দস্তাবেজ: প্রথমে সোনামণি সাঙানি (১৭৭৬), মাঝে কুট্টি কুণ্ডু জেন্টু (১৭৬৪) ও একেবারে ডান দিকে বড়বাজারের বিলাসিনী দাসীর (১৮১৯) ইচ্ছাপত্র
আঠারো শতকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রবর্তিত হওয়ার সূচনালগ্ন থেকে উনিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত বাংলার অন্দরমহলের ইতিহাস চর্চার উপাদান প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম। সেই কারণেই আজ পর্যন্ত তৎকালীন বাংলার মানবীবিদ্যার পৃথক চর্চাও উপযুক্ত ভাবে করা সম্ভব হয়নি। সম্প্রতি অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে উনিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত একশো বছরের কালখণ্ডে বাংলার অন্তঃপুরবাসিনীদের অপ্রকাশিত অর্ধশতাধিক ইচ্ছাপত্র এবং বিচারালয়ে তাঁদের এই বিষয়ে করা বেশ কিছু আবেদনপত্রের সন্ধান মিলেছে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এদেশীয় অন্তঃপুরিকাদের নব আবিষ্কৃত এই সকল তমসুক তৎকালীন মানবীবিদ্যা চর্চার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা যে সময়কাল নিয়ে আলোচনা করছি, সে সময় আনুষ্ঠানিক স্ত্রীশিক্ষা ছিল অতি বিরল। তৎকালীন প্রচলিত মতবাদ ছিল, নারীর শিক্ষা অকালবৈধব্যের কারণ, কিংবা লেখাপড়া শেখা স্ত্রীলোক পরের জন্মে গণিকা হয়। এর পরেও অন্তঃপুরে শিক্ষার আলো যে একেবারে ঢোকেনি তা নয়, যদিও তা ছিল অনানুষ্ঠানিক। বর্তমান প্রবন্ধে ব্যবহৃত মূল উপাদানগুলি বাংলায় আধুনিক নারীশিক্ষা প্রচলন পূর্ববর্তী। তাই সে দিক থেকেও এগুলির অন্যরকম গুরুত্ব রয়েছে। এই সকল দলিল সে যুগের এদেশীয় নারীদের সীমিত ক্ষমতায়নের পরিভাষা, মধ্যবিত্ত সমাজের ধ্যান-ধারণা, ধর্মবিশ্বাস, আর্থ-সামাজিক ইতিহাস প্রভৃতির প্রায় এক স্বচ্ছ দর্পণ।
১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দ নানা কারণে ইতিহাসে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এক দিকে যেমন এই বছর ভারতে বক্সার যুদ্ধে ইংরেজদের হাতে মীরকাশিম-সহ অন্যান্য ভারতীয় শাসকের পরাজয় ঘটেছিল, তেমনই অন্য দিকে এই বছরই আমেরিকায় ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম স্ফুলিঙ্গ দেখা দেয়। আমাদের সংগৃহীত সবচেয়ে পুরনো দলিলটি সেই ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দেরই। ২৭ এপ্রিল ১৭৬৪, অর্থাৎ বক্সার যুদ্ধের প্রায় ছ’মাস আগে কলকাতার আদি বিচারালয় মেয়র’স কোর্টে (১৭২৬ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত) দাখিল করা এই বাংলা ও ফার্সি দ্বিভাষিক ইচ্ছাপত্রটি থেকে জানা যায় সাং. সুতানুটির জনৈকা কুট্টি কুণ্ডু জেন্টু (‘জেন্টু’ শব্দটি অষ্টাদশ শতকে বাঙালি ভদ্রলোক শ্রেণির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হত) তাঁর বান্ধবী পারিজাত জেন্টুকে তাঁর পোশাক, গহনা, আসবাবপত্র, বসতবাড়ি প্রভৃতি সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিই দান করেছেন। ভাবা যায়, আজ থেকে ২৫৭ বছর আগে জনৈক বাঙালি মহিলা তাঁর সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি মৃত্যুর আগে নিজের ইচ্ছেমতো এক বান্ধবীকে উপহার দিচ্ছেন?
১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার সুপ্রিম কোর্টে (১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত) প্রবেটের জন্য জমা পড়া একটি বাংলা ইচ্ছাপত্রে ছিল সাং. কলকাতার বাসিন্দা সোনামণি সাঙানির। আঠারো শতকে প্রয়াত স্বামীর সম্পত্তির অর্ধাংশ, স্ত্রীধন সব মিলিয়ে সোনামণি সাঙানির সম্পত্তির পরিমাণ নেহাত কম ছিল না। পাঁচ কন্যার গর্বিতা জননী সোনামণি তাঁর ইচ্ছাপত্রে প্রত্যেক কন্যাকে পাঁচ হাজার করে টাকা ও কিছু গহনা দেওয়ার ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন। আমরা যে সময়ের কথা আলোচনা করছি সেই সময় এ দেশে ছাপাখানা আসেনি। মূলত বিত্তশালীদের দানেই সে সময় ধর্মগ্রন্থগুলি অনুলিখিত হত। সোনামণি সেই রকমই অষ্টাদশ খণ্ডের মহাভারত অনুলিখনের জন্য তাঁর ইচ্ছাপত্রে পাঁচশো টাকার ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন।
উনিশ শতকে বাংলায় সমাজ সংস্কার আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল নারী, তথা নারী অধিকার। কিন্তু আমরা আঠারো শতকের যে কালখণ্ড নিয়ে বর্তমানে আলোচনা করছি, সেই সময় এই সব সমাজ সংস্কার আন্দোলনের মুখ রামমোহন ছিলেন বালক আর বিদ্যাসাগরের জন্মাতে তখনও ঢের দেরি। কিন্তু সেই সময়ই কোম্পানির আদালতে নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য কড়া নেড়েছিলেন বাংলার গোলাপ দাস পটেলের বিধবা স্বরূপ কুমার (১৭৭৮), রামতনু ঘোষের বিধবা বিষ্ণু পরেহা (১৭৭৯), রূপনারায়ণ চৌধুরীর বিধবা সুখী মণি (১৭৭৯), রামচন্দ্র বসাকের বিধবা শ্রীমতি নুলিতা (১৭৭৯), বলরাম শেঠের বিধবা শ্রীমতী স্বরূপ (১৭৮০)-এর মতো নারীরা। এই সব সচেতন, সপ্রতিভ মহিলা প্রয়াত স্বামীদের সম্পত্তির প্রবেটের জন্য প্রক্টরের সাহায্যে আদালতে আবেদন করেছিলেন। এই নারীরা বেশির ভাগই ছিলেন নিরক্ষর। সে কারণে এই সব আবেদনপত্রে স্বাক্ষরের বদলে খুঁজে পাওয়া যায় তাদের হাতে আঁকা বিবিধ চিহ্ন। এই বিকল্প স্বাক্ষরকে সে যুগের আদালতি ভাষায় বলা হত ‘নিশান সই’।
এর পর আসব উনিশ শতকের প্রথমার্ধের কিছু ইচ্ছাপত্র নিয়ে। ১৮১৮ সালে লেখা বিবি মরিয়ম মোহাম্মদ খানুমের ইচ্ছাপত্রটি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। বিবি মরিয়মের মৃত্যুশয্যায় করা এই ইচ্ছাপত্রে তিনি তাঁর সকল স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি ধর্মবোন বিবি জহুনকে দিয়ে যান। মরিয়মের ইচ্ছাপত্র থেকে আমরা জানতে পারি, তাঁর অধীনে তিন জন বালিকা ক্রীতদাসী এবং এক বালক ক্রীতদাস ছিল। মরিয়ম এদের বিবি জহুনকে দান করে এই সকল ক্রীতদাস-ক্রীতদাসীকে সহৃদয়তা এবং যত্নের সঙ্গে প্রতিপালন করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। এই ইচ্ছাপত্রেই তিনি আবার তাঁর জনৈক ক্রীতদাসী ঝাবড়িকে পৃথকভাবে দু’শো টাকা দেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন। ঐতিহাসিক ইন্দ্রাণী চট্টোপাধ্যায়ের গবেষণা থেকে জানা যায়, পনেরো থেকে উনিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত ভারতে বেশির ভাগ ক্রীতদাস ও ক্রীতদাসী ছিল সতেরো বছরের কম বয়সি। এদের ভিতর আবার শিশুকন্যার সংখ্যাই ছিল বেশি। আর অল্পবয়সি পুরুষ ক্রীতদাসরা কোনও দিনই প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ হয়ে উঠতে পারতেন না, কারণ অতি অল্প বয়সেই তাঁদের পুরুষাঙ্গ ছেদনের ফলে তাঁরা হয়ে যেতেন খোজা। ১৮৪৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক আইনে ভারতের এই ক্রীতদাস প্রথার বিলুপ্তি ঘটে।
বিবি মরিয়মের পরে আসবে ১৮২১ সালে রচিত বিবি মারিয়ার ইচ্ছাপত্র। মরিয়মের মতো বিবি মারিয়া ততটা অর্থশালী না হলেও তাঁর সম্পত্তির পরিমাণও কম ছিল না। বর্তমান মধ্য কলকাতার তালতলা, কলিঙ্গ অঞ্চলে তাঁর বেশ কিছু বাড়ি, পুকুর, জমি ইত্যাদি ছিল। পুত্র ডাবলু জন এলস-কে কলিঙ্গ অঞ্চলে সাত কাঠা জমির উপরে একটি দোতলা বাড়ি দিয়ে গেলেও বাকি সব কিছু তিনি দিয়ে যান তাঁর কন্যা মিস মেরিকে। তিনি তাঁর ইচ্ছাপত্রে অছিদের নির্দেশ দিয়েছেন কলিঙ্গ অঞ্চলে তাঁর একটি পাঁচ কাঠা জমির উপর অবস্থিত বাড়ি বিক্রি করে অপর একটি ছয় কাঠা খালি জমিতে তাঁর নামাঙ্কিত একটি মসজিদ নির্মাণ করতে। মারিয়ার নামাঙ্কিত ওই মসজিদটি কোনও দিন নির্মিত হয়েছিল কি না, সে কথা জানা যায়নি।
উইলিয়াম ডালরিম্পলের লেখা ‘হোয়াইট মুঘলস’ বইটি যাঁরা পড়েছেন, তাঁদের কাছে কর্নেল কির্কপ্যাট্রিকের নাম অতি পরিচিত। হায়দরাবাদের অভিজাত সৈয়দবংশীয় নারী খেয়ার-উন-নিশার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে তিনি তখন আলোচনার শিরোনামে ছিলেন। সেই কর্নেল একচল্লিশ বছর বয়সে ১৮০৫ সালে কলকাতায় মারা যান।
১৮৩৫ সালে জনৈকা নুন্না বেগম, ওরফে বিবি ন্যানি, ওরফে বিবি কির্কপ্যাট্রিকের সম্পত্তির প্রবেট নেওয়ার জন্য তাঁর বড় বোন মুন্নি বেগম আবেদন করেন কলকাতার সুপ্রিম কোর্টে। বিবি কির্কপ্যাট্রিকের সম্পত্তির মোট পরিমাণ ছিল তিন হাজার টাকার মতো। আদালতি নথিতে নুন্না বেগমকে কর্নেল কির্কপ্যাট্রিকের পেনশনার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সম্ভবত এই নুন্না বেগম ওরফে বিবি কির্কপ্যাট্রিক, কর্নেল কির্কপ্যাট্রিকের কলকাতার জনৈকা উপপত্নী ছিলেন, যাঁর নাম এই নথি খুঁজে পাওয়ার আগে পর্যন্ত ইতিহাসে কোথাও কখনও লেখা হয়নি।
উনিশ শতকের যে ভারতীয় মুসলমান মহিলাদের ইচ্ছাপত্র নিয়ে আলোচনা করা হল, তা থেকে বোঝা যায় এই সকল মহিলা সে যুগে ইউরোপীয় অধিবাসীদের পত্নী অথবা উপপত্নী ছিলেন। এ ক্ষেত্রে মুসলমান মহিলারা ইউরোপিয়ানদের সঙ্গিনী হলেও তাঁরা নিজ ধর্ম ত্যাগ করেননি।
এ বার আসব উনিশ শতকের প্রথমার্ধের কয়েক জন হিন্দু রমণীর ইচ্ছাপত্র প্রসঙ্গে। এই সকল দলিলে তৎকালীন হিন্দু বিধবাদের তিনটি পদবির ব্যবহার আমরা দেখতে পাই— দেবী, দাসী এবং রাঁড়। ব্রাহ্মণ পরিবারের মহিলাদের পদবি ছিল দেবী। দাসী পদবিযুক্ত বিধবারা ছিলেন সাধারণ অব্রাহ্মণ পরিবারের মানুষ এবং রাঁড় পদবিযুক্ত বিধবারা ছিলেন সমাজের তথাকথিত নিম্নবর্ণের প্রতিনিধি।
এই সময় মহিলাদের ইচ্ছাপত্রগুলি বেশিরভাগই মৃত্যুশয্যায় রচিত। তাঁরা ‘ভদ্রাভদ্র’ (ভাল মন্দ) ঘটার আশঙ্কায় চটজলদি ইচ্ছাপত্রগুলি তৈরি করতেন। আর সাধারণত পুত্রহীন হিন্দু বিধবারাই মূলত এগুলি লিখতেন। এই সকল ইচ্ছাপত্রে আর একটি কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় লক্ষ্যণীয়। এই সময় মহিলারা কিন্তু তাঁদের শেষ ইচ্ছাপত্রে আত্মীয়া, এমনকি বান্ধবীদেরও সম্পদ, অর্থদান করার ক্ষেত্রে প্রভূত গুরুত্ব দিতেন।
উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, দুই কন্যার গর্বিতা জননী বলাসিনী দাসী (১৮১৮ খ্রিস্টাব্দ) যেমন তঁার জ্যেষ্ঠা কন্যা শ্রীমতী মণি দাসীকে পনেরো হাজার টাকা, একই সঙ্গে তাঁর চার দৌহিত্রীকে চারশো টাকা করে দওয়ার কথা বলে যান। একই সঙ্গে নিজের ছোট বোনকেও একশো টাকা দিতে ভোলেননি। অথবা শ্যামাসুন্দরী দাসী (১৮২৫ খ্রিস্টাব্দ) নিজের মাকে তেরোশো টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই সঙ্গে নিজের ঠকুরমার শ্রাদ্ধের জন্যও একশো টাকা রেখে যান। এ রকম আর একটি উদাহরণ, চোরবাগানের রাধামণি রাঁড় (১৮২৬ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি তাঁর তিন কাঠা জমির উপর দোতলা বাড়ি বিক্রি করে চারশো টাকা তাঁর মা অপর্ণা রাঁড়কে (মুচি) দিতে বলে যান। সর্বশেষ উদাহরণ, জোড়াবাগানের প্রখ্যাত মদনমোহন সেনের প্রথমা প ত্নী মতি দাসী (১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ)। সে যুগের নারীবাদী মতি দাসীর ভবিষ্যৎ চিন্তা ছিল বেশ অন্য রকম। তিনি তাঁর ইচ্ছাপত্রে জানিয়ে যান, যদি তাঁর নাবালক পুত্র ভবিষ্যতে সন্তানহীন অবস্থায় তার বিধবা স্ত্রী রেখে প্রয়াত হয়, তা হলে সে ক্ষেত্রে তাঁর পুত্রের বিধবা স্ত্রী তাঁর সম্পত্তির একাংশ, অলঙ্কার তথা বেশ কিছু অর্থ পাবে।
আঠারো শতক এবং উনিশ শতকের প্রথমার্ধে এক শ্রেণির বাঙালি জীবিকা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন বেনিয়ান বা মধ্যস্বত্বভোগীর কাজ। কলকাতার এই বেনিয়ান সম্প্রদায়ের মানুষ কোম্পানির সঙ্গে লেনদেনের সূত্রে সেই সময় বেশ বিত্তশালী হয়ে উঠেছিলেন। স্বাভাবিক ভাবেই সেই সব পরিবারের গৃহবধূরাও সেই সময় আস্থা রেখেছিলেন কোম্পানির উপরেই। তাই আমরা েদখতে পাই, এই সময়কার একাধিক অভিজাত বাঙালি বিধবাকে কোম্পানির বন্ড বা কাগজে অর্থ লগ্নি করতে। বড়বাজারের জনৈকা বিলাসিনী দাসীর (১৮১৯ খ্রিস্টাব্দ) ইচ্ছাপত্রে কুড়ি হাজার টাকার চারটি কোম্পানির বন্ডে সর্বমোট আশি হাজার টাকার লগ্নি ছিল। একই ভাবে মতি দাসীকে (১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ) কোম্পানির কাগজে ১৩,৫০০ টাকা লগ্নি করতে দেখি।
এই সকল ইচ্ছাপত্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল সে যুগের অন্দরমহলের ধর্মচর্চার কাহিনি। এই সব নথিপত্র থেকে সে যুগের কলকাতার জনপ্রিয় নানা বিখ্যাত মন্দিরের নাম, বাংলার বাইরের জনপ্রিয় বিভিন্ন তীর্থক্ষেত্রের কথা জানা যায়। এই ইচ্ছাপত্রগুলি থেকে আমরা কালীঘাটের ‘কালী ঠাকুরানী’, খড়দহের শ্যামসুন্দর জীউ, বাগবাজারের সিদ্ধেশ্বরী কালী ও মদনমোহন জীউ-এর উল্লেখ পাই। একই সঙ্গে বাংলার বাইরের তীর্থক্ষেত্র বৃন্দাবনধাম, শ্রীক্ষেত্র জগন্নাথধাম, গয়াক্ষেত্র, কাশীর বীরেশ্বরের জনপ্রিয়তার কথাও এখান থেকে জানা যায়।
প্রায় প্রতিটি ইচ্ছাপত্রে সে যুগের মহিলারা তাঁদের পারলৌকিক কাজের বিষয়ে বিস্তৃত নির্দেশাবলি দিয়ে গিয়েছিলেন। যেমন চিত্রামণি দাসী (১৮১৯ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর নিজের শ্রাদ্ধের জন্য তিন হাজার টাকা খরচ করার নির্দেশ দিয়ে যান। রাসমণি রাঁড় (১৮২২ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর মৃত্যুর পর মহোৎসবের জন্য একশো টাকার ব্যবস্থা করে যান। শ্যামাসুন্দরী দাসী (১৮২৫ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর প্রয়াত স্বামী রাধাকান্ত মিত্র এবং নিজের শ্রাদ্ধের খরচ বাবদ আড়াই হাজার টাকা রেখে গিয়েছিলেন। তৎকালীন সুতানুটি গ্রামের শেঠবাগানের বাসিন্দা জ্ঞানময়ী দাসীর (১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ) তিন কাঠা জমির উপর একটি দোতলা বাড়ি ছাড়া আর কিছু ছিল না। এটির তৎকালীন মূল্য ছিল হাজার টাকা। তিনি তাঁর ইচ্ছাপত্রে নিজের মৃত্যুর পর সেই বসতবাড়ি বিক্রির দ্বারা অর্থের সংস্থান করে শুধুমাত্র তাঁর শ্রাদ্ধকর্ম, গয়া-কাশীতে পারলৌকিক ক্রিয়াকলাপ প্রভৃতি ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিয়েছিলেন। ইহজগৎ ও পরপারে আধ্যাত্মিক উন্নতির আশায় সে যুগের সকল মহিলাই গুরু-পরম্পরায় বিশ্বাসী ছিলেন। এই গুরুরা মূলত বৈষ্ণব। সে যুগের এই সকল নারীর কাছে মা-গোসাঁইরাও বেশ গুরুত্ব পেতেন।
সে যুগের মহিলারা পুণ্যকর্ম হিসেবে মন্দির, গঙ্গার ঘাট নির্মাণ, পুষ্করিণী খনন প্রভৃতি কাজে অর্থ ব্যয় করতেন। শোভাবাজারের শ্যামাসুন্দরী দেবী (১৮২৪ খ্রিস্টাব্দ) চক জয়নগরে ছয়শত বিঘা জমির মালিক ছিলেন। তিনি তাঁর মৃত্যুর পর একটি প্রস্তরময়ী কালিকাবিগ্রহ স্থাপনের নির্দেশ দেন। গোকুলকিশোর শেঠের সহধর্মিণী টুনুমণি দাসী (১৮২৫ খ্রিস্টাব্দ) হুগলির বল্লভপুরে দ্বাদশ শিব মন্দির ও গঙ্গার ঘাট নির্মাণ করেছিলেন, বেলঘরিয়ায় পুকুর খনন করিয়েছিলেন। মৃত্যুর সময় তাঁর হাতে দশ হাজার টাকা নগদ ছিল। তিনি লিখে যান, সেই টাকা ছাড়াও স্ত্রীধন হিসেবে যেন তাঁর সমস্ত গহনা বিক্রি করে তাঁর নামে বিভিন্ন পুণ্যকর্ম করা হয়।
খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতকে নব্যস্মৃতির যুগে বাংলায় হিন্দুদের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত আইনের সংস্কার করেন রাঢ়বঙ্গের পণ্ডিত জীমূতবাহন। উত্তরাধিকার ও উত্তরাধিকারক্রমে প্রাপ্য সম্পত্তিতে নারীর অধিকার, স্ত্রীধন এই সকল বিষয়ে জীমূতবাহনের নির্দেশাবলি ছিল অনেকাংশেই আধুনিক এবং কালোত্তীর্ণ। ফলে বাংলা অবশিষ্ট ভারতের থেকে বহু কাল ধরেই একটি প্রগতিশীল আইন অনুসরণ করে আসছিল, যা আরও বেশি পূর্ণতা পায় এই অঞ্চলে ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থা প্রচলিত হলে। বর্তমান প্রবন্ধে আলোচিত এই সকল অপ্রকাশিত ইচ্ছাপত্র প্রমাণ করে, সংখ্যায় কম হলেও পুরুষদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলার কিছু সংখ্যক নারীও আঠারো শতক থেকেই কোম্পানির নতুন শাসনের প্রগতিশীল এই দিকটি নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিল।
প্রচলিত ইতিহাস আমাদের শেখায়, এই নবজাগরণের কেন্দ্র ছিল নারীর অধিকার আর সে কাজ করেছিলেন শুধুমাত্র পুরুষরাই। ঘটনা হল, সেই সংস্কারের কাজে পুরুষরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করলেও আমাদের প্রাপ্ত এই সকল নথিপত্র প্রমাণ করে তাঁদের কাজের ক্ষেত্র বহু আগেই প্রস্তুত করে রেখেছিলেন স্বয়ং নারীরাই। যদিও বর্তমানে প্রচলিত ইতিহাসে সে কথা আজও অনালোচিত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy