Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪

চিড়িয়াখানার তুমি কী জানো

গ্র্যান্ড হোটেলের ঘর ভাড়া নিয়ে এক দিনেই ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক রেকর্ড করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। শুটিংয়ে হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল উত্তমকুমারের। শরদিন্দু-সত্যজিৎ রায়-উত্তমকুমারের ‘চিড়িয়াখানা’র পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হচ্ছে আগামী সপ্তাহে। পুনু সেনগ্র্যান্ড হোটেলের ঘর ভাড়া নিয়ে এক দিনেই ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক রেকর্ড করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। শুটিংয়ে হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল উত্তমকুমারের। শরদিন্দু-সত্যজিৎ রায়-উত্তমকুমারের ‘চিড়িয়াখানা’র পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হচ্ছে আগামী সপ্তাহে। পুনু সেন

হাউসফুল: পূর্ণ সিনেমাহলের সামনে ‘চিড়িয়াখানা’ দেখতে ভিড়।

হাউসফুল: পূর্ণ সিনেমাহলের সামনে ‘চিড়িয়াখানা’ দেখতে ভিড়।

শেষ আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৭:০০
Share: Save:

নায়কের শুটিং চলতে চলতেই শেষ দিকে হঠাৎ উত্তমকুমার আমাকে ডেকে বলল, ‘‘শোন, তোরা অ্যাসিস্ট্যান্টরা মিলে একটা ছবি কর। আমি অভিনয় করব। আমি যা নিই, তার অর্ধেক দিলেই হবে!’’ মানিকদাকে সে কথা বলতেই উনি বললেন, ‘‘গল্প ভেবেছ কিছু? ‘চিড়িয়াখানা’টা করো বরং। আমি স্ক্রিপ্ট লিখে দেব! ’’

পঞ্চাশ বছর পরে এ সব কথা মনে পড়লে এখন অবাক লাগে। ব্যোমকেশের গল্প নিয়ে ছবি! উত্তমকুমার ব্যোমকেশ! মানিকদার চিত্রনাট্য! অথচ ছবি নিয়ে কত ঝঞ্ঝাটই না হয়েছিল! মানিকদা নিজে পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পরও তার শেষ হয়নি।

মানিকদা, মানে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ সেই ‘পথের পাঁচালী’র সময় থেকে। আমি সে সময়ে সহকারী সম্পাদকের কাজ করি। তখন থেকেই আমার ইচ্ছে, মানিকদাকে অ্যাসিস্ট করব! শেষ পর্যন্ত ‘নায়ক’-এ অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হয়ে ঢুকলাম। ‘নায়ক’-এর সেটেই উত্তমের এই প্রস্তাব, মানিকদা’র রাজি হওয়া। আমরা হইহই করে ইউনিটেরই ক’জন মিলে ‘স্টার প্রোডাকশন’ নামে একটা ব্যানার খুললাম। দুলালদা (সম্পাদক দুলাল দত্ত), কাশীনাথ বসু, অমিয় স্যান্যাল ছিলেন। সুব্রত লাহিড়ি সরাসরি পার্টনার ছিল না, কিন্তু সঙ্গে থাকত। গল্পের রাইট কিনতে গেলাম দুর্গাপ্রসাদ চক্রবর্তীর কাছে। দুর্গাদা মানিকদা’র সঙ্গে প্রেসিডেন্সিতে পড়তেন। শরদিন্দুর যত গল্পের রাইট, ওঁকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দেওয়া ছিল। দু’হাজার টাকায় ‘চিড়িয়াখানা’র রাইট কেনা হল।

ব্যোমকেশ করবে উত্তম, সে তো ঠিক হয়েই আছে। নিশানাথের চরিত্রে প্রথমে ভেবেছিলাম অশোককুমারকে। এক দিন মানিকদা বললেন, ‘‘তোমাদের বাড়ির কাছেই তো দারুণ আর্টিস্ট আছে। সুশীল মজুমদারকে ভাবছ না কেন?’’ সুশীলবাবুর কথা আমাদের মাথাতেই আসেনি। প্রস্তাবটা সবার খুব পছন্দ হল। প্রোডাকশন আর ডিস্ট্রিবিউশনের ব্যাপারে আর ডি বনসলের সঙ্গে কথাবার্তা পাকা হয়ে গেল। ‘নায়ক’-ও ওঁরাই করেছিলেন। এই অবধি সব কিছু ঠিকঠাক। তার পরই বজ্রপাত। বনসলরা আইনি ঝামেলায় ফেঁসে গেলেন। নায়ক-এর সেই বিখ্যাত দৃশ্য, উত্তমকুমার টাকার পাহাড়ে ডুবে যাচ্ছেন, তার জন্য প্রচুর নকল নোট ছাপানো হয়েছিল। প্রোডাকশনই সব ব্যবস্থা করেছিল! আমরা জানতাম, ওঁরা নিয়মকানুন মেনেই যা করার করেছেন। কিন্তু এখন দেখা গেল, রিজার্ভ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া নোট ছাপানো হয়েছে বলে বনসলদের নামে অভিযোগ এসেছে! প্রোডাকশনের কাজ এখন কিছু দিন বন্ধ রাখতে হবে!

আমাদের তো মাথায় হাত! এ বার টাকা আসবে কোথা থেকে? আমার ভাইপোর এক বন্ধু ছিল ডাক্তারি-বইয়ের পাবলিশার আর প্রিন্টার। ভদ্রলোকের নাম হরেন ভট্টাচার্য। এক দিন গিয়ে আলাপ করলাম। উনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘ছবি করতে ক’পয়সা লাগে?’’ আমি বললাম, ‘‘পয়সা কী মশাই? দু’-তিন লাখ টাকা লাগবে!’’ উনি গাঁইগুঁই করে রাজি হলেন। আমি ভাবলাম, ঝামেলা বুঝি মিটল! কিন্তু ক’দিন পরেই হঠাৎ উনি বেঁকে বসলেন, ‘‘তোমরা পরিচালনা করলে চলবে না! সত্যজিৎবাবু নিজে না করলে আমি টাকা দিমু না!’’ সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে মানিকদার কাছে এসে সব খুলে বললাম। মানিকদা বললেন, আমি একটু ভাবি। আমি লেগে রইলাম যথারীতি। সেই মুহূর্তে মানিকদা নতুন ছবি শুরুও করেননি। বললেন, ‘‘ঠিক আছে, আমি করে দেব।’’ শুধু বলে রাখলেন, ‘‘আমি আর্টিস্টের নাম বলে দেব, কিন্তু টাকাপয়সার কথাটথা বলতে পারব না।’’ আমি বললাম, ওটা আমার ওপর ছেড়ে দিন।

আমি কোনও রাখঢাক করিনি। সকলকেই সোজাসুজি বললাম, একটা ছবি করতে যাচ্ছি কয়েক বন্ধু মিলে। আমি কিন্তু কাউকে কিছু দিতে পারব না। এবং মানিকদা, উত্তমকুমার আর সুশীলবাবু ছাড়া আমরা আর কাউকে সত্যিই পয়সা দিতে পারিনি। সকলেই এক কথায় বলেছিল, পয়সাকড়ির ব্যাপারই নেই, আমরা করে দেব।

‘চিড়িয়াখানা’ ছবির পোস্টার

গোলাপ কলোনির জন্য বামুনগাছিতে একটা জায়গা পেলাম। এক ভদ্রলোক, তাঁর নিউমার্কেটে ফুলের দোকান ছিল। ওঁদেরই জমি। বংশীদাকে (শিল্প নির্দেশক বংশী চন্দ্রগুপ্ত) নিয়ে দেখে এলাম। মানিকদাকেও দেখানো হল। বংশীদা সব স্কেচ করলেন। হাওড়ার এক নার্সারি থেকে ফুল নিয়ে বাগান করা হল। স্টুডিয়োপাড়া থেকে কাঠ নিয়ে যাওয়া হল ঘর তোলার জন্য। কাঠ-বোঝাই লরিতে বংশীদা আর আমি বসতাম ড্রাইভারের পাশে। বংশীদা কিছু খুচরো কয়েন পকেটে নিতেন, এক-একটা মোড়ে পুলিশ ধরত আর বংশীদা দু’চার টাকা করে তাদের হাতে গুঁজে দিতেন। প্রায় এক মাসের উপর লেগেছিল সেট তৈরি হতে।

এর মধ্যে মানিকদা এক দিন বললেন, ‘‘চলো এক জায়গায় যাই!’’ মানিকদার এক বন্ধু ছিলেন কমল চৌধুরী। বিচিত্র জীবজন্তু পোষার শখ। আনোয়ার শাহ রোডে বাড়ি। ঢুকতে যাচ্ছি, দেখি বাইরের ঘরে কালনাগিনীর মতো দেখতে একটা সাপ ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি দেখেই বললাম, আমি যাব না। মানিকদা দিব্যি এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘‘এসো, এসো! আমি যাচ্ছি, তুমি যাবে না কেন?’’ কিছু ক্ষণ পরে কমলবাবু এসে কী একটা নাম ধরে সাপটাকে ডাকলেন! সাপ তো শুনতে পায় না! কিসে কী বুঝল জানি না। কমলবাবু তাকে আদর করে মাংসের কুচি খাওয়াতে লাগলেন। আমি তো ভয়ে সিঁটিয়ে আছি। তার পর মানিকদা যেমন চেয়েছিলেন, সে রকম একটা পাইথনের বাচ্চা ভেতর থেকে নিয়ে এল। মানিকদা দারুণ খুশি। কিন্তু এ সাপ আবার গরম সহ্য করতে পারে না। তাকে স্টুডিয়োর ফ্লোরে রাখা যাবে না। ঠিক হল, শুটিঙের দিন আমি ওকে নিয়ে আসব, আমার পাঞ্জাবির পকেটেই সে থাকবে। হলও তাই। সাপটা দিব্যি আমার পকেটে গোল হয়ে শুয়ে থাকত। শটের সময় আমি বের করে দিতাম। প্রথম দিন উত্তম বেশ ভয় পেয়েছিল। মানিকদা বোঝালেন, ‘‘ভয়ের কিছু নেই, এই তো আমি ধরছি!’’ উত্তম ভয়ে ভয়ে হাত দিল। তার পর আস্তে আস্তে সহজ হয়ে গেল।

‘নায়ক’-এর জন্য বার্লিন গিয়ে মানিকদা জার্মান কোম্পানি উহের-এর একটা টেপরেকর্ডার উপহার পেয়েছিলেন। সেটা সব সময় ওঁর কাঁধে ঝুলত। শুটিঙের ফাঁকে ফাঁকে পাখির ডাক, বৃষ্টির আওয়াজ, আরও নানা রকম শব্দ রেকর্ড করতেন। মনে আছে, মানিকদাকে নিয়ে এক দিন সুভাষগ্রাম গেছি সন্ধেবেলায়। একটা জঙ্গলঘেরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে মানিকদা ঝিঁঝিঁ আর ব্যাঙের ডাক রেকর্ড করছেন। আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট শুনতে পেলাম, দু’চার জন লোক বলাবলি করতে করতে গেল, ওরে চলে আয়! ডাকাত দাঁড়িয়ে আছে! এই সুভাষগ্রামেই নৃপতিদাকে (চট্টোপাধ্যায়) নিয়ে ঘোড়ার গাড়ির অংশটা নেওয়া হয়েছিল। নৃপতিদা’র ছিল রাতে নেশা করার অভ্যাস। উনি ওই ক’দিন বামুনগাছিতেই থেকে যেতেন। মানিকদা এক দিন নৃপতিদার ঘরে টেপরেকর্ডারটা রেখে এলেন। ব্যস! পরের দিন আর সেটা পাওয়া গেল না! নৃপতিদা’র সঙ্গে রাতে যারা আড্ডা মারতে আসত, তাদেরই কেউ নিয়ে চলে গিয়েছে! মানিকদা কিছু দিন পর আর একটা উহের রেকর্ডার আনিয়ে নিলেন।

আউটডোর তো উতরে গেল! ইনডোরেও প্রথম কিছু দিন ভালই চলল। তার পর শুরু হল উত্তমের ডেট নিয়ে সমস্যা। তখন ‘ছোটি সি মুলাকাত’-এর শুটিং চলছে মুম্বইতে। প্রায়ই ‘আসব’ বলে আসতে পারে না! আমাদের সেট পড়ে থাকে এন-টি ওয়ানে। টাকা গুনতে হয়। এ দিকে প্রোডিউসার টাকা দেয় টিপে টিপে। কোথা দিয়ে কী সামাল দেব, বুঝতে পারি না। ব্যোমকেশের ঘরে যে কঙ্কালটা ছিল, ওটা ভাড়া নিয়েছিলাম বিখ্যাত গুপিদার দোকান থেকে। প্রপস ভাড়া দেওয়াই ওঁদের ব্যবসা। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ির ঠিক উলটো দিকে একটা গলির মধ্যে দোকান। ‘পথের পাঁচালী’-র অনেক জিনিসও ওঁদের দেওয়া। এই গুপিদা মাঝে মাঝে স্টুডিয়োতে আসেন আর জিজ্ঞেস করেন, ‘‘কি রে আজকে কিছু দিবি-টিবি?’’ কিছুই দিতে পারি না! গুপিদা মজা করে বলেন, ‘‘কঙ্কালটা কার জানিস? স্যর আশুতোষের মায়ের! টাকা না দিলে ঘুমের মধ্যে তোদের ধরবে।’’

গুপিদা নাহয় অপেক্ষা করবেন! কিন্তু আমরা সেট খাটিয়ে কত দিন বসে থাকব? মানিকদা রেগে যাচ্ছেন! এক দিন তো স্ক্রিপ্ট ছুড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, ‘‘যাও, তোমাদের ছবি আর করবই না!’’ ওঁকে তখন মিথ্যে করে বললাম, উত্তম আসলে বলেইছিল যে ওর একটু দেরি হতে পারে। আপনাকে বলতে বলেছিল। মানিকদা তখন আবার আমাকে বকছেন, ‘‘সেটা আমাকে বলোনি কেন আগে?’’ কী জবাব দেব? মহা ফাঁপরে পড়লাম। শেষ অবধি সেট ভেঙে ফেলা হল। ঠিক হল, উত্তম এলে আবার সেট তৈরি হবে। একটা সময় এমন দাঁড়াল যে, শুধু ঘরের মধ্যে সবাইকে নিয়ে লাস্ট সিনটা বাকি! কিন্তু উত্তমকে পাওয়াই যাচ্ছে না!

বেশ কিছু দিন পর যে দিন উত্তম এল, মানিকদা একটু রেগেই ছিলেন। পায়চারি করছেন চুপচাপ। উত্তম সোজা মেক-আপ রুমে ঢুকে গেল। মানিকদা একটা কথাও বলেননি। আমি গিয়ে দেখি, উত্তম দরদর করে ঘামছে! আমার কেমন যেন লাগল! শুভেন্দু (চট্টোপাধ্যায়) তো ডাক্তার! ডেকে নিয়ে এলাম। ও দেখেই বলল, ‘‘ও পুনু, মনে হচ্ছে হার্ট অ্যাটাকের ব্যাপার!’’ শুভেন্দুই উত্তমকে নিয়ে ডা. সুনীল সেনগুপ্তের কাছে গেল। হার্ট অ্যাটাকই ধরা পড়ল! তার পর থেকে টানা তিন মাস আমি রোজ দুপুরে ময়রা স্ট্রিটের বাড়িতে চলে যেতাম। সারা রাত থেকে সকালে আসতাম। বেণু (সুপ্রিয়া দেবী) অসম্ভব সেবা করেছিল। নিজের হাতে সব কিছু করত। ওই সময়টা ওদের সঙ্গে বেশ খানিকটা জড়িয়েই পড়েছিলাম। উত্তম-সুপ্রিয়ার যে ঘরোয়া বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছিল পরে, সেখানেও আমি ছিলাম। এ দিকে উত্তমের অসুস্থতার খবর তত দিনে সবাই জেনে গিয়েছে। এক দিন একটা ছেলে এসে হাজির। ‘‘গুরুকে দেখব’’ বলেই নিজের পাঞ্জাবিটা ফরফর করে ছিঁড়ে ফেলল! ‘‘গুরু ঠিক আছে বাবা, তুমি এসো এখন,’’ বলে তাকে কোনও রকমে বিদায় করলাম।

এ দিকে শুটিং যখন শেষ হল, মিউজিক রেকর্ডিং-এর জন্য তখন আর কোনও টাকা নেই। ‘ভালবাসার তুমি কী জানো’ গানটা শুধু আগে থেকে রেকর্ড হয়েছিল। পুরো ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাকি। মানিকদা বললেন, আমার একটা দিন একটু নিরিবিলি চাই। বাড়িতে যা ছিল— কিছু পারকাশন, জাইলোফোন, সুরমণ্ডল— বাক্সে ভরে আর ওই উহের রেকর্ডারটা নিয়ে মানিকদা এক দিনের জন্য গ্র্যান্ড হোটেলে চলে গেলেন। সারা দিন ধরে স্রেফ একা সব যন্ত্রগুলো বাজিয়ে রেকর্ড করে ফেললেন উহের-এ। পিয়ানোটা তো নিয়ে যেতে পারেননি। ওটা পরে বাড়িতেই রেকর্ড করলেন। এই আশ্চর্য অসাধ্যসাধন মানিকদার পক্ষেই সম্ভব!

কিন্তু এত কাণ্ড করে ছবি শেষ হওয়ার পরেও কি নিশ্চিন্ত হওয়ার উপায় আছে? ঘাম ছুটে গেল ডিস্ট্রিবিউশন পেতে। সত্যজিৎ রায়ের ছবি, উত্তমকুমার লিড! ডিস্ট্রিবিউটরদের দরজায় দরজায় ঘুরেও ছবি নেওয়াতে পারিনি। রূপবাণী, ভারতী, অরুণা-র মালিকরা তখন ‘মিতালি’ বলে একটা ডিস্ট্রিবিউশন চালাতেন। ওঁরা বললেন, উত্তমের সঙ্গে সুচিত্রা থাকলে ভাল হত। এ ছবি নিতে পারব না। ছায়াবাণীর অসিত চৌধুরী বললেন, আমি তোমাদের ছবি চালিয়ে দিতে পারি ২% কমিশনে। কিন্তু টাকা দিতে পারব না। গেলাম সুনন্দা দেবীর স্বামী সুধীর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। ওঁর বন্ধু ডি এন ভট্টাচার্যের একটা ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি ছিল। সুধীরবাবু বললেন, ছবি আমরা নিতে পারি, কিন্তু অঞ্জনা ভৌমিককে নায়িকা নিতে হবে। ছবি তো শেষ, এখন নতুন নায়িকা কী করে হবে? চলে এলাম। দিলীপ রায়ের ভাই পরিতোষ নিয়ে গেল গায়িকা অসীমা ভট্টাচার্যের স্বামীর কাছে। তিনি বললেন, হ্যাঁ ঠিক আছে, কিন্তু সত্যজিৎবাবুকে আমার বাড়িতে এসে স্ক্রিপ্ট শোনাতে হবে।

শেষমেশ আমি আবার আমার ভাইপো রঞ্জিতকে বললাম, হরেনবাবুকে বল নিজে ডিস্ট্রিবিউশন করতে, তা হলে প্রথম থেকেই ও টাকাটা নিজে পাবে। সেই কথাটা ওদের মনে ধরল। তখন ‘বলাকা পিকচার্স’ নাম দিয়ে একটা ডিস্ট্রিবিউশন খুলে ছবিটা রিলিজ করানো হল রাধা, পূর্ণ, প্রাচী-তে। দিনটা ১৯৬৭ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর। কিন্তু হরেনবাবুর সঙ্গে আমাদের স্টার প্রোডাকশনের যে কন্ট্রাক্ট ছিল পার্টনার হিসেবে, তার কপি আমরা আর হাতে পাইনি। ফলে ছবি চললেও কোনও পয়সাই আমাদের জোটেনি।

সামনে পুজো, কারও পকেটে কিচ্ছু নেই। মানিকদারও সময়টা খুব কষ্টে যাচ্ছিল। ছবি শেষ হতে অনেক দেরি হয়েছে। হাতে অন্য ছবি নেই। টাকাও নেই। প্রোডিউসারের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে তখন বৌদিকে (বিজয়া রায়) এনে দিতাম প্রতি মাসে। তাতেই ওঁদের সংসার চলত। এই রকম টানাটানির মধ্যে মানিকদা ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পেলেন। আমাদের ডেকে বললেন, ‘‘আমার হাতে টাকা এসে গেছে পুনু, তোমরা আমার কাছ থেকে কিছুটা নিতে পারো।’’ তখন ইউনিটের সব মেম্বাররা এক মাসের টাকা মানিকদার থেকে নিলাম। প্রোডিউসারের টাকাটা পরে ওদের সঙ্গেই ‘অশনি সংকেত’ করে মানিকদা শোধ দিয়ে দেন।

যে ‘চিড়িয়াখানা’ নিয়ে এত ঝড়, পরে ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ আর এটা মিলিয়েই উত্তম ‘ভরত পুরস্কার’ পায়। এখানে আরও একটা কথা বলা উচিত। ডেট নিয়ে ঝামেলাটা বাদ দিলে উত্তম কাজটা খুব মন দিয়েই করেছিল। এমনিতে তখন উত্তমের শুটিং মানেই ওর চার-পাঁচ জন ল্যাংবোট ভিড় করে থাকা। মানিকদার ইউনিটে উত্তম তাদের কাউকে আসতে দিত না।

মানিকদাকে দিয়ে ছবি করানোর কথা এর পরেও ও ভেবেছিল। মানিকদার বাড়ি অবধি গিয়েও কথাটা কী ভাবে পাড়বে বুঝতে না পেরে ফিরে এসেছিল এক বার। আর একটা দিনের কথা খুব মনে পড়ে। এন-টি ওয়ানে জামরুলগাছটার নীচে কয়েক জনের সঙ্গে দাঁড়িয়ে উত্তম কথা বলছে। আমি পাশ দিয়ে যাচ্ছি। ডেকে বলল, ‘‘মানিকদাকে বলিস না রে! চাকরের রোল দিলেও আমি করব। এই সব কাজ আর ভাল লাগছে না! ’’

এই কথাবার্তার দু’দিন পরের তারিখটাই ২৪ জুলাই, ১৯৮০।

সাক্ষাৎকার: জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়

কৃতজ্ঞতা স্বীকার: সন্দীপ রায়

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy