২১ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৫। দলে দলে মানুষ গণেশকে দুধ খাওয়াচ্ছেন এবং গণেশ টেনে নিচ্ছেন দৈব শুঁড়ে চোঁ-চো।ঁ সম্ভবত দুর্গা তাঁকে শুনিয়েছেন বাংলা ব্যান্ডের গান ‘দুধ না খেলে, হবে না ভাল ছেলে’!
গ্লাসনস্ত আর পেরেস্ত্রোইকা এই জোড়া ফলার আঘাতে সাধের সোভিয়েত ইউনিয়ন তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছে আগের দশকেই। মোম হাতে গির্জায় যাচ্ছেন সমাজবাদের নয়া প্রবক্তা বরিস ইয়েলৎসিন। বজ্রকঠিন সমাজতন্ত্রের পীঠস্থানে বস্তুবাদ বিপন্ন হলে তার আঁচ পশ্চিমবঙ্গে লাগাটাই স্বাভাবিক, হোক না তা কমিউনিস্ট শাসিত অঙ্গরাজ্য।
ভুটান সফরে গিয়ে ভগবান বুদ্ধের শরণ নিলেন তথ্য-সংস্কৃতি মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। একশো টাকা দক্ষিণা দিয়ে বসলেন। পাড়ার স্বঘোষিত কমরেডরা যুক্তিবাদের চর্চা ভুলে জ্যোতিষ, গ্রহরত্ন, তাবিজ-মাদুলিতে আস্থাবান হতে লাগলেন। যত্রতত্র গজিয়ে উঠল শনি-শীতলা-কালীমন্দির । নিজেকে ব্রাহ্মণ মার্কসবাদী বলে কেউ কেউ জাহিরও করলেন। ডাকসাইটে শীর্ষ স্তরের নেতা ঘটা করে নাতির উপনয়ন দিয়ে সংবাদ শিরোনাম হলেন। এই আবহে দু’তিন মাসের ব্যবধানে দুটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটল, একই বছরে।
১৯৯৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর, বেশ মনে রয়েছে দিনটা। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে দেখলাম, বেশ কিছু গৃহবধূ চলেছেন মন্দিরে দুধ ঢালতে। ভাবলাম, তা বুঝি অবাঙালি মহিলাদের আচার মাত্র। কিন্তু চেহারা অবাঙালি না হওয়ায় কেমন একটা খটকা লেগেছিল। বি টি রোড ধরে বাসে ফেরার পথে আরও বহু জায়গায় উপচে পড়া ভিড় লক্ষ করলাম। বি টি রোডের ওপর অনেক দেবস্থান রয়েছে। সেই সব মন্দির ঘিরে প্রচণ্ড জটলা, ভিড়। ইতিমধ্যে দিকে দিকে চাউর হয়ে গেছে, দুপুর থেকে গণেশ দুগ্ধ পান শুরু করেছেন। সরল বিশ্বাসে ভক্তেরা দুধ ঢেলে আসছেন পুণ্যি লাভের আশায়। আমি সেই সময় যুক্তিবাদী সংগঠনের দিকে অল্পবিস্তর ঝুঁকেছি। এই ধরনের আচরণে মনটা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল।
বাসের মধ্যে হইহই রইরই। আমি আলোচনায় যোগ দিয়ে বলে বসলাম, এ কী করে সম্ভব? হঠাৎ করে দেবতার দুগ্ধপানের ইচ্ছা হল কী ভাবে? কোনও মতলবি চক্রের কারসাজি নয় তো? কিন্তু কে কার কথা শোনে। প্রায় সকলেই দেবতার মাহাত্ম্যে বিশ্বাসী। গণ-হিস্টিরিয়ার রূপ প্রত্যক্ষ করা গেল। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে শুনলাম, আমাদের এলাকার কিছু লম্বোদরও প্রবল দুগ্ধ পান করেছেন, এবং পাশের বাড়ির গোয়ালা শিবু নাকি মিল্ক-পাউডার গুলে বাড়তি রোজগার করেছে। কোনও এলাকার কোনও গণেশ বাদ পড়েননি। এবং আশ্চর্যের বিষয়, সব এলাকার সব গণেশ প্রায় একই সময়, একটু আগুপিছু করে দুধ পান করেছেন। এ যদি অলৌকিক নয় তো কাকে বলে অলৌকিক? দেবতা নেই বললেই হল? পুণ্যি এ বার ঘরেদোরে ধরলে হয়, পুকুরও ভরাট হল বলে।
পরে জানলাম, ঘটনাটি শুরু হয়েছিল রাজধানী থেকে। ভোর বেলায় দিল্লির একটি মন্দিরে গণেশ ঠাকুরের শুঁড়ের কাছে এক চামচ দুধ ধরা হয়েছিল, তিনি সেটি এক নিমেষে পান করেছেন। কিছু পরে এ-ও জানা গেল, শুধু ভারতীয় সিদ্ধিদাতাই নন, সিঙ্গাপুরের সিদ্ধিদাতারাও দুধ পান করে মহিমা বিস্তার করেছেন। ইংল্যান্ড, আমেরিকা, নেপাল, সিঙ্গাপুর সর্বত্র একই ব্যাপার। দিল্লির দুধ বিক্রি এক দিনে ৩০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ঘটনাটিকে ‘মিরাক্ল’ তকমাও দিয়ে দিল।
রাত ন’টা নাগাদ ইলেকট্রনিক মিডিয়া বিষয়টার আসল রহস্য ফাঁস করল। বিজ্ঞানীরা মন্দিরে গিয়ে নিজেরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, ব্যাপারখানি ঘটছে ‘ক্যাপিলারি অ্যাকশন’-এর দৌলতে। জনৈক চর্মকার তাঁর তেপায়াটিকে দুগ্ধ পান করিয়ে দেখানোয় লোকের ভুল ভাঙল। কয়েক ঘণ্টার জন্য নিজেদের যুক্তি-বুদ্ধি বন্ধক রাখার কারণে কারও কারও অনুশোচনা হতে লাগল। তবে তাদের সংখ্যা কম। অনেক লোক ওই চর্মকার আর বিজ্ঞানীদেরই নিখাদ ভিলেন ধরে নিয়ে নিশ্চিন্তে মুণ্ডপাত করতে লাগল। আর বাবা গণেশের শাপে তাদের কী অবস্থা হবে, তা দেখার জন্যে তাকিয়ে থাকল পরের লাইভ টেলিকাস্টের দিকে। কিন্তু তা হলেও, ধাক্কাটা একেবারে ভুলতে পারল না।
তাই, পরে যখন এল ২৪ অক্টোবর ১৯৯৫, পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের দিন, আগে থেকে হাইপ তৈরি হল। এ বার জনগণেশের চালাক সাজার পালা। কুসংস্কারগ্রস্ততার তকমা ঝেড়ে ফেলে বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে ওঠা। ‘ডায়মন্ড রিং’, ‘করোনা’ লোকের মুখে মুখে ঘুরতে শুরু করল, মুড়িমুড়কির মতো বিকোতে শুরু করল নিরাপদ গ্রহণ-চশমা। ভুসো কালি, এক্স-রে প্লেট দিয়ে রেডিমেড ব্যবস্থা তৈরি করা হল। ডায়মন্ড হারবার, শুশুনিয়া পাহাড়ে উৎসাহী হুজুগে পাবলিক দলে দলে ভিড় জমিয়েছিল। চিড়িয়াখানার শিম্পাঞ্জি রোদ-চশমা পরে পোজ দিয়েছিল। পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের ধারাবাহিক ফটোগ্রাফ বুকপকেটে রেখে অফিস-ফেরতা কেরানি আত্মশ্লাঘা অনুভব করল। হাতে যদিও শোভা পেতে থাকল রত্নশোভিত আংটি।
দুধ ও তামাকে সমান আসক্তি, ধর্ম ও জিরাফে বর্তমান থাকা যে বাঙালির সহজাত স্বভাব, কমিউনিস্ট শাসনে সে দিন তার কোনও ব্যত্যয় হয়নি।
সরিৎশেখর দাস, নোনাচন্দনপুকুর, ব্যারাকপুর
নব্বইয়ের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?
লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 90s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy