কর্নডগ, র্যামেনের স্বাদ কি টেক্কা দিচ্ছে চিলি চিকেন আর ফ্রায়েড রাইসকে? ছবি: সংগৃহীত
এ বছর মাধ্যমিক দেবে বড়দার মেয়ে ঐশী। ‘বিটিএস’-এর (কোরিয়ান ব্যান্ড) বড় ভক্ত সে। ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে যেমন শাহরুখ, সলমান, সচিনদের ছোট-বড় পোস্টার লাগানো থাকত, এখন দেখছি কোরিয়ান তারকা আরএম, জিন, সুগা, ভি, জিমিনদের পোস্টার লাগানো ঐশীর ঘর জুড়ে। শুধু পোস্টার লাগিয়েই ইতি নয়, সে দেশের খাবারের প্রতিও বেশ আগ্রহী সে। এক দিন ওদের বাড়িতে গিয়েছিলাম সন্ধের দিকে। কিছু ক্ষণ পর দেখি বৌদি গরমাগরম কোরিয়ান র্যামেন বানিয়ে এনেছেন। ম্যাগি ছেড়ে র্যামেন খাওয়া কবে থেকে শুরু করলেন ওঁরা? প্রশ্নের জবাবে বৌদি হেসে বললেন, ‘‘সবই তোমার ওই ভাইঝির কীর্তি।’’
কেবল ঐশীই নয়, এখন ট্রেন, মেট্রো, বাসে চাপলেই চোখে পড়ে তরুণ-তরুণীরা মোবাইল হাতে কোরিয়ান ড্রামার নেশায় বুঁদ হয়ে রয়েছে। অফিসেও গল্পের মাঝে অনেকের মুখেই শোনা যায়, কোরিয়ান ড্রামার প্রসঙ্গ। শহর কলকাতা বেশ মনখোলা! মানুষ হোক কিংবা খাবারের আদবকায়দা, কোনও কিছুকেই আপন করে নিতে এই শহরের খুব বেশি সময় লাগে না। বছর পাঁচেক আগেও কোরিয়ান খাবার সম্পর্কে শহরবাসীর খুব বেশি ধারণা ছিল না। তবে এখন কোরিয়ান ড্রামা ও বিটিএসের সুবাদে কোরিয়ার খাবারের প্রতিও তরুণ-তরুণীদের আগ্রহ বেড়েছে। শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ছোট-বড় রেস্তরাঁ খুলছে। সেখানে ভিড়ও থাকছে চোখে পড়ার মতো।
কোনও দিনই কোরিয়ান ড্রামা কিংবা গানের প্রতি উৎসাহী ছিলাম না। তবে ভিন্ন স্বাদের খাবার চেখে দেখতে বরাবরই বড্ড ভালবাসি। চারদিকে কোরিয়ান খাবারের এত রমরমা আর সেই খাবার চেখে দেখব না? তা আবার হয় নাকি! কোরিয়ান খাবার চেখে দেখার অভিযানে প্রথমেই আমার গন্তব্য হল নিউ টাউনের ‘সোনামু’। গ্যালাক্সি মলের চার তলায় এই ছোট্ট ঠেকে গিয়ে যখন মেনুকার্ডটি হাতে নিলাম, কিছু ক্ষণ চোখ আটকে গেল। খাবারের নাম পড়তে গিয়েই তো কালঘাম ছুটে যাবে! ক্যাশ কাউন্টারে বসে ছিলেন এক কোরিয়ান মহিলা, সাহস করে তাঁকেই ডেকে বললাম, ‘‘কী খাওয়া যায় বলুন তো?’’ তিনি বললেন, ‘‘জাপচে, কিমচি চিকেন, মুনেও ডিওপবাপ, নিওপচিওক মান্ডু, গিমবাপ— সব খাবারই ভাল এখানকার।’’ ওঁর মুখের দিয়ে খানিক ক্ষণ তাকিয়ে থেকেও কিছুই বোধগম্য হল না। আমার করুণ অবস্থা দেখে তিনিই বললেন জাপচে, গিমবাপ, নিওপচিওক মান্ডু আর ওঁদের বিশেষ র্যামেনটা চেখে দেখতে। মিনিট কুড়ি পর খাবার এল। খানিকটা চেনা আর অনেকটা অচেনা। জাপচে আসলে চিকেন আর হরেক রকম সব্জি দিয়ে স্টার ফ্রায়েড করা গ্লাস নুডলস। টেবিলে সুশি দেখে ভাবলাম আমি তো এটা অর্ডার করিনি। রেস্তরাঁর কর্ণধার ম্যাডাম নোহো বললেন, কোরিয়ান ভাষায় ওই পদটার নাম গিমবাপ। দেখতে জাপানি সুশির মতো হলেও এর ভিতরে কাঁচা মাছ, মাংসের পুর ভরা হয় না। নিওপচিওক মান্ডুগুলি দেখতে খানিকটা চ্যাপ্টা মোমোর মতো। স্বাদেও সে রকমই। তবে র্যামেন খেয়ে চোখে জল এসে গেল। মায়ের হাতের পুরনো রান্নার কথা মনে পড়েনি, ঝালের ঠেলায় এই হাল। ঝাল খাওয়ার যে একেবারেই অভ্যাস নেই। ম্যাডাম নোহো আমার অবস্থা দেখে বললেন, র্যামেনে গোচুজাং দেওয়া আছে তাই এত ঝাল! গোচুজাং আসলে কোরিয়ানদের ঝাল সস্। রান্নাতে এই সস্ দেওয়ার বেশ চল রয়েছে কোরিয়ানদের মধ্যে। জাপানি খাবারের স্বাদ আর ম্যাডাম নোহোর আতিথেয়তায় সত্যিই মন ভরে গেল। ঐশীর মতো আমিও কোরিয়ান খাবারের প্রেমে পড়লাম।
তবে কোরিয়ার পথে হাঁটলে পকেটে একটু বেশি টান পড়তে পারে। তাই সেই মতো প্রস্তুতি নিয়ে যাওয়াই ভাল।
ইনস্টাগ্রামে বেশ কিছু দিন ধরে গড়িয়াহাটের একটি কোরিয়ান ফুড ট্রাকের রিল নজরে আসছে। খাবারের ভিডিয়োগুলি দেখে বেশ লোভ হল। ঐশীকে সঙ্গে নিয়েই চলে গেলাম সেই ঠেকে। যতীন বাগচী রোডের দইওয়ালার ঠিক উল্টো দিকে ওই ট্রাকের সামনে গিয়ে দেখি লম্বা লাইন। মিনিট দশেক পরে আমাদের পালা এল। এ বার অবশ্য আগে থেকেই খানিকটা খোঁজখবর নিয়ে রেখেছি। তাই আগের বারের মতো বিব্রত না হয়ে নিজেরাই অর্ডার করলাম কর্ন ডগ, ফ্রায়েড চিকেন, বিবিমবাপ! চিজ আর সসেজ দিয়ে তৈরি কর্ন ডগ সঙ্গে ঝাল ঝাল সস্ আর মেয়োনিজ়। মোমো, রোল, কবাবের মতো সন্ধ্যার নাস্তায় এই খাবারগুলি পেলেও মন্দ হয় না।
সেখান থেকে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য হল লর্ডস মোড়ের ছোট্ট একটি দোকান। নাম ‘কোরিয়ান স্ট্রিট’। মাত্র ৯৯ টাকা থেকে শুরু সেখানকার কোরিয়ান খাবারদাবার। সেখানে গিয়ে আবার চেখে দেখলাম কর্ন ডগেরই আরও তিন রকম পদ। সঙ্গে বাফেলো উইঙ্গস! এত খাবার খেয়ে যখন গলাটা শুকিয়ে এল, তখন তেষ্টা মেটালাম বুবা টি দিয়ে। তবে এই পানীয়টা সত্যিই কোরিয়ান কি না, তা নিয়ে মালিকের মনেও সন্দেহ ছিল। তবে ঝাল ঝাল খাবারের পর, মিষ্টি পানীয়টির প্রয়োজন কতখানি, তা বলে বোঝাতে পারব না! এই ঠেকেও খাবারের দাম খুব বেশি ছিল না। ৫০০ টাকায় দু’জনে পেট ভরে খেতে পারবেন এখানে।
এত ঝাল খাবারের পরে একটু মিষ্টি কিছু চেখে না দেখলে তো মনটাই ভরবে না। তবে কোরিয়ান মিষ্টি কি পাওয়া যাবে এই শহরে? মোবাইলে একটু খোঁজাখুঁজি করার পর আবারও অবাক হলাম। এই শহরে কোরিয়ান বেকারিও আছে বইকি! নিউ টাউনের ‘কিংস বেকারি’। সেন্ট জেভিয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্টো দিকের এই বেকারিতে গিয়ে চেখে দেখলাম টুইস্টেড ডোনাট আর ভ্যানিলা সু। রসোগোল্লা, চমচম এক দিনের জন্য বাদ দিয়ে কোরিয়ান মিষ্টি খেতেও মন্দ লাগল না! মাঝেমধ্যে স্বাদবদল করতে এই ধরনের কোরিয়ান মিঠাই চেখে দেখা যেতেই পারে।
কোরিয়ান ফুড অভিযানের শেষে একটা কথা ভালই বুঝলাম, শহরবাসীর চিনাপ্রীতিকে টেক্কা দিতে কোরিয়ান খাবারও কিন্তু আটঘাট বেঁধে নেমে পড়েছে। নিউ টাউনের স্মার্ট স্ট্রিটে ‘সিওল ফুড ট্রাক’, সন্তোষপুরের ‘বাইট দ্যাট স্পুন’ ক্যাফে, ঢাকুরিয়ার ‘মিজ় ইন প্লেস’, যাদবপুরের ‘বেন্টো ক্যাফে’— উত্তর থেকে দক্ষিণ শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ঢুঁ দিলে এখন চোখে পড়বে কোরিয়ান খাবারের নানান ছোট-বড় ঠিকানা। সে সব জায়গায় চোখে পড়বে মাঝবয়সিদের ভিড়। নিজেদের প্রিয় কোরিয়ান তারকাদের পছন্দের খাবার চেখে দেখার উৎসাহ তাদের চোখমুখে স্পষ্ট।
শুধু রেস্তরাঁ, ফুড ট্রাক কিংবা ক্যাফে নয়, নিউ টাউনের রোজ়ডেল প্লাজ়া মলে বছর খানেক আগেই খুলেছে কোরিয়ান সুপার মার্কেট। কোরিয়ান নুডলস থেকে হরেক রকম সস্, স্টিকি রাইস থেকে শুকনো মাছ, হরেক রকম চাটনি, কোরিয়ান স্ন্যাকস— সবই পাওয়া যাচ্ছে সেই বাজারে। তবে দাম কিন্তু আকাশছোঁয়া। বাড়িতে কেউ কোরিয়ান খাবার রাঁধতে চাইলে সব রকম উপকরণের সম্ভার তিনি পেয়ে যাবেন এই দোকানেই। রান্না করতে বেশ ভালই লাগে। তাই চলে গেলাম নিউ টাউনের সেই দোকানে। ওখানে গিয়ে দেখলাম কমবয়সি এক তরুণী বিভিন্ন রকম জিনিস কেনাকাটা করছেন। কথায় কথায় জানতে পারলাম, সেই তরুণী রান্নায় মাঝেমধ্যেই গোচুজাং (কোরিয়ান ঝাল চাটনি) ব্যবহার করেন। আর সেই চাটনিটা কিনতেই এখানে আসা। শহরের আর পাঁচটা দোকানে তো কোরিয়ার চাটনি পাওয়া যায় না। বাঙালি এখন রান্নাতেও কোরিয়ান উপকরণ ব্যবহার করতে শুরু করেছে তা হলে। টুকিটাকি স্ন্যাক্স কিনে বিল করানোর সময় দোকানদারের থেকে জানতে পারলাম, তাঁদের দোকানে গোচুজাং, বিভিন্ন রকম র্যামেন, নুডলস আর কোরিয়ান স্ন্যাকসের চাহিদা এখন ভালই বেড়েছে।
খাবার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে বরাবরই পছন্দ করে বাঙালি। তাই তো মোগলাই খাবার হোক কিংবা চিনা, ইউরোপীয় খাবার হোক কিংবা ইতালীয়— সব খাবারেই বাঙালি নিজের ‘টুইস্ট’ দিয়েছে। কষা মাংসের পিৎজ়া হোক কিংবা ইলিশের বিরিয়ানি— সবই তো বাঙালি ফিউশনের ফল। তবে কোরিয়ার খাবার নিয়ে এখনও সেই পরীক্ষা শুরু হয়নি। তাই সে সব খাবারের স্বাদ নিতে হলে ছুটির দিনে সপরিবার চলে যেতেই পারেন এ সব রেস্তরাঁ কিংবা কাফেতে।
কোরিয়ার খাবার খেতে যাওয়ার আগে একটি কথা না জানলেই নয়। সে দেশের খাবারে ঝাল ও বিভিন্ন রকম সসের আধিক্য কিন্তু বেশি। তাই যাঁরা ঝাল খেতে পারেন না, তাঁরা খাবার অর্ডার করার সময় কম ঝাল দিয়ে বানানোর কথা উল্লেখ করতে ভুলবেন না যেন! আমি ভুগেছি, তাই সাবধান করলাম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy