Advertisement
০৪ নভেম্বর ২০২৪

শার্লি হুজুগ

‘শার্লি এবদো’র ঘটনার বিরুদ্ধে প্যারিসে মহামিছিল দেখে মনে হল, মোচ্ছব! চশমা-জুতোর রং ম্যাচিং। কাফের টয়লেটে লোকারণ্য। ব্যালকনি থেকে তারস্বরে বিটল্‌স। লিখছেন সোমঋতা ভট্টাচার্যএ দিকে তো ফরাসিদের পোষ্যপ্রীতির ঠেলায় বাস-ট্রাম-ট্রেন-মেট্রোয় হুলস্থুল। মানুষের সঙ্গে দিব্যি গ্যঁাট হয়ে চলেছেন তেনারা। তা, এতই যখন আদিখ্যেতা, তাঁদের নামগোত্র বদলানোর আগে পারমিশনটা নেওয়া হয়েছিল কি? লিলি-জুলি-মামিলিরা যে এক দিনে সকলে ডজন দরে ‘শার্লি’ হয়ে গেলেন, সেটা কি তাঁরা বুঝলেন? তবে যে তাঁদের সকলের পিঠে সাঁটা রইল ‘জো সুই শার্লি’? দিব্যি রোববারের তোফা একখানা দুপুর। এক্কেবারে পিকনিক পিকনিক রোদ।

ছবি: গেটি ইমেজেস

ছবি: গেটি ইমেজেস

শেষ আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০১৫ ০১:০০
Share: Save:

এ দিকে তো ফরাসিদের পোষ্যপ্রীতির ঠেলায় বাস-ট্রাম-ট্রেন-মেট্রোয় হুলস্থুল। মানুষের সঙ্গে দিব্যি গ্যঁাট হয়ে চলেছেন তেনারা। তা, এতই যখন আদিখ্যেতা, তাঁদের নামগোত্র বদলানোর আগে পারমিশনটা নেওয়া হয়েছিল কি? লিলি-জুলি-মামিলিরা যে এক দিনে সকলে ডজন দরে ‘শার্লি’ হয়ে গেলেন, সেটা কি তাঁরা বুঝলেন? তবে যে তাঁদের সকলের পিঠে সাঁটা রইল ‘জো সুই শার্লি’?

দিব্যি রোববারের তোফা একখানা দুপুর। এক্কেবারে পিকনিক পিকনিক রোদ। ঠান্ডাটা কামড়াচ্ছে কম। কাজেই পালক-লাগানো টুপি পরে চলো পানসি ‘জো সুই শার্লি’ ময়দানে থুড়ি প্লাস দো লা রেপুবলিক-এ। এমনিতে এঁরা রোববারকে যথার্থ অর্থেই ছুটির দিন হিসাবে দেখেন। দরকারে-অদরকারে কোনও কলিগের ফোন-টোনও ধরেন না কক্ষনও, এমনই একনিষ্ঠ এ ব্যাপারে। (অবশ্য ফ্রান্সের কোনও সরকারি প্রশাসনিক অফিসে কেউ কখনওই ফোন ধরেন না। নেভার। মেল পাঠালে উত্তর পাবেন, কিন্তু ফোন করলে? উঁহু)।

শার্লিতে ফেরা যাক। আগের দিন থেকেই জনগণতান্ত্রিক সরকার মোচ্ছবের সব বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন। প্যারিস এবং তত্‌সংলগ্ন ইল-দো-ফ্রঁস, মানে শহরতলি অঞ্চলে, টো-টো করতে গেলে কোনও টিকিট লাগবে না। এমন গণ-আন্দোলনের দিনে কি টিকিট-ফিকিটের মতো মামুলি জিনিসকে পোঁছে কেউ? পাঞ্চিং গেটের খোঁদলটার মুখ তাই সেঁটে দেওয়া হয়েছে নীল কালির পেনে ট্যারাবেঁকা ভাবে ‘গ্রাতুই’ লেখা কাগজ দিয়ে। যাঁরা আগের দিন জাস্ট টিভিটা চালাননি বা ফেসবুকটা খোলেননি বলে ভুল করে টিকিট কেটে ফেলেছেন, তাঁদের সে কী আপশোস!

আর বাকিরা? তাঁদের আর পায় কে! টেনশন-টেনশন মুখ করে অথবা খামকা বেশি রকমের স্মার্টনেস দেখিয়ে এক লাফে লোহার বেড়া পেরনোর প্রয়োজন রইল না। সামনের লোক টিকিট পাঞ্চ করার সময়ে তক্কে তক্কে থেকে তাঁর গায়ের সঙ্গে লেপটে বাধা পেরিয়ে যাওয়ারও দরকার নেই এই দু’দিন। অবশ্য এমনিতেই ইল-দো-ফ্রঁসের বনগাঁ লোকাল টাইপ ট্রেন (যেগুলোর সিট এবং কাচের জানলাসমূহ দুর্বোধ্য গ্রাফিতি আর N+T, P love S টাইপের বিবিধ কারিকুরিতে উপচে পড়ছে), বা ভদ্রস্থ বাসগুলোতেও টিটি-কাকুরা বিশেষ কাজকর্ম করেন বলে তো মনে হয় না। ট্রেন-বাসের মান্থলি রিনিউ করানো হয়নি? তাড়াহুড়োয় মনেই ছিল না টিকিট কাটার কথা? কুছ পরোয়া নেই। ধরা পড়ার চান্সই নেই! অবশ্য এমনিতেই আর-ই-আর লাইনের এই সব লোকাল ট্রেন যখন-তখন আজগুবি সব কারণে বন্ধ হয়ে যায়। তখন সারা রাত বনবাদাড়ে চরকি খাও, দশ কিমি হেঁটে অফিস পৌঁছোও!

যাক গে, কথা হচ্ছিল ‘জো সুই শার্লি’ ময়দান নিয়ে। আহা! অহো! গোটা দুনিয়ার কেউকেটা, হোমরাচোমরা সময়মত সেজেগুজে হাজির হয়ে হাত ধরে রেডি। সেই সঙ্গে কত রকমের খাপখোপ, চৌকো, গোল, পলকাটা পতাকা! খান দু’তিনেক দেশের ছাড়া বাকিগুলো তো চিনতেই পারা যাচ্ছে না। সবচেয়ে মনোহর জিনিসটা হল— প্ল্যাকার্ডে প্ল্যাকার্ডে ছয়লাপ। আমি, আমরা, তুমি, তোমরা সবাই শার্লি— মোদ্দা কথা হল এটাই। সেটারই প্রেজেন্ট, পাস্ট, পাস্ট পার্টিসিপ্‌ল, পাস্ট কন্টিনিউয়াস, সিম্পল ফিউচার, সেই সঙ্গে আবার ফরাসির বেদম বেআক্কেলে সব টেন্‌স— ব্যবহার করা হয়েছে সবই। জো সুই শার্লি, ন্যু সম শার্লি, ন্যুজেতিয়ঁ শার্লি, জো সোরে শালির্র্... মানে, আমরা শার্লি ছিলাম, আমরা শার্লি থাকব, আমরা শার্লি হচ্ছিলাম, আমরা শার্লি হতে থাকছিলাম, আমরা শার্লি হতে থাকব, আমরা যদি শার্লি হতাম, তা হলে সবাই শার্লিই থাকব... ফরাসি রেন অ্যান্ড মার্টিন উজাড়! এর মাঝে এক সিরিয়াস টাইপ ফরাসি বুড়ি আবার ‘বোকার মরণ’ টাইপের প্ল্যাকার্ড হাতে একটু অন্য হওয়ার চেষ্টা দেখিয়েছেন— ‘ম্যার্দ ও কঁ’।

কোন বেয়াদপ বলেছে ইউরোপে শুধু কালো আর ছাই রঙের একঘেয়েমি? এক বার এসে দেখে যাও। চুল, চশমা, জুতো আর ছাতার ডাঁটির রং ম্যাচ করে রাস্তায় নামার কথা ভাবতে পারা যায় ভারতে বসে? আর হ্যঁা! ও দিকে তো ম্যাংগো পাবলিক সবাই ক্ষণজন্মা কার্টুনিস্ট। শহিদ হওয়া শার্ব, কাবু, তিনু, উয়োলিনিস্ক-এরই মামাতো-পিসতুতো বোন-ভাইয়েরা। তাই তাদের কানে গোঁজা রঙচঙে পেনসিল। লালচুলো খোঁপায় গোঁজা পেনসিল। হিউমারই শেষ কথা ভাই, হিউমার। আর স্যাটায়ার। তাই অ্যাম্বিয়েন্সটা মোচ্ছব-মোচ্ছবই রাখতে হবে। কে যেন আবার জিজ্ঞেস করছিল, মৌনী মিছিল হল কি না। ছোঃ! টেররিস্ট অ্যাটাক, জার্নালিস্ট-কার্টুনিস্ট হত্যা, পাইকারি বাজারে হস্টেজ, গোলাগুলি, আতঙ্কবাদী খতম, এক জাঁহাবাজ মেয়ের পালিয়ে যাওয়া— এমন থ্রিলিং চিত্রনাট্যের পাশে গোমড়া মুখে কান্না চাপলে হয়?

তাই মার্শো মার্শো বলে যখন জাতীয় সংগীত ‘মার্সেইয়াজ’ গাওয়া হবে, তখনই এক চুমুকে হাইনেকেনের বোতল খালি করে ‘পনেরো দিলেই বিয়ার পাবেন একখানা, একখানা’ বলে গান ধরতে হবে একদম একই সুরে। ও দিকে, ঝোলা বারান্দায় মাথায় ফুলেল চুলপট্টি লাগিয়ে ঝুঁকে পড়ে দোদুল দুলছেন উদ্ভিন্নযৌবনা রূপসি। সর্বজনীন আমোদের ডেসিবেল বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য তাঁর খাটনির তুলনা নেই। বড় একখানা বক্সে উচ্চগ্রামে চালিয়ে দিয়েছেন বিটল্স। ইম্যাজিন দেয়ার’স নো হেভেন, ইটস ইজি ইফ ইউ ট্রাই, নো হেল বিলো আস... জনতা বেদম উত্তেজিত। এখান থেকে চেঁচিয়ে ফরমাশ চলেছে, মানে অনুরোধের আসর—স্বজাতীয় ক্লদ ফ্রঁসোয়া, বা জ্যাক ব্রেলের গান শোনার আর্জি তো আছেই, ভিড়ের মধ্যে থেকে কেউ কেউ চিল্লাচ্ছে, মাইকেল জ্যাকসন! জাস্টিন বিবার! তাঁদেরই কারও মন রাখতে যুবতী দৌড়ে ঘরের ভেতরে গেলেন। বোধহয় সিডি পালটাতে।

ঝুলবারান্দায় ঝুঁকে পড়া উত্‌সাহীদের কমতি নেই। বিবিধ ছন্দে হাততালির জোয়ার, সঙ্গে শার্লি-শার্লি রব। গোটাকয়েক ফেরেব্বাজ ছোকরা শার্লির জায়গায় নিজের নাম বসিয়ে একই ছন্দে চেঁচাচ্ছে! এক অতি উত্‌সাহী মহিলার উত্তেজনার পারদ বেশ চড়ে গিয়েছে। তিনি ক্যামেরা চোখে, রাস্তার ধারের লোহার ডাস্টবিনের উপরে উঠে দাঁড়িয়েছেন ব্যালান্স করে। কিন্তু সে বান্দা ভিড়ের চাপে কী ভাবে জানি কাত হয়ে গেল। যায় কোথায়! নাকমোছা টিস্যু, চিপ্সের প্যাকেট, আধখাওয়া ছিবড়ে বাগেত, চ্যাটচ্যাটে পোকা-ধরে-যাওয়া বাসি চিজ, সব কিছুর সঙ্গে মাখামাখি হয়ে অচিরেই তিনি পপাত ধরণীতলে। সেইখানটায় আর এক সার্কাস শুরু। দেখতে এ ওর পা মাড়িয়ে দিচ্ছে। কার আবার পেনসিল হিল মটাত্‌ করে দু’আধখানা। কোথায় লাগে গঙ্গাসাগর!

এ দিকে, রাস্তার ধারের সার-সার ক্যাফে-রেস্তরাঁরা হিমশিম। না, বিক্রির রেকর্ড ভাঙছে, তা নয়। প্রকৃতির বিভিন্ন রকমের ডাকে সাড়া দিতে সে-সব জায়গাতেও সমাবেশ যে! কীসের দোকান মাথায় থাক, টয়লেটটা ইউজ করতে দিন দাদা! তার ওপরে রেপুবলিক মেট্রো তো বন্ধ। নিরাপত্তার জন্য। কাজেই পিছোতে হবে। সেই গার দ্যু লেস্‌ত পর্যন্ত। কিন্তু ধাক্কাধাক্কি, পেছন থেকে অবিরাম গুঁতো— এ সব আবার ইউরোপীয় আদবকায়দার সঙ্গে যায় না। কাজেই এক পা এক পা করে ব্যাক-গিয়ার দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। এ দিকে ঘণ্টা দু’তিনের মধ্যেই উত্তেজনা কমতে কমতে মুখগুলো সব চুপসোনো বেলুন। জনাকয়েক খুদে তারস্বরে কান্না জুড়ে মা-বাবাদের বেজায় বেগ দিচ্ছে। টিন-এজারদের কারও কারও ডেট বা ইভনিং-আউটে যাওয়ার তাড়া।

দিন তো গেল। সন্ধে হল। ঘড়ির কাঁটা ছ’টা ছঁুই-ছঁুই। হাততালির আওয়াজ, ‘শার্লি শার্লি’ চিত্‌কার সবই মোটামুটি থামতে থামতে টিমটিম করছে। আছে শুধু হালকা সাইরেন বাজিয়ে টহল দেওয়া কিছু পুলিশি ভ্যান। ফিরতি পথে স্টেশনে গিয়ে দেখি, কালো পিচের প্ল্যাটফর্মে গুচ্ছের খাবারদাবারের উচ্ছিষ্ট-মাখা প্যাকেটের সঙ্গে লেপটে রয়েছে ‘জো সুই শার্লি’।

somrita87@gmail.com

এই প্রচ্ছদকাহিনি কেমন লাগল? মন্তব্য করতে, এই ফেসবুক পেজ-এ যান: www.facebook.com/anandabazar.abp

অন্য বিষয়গুলি:

rabibasaria somrita bhattacharya
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE