Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪

একটা ভয় [কষ্ট] লজ্জা

প্রথমটা হকচকিয়ে স্পেলবাউন্ড। সম্বিৎ ফিরতেই প্রশ্ন, এটা কি আমাদের পাড়া? এখানে গণপিটুনি হবে? তত ক্ষণে শিকারকে বাঁধা হয়ে গিয়েছে ল্যাম্পপোস্টের সঙ্গে। সদ্য কাটিয়ে ওঠা লোডশেডিং সব ল্যাম্পপোস্ট তখনও জানান দিতে পারেনি। আধো অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছি, বেশ কয়েকটা ছেলে তখন মারছে কাউকে একটা। এরা কারা, যারা এত তৎপর হয়ে এই মার্ডারটা কনডাক্ট করছে? আমাদের পাড়ার কেউ?

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০১৪ ০১:১৬
Share: Save:

প্রথমটা হকচকিয়ে স্পেলবাউন্ড। সম্বিৎ ফিরতেই প্রশ্ন, এটা কি আমাদের পাড়া? এখানে গণপিটুনি হবে? তত ক্ষণে শিকারকে বাঁধা হয়ে গিয়েছে ল্যাম্পপোস্টের সঙ্গে। সদ্য কাটিয়ে ওঠা লোডশেডিং সব ল্যাম্পপোস্ট তখনও জানান দিতে পারেনি। আধো অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছি, বেশ কয়েকটা ছেলে তখন মারছে কাউকে একটা।

এরা কারা, যারা এত তৎপর হয়ে এই মার্ডারটা কনডাক্ট করছে? আমাদের পাড়ার কেউ? কী হল হঠাৎ, অপরাধটা কী, কখনই বা তার নিদান হাঁকা হল? ‘অ্যাই পটকু, কী হল রে?’ বাবা চেঁচাল। ‘কাকু, মার হবে মার। চুরি করেছে ছোঁড়াটা।’ বাবা গলা উঁচিয়ে বলল, ‘তোরা জানলি কী করে? কে ধরল? আর মারছেই বা কারা?’ হঠাৎ একটা জাম্বো কনফিউশন আছন্ন করে ফেলল পটকুর গ্রুপকে। কে করছে, কারা করছে, কেন করছে, চুরির প্রমাণ কই? কোনও জুতসই উত্তর পটকুর কাছে নেই। সে কেবল জানে একটা গণপিটুনি হবে।

আশেপাশের জানলাগুলো এ বার ইতিউতি জ্বলে উঠতে লাগল। অল্প আলোয় দেখতে পেলাম খালি গায়ে ঢোলা হাফপ্যান্ট পরা বছর চোদ্দোর একটা ছেলে খুব জোর কাঁদছে। সে-ই কালপ্রিট। চটাস, চটাস আওয়াজ আসছে তার গা থেকে। চুল ধরে কেউ ঠুকে দিচ্ছে মাথা। আর সে তারস্বরে ভিক্ষে চাইছে, ‘আমায় ছেড়ে দাও গো।’ একটা দুটো বারান্দায় লোক এসে দাঁড়াচ্ছে, জানলার খড়খড়ি উঠছে কিন্তু তেমন করে প্রতিবাদ ভেসে আসছে না। আমি এক বার খুব চিৎকার করার চেষ্টা করলাম। পারলাম না। এ বার বাবা চেঁচিয়ে উঠল, ‘অ্যাই, হচ্ছেটা কী? কেন মারছিস? পুলিশ ডাক। কেউ একটা পুলিশকে ফোন কর তো। তোরা মারার কে?’ রেলাবাজ ক্রুদ্ধ ছেলের দল বাবার দিকে আগুনে চাউনি হানল। কয়েক সেকেন্ড ওদের মনোযোগ সরে গেল ছেলেটার থেকে। আর সেই ফাঁকে কোনও মতে ছেলেটা দড়ি ছাড়িয়ে ছুট দিল। ওরাও পেছন পেছন। ছেলেটা বোঁ করে ঢুকে এল আমাদের গলিতে। কিন্তু ওরা ওকে খপাত ধরে ফেলল, টানতে লাগল, লাঠি, চড়থাপ্পড়, চিমটি চলতে লাগল ছেলেটার ওপর। আমরা মরিয়া হয়ে ওপর থেকে পটকুদের ওপর বালতি বালতি জল ঢালতে লাগলাম। বাবা আর ওপরের কাকু একটা বড় লগা জোগাড় করে খোঁচাতে লাগল, যাতে মস্তানগুলো ছেলেটার থেকে সরে যায়। আর দু’দলের মধ্যে পড়ে ছেলেটার কী কাকুতি, ‘ওগো আমায় ছেড়ে দাও গো। আমি আর করব না গো। ওগো ছেড়ে দাও গো। মা গো, মা গো!’

এই সময় একটা পুলিশের পেট্রোলিং কার এসে দাঁড়াল। হয়তো গোলমাল শুনেই। গণহত্যা সংগঠকদের কয়েক জনকে ধরা গেল। কয়েক জন পালিয়ে বাঁচল। পুলিশ কথাবার্তা শুনে বুঝল, ছোট ছেলেটা ছিঁচকে চোর। আজও সে ম্যানহোলের ঢাকনা চুরি করার মতলব করেছিল। অতএব ‘হবু চোর’ মর্মে তাকে ধরা হল। এ বার তাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হবে। গালের হাড়ে কালশিটে, ঠোঁটের কোণ বেয়ে রক্ত আর চোখের কোল বেয়ে জল গড়াচ্ছে সেই ছেলের।

আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। যাক, ছেলেটা তো আর মারা যাবে না, এ রকম ভাবে মার খাবে না। বাবাকে পর দিন সকালে এক বার থানা যেতে হতে পারে, এ কথা জানিয়ে পুলিশ চলে যাওয়ার উদ্যোগ করল। বারান্দার দরজা বন্ধ করতে গিয়ে আমি দেখলাম এক জন পুলিশ প্রচণ্ড চড়থাপ্পড় চালাচ্ছে, জোরে কান মুলে দিচ্ছে ছেলেটার। আমার পেটের ভেতরটা এমন গুলিয়ে উঠল, মনে হল জীবনটাই বমি করে দেব।

অন্য বিষয়গুলি:

sanchari mukhopadhyay probondho
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE