আমেরিকার একটি শহরে ৭ জুন ‘প্রাইড প্যারেড’-এ তসলিমা
ভা ইরাসের মতো খবরটা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে, আমি ভারত ছেড়ে চলে গিয়েছি আমেরিকায়। কেন? আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের খুনিরা, যারা অভিজিৎ-ওয়াশিকুর-অনন্তকে কুপিয়ে মেরেছে, তারা আমাকেও মেরে ফেলবে— এই ভয়ে। এতই যদি আমার ভয়, তা হলে ইউরোপের নাগরিক হয়েও, আমেরিকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়েও, কেন বাংলাদেশে ফেরত যাওয়ার জন্য এত চেষ্টা করেছি? আর, কেনই বা বছরের পর বছর ভারতে শুধু থাকিইনি, থাকার জন্য যুদ্ধও করেছি? এ দুটো দেশেই তো জীবনের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি, এ দুটো দেশেই আমার বিরুদ্ধে মিছিল হয়েছে, আমার ওপর শারীরিক আক্রমণ হয়েছে, আমার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি হয়েছে, আমার মাথার দাম ঘোষিত হয়েছে, এ দুটো দেশেই ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীরা আমাকে মেরে ফেলার জন্য ওত পেতে থাকে। এত কাল পর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বেঁচে থাকায় অভ্যস্ত আমি ভয় পেয়ে পালাব? পালিয়ে যাওয়ার মানুষ তো কোনও দিনই ছিলাম না। নিরাপদ জায়গা ফেলে আমি তো সারা জীবন অ-নিরাপদ জায়গাতেই জেনেশুনে বাস করেছি।
আমাকে গৃহবন্দি করেছিল ভারত সরকার। ভারত ছাড়তে বাধ্য করেছিল। তার পরও ফিরে গেছি ভারতে। আশ্রয় ভিক্ষে চাইনি। আশ্রয়ের দাবি জানিয়েছি। গণতন্ত্রের কাছে, একটি সেকিউলার রাষ্ট্রের কাছে দাবি। মানবাধিকারের পক্ষে লড়াই করা এক জন লেখক হিসেবে দাবি। দিল্লি ছাড়া আর কোথাও যাওয়া নিষেধ। তার পরেও রয়েছি দিল্লিতে। ওই শহরটি ত্যাগ করা মানে গোটা একটি উপমহাদেশ ত্যাগ করা। আমার ভারত-বাসের অনুমতি আর না পাওয়া মানে, আমার জন্য উপমহাদেশের দরজা চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়া। এ বারই তো নতুন সরকার এসে ভারত-বাসের অনুমতিকে এক বছর থেকে কমিয়ে দুু’মাসে এনেছিল। শুধু যুদ্ধ করে বেঁচে আছি। নিজের আদর্শের জন্য যুদ্ধ। যেখানে বাস করতে ইচ্ছে করে, সেখানে বাস করার অধিকার চাই। পৃথিবীর সর্বত্র বাক্স্বাধীনতা চাই। আমি স্বাধীন ভাবে আমার মত প্রকাশ করব, সে কারণে আমাকে জেল খাটতে হবে না, আমার ফাঁসি হবে না, আমার পিঠে চাবুক চালানো হবে না, আমাকে পাথর ছোড়া হবে না, আমাকে নির্বাসনে যেতে হবে না। এই নিশ্চয়তা চাই। শুধু আমার জন্য নয়, সবার জন্য।
নিজের সুবিধের জন্য, নিজের বাঁচার জন্য, আজ অবধি কিছু তো করিনি। অনেক বছর আগে, যখন আমার খুব নামডাক, ইসলামি মৌলবাদীরা হাতের নাগালে পেলে আমাকে জবাই করবে— খবরটি বিশ্বের সর্বত্র প্রচার হচ্ছে, তখন ইউরোপের সরকার, সংগঠন, প্রতিষ্ঠান থেকে আমাকে জিজ্ঞেস করা হত, ‘তোমাকে কী করে সাহায্য করতে পারি বলো।’ আমি সবাইকেই বলেছি, ‘আমাকে নয়, বাংলাদেশের গরিব মেয়েদের সাহায্য করো।’ আমাকে দেশ থেকে বের করে দিয়েছে বলে কিছু দাতা দেশ বলেছিল, তারা বাংলাদেশকে দান দেওয়া বন্ধ করে দেবে। আমি বলেছি, ‘ও কাজটি কখনও কোরো না। বাংলাদেশের দরিদ্র মেয়েরা তোমাদের সাহায্য পেলে খেয়ে-পরে বাঁচবে, শিক্ষিত আর স্বনির্ভর হওয়ার সুযোগ পাবে।’
না, নিজের জন্য আজও ভাবছি না। এ বার আমার আমেরিকায় আসার কিছু কারণের মধ্যে একটি বড় কারণ, সেকিউলার হিউম্যানিস্ট কনফারেন্স-এ বলা: বাংলাদেশের নিরীশ্বরবাদী লেখকরা কী রকম মৃত্যুভয়ে গুটিয়ে আছেন। এবং তাঁদের প্রাণে বাঁচানোর জন্য ইউরোপ-আমেরিকার সরকার এবং সংগঠনের কাছে আবেদন করা। আর হ্যাঁ, এখানে যে ফান্ড তৈরি করা হচ্ছে আমার জন্য, সেটি মূলত খরচা হবে— দেশ থেকে ওই লেখকদের বিদেশে নিয়ে আসা এবং বিদেশে তাঁদের থাকা-খাওয়ার জন্য।
নব্বইয়ের শুরুতে লক্ষ লক্ষ মৌলবাদীর মিছিল দেখেছি, যে মিছিলে আমার ফাঁসির দাবি উঠত। ওই মৌলবাদীদের সুযোগ্য পুত্ররা আজ দেশের প্রতিভাবান লেখকদের জবাই করে, নয়তো পেছন থেকে ঘাড়ে কোপ বসায়। আমি তাদের পুরনো শত্রু। ঢাকা থেকে দিল্লি তো খুব দূরে নয়। সন্ত্রাসীরা পশ্চিমবঙ্গেই বোমা বানানোর কারখানা তৈরি করতে পারে, খোঁজ নিলে দেখা যাবে চাপাতি চালানোর ট্রেনিংটাও হয়তো পশ্চিমবঙ্গের কোনও শহরেই নিচ্ছে। ও-দিকে বাংলাদেশে সন্ত্রাসীদের হিট লিস্টে এখন এক ঝাঁক উজ্জ্বল লেখক, যাঁরা ধর্মে নয়, বিজ্ঞানে বিশ্বাসী, যুক্তিতে বিশ্বাসী, নারীর সমানাধিকারে বিশ্বাসী। লেখকরা আজ ভয়ে লেখালেখি বন্ধ করে দিয়েছেন, ঘরের কোণে লুকিয়ে রয়েছেন, দেশ ছাড়তে চাইছেন, মাথায় হেলমেট পরে বাইরে বেরোচ্ছেন, কেউ কেউ শহর ছেড়ে চলে গেছেন অচেনা গ্রামে, চেহারা বদলে মিশে গেছেন মানুষের ভিড়ে।
সবাই ভাবছে, কোপ এ বার তাকেই খেতে হবে। প্রায় প্রতি মাসেই এক জনকে কুপিয়ে মারা হচ্ছে। হুমকি পেয়ে পুলিশের কাছে রিপোর্ট করতে গেছেন কিছু লেখক, পুলিশ রিপোর্ট নিচ্ছে না, সোজা বলে দিচ্ছে, ‘বাঁচতে চাইলে দেশ থেকে পালাও।’ খুনিদের গ্রেফতার করছে না পুলিশ, কেন করছে না জিজ্ঞেস করলে বলছে, ‘ওপরের নির্দেশ নেই।’ শুধু লেখক বা ব্লগারদের নয়, রাজশাহি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শফিউল ইসলামকে কুপিয়ে মেরে ফেলেছে সন্ত্রাসীরা। তাঁর দোষ, তিনি তাঁর ক্লাসের ছাত্রীদের বোরখা পরে আসতে বারণ করেছিলেন, বলেছিলেন মুখ ঢাকা থাকলে পড়াতে অসুবিধে হয়।
অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান আর অনন্ত বিজয় দাস-এর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর শেখ হাসিনা একটি বিবৃতিও দেননি। খুনিদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র কোনও ব্যবস্থা নেবে না, মৃত্যুর হুমকি পাওয়া মুক্তমনা লেখকদেরও নিরাপত্তা দেবে না— এই দুঃসহ অবস্থায় দেশ ত্যাগ করা ছাড়া ওঁদের আর কোনও উপায় নেই। আপাতত বাঁচুন, দেশের অবস্থা ভাল হলে নাহয় ফিরবেন দেশে। কিন্তু মৌলবাদ-বিরোধী আন্দোলনের নেতা শাহরিয়ার কবীর চান না, ব্লগাররা দেশ ছাড়ুক। তিনি বলছেন, দেশ ছেড়ে কোনও লাভ হবে না, লাভ হবে জামাতে ইসলামি-কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে। জামাতে ইসলামি নিষিদ্ধ হলে সন্ত্রাসীরা মুক্তমনা লেখকদের খুন করবে না— এ কথা হলফ করে কে বলতে পারে?
গত দু’দশকে অজস্র মৌলবাদী-সন্ত্রাসীর জন্ম হয়েছে, যারা জামাতে ইসলামির চেয়েও বেশি ভয়ংকর। তারা আইসিস-আলকায়দার নির্দেশে চলে। শাহরিয়ার কবীর বললেন, তাঁর হাতে পিস্তল আছে, এবং তিনি একা বাইরে বেরোন না। উনি নাহয় লাইসেন্স-সহ পিস্তল জোগাড় করতে পারেন। কিন্তু অল্পবয়সি লেখকেরা পিস্তল কোত্থেকে জোগাড় করবেন, লাইসেন্সই বা তাঁদের কে দেবে? যে সরকার তাঁদের কোনও দেহরক্ষী দেয় না, সে সরকার তো লাইসেন্স দেবে না। কিছু দিন আগে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হয়েছে। যে দল খুন করে এসে গোটা দেশকে জানিয়ে দিচ্ছে তারা খুন করেছে, তার পরও তাদের টিকিটি পর্যন্ত স্পর্শ করছে না সরকার, তাদের নিষিদ্ধ করলেই কী, না করলেই কী!
সমাজ যে ভাবে আছে, সে ভাবেই যদি থাকে, ঘটে বুদ্ধি আছে এমন কাউকেই চাপাতির হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব নয়। সমাজকে বদলাতে হলে, ধর্মান্ধদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত করাটা খুব জরুরি। অন্য কোনও অনুভূতিতে আঘাত লাগলে মানুষ এত বীভৎস-বর্বর হয়ে ওঠে না, কেবল ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগলেই হিতাহিত জ্ঞান হারায়। যাঁরা বাংলাদেশের ব্লগার-হত্যার বিরুদ্ধে, তাঁরা অনেকেই ব্লগারদের পক্ষ নিতে গিয়ে বলছেন: ‘ব্লগাররা কারও ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেননি।’ তা হলে কি ধর্মান্ধদের মতোই, তাঁরাও মনে করেন— ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেওয়া অন্যায়? মুশকিলটা ঠিক এই জায়গায়। লক্ষ করেছি, এটা মেনে নিতে গণ্যমান্য মনীষীদেরও অসুবিধে হচ্ছে যে, মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়াটা অন্যায় নয়।
অনুভূতিতে কোনও রকম আঘাত ছাড়াই পুরো জীবনটা কাটিয়ে দিতে চাওয়ার দাবিই বরং অত্যন্ত অন্যায় দাবি। সব মানুষের মতামত এক নয়। মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা করলে অনুভূতি এক বার কেন, বার বার আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে। মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করলে, অনুভূতির ওপর আঘাত নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। মত প্রকাশের স্বাধীনতার অস্তিত্ব থাকতেই হবে, যদি গণতন্ত্রের অস্তিত্ব রাখতে হয়।
ধর্মানুভূতির রাজনীতি অনেক কাল ধরে চলছে। ধর্মানুভূতির সঙ্গে সংঘাত লাগছে গণতন্ত্রের, শুভবুদ্ধির, জ্ঞানের, বিজ্ঞানের, নারীর অধিকারের, মানবাধিকারের, সমানাধিকারের। যে কোনও একটি পক্ষ আমাদের নিতেই হবে। আমরা ধর্মানূভুতি রক্ষা করতে চাই, না কি গণতন্ত্র, শুভবুদ্ধি, জ্ঞান, বিজ্ঞান, নারীর অধিকার, মানবাধিকার, সমানাধিকার রক্ষা করতে চাই?
পৃথিবীর কোথাও নারীবিদ্বেষীদের অনুভূতিতে আঘাত না দিয়ে নারী-অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পৃথিবীর কোথাও মানবাধিকার-বিরোধী লোকদের অনুভূতিতে আঘাত না দিয়ে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পৃথিবীর কোথাও গণতন্ত্র-বিরোধী লোকদের অনুভূতিতে আঘাত না দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পৃথিবীর কোথাও ধর্মান্ধদের অনুভূতিকে আঘাত না দিয়ে বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পৃথিবীর কোথাও মানুষের ধর্মানুভূতিকে ক্রমাগত আঘাত না দিয়ে ধর্মানুভূতির নামে ধর্ম-ব্যবসা বন্ধ করা সম্ভব হবে না, ধর্মীয় সন্ত্রাস বন্ধ করা সম্ভব হবে না।
নাস্তিক ব্লগারদের পক্ষ নিতে চাইলে, ‘ওঁরা কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেননি’— এটা বলাটা ঠিক নয়। বরং বলা উচিত: ওঁরা মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছেন, কারণ আঘাতটা জরুরি ছিল। বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মের সংঘাত চিরকালের। কিন্তু বিজ্ঞান যে মানে না, তাকে বিজ্ঞানীরা ধারালো ছুরি নিয়ে কোপাতে যান না। কিন্তু ধর্ম যে মানে না, ধার্মিকরা তাদের কোপাতে যায়। একবিংশ শতাব্দীতে ১৪০০ বছর আগের বর্বরতাকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। কোপানোর বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে প্রতিবাদ না হলে কোপানো চলতে থাকবে। আজ বিজ্ঞানীদের, মুক্তমনাদের কোপাবে, কাল হিজাব না পরলে, নমাজ না পড়লে, রোজা না করলে কোপাবে।
সেকিউলার সংগঠনটি তাদের ফান্ড রেজিং-এর চিঠিটি বিলি করার পরই সমস্যা হয়েছে। বিশ্বের সব প্রচারমাধ্যমের কাছে, ‘আমি আমেরিকায় এসেছি’-র চেয়ে বড় খবর ‘আমি ভারত ছেড়েছি’। আমার ভারত ছাড়ার খবরটা যারাই ছড়িয়েছে,একটু বাড়াবাড়ি করেই ছড়িয়েছে। চিঠিতে লেখা ছিল না: আমি তল্পিতল্পা নিয়ে জন্মের মতো ভারত ছাড়ছি। ভারত ছেড়ে কোথায় যাব? এখনও তো ভারতেই পড়ে আছে আমার বাড়িভর্তি বইখাতা, কাপড়চোপড়, অযুত-নিযুত জিনিসপত্তর, পোষা বেড়াল।
দিল্লি থেকে বেরিয়েছি ছোট একটা সুটকেসে দুটো জিন্স, দুটো শর্টস, আর ক’টা টি-শার্ট নিয়ে। ল্যাপটপ, আইপ্যাড তো হাতে থাকেই, সে যেখানেই যাই। ভারত ছাড়ার খবরটা নিঃসন্দেহে কোনও সুখবর নয়। আমার কোনও সুখবর কি কখনও কোথাও প্রকাশ হয়েছে! এই যে দীর্ঘ ২২ বছর ইউরোপ আর আমেরিকার বিভিন্ন সরকার, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, মানবাধিকার সংগঠন, নারীবাদী দল আমাকে বক্তৃতার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছে, একটা সুস্থ সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন নিয়ে নিজের সময়, শ্রম, অর্থকড়ি, বিদ্যেবুদ্ধি সব ঢেলে দিচ্ছি, এই যে এত সভ্য দেশ থেকে এত সম্মান পেয়েছি, এত পুরস্কার, এত ডক্টরেট— উপমহাদেশের কোথাও কেউ কি খবর করেছে? কখনও করেনি, শুধু লিখে গেছে ক’টা পুরুষের সঙ্গে শুয়েছি, ক’টা বিয়ে করেছি, কোন দেশ আমাকে তাড়িয়েছে, কোন রাজ্য আমাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়েছে, কত লোক আমাকে ঘৃণা করে, কত লোক আমার লেখা পছন্দ করে না, আমাকে লক্ষ্য করে লোহার চেয়ার ছুড়ে মারা হয়, রাজ্য আমার বই নিষিদ্ধ করে, টিভিতে আমার মেগাসিরিয়াল দেখাতে আপত্তি করে— এ সব। আমার নামের আগে জুড়ে দেয় একটি শব্দ, ‘বিতর্কিত’। শব্দটি জুড়তে জুড়তে এখন এটিকে তারা আমার নামের অংশ বলেই সম্ভবত ভাবে। ‘বিতর্কিত’ বিশেষণটি আমার ক্ষেত্রে নেতিবাচক অর্থেই ব্যবহার করা হয়। দুই বাংলা আমাকে শুধু তাড়িয়ে শান্ত হয়নি, সব রকম চেষ্টা করেছে, যেন আমি হয়ে উঠি একটা নিষিদ্ধ নাম, একটা নিষিদ্ধ লেখক।
এত কাল কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করেনি, আমি কোথায় আছি, বা আমি বেঁচে আছি কি না। আজ হঠাৎ আমি ভারত ছাড়লাম কেন জানতে চাইছে। ভারতের মৌলবাদী-তোষক রাজনীতি, মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতা, গরিবের অসহায়তা, সামাজিক অব্যবস্থা, ধর্ম, জাতপাত, পুরুষতন্ত্র, কুসংস্কার ইত্যাদি নিয়ে নিজের মত প্রকাশ করলে কট্টর জাতীয়তাবাদী, ধর্মান্ধ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন পুরুষতান্ত্রিক নারীবিরোধীরা আমাকে নোংরা নোংরা গালি দিয়েছে, আমাকে ভারত ছাড়তে বলেছে, বলেছে বাংলাদেশে ফেরত যেতে। পৃথিবীর সব দেশকে আপন ভাবলে, দেশ আর দেশের মানুষের ভাল চাইলে, অনেক কষ্ট পেতে হয়। রিফিউজি, বেগার, ইউ বাংলাদেশি, আমাদের দেশের কোনও ব্যাপারে নাক গলাবি না— এ সব ধমক অনেক শুনেছি। অনেকের ধারণা, আমার নিশ্চয়ই কোনও বদ-মতলব আছে, তা না হলে অন্য দেশের মেয়েরা ধর্ষিতা হলে আমি এত রাগ করি কেন, কন্যাশিশুদের পুঁতে ফেলা হলে আমি এত রুখে উঠি কেন, নারীনির্যাতন বাড়লে আমি উদ্বিগ্ন কেন, এ দেশ তো আর আমার দেশ নয়! আমি আপন ভাবলেও আমাকে আপন ভাবার লোক আমি খুব কমই পেয়েছি। আমার কথা পছন্দ না হলে আমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে, আমাকে লাত্থি মেরে ভারত থেকে তাড়াবে— প্রায়ই শুনি এমন হুমকি। এক দিকে মুসলিম মৌলবাদীদের আক্রমণ। আর এক দিকে নারীবিদ্বেষী, কট্টর ডানপন্থী, কুসংস্কারের ডিপো, উগ্র হিন্দুত্ববাদীর আক্রমণ। যাদের থাকার কথা আমার পাশে, যে বামপন্থী সেকিউলার দলের— তারা আমার বই নিষিদ্ধ করে, আমাকে রাজ্য থেকে তাড়ায়, আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটায়। তারা মিথ্যে দোষ দেয়, তাদের সরল সমীকরণ: আমি যেহেতু ইসলামি মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করি, আমি তবে নিশ্চয়ই হিন্দুত্ববাদীদের বন্ধু, নিশ্চয়ই খ্রিস্টান অথবা ইহুদি মৌলবাদীদের বন্ধু। ভারতের উদারপন্থী সেকিউলারদের মধ্যে একটা বড় অংশই ভণ্ড। শুধু ভারতবর্ষে বধূহত্যা হলেই নয়, সোমালিয়ার মেয়েদের যৌনাঙ্গ ছেদন হলেও, ইতালির মেয়েদের গর্ভপাতে বাধা দেওয়া হলেও, সৌদি আরবে মেয়েদের বোরখা পরতে বাধ্য করা হলেও আমি প্রতিবাদ করি। বাংলাদেশে হিন্দুরা অত্যাচারিত হলেই নয়, গুজরাতে বা প্যালেস্টাইনে মুসলমানরা, পাকিস্তানে খ্রিস্টানরা অত্যাচারিত হলেও প্রতিবাদ করি। এ কথা সেকিউলার লোকদের অজানা নয়। তাদের অজানা নয় যে, যুগ যুগ ধরে এক দেশ থেকে আর এক দেশে ভাসমান জীবন কাটিয়েও, জীবনের ঝুঁকি নিয়েও, ফতোয়া সয়ে, নির্যাতন সয়ে, গৃহবন্দিত্ব সয়ে, ঘাড়ধাক্কা, অন্যায়, অপমান, অপবাদ, নিষেধাজ্ঞা, ঘৃণা সয়েও, আমি মানবাধিকারের জন্য, নারীর সমানাধিকারের জন্য, বাক্স্বাধীনতার জন্য, সহিষ্ণুতার জন্য, সমতার জন্য লড়াই করছি। তার পরও আমাকে ব্রাত্য করতে এরা দ্বিধা করেনি।
এদের বাইরেও মানুষ আছে, যারা আমাকে ভালবাসে। ভারতবর্ষের কত কত শহরে কত কত মানুষ দৌড়ে আসে সই নিতে, ছবি তুলতে, জড়িয়ে ধরতে, একটু হাত স্পর্শ করতে, একটু কাঁদতে, একটুখানি পায়ের ধুলো নিতে। ওই ভালবাসার কাছে আমি এক দিন ফিরে যাবই। আমার সবজিওয়ালা জয়ন্ত আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকে, আমার মাছওয়ালা বনমালী আমার জন্য অপেক্ষা করে। অপেক্ষা করে শাড়ির দোকানের মজুমদার। অপেক্ষা করে আছে অসংখ্য চেনা অচেনা শুভাকাঙ্ক্ষী। ওই ভালবাসাই আমার সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy