Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪

একটা [ ভয় ] কষ্ট লজ্জা

ক্লাস ইলেভেন-এ উঠলে আরও দুটো পাখনা গজায়। নিজেকে অসম্ভব ইম্পর্ট্যান্ট মনে হয়। আর সায়েন্স নিয়ে পড়লে তো ধরা ও সরা এক। বিশেষ করে যখন প্র্যাক্টিকাল ক্লাস আরম্ভ হয়। মা’কে রান্নাঘরে গিয়ে খামখাই আধঘণ্টা টাইট্রেশন নিয়ে নাতিদীর্ঘ বক্তিমে। কিন্তু ভেতরে থরহরি ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেল, যে দিন প্রথম ব্যাঙ কাটতে হবে শুনলাম।

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০১৪ ০০:১৪
Share: Save:

ক্লাস ইলেভেন-এ উঠলে আরও দুটো পাখনা গজায়। নিজেকে অসম্ভব ইম্পর্ট্যান্ট মনে হয়। আর সায়েন্স নিয়ে পড়লে তো ধরা ও সরা এক। বিশেষ করে যখন প্র্যাক্টিকাল ক্লাস আরম্ভ হয়। মা’কে রান্নাঘরে গিয়ে খামখাই আধঘণ্টা টাইট্রেশন নিয়ে নাতিদীর্ঘ বক্তিমে।

কিন্তু ভেতরে থরহরি ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেল, যে দিন প্রথম ব্যাঙ কাটতে হবে শুনলাম। এত দিন ব্যাঙ কাটব বলে একটা গ্ল্যামার অনুভব করতাম। আজ গুড়গুড় অনুভব করলাম। প্র্যাক্টিকাল রুমের দিকে পা আর উঠছে না। কেউ বলছে, ব্যাঙগুলো কি মরা? না রে, ওদের হাই ডোজে ক্লোরোফর্ম দিয়ে রাখে। কোনও ব্যাঙ কি টেবিলে লাফিয়ে ওঠে? যদি ক্লোরোফর্ম বেশি ক্ষণ কাজ না করে?

স্পষ্ট বুঝলাম, আমার বায়োলজি নেওয়া উচিত হয়নি। কিন্তু তত ক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। অনেক ক্লোরোফর্মের ডোজ দেওয়া হয়ে গেছে, আমার জন্য বরাদ্দ ব্যাঙের ওপর। নির্দিষ্ট টেবিলের সামনে দাঁড়ালাম। টিচার দেখিয়ে দিলেন কী করে ব্যাঙটাকে চিত করে চারটে পা’কে টেনে ধরে প্রথমে পিন দিয়ে বোর্ডের সঙ্গে আটকাতে হবে। পড়পড় করে মাঝখান দিয়ে চিরে ফেলতে হবে। তার পর সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বাদ দিয়ে কেবল পৌষ্টিক তন্ত্র বার করে আনতে হবে। এ জন্য নাকি প্রচুর প্র্যাকটিস দরকার। তার মানে প্রচুর ব্যাঙ আর প্রচুর ক্লোরোফর্ম।

শুরু করলাম। নিজেকে এত নৃশংস হতে কখনও দেখিনি। এবং অবাক হয়ে দেখলাম, আমি একদম নিখুঁত ভাবে, চিত করে ব্যাঙটাকে শুইয়ে তার শরীরের মাঝখান দিয়ে ছুরি চালিয়ে চামড়া কেটে ফেলে সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বের করে ভাস্কর্যের নৈপুণ্যে ফুটিয়ে তুলছি পৌষ্টিকতন্ত্র। কোনও ত্রুটি নেই। ছাঁক্কা নম্বর।

আমার খুব ভয় করতে লাগল। কী করে পারলাম? আমি কি তা হলে প্রতি ক্লাসেই অসহায় অজ্ঞান প্রাণীটাকে এমন অনায়াসে মেরে ফেলতে পারব? হঠাৎ করে নিজের ইমেজটা টাল খেয়ে গেল। ঘুমের মধ্যে আশ্চর্য সব স্বপ্ন দেখতে লাগলাম। কিছুই আর নিশ্চিত মনে হল না।

বন্ধুরা প্র্যাক্টিকাল ক্লাসে আমায় নিয়ে হাসাহাসি শুরু করল। কারণ ব্যাঙ কাটার আগে রোজই আমার মুখ কালো আর মন অন্ধকার হয়ে যেতে থাকে। ‘আহা রে, আমাদের গাঁধীজি এ বার অনশনে যাবেন। আমরা ব্যাঙেদের জন্য আন্দোলন শুরু করব।’ কিন্তু আমার বুক ধড়াসধড়াস শুরু হয়ে যেত। এর চেয়ে ব্যাঙ কাটতে গিয়ে মুচ্ছো গিয়ে নেকুপুষু নিকনেম পাওয়া ভাল ছিল। কিন্তু নিজেকে অপছন্দ হওয়ার ভয়টা সাংঘাতিক। আমি তো নিজেকে জানতাম, একটা বেশ ভাল লোক। একটু বেশি ঝগড়া করে, কিন্তু কারও অমঙ্গল চায় না। তা হলে সে এমন দুর্দান্ত হত্যা করে কী করে? ছুরি চালাতে তো কোথাও এতটুকু ভুলচুক হচ্ছে না। মস্তিষ্ক কক্ষনও বেলাইন হচ্ছে না। দিব্যি নম্বরের আকাঙ্ক্ষায় ব্যাঙগুলোকে নির্মম ভাবে কেটে ফেলতে পারছি।

আমায় অনেক বোঝানো হল, এগুলো নিয়ে কেউ ভাবে না কি? শিখতে গেলে এটাই করতে হয়, নিয়ম। কীসের নিয়ম? আমি ওরফে মানুষ আসলে ভয়াবহ একটি প্রাণী, এই সত্যটা নিজের কাছে উন্মোচন করাটা নিয়ম? তা হলে তাহা খুব ভয়ংকর নিয়ম।

নিজের ভেতরে অনেক শেড আছে, যা জানলে হাড় কেঁপে উঠতে পারে, তার ইঙ্গিত পেলাম। ভেতরটা খুব খালি লাগল।

amisanchari@gmail.com

অন্য বিষয়গুলি:

sanchari mukhopadhyay sanchari
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE