Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
হিন্দু, ইসলাম ও খ্রিস্টান খাদ্যাভ্যাস মিলেমিশে তৈরি কায়স্থ খাদ্যঘরানা। সেই রসনা প্রতিযোগিতায় ভুনা মা
Food

দম ও ভুনায় শাহি রসনা

এমন শাহি রসুই, খানদানি খাতিরদারি আর সম্ভ্রান্ত রুচি যাঁদের, তাঁরাই হলেন কায়স্থ সম্প্রদায়। জনপ্রিয় বিশ্বাস, তাঁরা ব্রহ্মার কায়া বা দেহজাত পুত্র চিত্রগুপ্তের বংশধর।

চিরশ্রী মজুমদার
শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০২০ ০০:৫৪
Share: Save:

পুজো এলে আমাদের পাকশালেও সাজো সাজো রব লাগে। চুড়ো করা ভাত, চার পাশে মাটন, চিংড়ি, চাটনি, সন্দেশ। তখন পাত দেখলেই বোঝা যায়, মেজাজে উৎসবের আমেজ লেগেছে। তবে এই ভারতেই এমন এক জনগোষ্ঠী আছে, যাদের খাবার টেবলে সংবৎসর উৎসবের ধুম। প্রায়ই তাঁদের বাড়ির পেল্লায় ডাইনিং টেবলে সাজানো হয় ক্ষীর মাখনা, শুখি উরদ ডাল, কুড়কুড়ি ভিন্ডি, শামি কাবাব, কিমা পরাণ্ঠা, পোলোয়া, হালুয়া। গৃহিণী আঙুলের আন্দাজে চিমটে করে চিনি, হলুদ, ধনে আর লঙ্কা গুঁড়ো ছিটিয়ে দেন ফুটন্ত সুরুয়ায়। তার পর আঁচ কমিয়ে ধৈর্য ধরে খুন্তির পাকে দেবভোগ্য ভোজন আয়োজন করেন, আঘ্রাণ গোটা পাড়ায় ছড়িয়ে পড়ে। এ বাড়িতে নেমন্তন্ন পেলেও ভাগ্য ধন্য। চিনেমাটির প্লেটে গিন্নিমা বেড়ে দেবেন বাড়িতে গড়া খাস্তা কচৌরি আর হিংগন্ধি আলু ভুনা। লোভে পড়ে তাতে পেট ভরে ফেললে অতিথি বিপদে পড়েন। কারণ তার পরই খানসামা রেকাবি জুড়ে আনে ভেড়ার দাওয়াতওয়ালি রাং।

এমন শাহি রসুই, খানদানি খাতিরদারি আর সম্ভ্রান্ত রুচি যাঁদের, তাঁরাই হলেন কায়স্থ সম্প্রদায়। জনপ্রিয় বিশ্বাস, তাঁরা ব্রহ্মার কায়া বা দেহজাত পুত্র চিত্রগুপ্তের বংশধর। তাই ‘কায়স্থ’ নামে পরিচিত। পরলোকের পাপ-পুণ্যের হিসেবলেখক পূর্বপুরুষের মতোই মর্ত্যলোকে হরেক রকম কলম পেষার কাজে এঁরা নিয়োজিত। মোগল থেকে ইংরেজ— নানা আমলে প্রশাসনিক কাজ সামলেছেন। সঙ্গে তাঁদের জীবনচর্যায় কালে কালে মিশেছে মোগল-ব্রিটিশদের খানাপিনা চালচলন। শাসকের সাম্রাজ্য যত ব্যাপ্ত হয়েছে, ততই কর্মচারীর দল ছড়িয়ে গিয়েছেন গাঙ্গেয় সমভূমিতে। প্রধানত, আরাবল্লির চারপাশে, উত্তরপ্রদেশ-বিহার আর পশ্চিমবঙ্গে। অঞ্চলভেদে মরসুমি ফল-আনাজ, মাছ-মাংসও

তাঁদের রন্ধনশালের স্বাদ বাড়িয়েছে। তৈরি হয়েছে এলাহি এক খাদ্যঘরানা— কায়স্থ খাদ্যাভ্যাস বা কায়স্থ কুইজ়িন।

• কালিয়া কোফতা পসিন্দা

উত্তর ভারতের বিখ্যাত গঙ্গা-যমুনি তেহজ়িব অর্থাৎ ইন্দো-ইসলামিক মিশ্র সংস্কৃতির ঝলক মেলে কায়স্থদের ভোজবিলাসে। হেঁশেলে মোগলাই দস্তরখানের আদলে অজমাংসের রাজপাট। মোগল রেওয়াজ মেনেই রান্না হয় ঢিমে আঁচে তেল-মশলায় আচ্ছা করে ঝলসিয়ে (ভুনা) বা ঢাকনা চাপা দিয়ে খাবারটাকে তরিবত করে ভাপিয়ে (দম)। ‘ধুনগার’ পদ্ধতিতে গরম কয়লায় ঘি গলিয়ে খাবারে অনবদ্য ক্রিমি ফ্লেভার জোড়া হয়। ঘুরিয়েফিরিয়ে রান্না হয় মাংসের কালিয়া, কিমার কোফতা, বাদামি গোস্ত পসিন্দা। তবে তাঁরা দরবারি ভোজের মতো দামি জ়াফরান বা মিঠা আতর দেন না। ম্যারিনেশন আর কষানোর কেরামতিতেই মাংসের আঁশটে গন্ধ দূর করেন। কড়াই থেকে রসুই নামিয়ে ছোট এলাচ, জায়ফল, জয়িত্রি কিংবা ক’ফোঁটা কেওড়া জল ছিটিয়ে দেন। মাংসের সেই মোগলাই পদেই ডুবিয়ে খান ব্রাহ্মণ্য পাকমতে ঘিয়ে ভাজা পরোটা বা হিন্দু বাড়ির পুরি-ফুলকা। বাঙালি কায়স্থ ঘরে যেমন লুচির সঙ্গে তেল কষা পাঁঠার কালিয়ার খুব কদর। দিল্লি দরবারের সঙ্গে রাজপুতানার যোগাযোগ থাকায় কায়স্থ পাতে লাল মাসও ভূরিভূরি।

এই মিশ্র সংস্কৃতিরই আর এক উদাহরণ কাবাব-পরোটা। উচ্চবর্ণের হিন্দু ঘরে রেস্তরাঁর খাবার ঢোকার বহু আগে থেকেই এঁরা বাজারের নানভাইদের কাছ থেকে শিরমল, কোর্মা আর রুমালি রুটি কিনে নৈশভোজ করেছেন। তবে কায়স্থ বংশের তারকা খাবার ইয়াখনি পোলাও। বাসমতি চালের দানায় ইয়াখনি বা মাংসের সুগন্ধি স্টক মিশে তাকে স্বর্গীয় স্বাদে মুড়ে দেবে।

• নকল মাংস, তেহরি, চচ্চড়ি

পরিবারের নানি-দাদিরা প্রায়শই নিরামিষাশী। কিন্তু তাঁরা মাছ-মাংসের পদ্ধতিতেই ডাল, আনাজ রাঁধেন। এঁচড় পিস পিস করে কেটে বা কাঁচকলার চাকলা মেথি-ফোড়নে রেঁধে নকল মাছ-মাংস তৈরি করে ফেলেন। যে টক দই বা গোটা গরম মশলায় আমিষ রান্নায় আঁশটে গন্ধ ঢাকা হয়, সেগুলোই এ সব পদেও মাখিয়ে দেন। ফলে সেই মুগ ডালের শামি কাবাব, ডালের কোফতা, আটে কা কিমা, কেলে কী মছলি বা গাছপাঁঠার (এঁচড়) কালিয়ার সঙ্গে ননভেজ আইটেমের ফারাক ধরে সাধ্যি কার! ডাল দিয়েই লিভার কারি, পাউরুটি বেসন দিয়ে অমলেট তৈরিতেও তাঁরা ওস্তাদ! ছোলার ডাল বাটা দিয়ে তৈরি বাঙালির প্রিয় ধোকার ডালনাও এই গোত্রেরই পদ। এই ঘরানারই সাক্ষ্য বহন করছে পলান্নের নিরামিষ সংস্করণ খড়া (গোটা) মশলায় তৈরি মটর বা কাঁঠালের তেহরি। স্বাদে-বর্ণে মোতি বিরিয়ানির সমতুল।

কায়স্থ রসনায় মরসুমি ফল ও আনাজপাতির জামাই আদর। গরম কালে করলার মতো অপছন্দের আনাজ দিয়েও মুচমুচে অ্যাপেটাইজ়ার তৈরি হয়। রসালো ঝিঙে, পটল, ঢেঁড়শের সঙ্গে কড়ায় ঢেলে পেঁয়াজ দিয়ে পৌনে ঘণ্টা কষলে তবে সোয়াদ খোলে। শীতে আলু, কপি, গাজর, শালগম দিয়ে সারা রাত ধরে রান্না করা হয় শাবদেগ বা পাঁচমিশেলি তরকারি। এতে কয়েক টুকরো মাংস দিলে আরও স্বাদ বাড়বে। অনেকটা বঙ্গদেশের কাঁটাচচ্চড়ির মতো। বিকেল নামে আঞ্জির পেয়ারার সুগন্ধে। কনকনে রাতে শৌখিন চাদর মুড়ি দিয়ে তাঁরা খান ভরওয়ান অর্থাৎ পুর ঠাসা রান্না। ছোলা-বাদাম-নারকোল কোরা পোরা বেগুন বা আলু-মৌরি-আমচুরে ঠাসা ক্যাপসিকাম। আচারের বয়ামের প্রতি তাঁদের দেখার মতো প্রীতি। আমচুর ডালে ফেলে বা লসুড়ে (জলপাইয়ের মতো) কা আচার, পুদিনার চাটনি দিয়ে চাখেন মিসি রোটি। পর্ক বা ল্যাম-এর হাড় ছাড়িয়ে লেবু-লঙ্কা-রসুন, ভিনিগার-গুড়ে নেড়েচেড়ে আচারি মাংস বানিয়ে তাক লাগিয়ে দেন।

• পোচ ও পোর্সেলিন

মোগল প্রভুরা বিদায় নিলে দ্রুত ইংরেজি শিখে ব্রিটিশ সরকারের অধীনে কাজ খুঁজে নেন কায়স্থেরা। ইংরেজদের সংস্পর্শে তাঁরা পোর্সেলিনের কাপ প্লেট ব্যবহার শুরু করেন, টেবল-চেয়ার, কাঁটা-চামচ, ন্যাপকিন, বেড টি, পোচের আদবকায়দা রপ্ত করেন। রান্নায় টম্যাটো পিউরি, মটরশুঁটির কেরামতি শুরু হয়। কিচেনে পোলট্রি পণ্য ঢুকে পড়ে। ইংরেজদের এগ কারিতে ভারতীয় মশলাপাতি ফেলে ধনেপাতা কুচি ছড়িয়ে জবরদস্ত ডিম কষার আবির্ভাব হয়। অন্য দিকে, নার্গিসি কোফতায় কিমার স্বাদ বহু গুণ বাড়িয়ে দেয় একটি ডিমসিদ্ধর উপস্থিতি।

দশেরা-দিওয়ালিতে কায়স্থ ঘরে রোশনাই নিয়ে আসে গাজরের হালুয়া, ঘিয়ে রোস্ট করা ড্রাই ফ্রুটস বাক্স। পুজো সাঙ্গ হলে অতিথি-পরিজন মিলে সান্ধ্য মজলিশে থাকবে গাজর-বিটের লাল কাঞ্জি, তেল কাতলা, কাবাব-কালিয়া-পলান্নের সুঘ্রাণ। আর কিঞ্চিৎ রঙিন পেয়ালার ঠুংঠাং। মোগল-ব্রিটিশের যৌথ কৃতিত্বে কায়স্থ খানা-ঘরানা ওই শখটি থেকে পরিত্রাণ পায়নি যে!

অন্য বিষয়গুলি:

Food Non-Veg Recipe
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy