রাজা রবি বর্মার আঁকা ছবির অনুকরণে টালির নকশা।
সপ্তদশ শতকের প্রথম দিক। এশীয় বাজার ও কাঁচামালের উৎস দখল করতে সমস্ত ইউরোপীয় বাণিজ্য সংগঠনের প্রতিযোগিতা যুদ্ধের রূপ নিচ্ছে। ১৬০৬-এর এপ্রিলে, মালাক্কা প্রণালীর কাছে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ১১টি বাণিজ্যতরীর পথ আটকে দাঁড়াল ২০টি পর্তুগিজ জাহাজের নৌবহর। শুরু হল যুদ্ধ। পর্তুগিজ কামানের গোলায় উড়ে গেল ওলন্দাজরা। তাদের দেড়শো নাবিক প্রাণ হারাল। ডুবে গেল ‘নাসাউ’ নামে একটি জাহাজ।
মালাক্কা প্রণালী। ভারত মহাসাগরের সঙ্গে দক্ষিণ চিন সাগরকে যুক্ত করার এই সঙ্কীর্ণ প্রণালীটির নিয়ন্ত্রণ আজও আঞ্চলিক ক্ষমতার একটি নির্দেশ সূচক, ঠিক যেমন ছিল সেই সপ্তদশ শতকের প্রথমে। আর এই নিয়ে সংগ্রামের নিদর্শন হিসেবে আজও এই সরু জলপথের নীচে লুকিয়ে আছে অসংখ্য ডুবে যাওয়া জাহাজ, যার মধ্যে ‘নাসাউ’ অন্যতম।
বহু বছর পরে ‘নাসাউ’-এর ডুবে যাওয়া জিনিসপত্র উদ্ধার হয়। জল থেকে উঠে আসে অনেক ইউরোপীয় সেরামিকের টালি, সম্ভবত নেদারল্যান্ডসে তৈরি। আর এখান থেকেই শুরু আমাদের এই গল্প, যার মূল চরিত্র ঘর সাজানোর সেরামিক টালি— পোশাকি নাম মাজোলিকা সেরামিক টালি।
‘মাজোলিকা’ কথাটি এসেছে স্পেন ও ইটালির মাঝে অবস্থিত মাজোর্কা দ্বীপ থেকে এবং শব্দটির দ্বারা গ্লেজ়ড বা চকচকে টালি তৈরির একটি বিশেষ পদ্ধতিকে বোঝানো হয়। ইসলামি দুনিয়ায় বহু প্রাচীন সময় থেকেই স্থাপত্যসজ্জায় টালির ব্যবহার হয়ে এসেছে, তবে ইউরোপে এই ধরনের টালির কাজ শুরু হয় পঞ্চদশ শতকে এবং নেদারল্যান্ডসে জনপ্রিয় হয় ষোড়শ শতকে।
ওলন্দাজরা প্রায় এক শতক ধরে এই ধরনের টালি তৈরিতে হাত পাকানোর পর সে দেশে পৌঁছল চিনের বিখ্যাত নীল সেরামিকের জিনিসপত্র। ডেলফট শহরের ওলন্দাজ কারিগরেরা সেটি দেখেই নকল করতে শুরু করে দিলেন। তত দিনে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও প্রতিষ্ঠিত। ওলন্দাজদের দখলে তখন এশিয়ার বেশ কিছু উপনিবেশ। ব্যস, সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ডেলফট-এর টালি পাড়ি জমাল এশিয়ার সব ওলন্দাজ উপনিবেশে।
কিন্তু চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়। এক সময় টালি তৈরির ব্যবসাতেও ঢুকে পড়ল প্রযুক্তি। হেনরি মিনটন নামে এক ব্রিটিশ প্রযুক্তিবিদ টালি তৈরির পদ্ধতিটিকে যন্ত্রচালিত প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত করে পেটেন্ট করিয়ে নেন। এই পরিবর্তনের জন্য ডাচ টালির চেয়ে অনেক সস্তায় তৈরি হতে শুরু করে ব্রিটিশ টালি, কারণ নেদারল্যান্ডসের শিল্পীরা টালি তৈরি করতেন পুরোপুরি হাতে। কাছাকাছি সময়ে বেশ কিছু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে বাজার ধরার প্রতিযোগিতায় ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বহু পিছনে ফেলে এগিয়ে গেল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ফলে টালির বাজারের দখলও চলে গেল ব্রিটিশদের হাতে। ১৮২৪ সালে অ্যাংলো-ডাচ চুক্তির ফলে মালাক্কা প্রণালীর নিয়ন্ত্রণ আর তাঁর সঙ্গে এশিয়ায় টালি রফতানির একচেটিয়া ব্যবসাটিও ওলন্দাজদের হাত থেকে চলে এল ব্রিটিশ কব্জায়।
ঐতিহাসিক: রামচন্দ্র গোয়েঙ্কার ঘাট। স্থাপত্যে মাজোলিকার জাপানি ফুল।
প্রযুক্তির সাহায্য সত্ত্বেও ব্রিটেন থেকে আমদানি করা টালির দাম ছিল সাধারণ মধ্যবিত্তের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তাঁরা তাই এশিয়ার উপনিবেশগুলোয় একমাত্র ধনীদের বাড়ি, মন্দির বা উপাসনাগৃহের স্থাপত্যে এই টালির ব্যবহার দেখা যেত। এ ভাবেই ভারতে ব্রিটিশ টালি দিয়ে ধনীগৃহ সাজানো শুরু হল উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে।
গৃহশোভার সরঞ্জাম হিসেবে সাধারণত দেখা হলেও, এই গ্লেজ়ড সেরামিক টালিগুলোর একটি ব্যবহারিক প্রয়োজন ছিল। সাধারণ চুনকাম করা দেওয়াল স্যানিটাইজ় করার জন্য ধোওয়া যেত না। টালি লাগালে এই সমস্যার সমাধান করা যায় অনায়াসেই। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি বড় বড় মহামারির আক্রমণ হয়ে গেল এ দেশে। চিকিৎসকরা শুকনো ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশে থাকার সুপারিশ করতে লাগলেন। সাধারণ মানুষ পরিচ্ছন্নতা ও জনস্বাস্থ্যের সম্পর্ক নিয়ে সচেতন হতে শুরু করলেন। এই টালির ব্যবহারে দেখা গেল যে, শুধু দেওয়াল ধোওয়া নয়, দেওয়ালের স্যাঁতসেতে ভাবও অনেকটা কমাচ্ছে। এই সব কারণেও টালির চাহিদা বাড়তে লাগল ক্রমশ।
এর মধ্যে এসে পড়ল বিশ শতক। বাণিজ্য প্রতিযোগিতায় ইউরোপীয় শক্তিগুলোর মহড়া নিতে শুরু করল জাপান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে আর্থিক মন্দার জন্য সব ব্রিটিশ কলকারখানা তখন ধুঁকছে। সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশে স্বাধীনতা আন্দোলনের অঙ্গ হয়ে উঠেছে ব্রিটিশ পণ্য বয়কটের ডাক। এই জোড়া সমস্যায় ব্রিটেন থেকে টালি আমদানির পরিমাণ হু হু করে কমতে লাগল। ফলে জোগান ও চাহিদার এই ফাঁক ভরাট করতে ‘উদিত সূর্যের দেশ’ থেকে নানা পণ্য আমদানির জন্য অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হল ভারতে, বিশেষ করে দুটি বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে। এই পণ্য তালিকার মধ্যে উল্লেখযোগ্য জায়গা নিল জাপান থেকে আমদানি করা, সুন্দর আলঙ্কারিক নকশা আঁকা মাজোলিকা টালির সম্ভার, যা বিশেষ ভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠল বাংলা-সহ ভারতের কিছু কিছু জায়গায়।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে ভারত তথা বাংলার সঙ্গে জাপানের নাগরিক যোগাযোগ ছিল নিবিড়। ঢাকার শিল্পোদ্যোগী শশিভূষণ মল্লিকের সাবান কারখানার প্রযুক্তিবিদ হিসেবে কাজ শুরু করেন উয়েমন তাকেদা। যার সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হয়ে প্রথম বাঙালি হিসেবে জাপান ভ্রমণ করেন হরিপ্রভা তাকেদা, সেই ১৯১২ সালে। দ্বিতীয় বার জাপান গিয়ে হরিপ্রভা দায়িত্ব নেন টোকিয়ো থেকে আজাদ হিন্দ ফৌজের বেতার সম্প্রচারের। সুতরাং জাপান ও বাংলার নাগরিকদের মধ্যে যোগাযোগের আরও একটি স্তর হিসেবে এল নানা জাপানি পণ্য এবং সেই সঙ্গে জাপানি টালি।
জাপানের টালি প্রস্তুতকারীরা ভারতে বাজার দখল করতে নিয়েছিল কিছু সূক্ষ্ম বিপণন কৌশল। স্বাধীনতা আন্দোলন ও জাতীয়তাবাদের জোয়ার দেখে তাঁরা টালির ডিজ়াইনে আনলেন বেশ কিছু পরিবর্তন। প্রথমে জাপানি মাজোলিকা টালির নকশা তৈরি হত ব্রিটিশ টালির নকশা নকল করে। পরে ভারতের পুরাণ ও ধর্মীয় থিমের উপর ভিত্তি করে তৈরি হতে লাগল বিশেষ ডিজ়াইন। এ ক্ষেত্রে বিশেষ করে চোখে পড়ে রাজা রবি বর্মার ছবিগুলোকে টালির ডিজ়াইনে রূপান্তরিত করার কথা। মন্দিরের দেওয়ালের অলঙ্করণ হিসেবে খুব জনপ্রিয় হল এই টালি।
ভারতীয় চিত্রকলার ইতিহাসে রাজা রবি বর্মা অবিস্মরণীয়। তাঁর হাতে পুরাণভিত্তিক চরিত্রগুলো বাস্তব রূপ পায়, যা ভারতের সাধারণের মানুষের ধর্মীয় চেতনার সঙ্গে জড়িত। সস্তা ছাপা ছবি ও ক্যালেন্ডারের সাহায্যে রবি বর্মার এই সব ছবি সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল। পাশাপাশি রবি বর্মার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল এক স্বাদেশিকতার ইমেজ। ধর্মবিশ্বাস, স্বাদেশিকতা এবং জনপ্রিয়তা, সব মিলিয়ে রবি বর্মার ছবি সেই সময়কার বাজারের পক্ষে ছিল আদর্শ নির্বাচন। এ দেশের বাজারের জন্য টালির নকশায় রবি বর্মার ছবি ছাড়াও এল নানা ক্যালেন্ডার-আর্টের পৌরাণিক অনুকরণ। নকশার অভিনবত্ব দিয়েও জাপানি টালি বাজিমাত করল।
শুধু সস্তা দাম, জনপ্রিয় নকশা আর অনুকূল বাজার পরিস্থিতির জন্যই যে এ দেশে জাপানি টালি এত ভাল ব্যবসা করতে পেরেছিল, তা নয়। সঙ্গে ছিল জাপানি পণ্যের গুণমান। কয়েক বছর আগে বালি-তে এক বনেদি বাড়িতে দুর্গাপুজো দেখতে গিয়েছিলাম। বিশ শতকের গোড়ার দিকে বাড়ির কর্তা ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবসায় প্রচুর মুনাফা করে গড়ে তোলেন এই বিশাল বাড়ি। বাড়ির বারান্দা ও সার্বজনীন ব্যবহারের জায়গায় লাগানো ছিল জাপানি টালি। তাঁর মধ্যে একটি টালির উপর আঘাতের চিহ্ন দেখিয়ে বাড়ির বর্তমান কর্তা বলেছিলেন যে, এক বার তাঁরা ছেনি হাতুড়ি দিয়ে টালির শক্তি পরখ করেছিলেন। ভাঙা তো যায়ইনি, হালকা চিড় ধরিয়েই ছিটকে গিয়েছিল ছেনি। এমন ছিল এর গুণগত মান।
এই পণ্য রফতানির সঙ্গে জাপানের সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাশার সরাসরি যোগ ছিল। ব্রিটিশ জনসাধারণের মধ্যে জাপানের আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকা নিয়ে অসন্তোষ থাকলেও বাণিজ্যিক স্বার্থ অগ্রাধিকার পেয়েছিল বৈদেশিক নীতি প্রণয়নে। ১৯১০ সালে জাপান-ব্রিটেন প্রদর্শনী আয়োজিত হয় পারস্পরিক আমদানি-রফতানি বাড়াতে এবং সেই প্রদর্শনীর সূত্রে ব্রিটিশ ও জাপানি রাজপুরুষেরা একে অপরকে মহান দ্বীপ সাম্রাজ্যের প্রতিনিধি বলে সম্বোধন করেছিলেন।
এই সব পুরনো ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে এখনও নানা জায়গায় চরম অবহেলায় পড়ে আছে এই সব জাপানি টালি। বাগবাজারের কাছে একটি বন্ধ মন্দিরে, বছরের পর বছর ধরে রোদ-জলে পড়ে আছে একটি দেওয়ালে লাগানো মাজোলিকা টালি। বাকি দেওয়ালের প্লাস্টার খসে ইট বেরিয়ে গিয়েছে। তবু এখনও উজ্জ্বল সেই একই দেওয়ালের নীচে লাগানো টালির সারি।
শহরের ঐতিহ্যবাহী ইমারত নিয়ে আমাদের ঔদাসীন্য অসীম। আজ মল্লিকঘাট ফুলবাজারের ভিতরে প্রায় অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে বিশিষ্ট শিল্পোদ্যোগী রামচন্দ্র গোয়েঙ্কা স্থাপিত মহিলাদের স্নানের ঘাট। ফুলবাজারের পসরার গোডাউন আর নেশাখোরদের আড্ডাস্থল হিসেবে পরিচিত এই হেরিটেজ স্থাপত্যটির ছাদের গম্বুজ থেকে খসে পড়ছে পলস্তারা। চার দিকে আবর্জনা। এত সব প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে ভিতরে ঢুকলে, অদ্ভুত সাদৃশ্য চোখে পড়ে তুরস্কের বিখ্যাত হামামগুলোর সঙ্গে। ভিতরের নকশা এমন ভাবে করা যাতে পোশাক পরিবর্তন করার সময় আব্রু রক্ষা হয়। স্নান সেরে জিরোবার বন্দোবস্তও আছে। আমাদের অবহেলা আর বিস্মৃতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ঐতিহ্যশালী স্থাপত্যটির ভিতরের দেওয়ালে লাগানো সবুজ জাপানি টালির সারি যেন ফুল হয়ে ফুটে আছে। নোংরা-কালো হয়ে গিয়েছে খানিকটা জায়গা। যেখানে সেখানে গুটখার দাগ। তবু তার সৌন্দর্য থেকে চোখ ফেরানো যায় না।
বিপরীত ছবিও আছে। শহরের কোথাও কোথাও সযত্নে রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে ইতিহাসের স্বাক্ষর এই টালির। শুধু বিশ শতকের প্রথম দিকের শহর ও শহরতলির মধ্যবিত্ত শ্রেণির রুচি ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন নয়, এই টালির নকশায় ধরা আছে বিশ্ববাণিজ্য আর শিল্প-ইতিহাসের নানা টুকরো স্মৃতি। একটু রক্ষণাবেক্ষণ আর সচেতনতা সুরক্ষিত রাখতে পারে এই ঐতিহ্য। শুধু তাই নয়। একটু খেয়াল করলে দেখা যায় যে মহামারির প্রকোপ আর তার সঙ্গে যুদ্ধের আবহাওয়া, বিদেশি পণ্য বয়কট, সব মিলিয়ে জাপানি টালির গল্পের নানা প্রেক্ষাপটের সঙ্গে আজকের পরিস্থিতির কী অদ্ভুত মিল!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy