Advertisement
২১ ডিসেম্বর ২০২৪
Rabindranath Tagore

রঙ্গমঞ্চে রবীন্দ্রনাথ

প্রথম অভিনয় ‘বাল্মীকি প্রতিভা’-য়। দর্শকাসনে মুগ্ধ সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র। কখনও দর্শকের অনুরোধে এক গান দু’বারও গাইতে হয়েছে কবিকে। সাড়া ফেলে দিয়েছিল ‘বিসর্জন’ নাটকে তাঁর রঘুপতি। অভিনয়ের ঝোঁকে এক বার ঠেলে দেওয়ার বদলে দু’হাতে তুলেই নিয়েছিলেন মা কালীর মূর্তি। বাষট্টি বছর বয়সে হয়েছিলেন ‘জয়সিংহ’। তখন ‘অপর্ণা’র ভূমিকায় রাণু।

Rabindranath Tagore

অভিনয়সজ্জা: ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ নাটকে বাল্মীকির ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ

অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০২৩ ০৭:০৩
Share: Save:

তাঁর গল্প কবিতা নাটক নভেল যা-ই হোক, তার অনুকূল সমালোচনা হলে তিনি খুশি হতেন, কিন্তু প্রতিকূল বা বিরূপ আলোচনা হলে তিনি কিছুতেই খুশি হতে পারতেন না; অভিমান করতেন, রাগ করতেন, কখনও কখনও বা যথেষ্ট ক্রুদ্ধ হয়ে উঠতেন। এমনকি রঙ্গমঞ্চে যদি তাঁর কোনও সহ-অভিনেতা বা অভিনেত্রীর অভিনয় কবির অভিনয়ের চেয়ে কিঞ্চিৎমাত্র বেশি প্রশংসিত হয়, তাতেও যে তিনি খুব বেশি খুশি হতে পারতেন, তা কিন্তু নয়।

শান্তিনিকেতন আশ্রমের একেবারে প্রথম আমলের আবাসিক প্রমথনাথ বিশী। লেখালিখি করা সেই প্রতিভাবান তরুণ ছাত্রটিকে কবি স্নেহ করতেন, পছন্দ করতেন। এমনকি ১৩৩০ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণে (ইং ১৯২৩) ‘প্রবাসী’-তে প্রকাশিত ‘রথযাত্রা’ নাটকের শিরোনামের নীচেই কবি লিখেছিলেন, “আমার স্নেহাস্পদ ছাত্র শ্রীমান প্রমথনাথ বিশীর কোনো রচনা হইতে এই নাট্যদৃশ্যের ভাবটি আমার মনে আসিয়াছিল।”

এই স্নেহাস্পদ ছাত্র কবির জীবৎকালেই ১৯৩৯ সালে ‘রবীন্দ্রকাব্যপ্রবাহ’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন, যার অন্তর্গত একটি অধ্যায়ের নাম ‘রবীন্দ্রকাব্যে দোষ’। সমালোচক বলেছিলেন গুরুতর দোষটি হল ‘অতিকথন’। কবি এই মন্তব্যে ভীষণ অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন, আঘাত পেয়েছিলেন। ‘রবীন্দ্রকাব্যপ্রবাহ’ প্রকাশের আগে সমালোচকের লেখা বড় উপন্যাস ‘জোড়াদীঘির চৌধুরী পরিবার’ কবিকে পাঠানো হয়েছিল। এই বইটি সম্পর্কে কবির কাছ থেকে কোনও মন্তব্যই প্রমথনাথ পাননি। কবির মৃত্যুর পর উত্তরায়ণের লাইব্রেরিতে কবির বহু মার্জিনাল মন্তব্য-সহ উপন্যাসটি পাওয়া যায়। তাতে কবি প্রায় পাতায় পাতায় লিখে গিয়েছিলেন— ‘এ কি অতিকথন নয়’, ‘এ কি পাগলামী’, ‘এ কি অদ্ভুত কাণ্ড’, ‘অতিকথন আর কাকে বলে’! পাতার পর পাতা তিনি লম্বা লম্বা দাগ টেনে কেটে দিয়েছিলেন। মুখে কিছু বলেননি; কিন্তু তাঁর সমস্ত নীরব ক্রোধ এবং ক্ষোভ ওই উপন্যাসের পাতাগুলির উপরে কালো কঠিন নির্মম আঁচড়গুলির মধ্যে প্রকাশ পেয়েছিল। এই ক্রোধের প্রকাশ ১৯৩৯ থেকে ১৯৪১-এর মধ্যে।

শেষ বয়সেই হোক কিংবা প্রথম বয়সে, প্রতিকূল সমালোচনা কোনও সময়ই তিনি সহ্য করতে পারতেন না।

তবে প্রশস্তি প্রশংসায় তিনি যে গর্বিত হতেন, খুশি হতেন, সাফল্যের তৃপ্তি লাভ করতেন, সে তাঁর জীবনের প্রথম অভিনয়ের সময় থেকেই লক্ষ করা গেছে। নিজের লেখা নাটক নিয়ে নিজের পরিচালনায় প্রযোজনায় মঞ্চে রবীন্দ্রনাথের অভিনীত প্রথম নাটক ‘বাল্মীকি প্রতিভা’। তারিখ ১৬ ফাল্গুন ১২৮৭ (ইং ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৮৮১) শনিবার; মহর্ষিভবনের বহির্বাটীর তেতলার ছাদে পাল খাটিয়ে বিশেষ স্টেজ বাঁধিয়ে। আহ্বায়ক ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। কার্ড করা হয়েছিল— “এই পত্র প্রবেশপত্র স্বরূপ দ্বার-দেশে গৃহীত হয়।” ‘বাল্মীকি প্রতিভা’-র অভিনয় দেখতে ঠাকুর পরিবারের আমন্ত্রণে বহু বিশিষ্ট বিখ্যাত ব্যক্তি দর্শক আসন গ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ‘বঙ্গদর্শন’-সম্পাদক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, স্যর গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রমুখ ছিলেন। প্রায় একশো লোকের সমাবেশ হয়েছিল। ‘বাল্মীকি প্রতিভা’-র রচয়িতা ও তাঁর অভিনেতার অভিনয় সাহিত্যসম্রাটকে মুগ্ধ করেছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের মুগ্ধতা ও খুশির ভাবটি রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘ তিনটি দশক কেটে যাওয়ার পরেও যে বিস্মৃত হতে পারেননি, তার প্রমাণ রয়ে গেছে ‘জীবনস্মৃতি’-র পাণ্ডুলিপিতে কবির লেখায়— “...বাল্মীকি প্রতিভার অভিনয় হইল। তাহাতে আমি বাল্মীকি সাজিয়াছিলাম। রঙ্গমঞ্চে আমার এই প্রথম অবতরণ।... দর্শকদের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন— অভিনয়মঞ্চ হইতে আমি তাঁহাকে স্বচক্ষে দেখিতে পাইলাম না কিন্তু শুনিতে পাইলাম তিনি খুশি হইয়া গিয়াছিলেন।”

বঙ্কিমচন্দ্র যে সত্যিই খুশি হয়েছিলেন, তারও প্রমাণ আছে। ১২৮৭-র ফাল্গুনে বঙ্কিম ‘বাল্মীকি প্রতিভা’-র দর্শক, সাত মাস পর, ১২৮৮ বঙ্গাব্দের আশ্বিনে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘বাল্মীকির জয়’ বইটি ‘বঙ্গদর্শন’-এ সমালোচনা করতে গিয়ে লেখেন, “যাঁহারা বাবু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাল্মীকি প্রতিভা পড়িয়াছেন বা তাঁহার অভিনয় দেখিয়াছেন, তাঁহারা কবিতার জন্মবৃত্তান্ত কখনো ভুলিতে পারিবেন না।” মঞ্চে প্রথম আবির্ভাবেই সাফল্যের এমন উচ্ছ্বসিত প্রশংসা, তাও আবার সাহিত্যসম্রাটের কলম থেকে, কে-ই বা ভুলতে পারে?

প্রথম অভিনয়ের পরবর্তী তিন দশকে বেশ কয়েক বার কলকাতায় শান্তিনিকেতনে ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ অভিনীত হয়। তারই মধ্যে রবীন্দ্রনাথ দু’-এক বার মঞ্চে নামেন।

ইংরেজ আমল তো, তৎকালীন লাটসাহেব লাটপত্নী এঁরাও রবীন্দ্রনাথের অভিনয়ের দর্শক ছিলেন। ১৮৯০-এর ডিসেম্বর ১৭, ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ— “আ ফ্যাশনেবল থিয়েট্রিকাল এন্টারটেনমেন্ট/ উই হিয়ার দ্যাট লেডি ল্যান্সডাউন অ্যান্ড স্যর চার্লস অ্যান্ড লেডি ইলিয়ট উইল বি প্রেজ়েন্ট অ্যাট আ থিয়েট্রিকাল পারফরম্যান্স টু বি গিভন অন ওয়েডনেসডে দ্য টোয়েন্টিফোর্থ [ডিসেম্বর এইটিন নাইন্টি] ইনস্ট্যান্ট, বাই দ্য মেম্বারস অব দ্য জোড়াসাঁকো টেগোরস ফ্যামিলি অ্যাট আ রেসিডেন্স অব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ টেগোর। আ লার্জ মেম্বার অব দ্য লিডার্স ইন ক্যালকাটা সোশ্যাল সার্কলস হ্যাভ বিন ইনভাইটেড টু দ্য এন্টারটেনমেন্ট।”

বুঝুক না বুঝুক, সাহেবসুবোরা, বিশেষত মেমসাহেবরা এমন জাঁকজমকপূর্ণ নাটক দেখে, অভিনয় দেখে, দস্যু দলের উচ্চকিত গান শুনে, নাচ দেখে বেজায় খুশি হয়ে ঘরে ফেরে।

‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-প্রণেতা বিখ্যাত আভিধানিক হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম কারও অজানা নয়। রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা-সহ ১৯৩২-এ সেই বইয়ের প্রকাশ সূচনা। খণ্ডে খণ্ডে বেরিয়েছিল। প্রথম সংস্করণের মোট পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ৩২৭৬।

এই হরিচরণ তাঁর তেইশ বছর বয়সে, ‘বাল্মীকি প্রতিভা’-য় রবীন্দ্রনাথকে দেখেন। তারিখটি ছিল ২৫ ডিসেম্বর। পর পর দু’দিন অভিনয় হয়েছিল। ২৪ তারিখ সাহেবসুবোদের জন্য, ২৫-এ সাধারণের জন্য। বড় দাদাকে নিয়ে হরিচরণ নাটক দেখতে এসেছেন। বনদেবীদের নৃত্য, মঞ্চে দস্যুদলের লম্পঝম্প, কিন্তু বাল্মীকির প্রবেশ তখনও ঘটেনি। হরিচরণ লিখছেন, “অত্যন্ত ঔৎসুক্য— তখন দেখলাম, দস্যুপতি বাল্মীকির বেশে কবির প্রবেশ— লম্বা জোব্বা পরা, গলায় শঙ্খ ঝুলছে— ডাকাত ডাকবার। একে কবির সহজ-মনোমোহন রূপ, তাতে যৌবনের [বয়স তখন ২৯] ললিত লাবণ্যচ্ছটা, অনুকূল পোষাক-পরিচ্ছদের সৌষ্ঠবসম্পন্ন— তাতে আবার রঙ্গমঞ্চের পরিস্ফুট আলোকপ্রভা প্রতিভাত— সে সৌন্দর্য আরও মনোমোহকর হয়েছে। দর্শকেরা কবির সেই বাল্মীকিবেশ দেখে চিত্রার্পিতের মতো নিস্পন্দ নির্বাক নির্ণিমেষ নেত্র। তখন কবির কলকণ্ঠে সঙ্গীত শোনা গেল— কবি গাইলেন: এক ডোরে বাঁধা আছি, মোরা সকলে।... গান গাওয়া শেষ হল— বাল্মীকি নেপথ্যের অভিমুখ হলেই, দর্শকদের মধ্যে কোলাহল উঠল— এনকোর, এনকোর। সকলেই কবির একফেরতা গান শুনে তৃপ্তি লাভ করতে পারেননি, আবার শোনবার জন্য সমুৎসুক! কবি কি করবেন— আবার ফিরলেন— গানের পূর্ববৎ আমূল পুনরাবৃত্তি হল— কবি নেপথ্যে অন্তর্হিত হলেন।”

অভিনয়মঞ্চে রবীন্দ্রনাথের সেরা পর্ব ‘বিসর্জন’-পর্ব। ১৮৯০-এ বাড়ির ছেলেদের অভিনয়ের তাগিদে ‘বিসর্জন’ নাটকটি রচিত। এবং ১৮৯০-এই কলকাতায় পার্ক স্ট্রিটে, জোড়াসাঁকোয় এক বার করে ‘বিসর্জন’ অভিনীত হয়। মহর্ষির ৫২ পার্ক স্ট্রিটে, আর দু’ঘর আগে ৫০ পার্ক স্ট্রিটে রঘুপতির ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ অভিনয় করেন। দর্শক ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য। তা ছাড়া দর্শকদের মধ্যে ছিলেন গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, রমেশচন্দ্র দত্ত, ‘সঞ্জীবনী’ সাপ্তাহিকের সম্পাদক কৃষ্ণকুমার মিত্র প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। রবীন্দ্রনাথের অভিনয় দেখে কৃষ্ণকুমার এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, পরে গোটা একটা আর্টিকলই লিখে ফেলেন।

সে কালে তো সব বড় বড় মানুষ রবীন্দ্রনাথের নাটক দেখতেন, অভিনয় দেখতেন। তাঁদেরই এক জন অভিনীত চরিত্রের প্রতি অভিনেতা রবীন্দ্রনাথের আত্মহারা তন্ময়তার উদাহরণ দিতে গিয়ে ১৯০০ সালের ১৬ ডিসেম্বর কলকাতায় অভিনীত রঘুপতি-রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে বলেন: “তিনি বিসর্জনের রঘুপতির অভিনয় কালে এমনই তন্ময় হইয়া পড়িয়াছিলেন যে খাঁড়া ব্যবহার কালে তাহা যে সত্যসত্যই তীক্ষ্ণধার তাহা ভুলিয়া গিয়াছিলেন; অভিনেতাদিগের মধ্যে আর একজন তাঁহার অবস্থা উপলব্ধি করিয়া ধ্রুবকে [চরিত্রাভিনেতাকে] তাড়াতাড়ি সরাইয়া না লইলে হয়ত একটা দারুণ দুর্ঘটনা ঘটিত।” দর্শক ছিলেন সে সময়কার বিখ্যাত সাংবাদিক সম্পাদক সাহিত্যসেবক হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ (১৮৭৬-১৯৬২)।

এ বার সেই ১৯০০ সালের অভিনয় প্রসঙ্গে অভিনেতা রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে অবনীন্দ্রনাথ কী বলছেন শুনুন: “জয়সিংহ তো বুকে ছোরা মেরে মরে গেল। স্টেজের এক পাশে ছিল কালীমূর্তি বেশ বড়ো, মাটি দিয়ে গড়া। কথা ছিল রঘুপতি দূর দূর বলে কালীর মূর্তিকে ধাক্কা দিতেই, কালীর গায়ে দড়াদড়ি বাঁধা ছিল, আমরা নেপথ্য থেকে টেনে মূর্তি সরিয়ে নেব। কিন্তু রবিকাকা করলেন কী, উত্তেজনার মুখে দূর দুর বলে কালীর মূর্তিকে নিলেন একেবারে দু’হাতে তুলে।...”

আর এর ফল কী হল?

যা হওয়ার তাই হল। ১৮৮৭-তে এক বার অসহ্য কোমরের ব্যথায় ভুগেছিলেন; তখন বলেছিলেন কোমরটা যে “কেবলমাত্র কাছা এবং কোঁচা গুঁজে রাখবার জায়গা তা আর কক্খনো মনে করব না— মনুষ্যের মনুষ্যত্ব এই কোমর আশ্রয় করে।” কিন্তু তিনটি বছর যেতে না যেতেই নিজের ও সব বড় বড় কথা অভিনয়মঞ্চে ভুলে বসলেন। তার ফল এক মাস ইজ়িচেয়ারে শুয়ে ‘প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মন/ তবু কোমর কেন টন্ টন্ করে রে’ গাইতে হল।

ওই ’৯০-এর তেত্রিশ বছর পর আবার মঞ্চে ‘বিসর্জন’ করার ভাবনা এল।

এ বার আসরে তাঁর ‘গার্ল ফ্রেণ্ড’— ঈশ্বরের ‘দূত’ হয়ে আসা সপ্তদশী বান্ধবী রাণু। রবীন্দ্রনাথ তো সেই চিরকালের রঘুপতি। অপর্ণা এ বার সৌন্দর্যপ্রতিমা ওই তরুণী রূপবতী প্রেমময়ী রাণু। কলকাতায় দিনের পর দিন মহড়া চলল। সে এক আয়োজন! শনি-রবিবার বিশিষ্ট লোকজন মহড়া দেখতে আসছেন। কবি কিছুটা বা শাসনের ভঙ্গিতে অভিনয় শেখাচ্ছেন, উচ্চারণ ঠিক করাচ্ছেন, হাত কোথায় কেমন ভাবে রাখতে হবে নির্দেশ দিচ্ছেন। রাণু আগে অভিনয় করেনি, তার উপর কবির নজর বেশি। দেখা গেল, তরুণ সহ-অভিনেতা ও মহড়া দেখতে আসা কারও কারও নজরও তাই! রাণুকে কবি অপর্ণা করে তুলতে চাইছেন। তাকে অভিনয়ে ভাল করে তালিম দেবেন বলে সাত দিনের জন্য তাকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে চলে এলেন। এখানেই নিশ্চয়ই কোনও সিদ্ধান্ত হল; কবি কলকাতায় ফিরে সকলকে জানালেন, তিনি আর সেই পুরনো রঘুপতি নন, তাঁর এ বারের নতুন ভূমিকা জয়সিংহ। রঘুপতি হবে দিনু। সকলেই আকস্মিক সিদ্ধান্ত বদলে অবাক বিস্মিত! জয়সিংহ! এই বাষট্টি বছর বয়সে। অনেকেই মনে মনে ভাবলেন, কবির নতুন বান্ধবীর প্রবল ইচ্ছার কারণেই সম্ভবত এই ভূমিকা পরিবর্তন। রাণুর কাছে তো কবি ‘সাতাশ’। কবি বলেন ‘সাতাশের চেয়েও কম’। তা হলে সেই মানুষটার জয়সিংহ হতে বাধা কোথায়? বয়স তো একটা সংখ্যামাত্র।

এম্পায়ার থিয়েটারে অভিনয় হল কয়েক দিন। অগস্টের শেষ সপ্তাহে। লোকে ইতিমধ্যেই সাংবাদিকদের সূত্রে জেনে গেছে রবীন্দ্রনাথ এ বার জয়সিংহ, তাঁর রাণু অপর্ণা। বাইরে টিকিটের হাহাকার; সমস্ত এম্পায়ার মানুষে মানুষের গমগম করছে। দর্শক-আসনে বসে সীতা দেবী জয়সিংহের সাজে তরুণ রবীন্দ্রনাথকে দেখলেন। “যে কেহ তাঁহাকে দেখিয়া যুবক বলিয়া ভ্রম করিতে পারিত, এমন সতেজ চলাফেরা, দৃপ্ত কণ্ঠস্বর।”

পরিমল গোস্বামী অভিনয় দেখতে দেখতে ‘যৌবনের রবীন্দ্রনাথকে কল্পনা’ করছিলেন।

এ বার আসি এক জন বিখ্যাত পেশাদার অভিনেতার অভিমতে। আমন্ত্রিত অহীন্দ্র চৌধুরী এম্পায়ারের সিটে বসে নাটক দেখলেন। তাঁর মন্তব্য: “সেদিন সে অভিনয় মঞ্চে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে অধিকতর প্রাণবন্ত ব্যক্তিত্ব আর ছিল না। তাঁর প্রশস্ত ললাট, সমুজ্জ্বল চোখ, উন্নত নাসা এবং সুমিষ্ট বাচনভঙ্গি, তাঁর সুমিষ্ট কণ্ঠ সমস্তই ছিল বড় অভিনেতার উপযোগী। যখন তিনি অভিনয় করতেন তাঁর সমুজ্জ্বল আঁখি ও ঔজ্জ্বল্যে চমক দিতে থাকত, যেন বিদ্যুতের ঝলক লাগছে। এ সকলই ঈশ্বরপ্রদত্ত গুণ। এই সুদক্ষ অভিনেতার দিক থেকে জোরপূর্বক নাটকীয় প্রভাব বিস্তারের কোনো চেষ্টাই ছিল না। আমি ভেবে পাই না, তার অভিনয় কী যাদুমন্ত্রের প্রভাবে অমন প্রাণবন্ত হত।... তাঁর অভিনয় সমগ্রভাবে শিল্পীর মিতব্যয়িতার এক আদর্শ কেতাব বলেই মনে হয়। খুব ভালো অভিনয়ের জন্য যে গভীর মনোযোগের প্রয়োজন তা তাঁর মধ্যে পূর্ণমাত্রায় ছিল।”

অভিনয়পর্ব শেষে এ বার কাগজে কাগজে শুধু প্রশংসাপর্বের পালা।

‘প্রবর্তক’ পত্রিকার সব প্রশংসা সমালোচনার কাটিংগুলো রবীন্দ্রনাথ রাণুকে পাঠিয়ে দিলেন বেনারসে। পুলকিত পত্রে তিনি লিখলেন, “পড়ে আমার মনে হল ‘শুধু তুই আর আমি’ প্রশংসায় আর কেহ নাই। এমনকি দিনুর রঘুপতিকে পর্যন্ত উড়িয়ে দিয়েছে। তোমার সিংহাসনের পাশে যে আমাকেও স্থান দিয়েছে সে কম কথা নয়।” সেই পত্রকর্তিকা থেকে দু’-চারটি ছত্র—

‘সঞ্চারিণী দীপশিখার’ মতো অপর্ণার অভিনয় প্রসঙ্গে: “তাহার কণ্ঠস্বর ও বাচনভঙ্গী স্বতঃউৎসারিত করুণার প্রস্রবণ, তাহার পদক্ষেপ নির্ভীক, তাহার অভিনয় সহজ, স্বৈর-বিহারিণী ভিখারিণীরই মতো সহজ সরল সতেজ। আর রবীন্দ্রনাথ, সুদীর্ঘ ভাব-বিপর্যয়ের মধ্যে, বিরুদ্ধ স্রোতের মধ্যে পতিত তৃণখণ্ডের মতো বিক্ষুব্ধ বিড়ম্বিত, বিপর্যস্ত জয় সিংহের চরিত্র অভিনয়ে যে নিপুণতা, সূক্ষ্ম নাট্যকলার অভিব্যক্তির পরিচয় দিলেন, তাহা ভাষায় বর্ণনা করা দুঃসাধ্য। বিশেষতঃ ষষ্ঠিপর বৃদ্ধ বিংশতি বর্ষের যুবার ভূমিকা গ্রহণ করিয়া যে সজীবতা ও স্বাচ্ছন্দ্য দেখাইলেন তাহা অসাধারণ।”

Rabindranath Tagore

নাট্যমুহূর্ত: ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ নাটকের একটি দৃশ্যে ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীর (বাঁ দিকে) সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ (ডান দিকে)

এম্পায়ার থিয়েটারে ২৫, ২৭, ২৮ অগস্ট, এই তিন দিনের শেষ দিনের অভিনয় শেষ হওয়ার পরের দিন ২৯ অগস্ট আনন্দবাজার পত্রিকা লেখে: “স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ জয়সিংহের ভূমিকা গ্রহণ করিয়াছিলেন। তাঁহার অভিনয় চাতুর্যের বর্ণনা করা আমাদের সাধ্যও নয়।... এরূপ উচ্চাঙ্গের অভিনয় কলা দর্শনের সৌভাগ্য সকল সময়ে হয় না।... অপর্ণা ও রানীর অভিনয়ও ভাল হইয়াছিল।... আমরা বিসর্জন অভিনয় দর্শনে বাস্তবিকই খুবপ্রীত হইয়াছি।”

কত পত্রপত্রিকা সমালোচনা করেছে! কয়েকটি নাম উল্লেখ করছি। ‘শিশির’ পত্রিকা, ইন্ডিয়ান ডেলি নিউজ়, বিশ্বভারতী কোয়ার্টারলি, দি ইংলিশম্যান এবং ছোট-মাঝারি আরও অনেক।

মঞ্চের এই নাটক সে সময় একটা আলোড়ন ফেলে দেয়। অধিকাংশ লোকের মত এই যে, এমন কাণ্ড তারা আর কখনও দেখেনি। যেমন এক দিকে রবীন্দ্রনাথ প্রশংসিত হয়েছেন, তেমনই আর এক দিকে রাণু।

সে কালের প্রবীণ প্রখ্যাত নাট্যকার, মঞ্চাভিনেতা রসরাজ অমৃতলাল বসুর বয়স তখন সত্তর। সত্তরেই এই ‘বিসর্জন’ দেখতে ছুটেছিলেন এম্পায়ারে। যে মানুষ ১৮৭২ সালে জোড়াসাঁকোর মধুসূদনের সান্যালের বাড়ির প্রাঙ্গণে ‘নীলদর্পণ’ নাটকের অভিনয় করেছিলেন, যিনি উনিশ শতকের সব ক’টা পেশাদারি মঞ্চে অভিনয় করেছিলেন, যিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সহ-সভাপতি এবং এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য ছিলেন— সেই তিনি তাঁর ওই বয়সেই রবীন্দ্রনাথের নাটক ও তাঁর অভিনয় দেখতে প্রেক্ষালয়ে গিয়েছিলেন। ‘ইন্ডিয়ান ডেলি নিউজ়’-এ ‘বিসর্জন’ নিয়ে একটি দীর্ঘ পত্র লেখেন। সামগ্রিক ভাবে এই লেখায় ‘বিসর্জন’ অভিনয় উচ্চ প্রশংসা লাভ করেছিল, কেবল এক জায়গায় ছোট করে লেখেন— “অ্যাজ় ইন পোয়েট্রি ওয়ান মাস্ট ড্রিঙ্ক অ্যাট দ্য ফাউন্টেন অব রবীন্দ্রনাথ’স মাইন্ড অ্যান্ড নট সিম্পলি বরো হিজ় ওয়ার্ডস, সো অন দ্য স্টেজ, ওয়ান শুড ইমবাইব দ্য স্পিরিট অব হিজ় অ্যাক্টিং অ্যান্ড নট ইমিটেট হিম ইন অ্যাকশন, অ্যাটিটিউড, জেশ্চার অর পোজ়। দে আর অল হিজ় ওন, অ্যান্ড দ্য কপি-রাইট ইজ় নট টু বি ইনফ্রিঞ্জড।”

সত্তরের এইটুকু মন্তব্যে বাষট্টির রবীন্দ্রনাথ রেগে আগুন। অমৃতলালের এই লেখা পড়ে ক্ষুব্ধ রবীন্দ্রনাথ রাণুকে চিঠি লেখেন— “প্রবীণ ও বিখ্যাত অভিনেতা অমৃত বোস তোমার অভিনয়ের জয়গান করে ইংরেজি দৈনিক ডেলি নিউজ়ে একটা পত্র লিখেচে...” ক্রোধ এতটাই যে ‘অমৃত বোস’ এবং ‘পত্র লিখেচে’— ‘লিখেচেন’ ও নয়! যাই হোক, তার পর কবি লিখলেন, “পড়ে দেখো... প্রশংসার ছলে আমার কি রকম নিন্দা করেচে, তাও দেখো। বলেচে আমার অভিনয় কেউ যেন নকল করবার চেষ্টা না করে। অর্থাৎ ওটা খারাপ। অথচ মজা এই, যে-কয়জনে অভিনয় করেচে সকলে আমারই অভিনয়ই নকল করেচে— আমিই তো তাদের দেখিয়ে দিয়েচি— দিনুর রঘুপতি আমারই রঘুপতি অভিনয়ের নকল।”

সামান্যতম বিরূপ মন্তব্যেই কবি ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন। রাণুর প্রতি সমালোচকের কোনও বিশেষ আনুকূল্যও কবি সহ্য করতে পারেন না; রাগ গিয়ে পড়ে বেচারা রাণুর ওপর— “ইংলিশম্যানে তোমার যে স্তবগান তোমার কোনো ভক্ত করেচেন, তুমি ভাবচ সে আমি যথাসময়ে পড়ি নি! পড়েচি, এবং তোমাকে পাঠাবো কিনা সে কথাও মনে মনে আলোচনা করেচি। কিন্তু যেহেতু নিশ্চয়ই জানতুম সেই লেখাটিও তোমার নয়নগোচর করবার জন্য আগ্রহবান যুবকের অভাব হবে না সেই জন্য, তোমার উপর এই পত্রাংশবৃষ্টি আর করলুম না।” এই চিঠিতে ক্ষুব্ধ রবীন্দ্রনাথের মনে যে প্রচ্ছন্ন অভিমানের সুরটি জমেছিল, তা অস্পষ্ট থাকে না।

১৯২৩-এর ‘বিসর্জন’কে আপাতত বিসর্জন দিয়ে একটু পিছনে ফিরে যেতে চাই।

আমাদের এখন পৌঁছতে হবে কবির ‘ডাকঘর’-এ। ১৯১৭-র অক্টোবর থেকে ১৯১৮-র জানুয়ারি— এই চার মাসে জোড়াসাঁকোর ‘বিচিত্রা’য় বহু বার ডাকঘর অভিনীত হয়। কবি ঠাকুরদা, প্রহরী ও বাউলের ভূমিকায়অভিনয় করতেন।

১৯১৭ সালের ২৬ থেকে ২৯ ডিসেম্বর কলকাতায় কংগ্রেস অধিবেশনে চলে অ্যানি বেসান্তের সভাপতিত্বে। ঠাকুরবাড়ির ইচ্ছে কংগ্রেসের শীর্ষনেতাদের এই সুযোগে সম্মানপূর্বক আমন্ত্রণ জানিয়ে ‘ডাকঘর’ দেখানো হোক। কবি আমন্ত্রণ করলেন। বছরের শেষ দিনে অ্যানি বেসান্ত, লোকমান্য তিলক, মদনমোহন মালব্য ও মহাত্মা গান্ধী ‘বিচিত্রা’র দোতলায় এসে কবির অভিনীত ‘ডাকঘর’ দেখলেন। সহায়তার জন্য তিলক ও মালব্যের মাঝে বসানো হয়েছিল অমল হোমকে। ডাক্তার দ্বিজেন মৈত্র বসেছিলেন গান্ধী ও বেসান্তের মাঝে। অমল হোম তাঁর স্মৃতিচারণে এই চার অভিনয়-দর্শকের কথা লিখে গেছেন, “মালবীয়াজী, মনে পড়ে, শেষের দিকে ভাববিগলিত হইয়াছিলেন; তাঁহার চক্ষু সজল হইয়াছিল। টিলক নিবাত নিষ্কম্প প্রদীপের মতো— দৃষ্টি অভিনয়মঞ্চের উপর স্থির-নিবদ্ধ। মিসেস বেসান্ত অতীব আগ্রহে অভিনয় দেখিয়াছিলেন। শেষ দৃশ্যে সুধা যখন ফুল লইয়া আসিয়া বলিল— অমলকে বোলো সুধা তাকে ভোলেনি; তখন মিসেস বেসান্ত ডাক্তার মৈত্রকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘হোয়াট ডিড শি সে?’ দ্বিজেনবাবু উত্তর দিতে মিসেস বেসান্ত বলিলেন, ‘ইউ হ্যাভ এগজ়্যাক্টলি দ্য সেম আইডিয়া ইন ব্রাউনিং’স ইভলিন হোপ।’ গান্ধীজি মনোযোগ সহকারে অভিনয় দেখিয়াছিলেন— কোনো কথা বলেন নাই।” অনেক সময় মুগ্ধ বিস্ময়ে মানুষ স্তব্ধ গম্ভীর হয়ে যায়।

আরও পিছনে ফিরি। উনিশ শতকের শেষ পর্ব। গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বৈঠকখানায় ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’র অভিনয় হল। কেদার হলেন রবীন্দ্রনাথ, অন্য অভিনেতারা নাটোরের মহারাজা, গগনেন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ প্রমুখ। এই অভিনয় নাট্যসম্রাট গিরিশচন্দ্র ঘোষ দেখেছিলেন। নাটক দেখে মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন— “এরকম অ্যাকটার সব যদি আমার হাতে পেতুম তবে আগুন ছিটিয়ে দিতে পারতুম।”

এই সব বিখ্যাত নাট্যকার শুধু যে নিজেরা নাটক লিখে যেতেন তাই নয়, অন্যদের সৃষ্টির প্রতিও তাঁদের অনুক্ষণ আগ্রহ থাকত। বঙ্কিম ছিলেন তাঁর সমকালীন। বঙ্কিম তাঁর কালের সেরা ঔপন্যাসিক। গিরিশ ঘোষ নিয়মিত বঙ্কিম পড়ে যাচ্ছেন। ন্যাশনাল থিয়েটারে তিনি ‘বিষবৃক্ষ’ করলেন। তার পর ‘মৃণালিনী’। বঙ্কিম ন্যাশনাল থিয়েটার ‘মৃণালিনী’ দেখতে গিয়ে বিনোদিনীর অভিনয় মুগ্ধ হলেন। গিরিশ ঘোষ ‘দুর্গেশনন্দিনী’ও করেছিলেন ন্যাশনালে। জগৎসিংহের ভূমিকায় নিজে অভিনয় করেছিলেন। এই সব উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়েছিলেন গিরিশ ঘোষ নিজেই। এই গিরিশ ঘোষকে সে কালের নাট্যব্যক্তিত্ব অমরেন্দ্রনাথ দত্ত ‘চোখের বালি’র নাট্যরূপ দিতে অনুরোধ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে গিরিশচন্দ্রের কমপ্লেক্স অনেকেরই জানা ছিল। গিরিশ অমরেন্দ্রর অনুরোধের উত্তরে বলেন, “কি! ওই দুর্নীতিমূলক বইয়ের আমি নাট্যরূপ দেব? আমি যে থিয়েটারে আছি, সে থিয়েটারে কখনও অমন জঘন্য বই অভিনীত হতে দেব না।” অমরেন্দ্রনাথ পরে নিজে ওই নাটক প্রস্তুত করে ক্লাসিক থিয়েটারে অভিনয় করিয়েছিলেন।

ফিরে আসি ‘বিসর্জন’-এর পরবর্তী পর্বে। ‘বিসর্জন’-এর পর কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের বড় রকমের আবির্ভাব ‘তপতী’তে। ১৯২৯ সালে। ২৬, ২৮ ও ২৯ সেপ্টেম্বর ঠাকুরবাড়ির মঞ্চে ‘তপতী’র অভিনয়ে রবীন্দ্রনাথ রাজা বিক্রমদেব সেজেছিলেন। ‘নবশক্তি’ লেখে, “জয়সিংহের পর এত বড় ভূমিকায় তিনি বোধহয় আর অবতরণ করেননি।” কবির বয়স তখন আটষট্টি। পত্রিকা বলছে, কবির কণ্ঠস্বরে বিধাতাপুরুষের সম্পদ প্রাচুর্য রয়েছে। এক আশ্চর্য সাবলীল অভিনয়। সবার উপরে ফুটে উঠেছে কবির বিশ্বজয়ী ব্যক্তিত্ব।

কবির কণ্ঠস্বর এবং তাঁর সৌষ্ঠব, প্রচণ্ডতা, সপ্রাণতার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছে ‘নাচঘর’ তার প্রতিবেদনে। আনন্দবাজার পত্রিকার মন্তব্য, “তিনি অভিনয়ে যে নূতন আদর্শ দেখাইলেন, বাঙ্গলার নাট্যশিল্পে তাহা নবযুগের সূচনা করিবে।”

অভিনয়মঞ্চে রবীন্দ্রনাথ, সেই নাটক দেখে দর্শক প্রতিক্রিয়া কী রকম, সে বিষয়েই আলোচনা তো হল। সেই সঙ্গে আর একটা কৌতূহল জেগে ওঠে— মঞ্চে ‘রবীন্দ্রনাথ’, অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের নাটক আর দর্শক আসনে রবীন্দ্রনাথ— সেই রোমাঞ্চটা কী রকম! কবির পঞ্চাশ বছরের জন্মদিন উপলক্ষে ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট-এর সভ্যরা কবির সামনে তাঁর ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ অভিনয় করেন। কেদারের ভূমিকায় ছিলেন শিশির ভাদুড়ী। কবি বলেন, “কেদার আমার ঈর্ষার পাত্র। একদা ওই পার্টে আমার যশ ছিল।”

কলকাতায় শিশির ভাদুড়ী প্রযোজিত ‘বিসর্জন’ও কবি দর্শকাসনে বসে দেখেছিলেন। কবির সঙ্গে অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথও ছিলেন। রঘুপতিরূপী শিশিরকুমার তাঁর অভিনয়ে সকলকে মুগ্ধ করতে পেরেছিলেন। তাঁর প্রযোজনাও কবির প্রশংসা পেয়েছিল।

সেটা ১৯২৬ সাল। মঞ্চে ‘শোধবোধ’ নাটক করবেন অহীন্দ্র চৌধুরী। নাটকের শেষ দৃশ্যে সতীশের চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলতে অহীন্দ্রবাবুর অসুবিধে হচ্ছিল। এক বার কবিকে তিনি অভিনয়ের মতো করে পড়ে দেওয়ার অনুরোধ জানালেন। “যখন তিনি ঐ অংশটা পড়ছিলেন, তিনি এত বেশি ঐ চিন্তায় নিমগ্ন ছিলেন যে পারিপার্শ্বিক সম্বন্ধে অচেতন ছিলেন। যে বেদনা নায়কের মনকে বিদীর্ণ করছিল, সেই মুহূর্তে তাঁর মানসপটে তা ফুটে উঠেছিল। এমন গভীর মনোনিবেশ আমি কোথাও দেখি নি।” রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছাক্রমেই অহীন্দ্র চৌধুরী সতীশ হন।

‘শেষরক্ষা’র প্রথম অভিনয় ১৯২৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর। রবীন্দ্রনাথ ‘শেষরক্ষা’ও রঙ্গমঞ্চে এসে দেখে গিয়েছিলেন এবং খুবই খুশি হয়েছিলেন।

রঙ্গমঞ্চে রবীন্দ্রনাথের অভিনয় নিয়ে আমরা আপাতত আমাদের আলাপ-আলোচনার শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি।

যে দিন রবীন্দ্রনাথের শিশির ভাদুড়ীর নাট্য-নিকেতনে ‘শেষরক্ষা’ দেখতে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন, সে দিন কল্লোল গোষ্ঠীর লেখকরাও আমন্ত্রিত হয়ে প্রেক্ষাগৃহে এসেছিলেন। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের স্মৃতিচারণায়, “সেটা কল্লোলের পক্ষে একটা স্মরণীয় রাত।... আমরা অনেকেই সেদিন গিয়েছিলাম। অভিনয় দেখবার ফাঁকে-ফাঁকে বারে-বারে রবীন্দ্রনাথের মুখের দিকে তাকিয়ে লক্ষ করেছি তাতে কখনও কতটুকু হাসির রশ্মি বিচ্ছুরিত হয়। স্বভাবতই, অভিনয় সেদিন ভয়ানক জমেছিল। গানের সময় অনেক দর্শকও সুর মিলিয়ে ছিল মুক্তকণ্ঠে। শেষটায় আনন্দের লহর পড়ে গিয়েছিল চারিদিকে। শিশিরবাবু ব্যস্ত সমস্ত হয়ে ছুটে এলেন কবির কাছে, অভিনয় কেমন লাগল তাঁর মতামত জানতে। সরল স্নিগ্ধ কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘কাল সকালে আমার বাড়িতে যেও, আলোচনা হবে।’ আমাদের দিকেও নেত্রপাত করলেন, তোমরাও যেও।

দীনেশদা, নৃপেন, বুদ্ধদেব আর আমি— আর কেউ সঙ্গে ছিল কিনা মনে করতে পারছি না— গিয়েছিলাম পরদিন। শিশিরবাবুও গিয়েছিলেন ও-দিক থেকে। রবীন্দ্রনাথের জোড়াসাঁকোর বাড়িতে বসবার ঘরে একত্র হলাম সকালে। স্নানশেষে রবীন্দ্রনাথ ঘরে ঢুকলেন। সেদিনকার সকাল বেলার সেই ছোট্ট ঘটনাটা উল্লেখ করছি, আর কিছুর জন্যে নয়, রবীন্দ্রনাথ যে কতটা মহিমময় তা বিশেষভাবে উপলব্ধি করেছিলাম বলে। এমনি শিশিরকুমার আমাদের কাছে বিরাট বনস্পতি— অনেক উচ্চস্থ। কিন্তু সেদিন রবীন্দ্রনাথের সামনে ক্ষণকালের জন্যে হলেও শিশিরকুমার ও আমাদের মধ্যে যেন কোনই প্রভেদ ছিল না। দেবতাত্মা নগাধিরাজের কাছে বৃক্ষ-তৃণসকলেই সমান।”

শিশির ভাদুড়ী কবির সঙ্গে যোগাযোগ রেখেই চলেছিলেন। তাঁর নাছোড়বান্দা অনুরোধ এড়াতে না পেরে সত্তরোর্ধ্ব বয়সের ক্লান্ত শরীরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে তাঁর ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়েছিলেন। “দুঃসাধ্য কাজ করতে হয়েছে, এমন একটানা পরিশ্রম আর কখনো করি নি।” সেই নাটক শিশির ভাদুড়ীর প্রযোজনায় অভিনয়ে কলকাতার পেশাদারি মঞ্চে এল ১৯৩৬ এর ২৩ ডিসেম্বর। উপর্যুপরি অনুরোধে কবিকে কলকাতায় এসে রঙ্গমঞ্চে নাটকটি দেখতেও হল। দেখে, ‘মনে আনন্দ ও বিস্ময় নিয়ে’ ফিরে এসেছিলেন। প্রেক্ষাগৃহ ত্যাগ করার আগেই, সেখানে দাঁড়িয়েই লিখে দিয়েছিলেন, “এমন সম্পূর্ণপ্রায় অভিনয় সর্বদা দেখা যায় না।”

দুই রবীন্দ্রনাথ। কখনও তিনি নাট্যাভিনেতা; আবার কখনও নাটকের দর্শক। এমনকি যখন পঁচাত্তর বছর বয়স, আগ্রহ বা উৎসাহের খামতি ছিল না একটুও।

অন্য বিষয়গুলি:

Rabindranath Tagore Theater
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy