ছবি: কুনাল বর্মণ।
রামায়ণের শিক্ষায় হিন্দুদের দৃঢ় সংস্কার, জ্যৈষ্ঠ মাসে প্রথম পুত্রের বিবাহ দিলে দাম্পত্যে বিচ্ছেদ আসবেই। ‘পাপিষ্ঠ জ্যৈষ্ঠমাস’-এ অযোধ্যাপতি দশরথ বিবাহ করেছিলেন বলেই নাকি দাম্পত্যসুখ পাননি। হিন্দু বাঙালির বিয়ের গানে-ছড়ায় শিব-দুর্গার সঙ্গে রাম-সীতার উপস্থিতিও লক্ষ্যণীয়।
এক কালে বিয়েতে নরসুন্দরদের ভূমিকা ছিল গৌরবের। শাস্ত্র-নির্দেশিত ক্ষৌরকর্ম পালনের পরে তাকে সেই আসরে বিবাহের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে হত পয়ার ছন্দের পাঁচালি সুরে— ‘শুনুন শুনুন মহাশয় করি নিবেদন/ রামসীতার বিবাহ কথা করুন শ্রবণ/ প্রজাপতি নির্বন্ধ কহেন সর্বলোকে/ কন্যাদান মহাফল সর্বশাস্ত্রে লেখে।’ এ ছাড়া বাসি বিয়ের আসরে কন্যার সখিদলের গানেও থাকত শ্রীরামের মহিমা, ‘শ্রীরামচন্দ্রের বাসি বিয়া মিথিলায়/ দেখিতে রামের বিয়া/ স্বর্গপুরের বাসী যারা/ গোপনে থেইকে চায়।’
গবেষকদের আক্ষেপ, বাঙালি হিন্দু সমাজে একদা প্রবল প্রচলিত এই ছড়া বা গানগুলি ঠিকমতো সঙ্কলিত হয়নি। এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মে মূলত শ্রুতিধরের মৌখিক ব্যবহারেই থেকে গিয়েছে। যেমন রাজশাহী জেলায় প্রচলিত ছিল হলুদ কোটার ছড়া: ‘শোনে হরিণের ডাক/ ওই না হলদি কুটতে ক’নার মা।/ শোনে বাঘের ডাক/ দৌড় দিয়ে যায় ক’নার মা।’ এর পর আমরা বলিউডি ছবি দেখে বিয়ের আসরে মেহেন্দি-চর্চা করে, ‘সঙ্গীত’-এর আসর বসিয়ে ‘এক দেশ এক বিয়ে’-র আদেখলেপনা করেছি, আর হারিয়ে গিয়েছে স্ব-ঘরানার ঐতিহ্য। তবে আশার আলো জোনাকির পুচ্ছেও থাকে। তাই এখনও হয়তো দক্ষিণ দামোদর অঞ্চলে কোনও লোলচর্ম বৃদ্ধা নাতনির বিবাহ বাসরে ডিজে-দাপটের পূর্বাহ্ণেই শুনিয়ে দেন এমন দু’-একটি গান— ‘এলাম সই তোদের বাড়ি মালা দিতে/ মালা দিতে লো সজনী বর দেখিতে/ আমি রসেরও মালিনী/ রসের খেলা কতই জানি।’
বিবাহকর্মকে ইসলাম ধর্মে অত্যন্ত পুণ্যকর্ম বলে মনে করা হয়। হাদিসে বলা হয়েছে: ‘যখন কোনও বান্দা বিবাহ করে, সে তার ধর্মের অর্ধেক ইমান পূর্ণ করে।’ তাঁদের বিশ্বাস— বিয়ের কাপড় মুসলমানের সঙ্গে বেহেশ্ত পর্যন্ত যায়। বাঙালি মুসলিম সমাজে প্রচলিত আছে সহস্রাধিক বিয়ের গান। এই গীতি শুরু হয় আল্লাহর বন্দনা দিয়ে: ‘পাঁচোপির পাঞ্জাতন/ সালাম বাজাই জনার জন/ সেই সালামটি বাজাই আমার আল্লার রসুলকে।’ এখানে ‘পাঞ্জাতন’ হলেন হজরত মহম্মদ, হজরত আলি, হজরত ফাতেমা, হজরত হাসান এবং হজরত হোসেন। এঁদের বন্দনার পর স্মরণ করা হয় ইমাম হোসেন, বড় পিরসাহেব, খাজা পিরসাহেব প্রমুখকে।
‘ঢেঁকি-মুঙ্গলা’ গ্রামীণ মুসলিম বিবাহরীতির প্রাচীন আচার। সাত এয়ো স্ত্রী ঢেঁকির পাড়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মঙ্গলগীত গায়— ‘চোখ মুজি মুজি চোখে ছাই/ ঢেঁকি মুঙ্গলানো দেখে যাই/ গাল ভ’রে পান পাই/ মাথা ভ’রে তেল পাই।’ গালভরা পান এবং মাথাভরা কেশরঞ্জনীর সামান্য প্রাপ্তির আন্তরিক খুশি আমরা ভুলেই গেছি। হিন্দুদের মতোই বাঙালি-মুসলমান সমাজে বাসর-জাগা গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে বরকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করে গানের রেওয়াজ। বর-কনেকে মাঝে রেখে মেয়েরা দু’টি দলে ভাগ হয়ে প্রশ্নোত্তরের ভঙ্গিতে এই গান গায়, ‘তার-ই-তসন (অপূর্ব সুন্দরী) মেয়ে আমার, জামাই কেন মোর কালো গো?/ হোক না মা তোর কালো জামাই, আঁধার ঘরে ভালো গো।/ তার-ই-তসন মেয়ে আমার, জামাই কেন মোর দেঁতড়ো গো?/ হোক না মা তোর দেঁতড়ো জামাই, কচু ছিলবার ভালো গো।”
বাংলার খ্রিস্টানদের বিবাহ-বাসরে কিছু দিন আগে পর্যন্ত প্রচলিত ছিল ‘নবদো’। জনৈক বিলেত-ফেরত পাদরি রচিত এই শপথ-কবিতার ভাষা ল্যাটিন। জিশুসেবক পুরুতমশাই এটি রচনা করেছিলেন বাঙালি খ্রিস্টানদের জন্য। এর অর্থ না বুঝে গড়গড়িয়ে মুখস্থ বলে যেত বাংলাভাষী বর-বেচারা। ত্রুটি ঘটলে হাসির রোল, আবার প্রথম থেকে আবৃত্তি করতে হত। তবে এখন জিশুধর্মী স্বস্তি পেয়েছেন, ‘নবদো’ জব্দ হয়েছে চিরতরে লুপ্ত হয়ে।
বৌদ্ধ সমাজে এক কালে প্রচুর বিয়ের ছড়া ও গান প্রচলিত ছিল। বৌদ্ধরা এই ঐতিহ্য বিস্মৃতির ক্ষেত্রে হিন্দু অনুগামী। অব্যবহারে হারিয়ে গেছে অধিকাংশ রচনা, কোনও সঙ্কলনগ্রন্থ নেই, গবেষণায় আগ্রহীর সংখ্যাও নগণ্য। বাপের বাড়ি থেকে বিদায়লগ্নে বৌদ্ধ কন্যা মনের দুঃখে চোখের জল মুছতে মুছতে বলছে: ‘ঢোল বাজে আর মাইক বাজে/ আঁর পরাণে ক্যান গররের/ ক্যান গরি আঁই যাইয়ম পরের ঘর।’ এই গানটিতে ‘মাইক বাজে’ বলে বোঝা যাচ্ছে খুব বেশি সময়ের ছাপ তাতে পড়েনি। আবার এমনও হতে পারে মূল পদ্য সুপ্রাচীন, মাইক বাজানোর শব্দদূষণ নিতান্তই প্রক্ষিপ্ত।
নেপালি সমাজে বিয়ের প্রীতিভোজের সময়ে ছড়া কেটে ‘বাগ্যুদ্ধ’ হয়। বঙ্গদেশে কলাপাতার মতো নেপালিদের ভোজনপত্র ছিল নাঙলো পাতা। এটি দেখতে বড়সড় ট্রে-র মতো। বিয়ের ভোজ চলতে থাকে, সেই সঙ্গে ছড়া-অস্ত্রে দুই পক্ষের মধ্যে চলতে থাকে চাপান-উতোর: ‘নাঙলো জত্রো পাত,/ কসরী খানছৌ জন্তী…’, কোদাল চালানো খসখসে হাতে বরযাত্রীরা নাঙলো পাতায় কী ভাবে খাবে!
‘তিতি’ নামের পাখিটি একা থাকতে পারে না। তাদের অটুট জোড়ের মিথ উঠে আসে সাঁওতাল সমাজের বিয়ের আচারে। বরের আশীর্বাদ অনুষ্ঠানে তাদের গান: ‘আরুরে বিহুরে সেহে’লে তিতি দ’, মানে, তিতি পাখির মতো হোক হবু দম্পতির নবজীবন। বিবাহে গ্রামের জগমাঁঝির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হলুদ বাটার দিন জগমাঁঝির স্ত্রী তিনটি আইবুড়ো মেয়েকে নিয়ে আসে। তারা পুবপানে মুখ রেখে বরের মা-বাবার উদ্দেশে গান গেয়ে হলুদ বাটে: ‘বাছাও সাসাং রিৎ রিৎতে/ ধিরি মা রাপুৎএন্…।’ বাছা, হলুদ পিষতে পিষতে শিল ভেঙে গেল, ওগো বরের বাবা-মা, শিল কিনতে লোক পাঠাও।
উত্তরবঙ্গীয় হাজংদের বিয়েতে ‘গীদাল’দের আমন্ত্রণ জানানো বিশেষ রীতি। গানের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে তাঁরা ‘গীদাল’; সম্পূর্ণ অনুষ্ঠানে গান-বাজনার দায়িত্ব তাঁদের। বিয়ের যাবতীয় খুঁটিনাটি গানের মধ্য দিয়ে এঁরা রাঙিয়ে তোলেন। পাশাপাশি মেচ-সমাজে বিবাহ রীতিমতো উৎসব হয়ে ওঠে নানা ধরনের সঙ্গীত ও নৃত্যানুষ্ঠানের মাধ্যমে। প্রায় প্রতিটি আচারের সঙ্গে গান এদের বিয়ের মূল বৈশিষ্ট্য। গান ও সুরার যৌথতায় কনেপক্ষ বিয়ের আসরে আগমন উদ্যত বরের পথ রুদ্ধ করে বলে ওঠে: ‘ফাসা-গহবলি-লাইলুলাই’, গভীর বনের হে নববর, তোমার বিয়ের হাঁড়িয়া (মদ) নিয়ে এসো।
‘আড়দি দুরাং’ কথাটির অর্থ বিয়ের গান। কোড়া জনজাতি সমাজে বিয়ের নানা আচারে এই ‘আড়দি দুরাং’ প্রচলিত। যেমন কনেকে ছাঁদনাতলায় নিয়ে আসার আগে যে আচারটি পালনীয় তার নাম ‘লুড়গু আড়গু’। মেয়ের বাবা হাঁটুতে নোড়া রেখে মাথা ঠেকায়, তখন পার্শ্ববর্তী মেয়ের দল গান ধরে: ‘অকয় লুড়গু আড়গু ইকে?’— কে নোড়া নামাচ্ছে? যে নিজের বাবা সে নোড়া নামাচ্ছে। লোধা সমাজে কুলবধূর দল জলাশয় থেকে জল ভরে মঙ্গলঘট নিয়ে ফেরার পথে কোকিল পাখির উদ্দেশে গান ধরে: ‘কুইলি, কুইলি, ওগো কুইলি,/ এ পথে না করিও বাসা গো।/ এখনি আসিবে বর যাতরি,/ ভাঙ্গিবে কুইলির বাসা গো।’ উত্তরবঙ্গের আর এক জনজাতি ধিমালদের বিয়ের দিন গ্রামের পথে বরযাত্রীদের আটকানো হয়। তার পর গানে গানে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে তোলে কন্যাপক্ষ। বরকে বলা হয়: ‘রেমকা বেজান কেলাকো মাপিঙ্গেরে…’— আমাদের সুন্দর মেয়েটাকে তোমার কাছে দেব না। এর পর মদ ও চুরুট বিনিময়ের পর পথ অবরোধ তোলা হয়।
‘ঘর আর বর/ মাঘ ফাল্গুনে কর’— বিবাহ-বিষয়ক প্রবাদটি কুড়মি সমাজে পেশা সৌজন্যে প্রচলিত হলেও, প্রাকৃতিক কারণটির প্রয়োজন আজও গুরুত্ব হারায়নি। কুড়মি-কন্যা যখন বাবা-মায়ের কাছে বিদায় নেয় তখন পাত্রপক্ষের গান: ‘তর বিটিকে লিয়ে যাচ্ছি বাইজ-বাজনা করে/ থাক লো কইন্যার মা শুধা ঘরটি লয়ে।’ এর পর বর বাবাজীবন নবপরিণীতাকে নিয়ে নিজগৃহে প্রবেশ করে। ননদিনী রায়বাঘিনীর দল ঠাট্টা, বিদ্রুপ শুরু করে গানে, ছড়ায়। এমনকি সেই রাতে খেতে দিয়ে নতুন বৌয়ের খাওয়া নিয়েও ঠাট্টা করে ননদকুল: ‘আছাঁটা চাউলের ভাত আলতি বেসাতি/ খা বলতে খালি, বহু এতই ভখে ছিলি!’ সংসার যে সমরক্ষেত্র, তার ইঙ্গিত কি এই ছড়াতেই পেয়ে যায় নতুন বৌটি? শবর-সমাজে গায়ে হলুদের সময়েই ‘বিপদ’-এর পূর্বাভাস পায় পাত্র অথবা পাত্রী। এদের গায়ে হলুদের নাম ‘গাঁইডা হুড়িৎ’। হলুদ মেখে স্নান করে এল ছেলে বা মেয়েটি, বৌদি আকন্দ ফুলের মালা পরিয়ে দিলেন, তখনই সমবেত গানে ফুটে ওঠে সাবধানবাণী: ‘ফুলের মালা পরিস না রে/ যাবেক জাতের কুল।’ অভিজ্ঞজন তাঁর কর্তব্য করলেন ঠিকই, তবে এ সব সুপরামর্শ কে, কবে কানে তুলেছে!
কৃতজ্ঞতা: প্রভাত ঘোষ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy