্রন্থে লিখেছেন, ‘কোন কোন বৃক্ষ ফুল ফোটাবার কালে সুগন্ধি হয়, কোন কোন বৃক্ষের কাঁচা ফল হয় সুরভিত ও সুস্বাদযুক্ত, কোন কোন বৃক্ষ আবার ফল পাকলে হয় মনোরম, কিন্তু ফুল ফোটাবার কাল থেকে ফল পেকে যাওয়া পর্যন্ত আগাগোড়া মাধুর্য এ জগতে একমাত্র আম্রবৃক্ষেই প্রকটিত’।
কথায় বলে বিত্ত মানুষের রুচিকে পরিশীলিত করে জীবনকে সম্পূর্ণ রূপে উপভোগ করতে শেখায়। শহরওয়ালি সম্প্রদায়ের আমের প্রতি এই অনুরাগ শুধু এই সুবাসিত ফলটির জন্যই নয়। প্রতিটি পর্যায়ে গাছের এই বিবর্তনের মাধুর্যের মূল্যায়ন তারা করে অশেষ ধৈর্য আর পরম যত্ন সহকারে। শুধু একটি ফলকে ভালোবেসে যে ভাবে এই সম্প্রদায় তাদের জীবনশৈলীতে, অনুভূতিতে আমকে একাত্ম করে নিয়েছেন, তার জুড়ি মিলবে না আর কোথাও।
শহরওয়ালি সম্প্রদায়ের রান্নায় মুঘল প্রভাব হিসেবে যে পদটির কথা প্রথমেই মনে হবে তা হল কাঁচা আমের পায়েস বা ‘কচ্চে আম কি ক্ষীর’।
মুঘল রান্নার রাজধানী হিসেবে খ্যাত লখনউয়েও এই পদটি বেশ জনপ্রিয়। আবার অদ্ভুত ভাবে উনিশ শতকের শেষ ভাগে প্রকাশিত বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়ের লেখা মিষ্টান্ন পাক গ্রন্থেও এই পদের উল্লেখ মেলে। যদিও সে রান্নার পদ্ধতি বেশ খানিকটা অন্য রকম।
কচ্চে আম কি ক্ষীর (কাঁচা আমের পায়েস)
পাকা মিষ্টি আমের ক্ষীর বা পায়েস সকলেই খেয়েছেন। রইল শহরওয়ালি সম্প্রদায়ের অভিনব সেই কাঁচা আমের পায়েসের প্রণালী। বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাসের প্রবল গরমের দিনে জাফরান, বসরাই গোলাপের জল আর কাঁচা আমের হালকা গন্ধে সুবাসিত এই পায়েস পরিবেশন করা হয় বরফের কুচির উপর রেখে ঠান্ডা করে।
উপকরণ:
কাঁচা আম: ১টি বড় (আঁটি হওয়া শক্ত সুগন্ধিত আম)
দুধ: ১ লিটার
চিনি: ৪ টেবিল চামচ বা স্বাদমতো
জাফরান: ১ চিমটি
গোলাপজল: কয়েক ফোঁটা
খোসা ছাড়ানো আমন্ড বাদামের কুচি: ইচ্ছে মতো
পদ্ধতি:
তলা পুরু পাত্রে দুধ ফুটতে দিন।
দুধ ফুটতে শুরু করলে আমের খোসা ছাড়িয়ে ভাল করে কুরিয়ে নিন। হাত দিয়ে চেপে নিংড়ে সমস্ত রস চেপে বার করে ভাল করে দু’বার জল বদলে কচলে ধুয়ে নিন।
একটা বাসনে জল ফুটতে দিন। জল ফুটে উঠলে আমেরে কুচি খুব ভালো করে নিংড়ে ফুটন্ত জলে দিয়ে ফুটিয়ে নিন দু’মিনিট। আম সেদ্ধ হয়ে গেলে ছাঁকনিতে ছেঁকে বার বার ধুয়ে নিন যতক্ষণ না আমের টকজল পুরোটা বেরিয়ে যায়। ভাল করে নিংড়ে সরিয়ে রাখুন।
দুধ ফুটে ঘন হয়ে ৭০০ মিলি মতো হলে এতে চিনি আর জাফরান দিয়ে আরও দু’মিনিট ফুটিয়ে নিন। গ্যাস বন্ধ করে দুধ ঠান্ডা করে নিন।
আমের কুচি, গোলাপ জল আর বাদাম ভাল করে মিশিয়ে ফ্রিজে রেখে ঠান্ডা করে পরিবেশন করুন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy