Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
ছোটগল্প

নীড়

মোবাইল বেজে উঠেছে। ফোন ধরতেই, ‘‘মা, খেয়ে নিয়েছ?’’

ছবি: বৈশালী সরকার

ছবি: বৈশালী সরকার

অ্যাঞ্জেলিকা ভট্টাচার্য 
শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:১৪
Share: Save:

আকাশে এখনও মেঘ জমে রয়েছে। গাছের একটা পাতাও দুলছে না। নিরুপমা বারকয়েক ব্যালকনি থেকে ঘুরে গেলেন। না, এখনও ঝড়ের আশঙ্কা তেমন প্রকট নয়। টিভিতে খবরের চ্যানেল খুলতেই দেখা গেল বিকেলে ঝড় আসার পূর্বাভাস।

বিকেল মানে, পাঁচটার সময় কি ঝড় আসবে! না, ও রকম ভাবে তো আর সময় বলা যায় না। তবে আজকাল ঝড় এলে খুব ভয় করে নিরুপমার। এই তো দু’দিন আগেই ঝড়বৃষ্টিতে বাজ পড়ে, গাছ চাপা পড়ে কয়েকজন মারা গেল।

মোবাইল বেজে উঠেছে। ফোন ধরতেই, ‘‘মা, খেয়ে নিয়েছ?’’

‘‘অনেক ক্ষণ। নন্দিনী, আজ তাড়াতাড়ি আসিস। ঝড় আসছে।’’

‘‘সারাদিন বসে বসে খবর দেখবে, আর দুশ্চিন্তা করবে। ইন্দ্র তোমায় ফোন করেছিল?’’

‘‘না তো।’’

‘‘এই তোমার এক ছেলে হয়েছে। পৌঁছে কিছুতেই একটা মেসেজ করে জানাবে না। অন্তত তোমাকে তো জানাতে পারে?’’

‘‘বাবলু এখনও পৌঁছয়নি?’’

‘‘তোমার চিন্তা করার কিচ্ছু হয়নি। ফ্লাইট যথাসময়ে দিল্লি পৌঁছে গিয়েছে। হয়তো কাজের চাপে জানাতে পারেনি। আমার ড্রয়ারে একটা নতুন রহস্য উপন্যাস আছে। কালকেই বইপাড়া থেকে কিনে এনেছি। দেখো তো কেমন!’’

নিরুপমা উৎসাহিত হয়ে নন্দিনীর ঘরে গিয়ে ড্রয়ার থেকে বইটা হাতে নিলেন। গল্পের বইয়ের নেশা নন্দিনীই ধরিয়েছে। নইলে সারা জীবনে লক্ষ্মীর পাঁচালি ছাড়া কিছুই পড়া হয়নি।

নিরুপমা এই ক’বছরে ভুলেই গিয়েছেন নন্দিনী বৌমা, না কি নিজের মেয়ে!

বিকেলের আগেই ঝড় শুরু হয়েছে। চারদিকে ঘন অন্ধকারের মধ্যেই বিদ্যুতের ঝলকানি দেখা যাচ্ছে। ঝড়ের দাপটে দক্ষিণের জানলাটা দড়াম করে খুলে গিয়েছে। নিরুপমা দৌড়ে গিয়ে বন্ধ করল। এই জানলার ছিটকিনিটা ঠিক করে লাগে না। একটা দড়ি দিয়ে কড়াগুলো বেঁধে দিল। এই ঝড়ের সময়টা একটু ভয়ই করে নিরুপমার। পাঁচ বছর হল স্বামী পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছেন। একটা ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকেই শেষ। বাবলুর তখন বিয়ের এক বছরও পূর্ণ হয়নি। পুরো ব্যাপারটা সামলেছিল নন্দিনী। বাবলু অফিসের কাজে বিদেশে ছিল। ফিরতে দু’দিন সময় লেগেছিল। দু’দিন ধরে বরফ চাপা দিয়ে বডি ছিল।

সেদিনের পর থেকে নিরুপমা অদ্ভুত এক স্বাধীনতার স্বাদ পেলেন। সময়ে সময়ে খাবার, ওষুধ, যত্ন— এগুলো দেওয়ার বালাই থাকল না। নিরুপমার স্বামী ছিলেন রাশভারী মানুষ। তাঁর সব কিছু ছিল সময়ে বাঁধা। চাকুরিরত ছেলে-বৌমার উপর তাঁর কোন হুকুম খাটবে না, তিনি জানতেন। তারা ঘরে থাকে কতক্ষণ! তাই সব দায়ভার যেন নিরুপমার। শুধু হুকুম দেওয়ার ভার তাঁর।

স্বামীর মৃত্যুর পর নিরুপমা স্বাধীন হলেন বটে, কিন্তু তাঁর মধ্যের চিরকাল পরগাছা হয়ে থাকা মানুষটা একটা অবলম্বন চাইছিল। তাঁর নিজের কিছুই করার ক্ষমতা নেই। তিনি সামনের ছোট রাস্তা পেরোতে পারেন না। তিনি একা ব্যাঙ্কে গিয়ে স্বামীর পেনশন তুলতে পারেন না। ডাক্তার দেখাতে গেলেও তাঁর একজন সঙ্গী চাই।

ছেলে বরাবর একটু চুপচাপ। মাধ্যমিকের পর থেকে হস্টেলে মানুষ। বরাবর আত্মকেন্দ্রিক। বাপের মতো। নিরুপমা চিরকাল গুটিয়েই থেকেছেন। তিনি জেনে এসেছিলেন, মেয়েরা চিরকাল পরিবার সামলানো আর বংশরক্ষার কাজেই আসে। তা ছাড়া আর কী দরকার তাঁর এই পৃথিবীতে! কিন্তু নন্দিনী আসার পর সব কিছু উল্টোপাল্টা হয়ে গেল। নন্দিনীর সঙ্গেই প্রথম গঙ্গায় নৌকো চাপা। স্বামীকে সে কথা জানালে, বলেছিলেন, ‘‘বাহ্! মডার্ন বৌমা বেশ পাখা মেলতে শেখাচ্ছে। উড়তে গিয়ে আবার ধপাস করে পড়ে যেয়ো না।’’

কথাগুলোর মধ্যে বেশ ঝাঁঝ ছিল। রান্নাঘরে সেদিন অপ্রয়োজনে পেঁয়াজ কেটেছিলেন নিরুপমা। নন্দিনী পিঠের উপর হাত রেখে বলেছিল, ‘‘মা, সব কথা স্বামীকে বলতে নেই। সে কি তোমার প্রভু না কি?’’

‘‘হ্যালো, নন্দিনী! ঝড় শুরু হয়ে গিয়েছে। এখন একদম অফিস থেকে বেরবি না।’’

‘‘উফ্ মা! আমি জানি। চিন্তা কোরো না। তুমি ঠিক আছ? বুক ধড়ফড় করছে না তো?’’

এক বছর হল নিরুপমার হার্টের দোষ ধরা পড়েছে। যে-কোনও সময়ে তাঁর হদ্‌যন্ত্র বিকল হয়ে যেতে পারে। নিরুপমার হার্টের সেভেন্টি পারসেন্ট বিকল। বাইপাস সার্জারি প্রয়োজন। কিন্তু হাই শুগার, হাই প্রেশার। এই বয়েসে ডাক্তার রিস্ক নিতে পারছেন না। এত কথা নন্দিনী নিরুপমাকে বলেনি। কিন্তু নিরুপমা শুনেছেন। ছেলে-বৌমার আলোচনা থেকে।

ঠাকুরের কাছে রোজ একটু করে আয়ু ভিক্ষা চেয়ে নেন। নিজের জন্য নয়, একটা সম্পর্কের জন্য। জানেন তিনি যত দিন, তত দিনই তাঁর ঘরের লক্ষ্মী বাঁধা। বাবলু আর নন্দিনীর সম্পর্কটা তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত টিকবে। তার পর দু’জন দু’দিকে ছিটকে যাবে।

বাবলু আর নন্দিনী একে অপরকে পছন্দ করে সংসার পেতেছিল। দুই বাড়ির অমত ছিল না। দু’জনেই স্বাবলম্বী। নিরুপমার স্বামী কোষ্ঠী নিয়ে ঝামেলা করেছিল। কিন্তু সেটাও একদম রাজযোটক বেরল। বিয়েটা ঘটা করেই হয়েছিল। কিন্তু বিয়ের পাঁচ বছরেই সম্পর্কটা তেতো হয়ে গিয়েছিল। তার আভাস নিরুপমার অভিজ্ঞ চোখে ধরা পড়েছে।

নিজের অজান্তে মাঝরাতের চাপা গুঞ্জন কানে এসেছে, ‘‘নন্দিনী তোমার সঙ্গে আর পারছি না, এ বার মুক্তি দাও।’’ নন্দিনীর ভাঙা গলায় শুনেছেন, ‘‘আমি তো তোমায় ধরে রাখিনি ইন্দ্র! তোমার ইচ্ছে হলে দেশের বাইরেও চলে যেতে পারো।’’

আগেও বারকয়েক তেমনই শুনিয়েছিল ইন্দ্র, ‘‘স্টেটাস, লাইফ কি নেই ওই দেশে! কিন্তু পিছুটান থাকলে কি আর নিশ্চিন্তে যাওয়া যায়?’’

নিরুপমার সেই রাতে, কানের ভিতর নন্দিনীর একটা কথাই বাজছিল, ‘‘আমি মা-কে ছেড়ে কোথাও যেতে পারব না।’’

আগে একটা দাদুভাইয়ের স্বপ্ন দেখতেন নিরুপমা। ভুল ভেঙেছে। এখন বুঝে গিয়েছেন, এক ছাদের তলায় দুটো মানুষ থাকে শুধু। তাদের চাওয়া-পাওয়াগুলো আলাদা। কারণ জানতে চাননি কখনও। সে অভ্যেস নিরুপমার নেই।

ঝড় কখন থেমেছে, জানেন না নিরুপমা। কখন সন্ধ্যা ঘোর হয়ে এসেছে তাও জানেন না। কারেন্ট চলে গিয়েছে। চারিদিকে নিঝুম অন্ধকার। বেডরুম থেকে একটা ঝাপসা আলো দেখা যাচ্ছে। নিরুপমা সেদিকে এগিয়ে গেলেন। দরজাটা একটু ঠেলা দিতেই পুরোটা খুলে গেল। ভিতরে যত্ন করে চুল আঁচড়ে দিচ্ছেন নিরুপমার শাশুড়ি ননীবালা। ঠিক তিরিশ বছর আগে যেমন শক্তপোক্ত চেহারা ছিল ননীবালার, ঠিক তেমন। তখন নিরুপমা তিরিশের যুবতী। বাবলুর বয়েস চোদ্দো।

‘‘নিরু, চুল বাঁধার সময় এত নড়লে চুল বাঁধা যায় না। কী করে হল ঘাড়ের কাছে এই দাগটা?’’ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বললেন, ‘‘বিশু তোকে এখনও মারে? বলিসনি তো?’’

নিরুপমা চকিতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, ‘‘অনেক কাজ পড়ে আছে, এখন যাই মা। রাতের রান্নাটাও সারতে হবে।’’

‘‘বৌমা, আজ পনেরো বছর ধরে মার খেয়ে যাচ্ছিস, কোনও দিন একবারের জন্য বলিসনি মুখ ফুটে। কিন্তু আমি তো মা। সব বুঝতে পারি। বৌমা, তোকে একটা কথা বলব?...আমার বিশুকে ভালবাসিস?’’

নিরুপমা এর উত্তর কী দেবেন, বুঝতে পারেন না।

‘‘ভাল না বাসলে, এক ছাদের তলায় কী করে থাকবি সারাজীবন?’’

‘‘মেয়েরা পারে মা। মেয়েরা যে ছাদ ছাড়া থাকতে পারে না।’’

এই কথার অনেক মানে ছিল। ননীবালা কথা বাড়াননি। নিরুপমার শেষ কথায় নিজের অস্তিত্বের সঙ্কট প্রকট হয়ে উঠছিল।

অনেকক্ষণ ধরে ডোরবেল বেজে চলেছে। নিরুপমা চোখ রগড়াতে-রগড়াতে উঠে বসেছেন। কখন সোফায় বসে চোখ লেগে গিয়েছিল। শুধু এ ঘরের আলোটাই জ্বলছে। বাকি ঘর অন্ধকার। দরজা খুলতেই কেমন উদ্‌ভ্রান্ত দেখাচ্ছে নন্দিনীকে।

‘‘মা, তুমি ঠিক আছ তো?’’ বলে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছে।

নিরুপমা অবাক হয়ে গিয়েছেন, ‘‘কেন আমার আবার কী হল?’’

‘‘প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে বেল বাজাচ্ছি, তোমায় ফোন করছি, কোনও সাড়া নেই! এমনিতেই ফিরতে আজ দশটা বেজে গিয়েছে। রাস্তায় গাছ ভেঙে পড়েছে...’’ কথা বলতে বলতেই নিরুপমার ফোন নিয়ে নাড়াচাড়া করে বলে, ‘‘এ তো সাইলেন্ট মোডে রেখেছ!’’

নিরুপমা বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘‘এই এক ছাতার ফোন হয়েছে। কী করতে যে কী হয়ে যায়!’’ মনে-মনে অবাক হয়ে ভাবতে থাকেন, এতক্ষণ ঘুমিয়েছেন উনি!

কাঁধের ব্যাগ রেখে নন্দিনী সটান খাটে, বলছে, ‘‘আজ ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। এখনও বুকটা ধক ধক করছে, দেখো!’’ বলে নিরুপমার হাতটা নিজের বুকের উপর রাখে ।

নিরুপমা মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলেন, ‘‘আজ যদি সত্যি মরে যেতাম, কী হত?’’

‘‘বাজে কথা বলবে না। মরলেই হল? আমাদের বিকিনি পরে সমুদ্রে ঘোরার কথা ভুলে গেলে না কি?’’

‘‘এই, তুই কিন্তু বড্ড ফক্কড় হয়েছিস। দাঁড়া এ বার বাবলু ফিরুক, তোর নালিশ করছি।’’

নন্দিনী বাথরুমে ঢুকে জোরে কল খুলে দিয়েছে। মাথার উপর শাওয়ারের শীতল জলরাশি মাথা বেয়ে শরীর ভিজিয়ে দিচ্ছে। এই জলের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে নন্দিনীর চোখের নোনা জল।

ইন্দ্র কোনও দিনই ফিরবে না। কানাডায় অফিসের ফ্ল্যাট, গাড়ি পেয়েছে। বড় প্রোমোশন। কয়েক মাসের মধ্যে দু’জনের মিউচুয়াল ডিভোর্সটাও হয়ে যাবে। ইন্দ্র মা-কে নিয়ে যাবে না। কারণ হার্টের যা কন্ডিশন, রিস্ক নেবে না। এখানকারই এক বৃদ্ধাশ্রমের সঙ্গে কথা বলেছে। খুব ভাল ব্যবস্থা।

নন্দিনী এক প্রস্থ ঝগড়াই করেছিল, ‘‘আজ দশ বছর পর তোমার মনে হল ডিভোর্সের কথা? এই ক’বছর ধরে একজন ঝিয়ের দরকার ছিল তোমার, যে তোমার মা-কে দেখবে, তোমার পারিবারিক সম্মান বজায় রাখবে। আর যখন কলকাতা ছাড়ছ, কানাডায় নতুন ভাবে জীবন শুরু করবে, তখন আমায় ছেঁটে ফেললে?’’

কথাগুলো বলে নিজের মনেই ভয় পেয়েছিল, মা শোনেনি তো! নিরুপমা তখন পাশের বাড়িতে নামসঙ্কীর্তন শুনতে গিয়েছিলেন।

অন্ধকার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দু’জনে আকাশের তারা গুনছে। নিরুপমা বলেন, ‘‘নন্দিনী, কানাডায় এখন দিন না রাত রে?’’

নন্দিনীর চার দিক আজ বড় বেশি অন্ধকার লাগছে, সে বলে, ‘‘তুমি যাবে?’’

‘‘পাগল না কি! আমি আমার মেয়েকে ছেড়ে কোথায় যাব? কী রে, আমায় ছাড়তে পারবি?’’

‘‘আমি যদি এই বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যাই? যাবে আমার সঙ্গে?’’

‘‘তোর টাইফয়েডের সময়, হসপিটালে সারা রাত তোর পাশে থাকিনি?’’

অনেক দুঃখেও ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল নন্দিনীর।

‘‘মরতে চাই না আমি। তোর সঙ্গে বাঁচতে চাই।’’

নন্দিনী তলিয়ে যাচ্ছে মায়ের বুকে। ছোট্ট একটা নীড়। সেখানে এত মায়া, মমতা, ভরসা, ভালবাসা!

ঝড় এলেও এই নীড় কিছুতেই ভেঙে পড়বে না।

অন্য বিষয়গুলি:

Neer Short Story
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy