ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
কাঁচাপাকা দাড়ি-গোঁফের জঙ্গলে মুখটা ভাল করে দেখার উপায় নেই। তার উপরে মাথার টুপিটায় আরও অন্ধকার নেমেছে চোখে-মুখে। ইনিই টমাস স্নডগ্রাস! ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বড় চাকুরে। ১৭৭৭ সালে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে (অধুনা তামিলনাড়ু) কোম্পানির কেরানি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন, পরে প্রমোশন পেয়ে ওড়িশার গঞ্জাম জেলার কালেক্টর বা জেলাশাসক। আজ তাঁর গায়ে একটা ময়লা কোট, হাতে ঝাড়ু। লন্ডনের লিডেনহল স্ট্রিটে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অফিসের সামনে ঝাঁট দিচ্ছেন। এত দিন যে কোম্পানিতে কাজ করেছেন, বেছে বেছে সেই অফিসের সামনেই!
দেখে মনে হয়, বড়সড় একটা ঝড় বয়ে গিয়েছে। বয়সটাও এক ধাক্কায় বেড়ে গিয়েছে। শুকনো মুখ, চোখের নীচে কালি, দু’দিন বোধ হয় পেটেও কিছু পড়েনি।
লিডেনহল স্ট্রিটে অফিসের সামনে তখন বড়সড় জটলা। যে স্নডগ্রাস সাহেবের নামে এক সময় পাইক-পেয়াদারা লম্বা সেলাম ঠুকত, মুখের উপর কথা বলার সাহস করত না কেউ, তার এই পরিণতি!
‘ওরা পেনশন আটকে দিল যে...’ ভিড়ের মধ্যে বলে উঠলেন এক জন। পাশের লোকটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘নামেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। অথচ তাঁর হকের টাকা আটকে দিয়েছে।’ পাশ থেকে আর এক জন: ‘এই কোম্পানিই নাকি বাংলা বিহার শাসনের সনদ পায়!’
আরও পড়ুন: মার্জিনে রবীন্দ্রনাথ
খবরটা ছড়াতেও বিশেষ সময় লাগল না। রিপোর্ট গেল কোম্পানির উপরমহলে। পথেঘাটে সমালোচনার বন্যা। কোম্পানির নামে ছিছিক্কার। মান বাঁচাতে কোম্পানি ক’দিন পরেই স্নডগ্রাসকে ডেকে নিয়ে গেল। টাকা মিটিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।
পেনশন আটকানোর কারণও ছিল। কোম্পানির নথিপত্রে তখন স্নডগ্রাসের নামে অজস্র অভিযোগের ফাইল। কোনওটায় গঞ্জাম জেলায় সরকারি খাজনা আদায়ে দুর্নীতির অভিযোগ। কোনওটায় লেখা, খাজনা আদায়ে চূড়ান্ত অব্যবস্থার অভিযোগে কালেক্টর-এর পদ থেকে স্নডগ্রাসকে অপসারণ করা হচ্ছে। অন্য একটা ফাইলে আবার সরকারকে অবমাননা করেছেন বলে তাঁর কাছ থেকে নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থনা দাবি করা হয়েছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রেকর্ডস-এ এমনও ফাইল আছে, যেখানে লেখা, কোম্পানির চাকরিতে স্নডগ্রাসকে পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত এখনও অমীমাংসিত। মনে হয় এই কারণেই বেগতিক বুঝে রিটায়ারমেন্ট প্ল্যান করে ফেলেন স্নডগ্রাস।
যদিও তাতে ধনে-মানে বাঁচেননি। পেনশনের দাবি জানিয়ে কোর্টে আবেদন করেন, কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, তিনি গঞ্জামের কালেক্টর থাকাকালীন যে রাজস্ব আদায় করা হয়েছিল, তার হিসেব মিলছে না। আগে কোম্পানির হিসেবনিকেশ মেটাও, তার পরেই পেনশনের কথা ভেবে দেখবে তারা। স্নডগ্রাসেরও উত্তর তৈরিই ছিল। তিনি জানান, ওই হিসেব দেখানো তাঁর পক্ষে অসম্ভব। কারণ, ওই সব কাগজ যে নৌকায় ছিল, সেটা নাকি চিল্কা হ্রদের জলে ডুবে গিয়েছে!
স্নডগ্রাসের এ হেন যুক্তি শুনে হাসিতে ফেটে পড়ে আদালত। তখনও তারা জানত না, এ হাসির দাম চোকাতে হবে কড়ায়-গন্ডায়। স্নডগ্রাসও যে ছাড়ার পাত্র নন। অতএব আটঘাঁট বেঁধে সাত দিনের না-কাটা দাড়ি আর ধুলোময়লা মাখা কোট গায়ে চাপিয়ে তিনি হাজির হলেন কোম্পানির হেডকোয়ার্টার্সের সামনে। হাতে ঝাঁটা।
বাকিটা কী হবে, জানাই ছিল দূরদর্শী স্নডগ্রাসের! ১৮৩৪ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত কোম্পানির দেওয়া পেনশনের প্রতিটা পয়সা নগদ বুঝে, আদায় করে ছেড়েছিলেন!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy