আমি কনকপিসিকে জীবনে দু-এক বার দেখেছি, তা-ও নেহাতই ছোটবেলায়। আবছা মনে আছে। তবে প্রত্যেক পারিবারিক আড্ডায় তাঁর কথা উঠতই। তাঁর সম্পর্কে প্রথম বলে নেওয়া হত একটা কথা, ‘এত দেরি হল যে?’— বলেই একটু হাসাহাসি হত, তার পর কনকদি’র সুখ কম দুঃখের কথা বেশি। বড় হতে হতে কনকপিসির দুঃখের কথাগুলো বুঝতে শুরু করলাম।
কনকপিসির শ্বশুরবাড়িতে বৈরাগ্যের বেশ একটা চল ছিল। সে কথা নাকি কনকপিসির শ্বশুরবাড়ির লোকেরা বিয়ের সময় বেমালুম চেপে গিয়েছিল। তখনকার কালে কোনও বাড়ির দু-চার জন পুরুষমানুষ সন্ন্যাসী হয়ে গেলে, সে বাড়িতে লোকে আর বিয়ে দিতে চাইত না। তবে এ সব যেন বিয়ের দিন ফিসফিসিনি বেয়ে আসবে বলেই চেপে যাওয়া হয়। কনকপিসির বিয়ের দিনও চাপা গলায় জানাজানি হল, কনকপিসির দাদাশ্বশুর আর এক খুড়শ্বশুর নাকি সন্ন্যাসী হয়েছিলেন। কনকপিসির বাড়িতে একটা আতঙ্কের বীজ সেই দিনই রোপিত হল।
দিন যায়, বছর যায়। কনকপিসির সংসারও যায়। দুই ছেলে নিয়ে ভরভত্তি সংসারে এক কনকপিসি ছাড়া আর সবাই নর্মাল। এমনকী কনকপিসির বরও। বরং কনকপিসির আচারআচরণ নিয়ে লোকজন মাঝে মাঝে প্রশ্ন করত। কনকপিসির বর বলতেন, ‘আর বলবেন না। এমন টেনশনের রোগ আমি কারও দেখিনি। আমার বাড়ি ফিরতে একটু দেরি হলেই জিজ্ঞেস করবে, এত দেরি হল কেন? এমনকী বাজার থেকে ফিরতে দেরি হলেও এক কথা।’ ভদ্রলোক টেনশন সামাল দিতে দিতে বেশ একটু বিরক্তই হতেন!
কিন্তু বৈরাগ্য রক্তে বইলে কি আর আতঙ্ক দিয়ে আটকে রাখা যায়? কনকপিসি যা ভাবতেন, তা-ই সত্যি হল। এক দিন অফিস থেকে আর ফিরলেন না কনকপিসির স্বামী। মাস গেল, বছর গেল। কনকপিসি আলুথালু চুল সামলে উঠে সংসার আর ছেলে সামলানোর কাজে লেগে পড়লেন। পড়শিরাও উৎসবের দিনগুলো ছাড়া আহা-উহু করা ছেড়ে দিল। তার পর জানা গেল— কনকপিসির স্বামী সন্ন্যাসী হয়েছেন। দু’এক বার পরে দেখা করতেও নাকি এসেছিলেন। কনকপিসির দুই ছেলে তখন বেশ ছোট।
কনকপিসির টেনশনের রোগ আরও বাড়ল। এ বার বড়ছেলে। ‘কী রে, স্কুল থেকে কোথাও গিয়েছিলি? এত দেরি হল কেন? দোকান থেকে আট আনার গুড় কিনতে এত সময় লাগে? বন্ধুর বাড়ি থেকে ফিরতে কত সময় লাগে?’ সে মাঝরাতে বাথরুমে গেলেও পিসি উঠে পায়চারি করতেন, যত ক্ষণ না ফেরে। কনকপিসির বড়ছেলে ভারী শান্ত আর মুখচোরা ছিল। সে মুখে মুখে কোনও উত্তর দিত না।
সম্ভবত এই রকম সময়েই দু-এক বার আমি কোনও কোনও বিয়ে বা পইতে-বাড়িতে কনকপিসিকে দেখেছি। ছোট ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে আসতেন। আর বাড়ি যাওয়ার জন্য ছটফট করতেন। অবিশ্যি অজুহাত দিতেন, বড়ছেলের খাওয়ার অসুবিধে হবে বা বড়ছেলে চাবি না পেলে কী করে বাড়ি ঢুকবে। কিন্তু তত দিনে পাবলিক বুঝে গেছে কনকপিসির ব্যারাম কী। কেউ আটকাত না তাঁকে।
কিন্তু ফের বাদ সাধল বৈরাগ্য। ঘুম থেকে উঠে ছোট চিরকুট— আমায় খুঁজো না।
এ বার সুনসান, দমচাপা বাড়িতে ঘুরে বেড়াতে লাগল— কনকপিসি, তাঁর ছোটছেলে, আর একটা গেরুয়া রঙের ভয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy