ছবি: প্রীতম দাশ
সকাল আটটা থেকে রাত্রি আটটা পর্যন্ত সারা দিনের মানসিক দোলাচল, বুদ্ধির আদান প্রদান— এ সবের পর বাড়ি ফেরার সময় চোখ-মুখের ক্লান্তি অস্বাভাবিক নয়। বরং এটা পৃথিবীর চরম নিত্যতা সূত্রগুলোর মতোই একটা। আদিত্যর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয় না। শারীরিক পরিশ্রম একদমই হয় না বলে, শরীরী ভাষায় ক্লান্তির ছাপ থাকে না, তবে চোখ সমস্ত কথা বলে।
পশ্চিমবঙ্গের এক মফস্সলের ছেলে আদিত্য। বছর দুয়েক আগে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে কলকাতার এক বহুজাতিক সংস্থার কর্মী। ফার্স্ট হোম বলতে অফিস আর সেকেন্ড হোম বলতে ভাড়ায় নেওয়া একটা ওয়ান বেডরুম ফ্ল্যাট। সকাল সাড়ে সাতটায় ঘড়ির অ্যালার্মের সুইচ অফ করা থেকে রাত্রি আটটা অবধি একটা অদ্ভুত ব্যস্ততার মধ্যে কেটে যায়। বাকি সময়টা কাটে ফ্ল্যাটের অগোছালো ঘরে নিজের মতো করে সাজানো ডেস্কটপের সঙ্গে। অফিস থেকে ফিরেই বসে গেম নিয়ে, তবে শরীর বেশি ক্ষণ পারমিট করে না। তাই রাতের খাওয়ার পরেই বিছানা, আর তার পর আবার সেই অ্যালার্ম।
জীবন একটা অত্যন্ত একঘেয়ে রুটিন। যেখানে সকালে উঠতে হয়, স্নান-ব্রেকফাস্ট সেরে একটা মুখোশ পরে অফিসে যেতে হয়, আর রাতে, মুখোশ খুলে নিজেকে উপভোগ করতে হয়। তবে আদিত্য অসন্তুষ্ট নয়। আসলে জীবনের সুখ-দুঃখকে ও উপভোগ করতে জানে। সুখের সময়কে উপভোগ করে আর দুঃখের সময় সুখের জন্য অপেক্ষা করে। ওর জীবনে সবই আছে। নামের সঙ্গে একটা মানানসই ডেজ়িগনেশন, পয়সার জন্য চাকরি... তবুও যেন কিছু একটা নেই। এই কারণেই মাঝে মাঝে বেশ বোরিং লাগে। নিজেকে ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করে, তবে পারে না।
আজ ফ্রাইডে। দিনটার সঙ্গে ‘ড্রাই ডে’ শব্দটার একটা ছন্দগত মিল থাকলেও দিনটা অদ্ভুত। বেশ ভাল। অফিসে বেশ ভাল কাটে দিনটা, সবাই খোলামেলা মেজাজে থাকে। উইকএন্ডের প্ল্যান, একটানা পাঁচ দিনের একঘেয়ে রুটিন থেকে মুক্তি... সব মিলিয়ে মিশিয়ে দিনটা যেন অনেকটা মহালয়ার মতো। এই অনুভূতি থেকে আদিত্যও বাদ যায় না। সন্ধেবেলা কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে একটা সিনেমা দেখতে যাওয়ার প্ল্যান থাকলেও কাজের চাপে মিনি মহালয়াটা যেন দক্ষযজ্ঞ হয়ে উঠেছে। সহজে হাল ছেড়ে দেওয়াটা আত্মবিশ্বাসে খুব খারাপ প্রভাব ফেলে। আদিত্য তাই তাড়াতাড়ি দরকারি কাজগুলো সেরে নিয়ে বাকি কাজ বুঝিয়ে দেয় পরমকে। পরম আদিত্যর জুনিয়র টিমমেট। আর তার পর সোজা দেশপ্রিয় পার্ক।
ফার্স্ট হাফটা মুখ বুজে সহ্য করলেও হাফ টাইমের পর আর হলে ঢুকতে ইচ্ছে করছিল না। শিল্পের এ এক বড় দোষ! কোনও কিছুই পুরোপুরি ঠিক নয়, এমন কোনও কিছুই নেই যা সবার ভাল লাগে, আবার এমন অনেক কিছু আছে যা ভালবাসার সমার্থক হয়ে যায়। বন্ধুরা রাজি না হওয়ায় একা-একাই আদিত্য বেরিয়ে পড়ে রাত ন’টার রাস্তায়। শহরটাকে অনেক দিন ভাল করে দেখা হয়নি। রাত্রির উজ্জ্বল কলকাতা, চার পাশে একটা অদ্ভুত স্বস্তি, একটা অদ্ভুত উত্তেজনা। যেন একটা উৎসব। হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে পড়ে সামনের পার্কে। পার্কের চার পাশে এক বার চোখ বুলিয়ে নেয়। এখন আর ছাতার দরকার পড়ে না। পরকীয়া প্রেমেও নয়। একটা কোণে গিয়ে বসে আদিত্য। এখান থেকে গোটা পার্কটা দেখা যায়। একটা সিগারেট ধরায়। মনে পড়ে যায় হস্টেল জীবনের কথা... তার পর নস্ট্যালজিয়া... তার পর আসে শহর। এই শহর আদিত্যকে অনেক কিছু দিয়েছে, লেখাপড়া, চাকরি। কিন্তু শহরটার জন্য তার কিছু করা হয়ে ওঠেনি। দু’-চার বার মনে করে রাস্তায় থুতু না ফেলা আর চিপ্স-বাদাম এর প্যাকেট ঠিকঠাক ডাস্টবিনে ফেলা—এতটুকুও তো সব সময় মনে করে করা হয়ে ওঠেনি। হঠাৎ মনে পড়ে যায় পরমকে একটা ফোন করার কথা। পকেট থেকে মোবাইল বার করে কল করে পরমকে। ফুল রিং হয়ে গেল, কেউ তুলল না। ফ্রাইডে নাইট! হয়তো কোনও পার্টিতে আছে। পকেটে ঢুকিয়ে নেয় ফোনটা।
শেষ হয়ে যাওয়া সিগারেটটা থেকে আবার একটা সিগারেট ধরায়। আর তার পরই শুরু হয় সেই উল্টোপাল্টা ভাবনাচিন্তা। এর আগে বহু বার মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে এই সব উল্টোপাল্টা চিন্তা আর করব না, কিন্তু এটা যেন নিজে থেকেই আদিত্যর প্রতি দিনের রুটিনে জায়গা করে নেয়। সিগারেটের হাফও শেষ হয়নি, হঠাৎ মোবাইলের মেসেজ টিউন বেজে ওঠে। ব্যস্ত হয়ে পকেট থেকে মোবাইল বার করে দেখে পরমের এসএমএস। কিন্তু বক্তব্যটা বড় অদ্ভুত— ‘ফিউ মিনিটস এগো, আই হ্যাড আ মিস্ড কল ফ্রম দিস নাম্বার। মে আই নো হু আর ইউ!’
ছেলেটা কি নেশা করে আউট হয়ে গেল নাকি! নিজের মনে বিড়বিড় করে বলে ফেলে কথাগুলো। তা হলে কি ওর ফোনে নাম্বারটা সেভ করা নেই! নম্বরটা ফের ডায়াল করতে গিয়েও থেমে যায় আদিত্য। ওর কাছেই পরমের ভুল নম্বর সেভ করা নেই তো! ব্যস্ত ভাবে সিগারেটটা শেষ করে মেসেজ টাইপ করতে শুরু করে, ‘হেই পরম। দিস ইজ় আদিত্য’... তার পর কী ভেবে লাইনটা ডিলিট করে দিয়ে আবার টাইপ করতে শুরু করে ‘হাই, ইজ় দিস পরম? আই অ্যাম আদিত্য’, আর কিছু না লিখে পাঠিয়ে দেয় পরমের নম্বরে। দু’ফোঁটা বৃষ্টি এসে পড়ে আদিত্যর মোবাইল স্ক্রিনে। দ্রুত হাতে জল মুছে পকেটে ঢুকিয়ে নেয় মোবাইলটা। এর পর আর বৃষ্টি থেমে থাকতে পারেনি। নির্দ্বিধায় ঝরে পড়েছে শহর কলকাতার উপর। বৃষ্টিভেজা কলকাতা বড্ড ভাল লাগার জিনিস। আদিত্যও আর লোভ সামলাতে পারেনি। কাকভেজা ভিজে বেরিয়ে পড়ে পার্ক থেকে। বেশ কয়েক জন বিরক্ত লোকজনের সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ে হলের সামনে একটা শেডের নীচে।
বন্ধুদের হল থেকে বেরোতেও বেশি দেরি হয়নি। তাই সাড়ে ন’টা নাগাদ সবাই মিলে বেরিয়ে পড়ে বালিগঞ্জের একটা বারের উদ্দেশ্যে। অল্প একটু তরল আর ধোঁয়া, তার পর যে-যার গন্তব্যস্থল। আদিত্যও একটা ট্যাক্সি নিয়ে রওনা দেয়।
*****
মাথা ঝিমঝিম করছিল আদিত্যর। এ ঘটনা নতুন নয়। এ জিনিসটা বেশ উপভোগ্য। তার পর আবার বাইরে বৃষ্টি। পকেট থেকে ফোনটা বার করে ডায়াল করে একটা নাম্বার। এটা ওর বহু দিনের চেনা একটা নাম্বার। এই নাম্বারটা ডায়াল করার পিছনে কোনও কারণ থাকে না, তবে বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে এই নাম্বারটা ডায়াল করা ছাড়া আর কোনও উপায়ও থাকে না আদিত্যর। নেশা করার পরের মুহূর্তটা ঠিক এ রকমই একটা মুহূর্ত। জীবনে প্রায় প্রতি বারই নেশা করার পরে এই ঘটনাটা ঘটেছে, আর তার পর নেশা কাটতেই ফোন করে জিজ্ঞাসা করেছে, “তখন কী বলেছিলাম?” নম্বরটা ওর এক ছেলেবেলার বান্ধবীর। বান্ধবীই শুধু। প্রেমিকা নয়।
ও পাশের ফোনে দু’-তিন বার রিং হয়েছে কিন্তু কেউ তোলেনি, এমনই সময় একটা মেসেজ টিউন। আদিত্য দ্রুত হাতে মেসেজের ইনবক্স খোলে, দেখে ব্যাঙ্কের ক্রেডিট কার্ডের অ্যাড। মনে মনে পরমকে গালিগালাজ করে আবার ডায়াল করে সেই চেনা পরিচিত নম্বর।
“হ্যালো, কী করছিস?”
“সরি, আপনাকে তো চিনতে পারলাম না!”
“ইয়ার্কি করিস না!”
“আপনি রং নাম্বার ডায়াল করেছেন।”
আদিত্য নম্বরটা ভাল করে দেখে নেয়। শোভার জায়গায় ভুল করে পরমের নম্বর ডায়াল করে ফেলেছে।
“সরি। আসলে এটা আমার এক কলিগের নম্বর বলে সেভ করা ছিল। অ্যান্ড ইট ইজ় ভেরি আর্জেন্ট টু কল হিম। সো... প্লিজ় ডোন্ট মাইন্ড।”
“ইট’স ওকে।”
এর পর চুপচাপ ফোনটা বন্ধ করে পকেটে ঢুকিয়ে নেয় আদিত্য। তার পর সোজা ফ্ল্যাটে এবং সেই চির পরিচিত সুখ-স্বাছন্দ্যের বিছানায়।
সকালে ঘুম থেকে উঠতে আদিত্য কোনও দিনই পারে না। ছুটির দিন হলে তো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু আজকের সকালটা অন্য রকম। বিছানাতেই পাশ ফিরে মোবাইলটা এক বার দেখে নেয়। সকাল নটা আট আর সঙ্গে দু’টো মিস্ড কল। সকাল সকাল এই মিস্ড কলের গিফ্টটা আদিত্য বহু দিন ধরেই পেয়ে আসছে। বাড়ি থেকে ফোন। সুতরাং নতুন ঘটনা নয়।
কিন্তু আজ একটা অন্য নম্বর। একটু পরে ফোন করার চিন্তাটা মাথায় খেললেও আদিত্য দেরি করেনি। দরকারি ফোনও হতে পারে। তাই ঘুমচোখেই ফোন করে। ও পাশের গলাটা বেশ চেনা চেনা...
“হ্যালো... আই গট আ মিস্ড কল...’’
“ওহ্! দিস টাইম মাই মিসটেক। আসলে ভুল করে...”
“নো প্রবলেম। ইট্স ওকে।’’
“ওকে। এ বার থেকে আপনার নম্বরটা রং নাম্বার বলে সেভ করে রেখে দেব।”
“কেন! আমার কি কোনও নাম নেই?”
“অ্যাকচুয়ালি আই ডিডন্ট মিন ইট। বাই দ্য ওয়ে, হোয়াটস ইয়োর নেম?”
“আদিত্য। আদিত্য মুখার্জি। অ্যান্ড ইয়োর্স?”
“পিয়ালি। আপনি কী করেন?”
“আইটি প্রফেশনাল। একটা এমএনসি-তে জব করি। অ্যান্ড ইউ!”
“আমি এমবিএ করছি।”
“ভেরি গুড। কোথা থেকে?”
এর পর আরও অনেক প্রশ্ন-উত্তর, পছন্দ-অপছন্দ, আপনি-তুমি এবং শেষে— “মে উই বি ফ্রেন্ডস?”
আদিত্য বেশি ভাবেনি। সোশ্যাল নেটওয়র্কে কত অজানা মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছে, চ্যাট করেছে, সুতরাং এ সব নতুন কিছু নয়। তাই সব শেষে ফোনবুকে নম্বরটা সেভ করে রাখে ‘রং নাম্বার’ বলে।
*****
অনুভূতিটা অনেক দিন হয়নি। এ এক অদ্ভুত জিনিস। সমগ্র পৃথিবীটা অন্য রকম মনে হয়। খারাপ কোনও কিছু চোখেই পড়ে না। প্রতি দিনের একঘেয়ে অফিস, বাড়ি, বাইপাস সব কিছুই নতুন মনে হয়। ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটার দিকে তাকিয়ে কেটে যায় সারা দিন। কখন সাড়ে ন’টা বাজবে! উইক-ডেতে কথা বলাটা বড্ড চাপের, তাই রাত্রি সাড়ে ন’টার জন্য অপেক্ষা করতে হয় সারা দিন। আর সাড়ে ন’টা বাজলে শুরু হয় পৃথিবীর উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরুর দিকে যাত্রা। এক এক করে উপন্যাসের পাতার মতো খুলতে থাকে চাওয়া-পাওয়া, ভাল লাগা, ছোটখাটো হাসিঠাট্টা, খুনসুটি।
দিনের পর দিন পেরিয়ে যেতে থাকে, কিন্তু আসল কথাটা আর জিজ্ঞেস করা হয়ে ওঠে না। প্রতি দিনই ভাবে বলবে, কিন্তু বলার সময় বুকটা কেমন যেন করে, একটা অদ্ভুত শ্বাসকষ্ট হয়। তাই থেমে যায়। সারা রাত মনের উপর এই অকথ্য অত্যাচারের জন্য সকাল থেকে মনকে বোঝাতে হয়, এটা ইনফ্যাচুয়েশন। ভালবাসার অনেক ধাপ আছে। এ রকম শুধু কথা বলে আর কথা শুনেই কি আর... কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মনের উপদ্রবটা বাড়তে থাকে। আবার জেগে ওঠে শব্দগুলো— আজ জিজ্ঞেস করবই!
নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে নম্বরটা ডায়াল করল আদিত্য। কিন্তু ডায়াল করতেই যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর— দ্য নাম্বার ইউ হ্যাভ ডায়ালড, ইজ় কারেন্টলি আনঅ্যাভেলেবল। হয়তো চার্জ শেষ মোবাইলের। কিছু ক্ষণ পর আবার ডায়াল, কিন্তু ও পাশের উত্তর সেই এক। এর পর বহু বার ডায়াল করেছে। সকালে... দুপুরে... রাতে এবং আরও অনেক সময়। কিন্তু প্রতি বারই বিভিন্ন ভাষায় বেজে উঠেছে একই অর্থের শব্দ— আপনার ডায়াল করা নাম্বারটি বাস্তবে উপলব্ধ নেই। মনটা বেশ অস্থির লাগছিল আদিত্যর। অবশেষে একটা সিগারেট শেষ করে মেসেজ টাইপ করতে শুরু করে ‘হোয়াট হ্যাপেনড উইথ ইয়োর ফোন!’ লাইনটা ডিলিট করে দিয়ে আবার টাইপ করতে শুরু করে ‘হাই মিস রং নাম্বার! হোয়াটস রং উইথ ইয়োর নাম্বার!’ কিন্তু এটাও ডিলিট করে দেয়। আর ফোন করে না আদিত্য। ফোন করার মতো আস্তে-আস্তে ফোন না করাটাও অভ্যেস হয়ে যায় এক দিন। পৃথিবী তার মতো ঘুরে চলে। শীত থেকে বসন্ত, বসন্ত থেকে আবার শীতের দিকে। অনেক আবর্তনের রেশ পেরিয়ে মনের কোণে জেগে থাকে একটু শূন্যতা। তার পর কখনও হয়তো আর সেটুকুও... কে জানে!
আদিত্য জানে, কিছু কিছু নম্বর রং হওয়াই ভাল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy