উদ্বাস্তু: সিরিয়ান শরণার্থী পরিবার। মারিয়াম অবশ্য প্রবাসে একা
পথের ধারে মৃতদেহের স্তূপ। সকাল থেকে বেশ কয়েকটা মৃতদেহবাহী গাড়ি ঘোরাঘুরি করছে ঠিকই, কিন্তু উদ্ধারকাজ দ্রুত সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, গাড়ির তুলনায় মৃতদেহের সংখ্যা অনেক বেশি। ধিকিধিকি আগুন জ্বলছে। চারদিকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেহাবশেষ। আলেপ্পো শহরে হররোজ এমন ছবি দেখা যায়। যুদ্ধ চলে এখানে বারো মাস। প্রাণ হারায় অসহায় সাধারণ মানুষ। যারা বেঁচে থাকে, তারাও রোজ যুদ্ধ করে। বেঁচে থাকার যুদ্ধ। দু’বেলা দু’মুঠো খাবার জোগানোর জন্য নিত্য সংঘর্ষ।
মারিয়াম দেখেছে, আধ-জ্বলন্ত মৃতদেহগুলো গাড়িতে জড়ো করছে লোকেরা। স্তব্ধ মারিয়ামের মনে হয়েছে, তার জীবনও ফুরিয়ে যাবে এ বার। তবু সে হার মানেনি। আলেপ্পো থেকে জাহাজে আফ্রিকা, সমুদ্র পেরিয়ে গ্রিস। ইউরোপের মূল ভূখণ্ড। তারও পরে নেদারল্যান্ডস পৌঁছে ডাচ সরকারের কাছে ‘অ্যাসাইলাম’ প্রার্থনা। সিরিয়ায় তার জীবন সংশয়। সে বাঁচতে চায়।
প্রতি বছর শয়ে শয়ে শরণার্থী আশ্রয় নেন ইউরোপে। এক নেদারল্যান্ডসেই গত বছর ‘শরণার্থী’ স্টেটাস চেয়ে আবেদনপত্র পড়েছিল ২০,৩৫৩টি। তার মধ্যে সিরিয়া থেকে ২৯৫৬টা। ডাচ সরকার ১৭৬০টা আবেদনপত্র মঞ্জুর করেছে। এই ১৭৬০ জনের মধ্যে সিরিয়ান ৫৯০ জন। মারিয়াম তাঁদেরই এক জন। ইউরোপের কিছু দেশ— জার্মানি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস— শরণার্থীদের থাকার, ভাষা শেখার, রোজগারের ব্যবস্থা করে। যত দিন না স্বনির্ভর হতে পারছেন, সরকার টাকা দেয় কিছু। মাথার ওপর ছাদ, শীতে গরম জামা, মাসে এক বার বেড়ানোর ট্রেনের টিকিট, সুপারমার্কেটের কার্ডও।
একটা বেসরকারি সংস্থায় কাজ করতে গিয়ে আলাপ হয়েছিল মারিয়াম আলসারি-র সঙ্গে। গোলাপি গায়ের রং। চোখ দুটো গভীর। ঠোঁটদুটো ফুলের পাপড়ির মতো। সিরিয়ান নারীরা ট্র্যাডিশনাল বোরখা পরেন না। ওঁদের মাথার স্কার্ফটা বিশাল বড় একটা চাদরের মতো. শুধু মুখটুকু খোলা, বাকিটা ঢাকা। নীচে লম্বা ঘেরের স্কার্ট, পায়ের পাতা অবধি ঢাকা। হাত দু’খানাও দেখা যায় না, চাদরের তলায় ঢাকা থাকে। মারিয়ামের নিজের ভাষা আরবি। কিন্তু ক’দিনের মধ্যেই সে ডাচ রপ্ত করে নিয়েছিল।
আলেপ্পো থেকে বাণিজ্যিক জাহাজ ছাড়ে প্রতি দিন। মানুষ পাচারকারীদের একটা চক্র কাজ করে জাহাজঘাটে। অসহায় মানুষগুলোকে এরা আফ্রিকা অবধি পৌঁছে দেয়. তার পর নিজেরাই নৌকোয় করে গ্রিসে আসেন ওঁরা। মাঝসমুদ্রে নৌকাডুবিতে মারা যান বহু মানুষ। যাঁরা বেঁচে গ্রিস পৌঁছন, তাঁরা ধরা পড়লে প্রথমেই পাসপোর্ট চেক করা হয়। বেশির ভাগই ধরা পড়েন, তার পর অ্যাসাইলাম ভিক্ষা চান। গ্রিস থেকে যিনি যে দেশে ঢোকার সুযোগ পান, তিনি সেই দেশের শরণার্থী স্টেটাস চান। কাগজপত্র না থাকলে, পুলিশের হাতে পড়লে পুলিশি হেফাজত। আর কাগজ, পাসপোর্ট থাকলে ঠাঁই হয় কেয়ার হোমে।
বছর তিরিশের মারিয়াম সারা ক্ষণ হাসে, অনর্গল কথা বলে। ওর সব কথা জানার পর মনে হয়েছিল, কী করে পারল ও? যে দিন চোখের সামনে ওর তিন ছেলেমেয়ে ভয়াবহ বিস্ফোরণে আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছিল, সে দিনই নিজের জীবনটাও হয়তো শেষ করে দেওয়ার কথা ওর! জীবন থেকে সরে দাঁড়াতে পারত সে দিনও, যে দিন জাহাজঘাটে ২০০০ সিরিয়ান পাউন্ড দিতে না পারায় নিজেকে বিকিয়ে দিতে হয়েছিল। ক্ষতবিক্ষত মনটার সামনে সে দিন হয়তো নিজের শরীরটারও কোনও মূল্য আছে বলে মনে হয়নি!
মারিয়াম এখন এক বেসরকারি সংস্থার কর্মী। সিরিয়ান শরণার্থী শিশুদের নিয়ে কাজ করে এই সংস্থা। দিনের বেলায় সে কলেজে ডাচ ইন্টিগ্রেশন কোর্স করে, আর বিকেলে কেয়ার হোমে ধোয়ামোছার কাজ। নেদারল্যান্ডসে আসার পর কিছু দিন পুলিশের নজরে ছিল সে। পরে ডাচ সরকার তার আর্জি মঞ্জুর করায় এখন সে মুক্ত। এই হোমে থেকে, ডাচ কোর্স শেষ করে, পরীক্ষা দিয়ে তাকে প্রমাণ করতে হবে—শিক্ষা, সহবত, সামাজিক রীতিনীতিতে সে এ দেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার উপযুক্ত।
তবু ফিরে যাওয়ার ভয় তাকে তাড়া করে ফেরে সব সময়। এখনও তাড়া করে আইএস-এর কাছে ধরা পড়ার ভয়। ২০১৫ সালে মারিয়ামদের ইয়াজিদি গোষ্ঠীভুক্ত সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি মানুষকে বন্দি করেছিল আইএস। তার মধ্যে ছিল মারিয়ামের স্বামী ও বাবাও। জীবন বাঁচাতে কোনও রকমে সে দিন তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে, বসতি ছেড়ে, অন্য শহরে চলে গিয়েছিল সে। মারিয়াম আজও এই ভিনদেশি শহরের অলিগলিতে তার হারিয়ে যাওয়া স্বামীকে খোঁজে। যদি সে কোনও ভাবে সমুদ্র পেরিয়ে এ দেশে এসে থাকে?
তিরিশ বছর বয়সে অক্ষরপরিচয় হয়েছে তার। মারিয়াম এখন নাম সই করতে পারে, লিখতে পারে। মাঝে মাঝেই খাতার পাতা জুড়ে নিজের নাম লেখে। হয়তো বেঁচে থাকার আনন্দে, নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করার খুশিতে। সম্পর্কের সুতোগুলো যখন এক এক করে আলগা হয়ে গেছে ওর জীবন থেকে, তখন নিজেকে আগলে রাখতে শিখেছে সে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy