Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
Junir Janmodine

জুনির জন্মদিনে

রঙের স্কার্ট। কালো টপ। চুলগুলো অযত্নে বাঁধা। এই ড্রেসটাই তো পরে ছিল হারিয়ে যাওয়ার আগে। ওর জন্যই অপেক্ষা করছিল নীলাঞ্জন?

ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০২০ ২২:৪৪
Share: Save:

আজ লক্ষ্মীপুজো। পড়েছেও বৃহস্পতিবার। বাজারে জিনিসের দাম বেশ চড়া। মনে-মনে একটু বিরক্ত হল মোহনা। চার পুরুষের সোনার লক্ষ্মীপ্রতিমা ওদের বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত। তাই একটু ঘটা করে পুজো করতে হয় প্রতি বার। আসল পুজোর বাজার দারোয়ান করে নিয়ে গেছে। একটু হাঁটার জন্য ছুতো খুঁজে মোহনা এসেছে বাকি টুকিটাকি কিনবে বলে। চাঁদমালা, কলাপাতার নৌকোর মতো কিছু কিছু। হাঁটতে ভালই লাগে তার। কলকাতার বাতাসে বিষ। তাও পুজো-পুজো গন্ধের এই সন্ধেগুলো বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে ইচ্ছে করে। আজকাল দুর্গাঠাকুর বিসর্জন অনেক দেরিতে হয়। লক্ষ্মীপুজো অবধি যেন আলো-আলো রং মেখে থাকে রাস্তাঘাট। আর তা ছাড়া ঘরে ফেরা মানেই তো দুটো ভূতের মতো মানুষ, দুটো আলাদা ঘরে বসে থাকা। নিয়ম করে খাওয়া, শোওয়া, ওষুধের ফিরিস্তি। এর পর আছে রাত গভীর হলেই নীলাঞ্জনের ওই ভয়ানক নেশা। দমবন্ধ হয়ে আসে মোহনার। অথচ দিনের বেলা একদম স্বাভাবিক সব কিছু। দিব্যি ইউনিভার্সিটি যাচ্ছে, প্রবন্ধ লিখছে, সভা-সমিতি করছে। জুনি চলে গিয়ে ব্যবধানের পাঁচিল যেন একেবারে পাহাড়ের মতো উঁচু করে দিয়ে গেল দুজনের মধ্যে। মানুষটাই অন্য রকম হয়ে গেল কেমন!

*****

শাড়িটা পরে শেষ বার নিজেকে আয়নায় দেখে নিল মোহনা। সাদা জামদানির ওপর সাদা কাজ। গলায় নাকে কানে হিরের কুচির চিকমিক। হাতে সোনার হালকা একটা নোয়া। কত জাঁকজমক হত আজকের দিনটায়। মানে জুনির জন্মদিনে। শুধু যে-বছর জুনি চলে গেল, সেই বছর নীলাঞ্জনকে ভিজ়িটিং প্রোফেসর হিসেবে যেতে হয়েছিল বিদেশে। সেই বছরটাই কেবল আয়োজন করা হয়নি কিছু। মোহনা তখন জন্মদিনের উপহার হিসেবে বাঁকুড়ার গ্রামে মেলা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল জুনিকে। আর ফেরেনি জুনি। মোহনা একা ফিরে এল। মেয়েটা চলে যাওয়ার পর থেকে নীলাঞ্জন আজকের দিনে আড়ম্বর কমিয়েছে ঠিকই, কিন্তু উদ্‌যাপন বন্ধ হয়নি। গুটিকয়েক খুব কাছের লোক এখনও আসে। নীলাঞ্জন পছন্দের উপহার কিনে জমিয়ে রাখে জুনির ঘরের আলমারিতে। তেরো বছর হয়ে যাবে এ বার। তবু জুনি নেই এখনও মানে না নীলাঞ্জন। মোহনা বহু বার বলেছে, “এ সব বন্ধ করো। কী পাগলামি করে যাচ্ছ এতগুলো বছর ধরে?” নীলাঞ্জন চুপ করে থাকে। যে-প্রশ্নের উত্তর প্রতিবাদ, সে-উত্তর নীলাঞ্জন দেয় না মোহনাকে। যে দিন মোহনা বলেছিল, জুনি তো বড় হয়ে গেছে, তাই এ বার সে চাকরি করতে চায়, সে দিনও চুপ করে ছিল নীলাঞ্জন। চুপ করে থাকারই কথা। বিয়ের সময় চাকরি না করার অলিখিত শর্তই তো দিয়েছিল নীলাঞ্জন। আরও শর্ত ছিল, কোনও দিন জুনি ছাড়া আর কেউ আসবে না তাদের জীবনে। মোহনা তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপত্নীক প্রফেসরটির প্রেমে এক্কেবারে অথৈ জলে। আগুপিছু না ভেবেই রাজি হয়ে গিয়েছিল। নীলাঞ্জন যে তাকে ভালবাসেনি, এমন নয়। জুনিও খুব ভালবাসত। ইউনিভার্সিটির গেটে ওড়না টেনে ধরত— “আজ তুমি বাড়ি যাবে না মোহনাপিসি, আমাদের সঙ্গে পার্কে চলো, আমাদের সঙ্গে মেলায় চলো।” এ রকম কত আবদার। মোহনা জানত, নীলাঞ্জনকে পেতে হলে জুনিকে পেতে হবে আগে। মৃদু হেসে আর্তি-মাখা চোখে তাকাত নীলাঞ্জনও। কী সুখ, কী সুখ! এমন ভালবাসার জন্যই তো অপেক্ষায় ছিল মোহনা।

আজ মোহনাদের লাশকাটা ঘরের মতো নীরব বাড়িটাকে যেন বদলে দিয়েছিল নীলাঞ্জন। হাসিখুশি অন্য মানুষ। অতিথিরা সবাই চলে গেছে এখন। দেয়ালে জুনির একটা বিশাল ল্যামিনেশন করানো ফটো। যে বছর চলে গেল জুনি, তার আগের বছর, মানে ওর ষোলো বছরের জন্মদিনে বাড়িতে ফোটোগ্রাফার ডেকে তুলিয়েছিল নীলাঞ্জন। হলুদ রঙের ড্রেসটায় যেন সূর্যমুখী ফুলের মতো উজ্জ্বল হয়ে আছে মেয়েটা। নীলাঞ্জনের চোখ এক বার ফোটোর দিকে, আর এক বার দরজায়। লক্ষ করেছে মোহনা।

“কী দেখছ দরজায় অত বার করে?” চাপা স্বরে বলে মোহনা।

“আসবে বলেছিল আজকে...” বিড়বিড় করে নীলাঞ্জন।

“কে আসবে?” বলতে বলতেই দরজার দিকে চোখ স্থির মোহনার।

ও কে ঢুকছে দরজা দিয়ে? তেরো বছরে আরও যেন ফর্সা হয়েছে জুনি। তবে বড্ড ফ্যাকাশে। খুব রোগা লাগছে। পা অবধি কামরাঙা

রঙের স্কার্ট। কালো টপ। চুলগুলো অযত্নে বাঁধা। এই ড্রেসটাই তো পরে ছিল হারিয়ে যাওয়ার আগে। ওর জন্যই অপেক্ষা করছিল নীলাঞ্জন? জুনি ওকে জানিয়েছিল যে, সে আসবে? কী করে সম্ভব? মোহনাকে আগে কিছু বলেনি কেন নীলাঞ্জন? দৌড়ে গিয়ে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরল বাবা। অন্য দিকে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল হতবাক মোহনা।

*****

জ্ঞান যখন ফিরল, মোহনা দেখল সে নিজের ঘরে শুয়ে আছে ।

পুরনো ডায়েরি হাতড়ে নম্বর খুঁজে চাপা গলায় হরিয়াকে ফোনটা করল সে। ভাগ্যিস নম্বরটা বদলায়নি।

“তুমি ঠিক বলছ?”

“আরে হাঁ ম্যাডামজি। যে ভাবে বলিয়েছিলেন, সেই ভাবেই হয়েছিল কাম। শুধু একটু বাড়াবাড়ি করেছিল ছেলেরা। তা উসব কি আর আমার হাতে থাকে?”

“কী বাড়াবাড়ি?”

“ছোড়িয়ে ম্যাডামজি, লেকিন ইতনা সাল বাদ এ সব বাত কেন? কুছ প্রবলেম?”

বলতে গিয়েও থমকে গেল মোহনা। সেলফোনটা হাতে ধরা। দরজায় দাঁড়িয়ে জুনি।

কিন্তু হরিয়া যদি সত্যি বলে থাকে, তা হলে তো জুনি...

“কেমন আছ, মোম?”

জুনি মোহনাকে মা বলেনি কোনও দিন। ‘মোম’ বলে ডাকত ওদের বিয়ের পর। কত বার হাত ধরে বলেছিল দু’জনকে, “তোমরা বর-বৌ হোয়ো না। মোহনাপিসি আর বাবা থাকো।” বাচ্চা মেয়ের কথায় অত পাত্তা দেয়নি কেউ। বরং সুন্দরী শান্ত শিক্ষিতা অল্পবয়সি মোহনাকে দেখে নীলাঞ্জনের আত্মীয়দের সবার ভাল লেগেছিল। জুনির এক জন মা আসছে, এতে সবাই শান্তি পেয়েছিল।

শুধু যে মোহনাপিসি জুনির এত প্রিয় ছিল, বিয়ের পরদিন থেকেই আমূল বদলে গেল সম্পর্কটা। মোহনার সঙ্গে ঠিকমতো কথা বলা বন্ধ করে দিল জুনি। অসহযোগিতা সব বিষয়ে। যত বড় হচ্ছিল, নানা ভাবে হেনস্থা শুরু করল মোহনাকে। নীলাঞ্জন ব্যস্ত মানুষ। মেয়ের উপর অন্ধবিশ্বাস। কিছু বোঝাতে গেলে মোহনার সঙ্গেই তিক্ততা বেড়ে যেত বার বার। বড্ড একা আর কোণঠাসা হয়ে পড়ছিল মোহনা। অতীত থেকে ফিরে আসতেই দরদর করে ঘাম নেমে আসছে মোহনার কপাল বেয়ে। জুনি এসে হাতটা ধরেছে তার। বরফের মতো ঠান্ডা একটা অনুভূতি ছড়িয়ে গেল শরীর জুড়ে।

জুনি কথা শুরু করে, “বাবা বিদেশে গেল আর আমাকে জন্মদিনে প্রায় জোর করেই গ্রামের মেলা দেখাবে বলে বাঁকুড়া নিয়ে গেলে। তোমাদের বিয়েটা হোক আমি চাইনি। ভেবেছিলাম বাবা না বুঝলেও তুমি আমার কথা রাখবে। তাই তোমার ওপর অনেক বেশি অভিমান ছিল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তো ভালবাসতাম তোমায়। তাই বেশি আপত্তি করিনি তোমার সঙ্গে একা বেড়াতে যেতে। তুমি তো তখন ডিপ্রেশনের অসুধ খাও না নিয়মিত। মাথাও ঠিকমতো কাজ করত না তোমার। ওদের হাতে আমায় তুলে দিয়ে এক বারও পিছন ফিরে তাকাওনি তুমি মোম।”

মনে পড়ে যাচ্ছে সব কিছু মোহনার। রাগে-কষ্টে পাগল হয়ে আছে সে তখন। ডিপ্রেশনের ওষুধ দিয়েছিল ডাক্তার। মোহনা খেত না। নীলাঞ্জন ব্যস্ত নিজের জগতে। খেয়াল রাখার মতো সময় তার নেই। মা-বাবাও বেঁচে নেই তখন আর। একটু মায়া কেউ কোথাও জমিয়ে রাখেনি মোহনার জন্য। নিজের কেরিয়ারের ইতি, মা হতে না পারা, জুনির অপমান, নীলাঞ্জনের সঙ্গে দূরত্ব— সব যেন শেষ করে দিচ্ছিল মোহনাকে। জুনিকে দেখলেই রক্ত গরম হয়ে যেত ওর। মনে হত, যে বিয়েটা ওর সুখের ঠিকানা হতে পারত, সেটাকে বিষিয়ে দিল এই মেয়ে। ঠিক এমন সময়ে খোঁজ পেয়েছিল হরিয়ার ।

টাকার বিনিময়ে তাকে দিয়ে কাজটা করিয়েছিল মোহনা। জুনিকে শেষ করার সুপারি দিয়েছিল ওকে। সে জন্যেই বাঁকুড়া যাওয়া, যাতে কেউ কিচ্ছুটি টের না পায়।

“ওরা আমায় মেরেছিল মোম। তার আগে সবাই মিলে ছিঁড়ে খেয়েছিল দু’দিন ধরে। ব্যথায় আমি নড়তে পারছিলাম না। তার পর যখন ছুরি দিয়ে বার বার কুপিয়ে দিচ্ছিল আমার শরীর, মনে হচ্ছিল সেটা অনেক বেশি শান্তির। আমার গলায় পাথর বেঁধে নদীতে ফেলে দিচ্ছিল দেহটা, তখনও একটু একটু প্রাণ ছিল আমার। বাবিকে আমি সব বলে দিয়েছি মোম। বাবি তো রোজ প্ল্যানচেটে কথা বলে আমার সঙ্গে। আমি তেরো বছর কমপ্লিট না হলে আসতে পারছিলাম না। তুমি তেরো তারিখ শুক্রবার হলে ভয় পেতে, মনে আছে? দেখো, রাত বারোটা বেজে গেছে। আজ ফ্রাইডে দ্য থার্টিন্থ।”

অপার বিস্ময়ে তাকিয়ে মোহনা। নীলাঞ্জন তাকে কোনও দিন কিচ্ছুটি বলেনি। জুনি চলে যাওয়ার পর থেকে ওই যে রোজ রাতে এক মিডিয়াম ধরে এনে প্ল্যানচেটের নেশা, সেই নিয়েও কখনও কিছু শেয়ার করেনি। রোবটের মতো মোহনার সব দায়িত্ব বহন করে গেছে এতগুলো দিন ধরে। ভীষণ শান্ত গলায় কথা বলেছে রোজ। শুধু একটু খটকা লাগত মোহনার। বাঁকুড়া থেকে ফিরে এসে সে সবাইকে বলেছিল, মেলার ভিড়ে হারিয়ে গেছে জুনি। মোহনাকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে ছৌ-নাচ দেখতে গিয়ে নাকি জুনি আর ফিরে আসেনি। যদিও কাজটা করে ফেলার পর হাহাকার জমে উঠেছিল মোহনার বুকে। কিন্তু ভুল শুধরে নেওয়ার উপায় ছিল না আর। ধীরে ধীরে অভিনয় দিয়ে সামলে উঠেছিল মোহনা। কিন্তু খুব অদ্ভুত ব্যাপার, বিদেশ থেকে ফিরে প্রথম কয়েকদিন ছাড়া জুনির নিখোঁজ হওয়া নিয়ে খুব বেশি প্রশ্নও করেনি নীলাঞ্জন। প্ল্যানচেট শুরু করার পর পুলিশ কেসও তুলে নিল। জুনির কথা খুব কম বলত মোহনার সঙ্গে। এক দিনও প্ল্যানচেটের ঘরে ডাকেনি মোহনাকে। তা হলে কি এতগুলো বছর শুধু ইচ্ছে করেই সত্যিটা জেনেও চুপ ছিল নীলাঞ্জন? যদি মোহনা ভেঙে পড়ে এক দিন নিজে থেকেই সব অপরাধ স্বীকার করে নেয়, তার অপেক্ষায় বসে ছিল শিকারি বেড়ালের মতো? এত শীতলতা, এত ঘেন্না কেউ পুষে রাখতে পারে কারও জন্য? শিউরে ওঠে মোহনা। জীবন্ত লাশ জুনির চেয়েও ওর যেন অনেক বেশি ভয় করছে রক্তমাংসের নীলাঞ্জনকে।

দরজার পর্দাটা হঠাৎই নড়ে ওঠে। নীলাঞ্জন দাঁড়িয়ে। অন্ধকারে ওর সাজানো দাঁতের সারি ঝিকমিকিয়ে উঠছে। ওই হাসি দেখে এক দিন প্রেমে পড়েছিল মোহনা, জীবন তোলপাড় করে বন্যার মতো এসেছিল সে প্রেম। আজ খুব ভয় করছে সেই হাসির নিষ্ঠুরতা দেখে। এগিয়ে আসছে নীলাঞ্জন মোহনার দিকে।

মাথাটা আবার ঝিমঝিম করছে মোহনার। জুনি আর নীলাঞ্জন, দু’জনেই মুছে যাচ্ছে ধীরে ধীরে চোখের সামনে থেকে।

দু’দিন পর খবরের কাগজে খবর বেরোল— ‘স্বনামধন্য অধ্যাপক এবং সুলেখক নীলাঞ্জন রায় নিজের বাড়িতে অতিরিক্ত মাত্রায় ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন। ওঁর স্ত্রী মোহনা দীর্ঘদিন ধরেই মানসিক রোগে ভুগছিলেন, তিনিও নিখোঁজ। ঘটনাটি তদন্ত করছে কলকাতা পুলিশ।’

ছবি: সৌমেন দাস

অন্য বিষয়গুলি:

Junir Janmadine Short Story
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy