Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
কেউ এক জন সেখান দিয়ে হেঁটে গেল, আর এক জন তা দেখল, তাতেই তৈরি হয় নাটক। মনে করতেন নাট্য-পরিচালক পিটার ব্রুক। তাঁর মঞ্চায়নে তিন পর্বের ‘মহাভারত’ দর্শকদের মনে আজও ভাস্বর।
Bengali Story

ফাঁকা স্থান মানেই শূন্য মঞ্চ

১৯৮৭-র অক্টোবর থেকে ’৮৮-র জানুয়ারি পর্যন্ত সেই পরিবর্ধিত ম্যাজেস্টিক থিয়েটারে মঞ্চস্থ হল ‘মহাভারত’।

সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০২২ ০৫:৪৩
Share: Save:

নিন্দা মহানের ভূষণ। যিনি নন্দিত হন, তিনি নিন্দিতও হবেন। এটাই সভ্যতার নিয়ম। পিটার ব্রুকের নাম প্রথম শুনি এই রকম একটি যুগপৎ নন্দিত ও নিন্দিত নাম হিসেবে। এক জন জগৎবিখ্যাত নাট্য-নির্দেশক, যিনি আজীবন চেনা ছকের বাইরে কাজ করেছেন, অভিনয়-শিল্পকে নতুন ভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন, পশ্চিমা থিয়েটারের চিরাচরিত গণ্ডির বাইরে গিয়ে বলেছেন, করেও দেখিয়েছেন, পশ্চিমের নাট্যধারা পৃথিবীর একমাত্র বা শ্রেষ্ঠ নাট্যপরম্পরা নয়। তাঁর ‘দি এম্পটি স্পেস’ গ্রন্থে ব্রুক বলেছেন, “দৈনন্দিন জীবনে ‘যদি’ হল এক রকম বানানো গল্প, কিন্তু থিয়েটারে ‘যদি’ মানে নিরীক্ষা। দৈনন্দিন জীবনে ‘যদি’ মানে এড়িয়ে যাওয়া, থিয়েটারে ‘যদি’ মানে সত্য।” এমন গভীর যাঁর জীবনদর্শন, সেই তিনিই নাকি ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবাহী ‘মহাভারত’ ফরাসি ও ইংরেজি ভাষায় মঞ্চায়িত করে আমাদের অপমান করেছেন! দীর্ঘ দিন ধরে, একাধিক বার ভারতে এসে, উপমহাদেশের নানা অঞ্চলে ‘মহাভারত’-ভিত্তিক নাট্যপরিবেশনার নানা নিদর্শন দেখে, সেই শিল্পীদের শিল্পসম্পদ আত্মসাৎ করে নিজের মর্জিমাফিক এক ‘মহাভারত’ তৈরি করেছেন, যা বিকৃতি ও চৌর্যবৃত্তিরই নামান্তর! আশির দশকের শেষে এই নিয়ে তুমুল বিতর্কের ঝড় উঠেছিল ভারতীয় থিয়েটারমহলে, পাশ্চাত্যের নাট্যচর্চার জগতেও।

কিন্তু সত্যিই কি তাই? এক সংস্কৃতির সম্পদ আর এক সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে কি এতটাই বদলে যায় যে, তাকে চুরি বলা ছাড়া উপায় থাকে না? পৃথিবী কি তা হলে দেশকালের সীমায় খণ্ডিত এক অস্তিত্বমাত্র? শতধাবিভক্ত এক রক্তাক্ত মানচিত্র? প্রশ্নগুলো উস্কে দিয়েছিলেন পিটার ব্রুক, তাঁর নাট্যকর্মে। প্রথমে কাজ শুরু করেছিলেন নিজের দেশ ইংল্যান্ডে। ওই সময়ে বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য রয়্যাল শেক্সপিয়র কোম্পানির সঙ্গে তাঁর অসামান্য শেক্সপিয়র-প্রযোজনাগুলি, যার ছবি বা ভিডিয়ো দেখলে মনে হয় ওগুলি আজও সমসাময়িক— ‘রোমিয়ো অ্যান্ড জুলিয়েট’, ‘টাইটাস অ্যান্ড্রনিকাস’, ‘কিং লিয়র’, ‘অ্যান্টনি অ্যান্ড ক্লিয়োপেট্রা’, ‘আ মিডসামার নাইট’স ড্রিম’ ও ‘দ্য টেম্পেস্ট’। এ ছাড়াও চমকপ্রদ ছিল জার্মান নাট্যকার পিটার ভাইসের ‘মারা/সাদ’-এর ইংরেজি মঞ্চায়ন ও তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে মঞ্চায়িত, ‘ইউ-এস’। ইংল্যান্ডে তাঁর নির্দেশিত প্রযোজনার মধ্যে সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য, পল স্কোফিল্ডের অভিনয়-খ্যাত ‘কিং লিয়র’ (১৯৬২) ও তখনকার সমস্ত প্রথা লঙ্ঘনকারী ‘আ মিডসামার নাইটস ড্রিম’ (১৯৭০), অভিনয় করেছিলেন বেন কিংসলে, প্যাট্রিক স্টুয়ার্ট, হেলেন মিরেন ও ফ্রান্সেস ডে লা ট্যুরের মতো তাবড় তাবড় অভিনেতা।

কিন্তু ইংল্যান্ডের প্রথাবদ্ধ, মূলত প্রসেনিয়াম-কেন্দ্রিক, বাণিজ্যিক থিয়েটার বেশি দিন ধরে রাখতে পারেনি পিটার ব্রুককে। কৈশোর-যৌবনে আন্তর্জাতিক সাংবাদিক হতে চেয়েছিলেন কারণ তাঁর মনে হয়েছিল, “দুনিয়াটা লন্ডনের এই ছোট্ট মধ্যবিত্ত দুনিয়া নয়।” প্রায় তিন দশক ইংল্যান্ডে কাজ করার পর তিনি প্রতীচ্যের গতে বাঁধা নাট্যধারাকে বিদায় জানিয়ে ফিরেছিলেন প্রাচ্যের দিকে, বিশেষত আফ্রিকা, জাপান, পারস্য, চিন, ইন্দোনেশিয়া, ভারতের দিকে। লন্ডন ত্যাগ করে বহু-সাংস্কৃতিক আসর জমিয়েছিলেন প্যারিসে। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এক অনন্য শৈলীর নাট্যচর্চায় ব্রতী হবেন বলে। সেই প্রয়াসের ফল অসাধারণ সব প্রযোজনা, যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ‘কনফারেন্স অব দ্য বার্ডস’ (১৯৭৯)— দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকের পারস্যের সুফি কবি ফরিদুদ্দিন আত্তারের কাব্য-আখ্যান অবলম্বনে অন্তরাত্মাকে খোঁজার নাটক। তার পর নানা নিরীক্ষা ও শেক্সপিয়র-চেখভ ঘুরে, ১৯৮৭ সালে মঞ্চস্থ করলেন জঁ ক্লদ কারিয়েরের লেখা ‘মহাভারত’, ফ্রান্সের সুবিখ্যাত আভিনিয়ঁ নাট্যোৎসবে।

সে বছরের শেষে ‘মহাভারত’ পাড়ি দিল অতলান্তিক। মার্কিন মুলুকে প্রথম মঞ্চায়নের জন্য পিটার ব্রুকের নির্দেশে, বিপুল ব্যয়ে নিউ ইয়র্কে ‘ব্রুকলিন অ্যাকাডেমি অব মিউজ়িক’-এর ম্যাজেস্টিক থিয়েটারের খোলনলচে বদলে এক নতুন মঞ্চ তৈরি হল। ১৯৮৭-র অক্টোবর থেকে ’৮৮-র জানুয়ারি পর্যন্ত সেই পরিবর্ধিত ম্যাজেস্টিক থিয়েটারে মঞ্চস্থ হল ‘মহাভারত’। তিন পর্বের নাটক, মঞ্চায়নের মোট সময় প্রায় ৯ ঘণ্টা। পরে আমাদের এক শিক্ষক-স্থানীয় ব্যক্তি সেই পারফরম্যান্সের কিছু ঝলক ভিডিয়োয় দেখিয়েছিলেন। মঞ্চের দুধের স্বাদ (সাধও বটে) কিছুটা মিটেছিল ভিডিয়োর ঘোলে। আজও ভুলতে পারিনি দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের মুহূর্তে কমলা কাপড়ে মঞ্চ আবৃত হয়ে যাওয়ার দৃশ্য, ভোলার নয় কর্ণ-কুন্তীর নৈশসাক্ষাৎ, চক্রব্যূহের ফাঁদে পড়া অভিমন্যুর মর্মান্তিক মৃত্যু।

এ তো গেল বাইরে থেকে মুগ্ধ হওয়ার কথা। ব্যক্তি মানুষটির সঙ্গে কিছুটা আলাপ হয়েছিল নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘টিশ স্কুল অব দি আর্টস’-এ এমএ পড়ার সময়। সালটা ১৯৮৯। আমাদের প্রধান শিক্ষক অধ্যাপক রিচার্ড শেখনার এক দিন ক্লাসে ঘোষণা করলেন, পিটার ব্রুক আসবেন, আমাদের নিয়ে দু’দিনের ওয়ার্কশপ করাতে। আগের দিন রাতে ঘুমোতে পারিনি। হাতের কাছে ছিল লাইব্রেরি থেকে আনা ওঁর সাম্প্রতিক বই, ‘দ্য শিফটিং পয়েন্ট’। তার আগে ১৯৬৮-তে লেখা ‘দি এম্পটি স্পেস’ পড়েছিলাম। সেই বইয়ে ব্রুক লিখেছিলেন, “যে কোনও একটি খালি জায়গাকে চিহ্নিত করে আমি বলতে পারি, এটা একটা শূন্য মঞ্চ। এক জন মানুষ তার উপর দিয়ে হেঁটে গেলেন, আর এক জন মানুষ সেটা দেখলেন। ব্যস, জমে গেল নাটক!” আরও দুই দশকের প্রজ্ঞা নিয়ে ব্রুক ‘দ্য শিফটিং পয়েন্ট’-এ পৌঁছে বললেন, “নাটমঞ্চের নিয়ম বলতে দু’টি: এখানে— ১. যা-খুশি ঘটে যেতে পারে, আর ২. কিছু একটা ঘটতেই হবে।”

পরের দিন ওয়ার্কশপে এসে তিনি প্রথমেই বললেন, “যে কোনও বড় প্রশ্নের শ্রেষ্ঠ উত্তর হল ছোট ছোট আরও প্রশ্ন। ‘বাস্তব’ শব্দটা দ্যোতক। এর কোনও চিহ্নিত অর্থ হয় না, শুধু চিহ্ন হয়। চিহ্নের সমাহার। থিয়েটারের কাজ সেই চিহ্নগুলিকে নিয়ে খেলা, তার তত্ত্বতালাশ করা। তার দ্যোতনা ও দ্যোতকগুলিকে উল্টেপাল্টে দেখা, চেনার চেষ্টা করা, ভাবা।” এ কথা আরও অনেক মহান শিল্পী ও দার্শনিকও বলে গিয়েছেন। কিন্তু সে দিন এক তরুণ বাঙালি ছাত্রের কানে সেই কথাগুলি পথনির্দেশিকার মতো, শিল্পপথে চলার পাথেয় রূপে পৌঁছেছিল। ওয়ার্কশপের বিরতির সময় ওঁকে কফি এনে দিতাম আর নানা প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করতাম। যথাসম্ভব ধৈর্য সহকারে উত্তর দিতেন। অসামান্য শব্দচয়ন ও প্রয়োগ ছিল তাঁর। যত কম কথায় যত বেশি বলা যায়, সর্বদা সেই প্রয়াস।

তার পর দু’দশক ও নানা অভিজ্ঞতার পরে, আমেরিকা ছেড়ে ইংল্যান্ডে বসবাস করছি। ২০১০ সাল। তার বছর পাঁচেক আগে আমার এক নাট্য-পরিচালক বন্ধুর সঙ্গে জুটি বেঁধে একটা পারফরম্যান্স তৈরি করেছি— ‘ম্যান অব দ্য হার্ট’— লালন শাহ ফকিরকে নিয়ে। সেই পারফরম্যান্স নানা হাত ও হাট ঘুরে এসে পৌঁছেছে লন্ডনের বার্বিকান থিয়েটারে। আমাদের সেট বসানো, আলো লাগানো আর ফাইনাল রিহার্সাল চলছে। আমি আর আমার বন্ধু কাজের এক ফাঁকে বার্বিকানের ব্যাকস্টেজ দরজার ঠিক বাইরে এসে দাঁড়িয়েছি, হঠাৎ দেখি এক বৃদ্ধ মানুষ, মাথায় একটা টুপি আর লম্বা টুইডের ওভারকোট পরা, হাতে একটা প্লাস্টিক ব্যাগ নিয়ে ধীরে ধীরে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন। বৃদ্ধ খানিক কাছে আসতেই মুখটা চিনতে পারলাম। পিটার ব্রুক! ভদ্রলোক কাছে আসতেই, আচমকা ঢিপ করে পা ছুঁয়ে একটা প্রণাম করে ফেললাম। তার পর বেশ কিছু বোকা বোকা আমতা আমতা কথা, বড় জোর এক কি দু’মিনিটের নার্ভাস কথোপকথন। ২১ বছর আগেকার আলাপের কথা মুখেও আনতে পারলাম না। ওঁর কেন মনে থাকবে আমার মতো নগণ্য এক জনকে? সব মিলিয়ে কেমন যেন হতভম্ব অবস্থা। বৃদ্ধ আমাদের অভিবাদন জানিয়ে হাঁটা দিলেন নিজের গন্তব্যের দিকে। ব্যস্ত লন্ডনের পথচারীদের ভিড়ে মিলিয়ে গেলেন ক্রমশ। আকস্মিক বিস্ময়ের অভিঘাতে ওঁকে আমাদের নাটকটা দেখার আমন্ত্রণ জানানোর কথা মনে পড়েনি একেবারেই।

আজ পিটার ব্রুক আমাদের নাগাল থেকে বহু দূরে। এই মুহূর্তে হয়তো কোনও মহাজাগতিক থিয়েটার নিয়ে ব্যস্ত।

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Story Theater
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy