Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
Short story

বৃশ্চিকবৃত্ত

দেখে নিতে হবে হাতেকলমে। ল্যাপটপ, ফোন, আর্মস, এগুলো সব আজ বিকেলেই হাতে পেয়েছে। কাজে নামার আগেই সব ঝালিয়ে নেওয়া দরকার।

সুপ্রিয় চৌধুরী
শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৬:৪৭
Share: Save:

দিনের শেষে গোটাকয়েক পচাফাটা লাশ নিয়ে গিয়ে কাঁটাপুকুর নয়তো পিজির মর্গে ফেলা। দিক ধরে গেল শালা এই ফালতু জিন্দেগিতে। জানলা দিয়ে ঝুঁকে রাস্তায় গুটখার পিক ফেলতে যাবে, তখনই বুকপকেটে মোবাইলটা বেজে উঠল হিমেশ রেশমিয়া শুনিয়ে। পিক ফেলে ফোনটা ধরে কানে লাগাতেই লাইনের ওপারে মজিদসাহেবের গাঁকগাঁক চিৎকার, “আরে উল্লুকের ব্যাটা বেল্লিক! কোন চুলোয় আছিস তুই? রুদ্রস্যর ফিরে এসেছেন। তোকে খুব দরকার। চলে আয় এক্ষুনি!” কেটে গেল লাইনটা। আনন্দেও লোকে থরথর করে কাঁপে। ঠিক সেই ভাবেই কাঁপতে কাঁপতে কোনও রকমে মোবাইলটা বুকপকেটে ঢোকাল তারক। পরক্ষণেই চোখ গেল বাংলোর গেটের দিকে। এখনও বেরোচ্ছে না কেন শালা ডোমদু’টো? ভাবতে ভাবতেই খুলে গেল কারুকাজ করা দামি কাঠের দরজাটা। মর্গের ডোম রাজুয়া আর ছোটু, দু’জনে মিলে সাদা কাপড়ে মোড়া একটা লাশ নিয়ে আসছে ধরাধরি করে। সঙ্গে কনস্টেবল বীরেন মাইতি।
বাংলোর ব্যালকনিতে ক্রন্দনরত বাড়ির লোকজন। ছুটে গিয়ে হাট করে ভ্যানের দরজাটা খুলে দিলো তারক, “ঢোকা জলদি!”

“কা হুয়া তারকভাইয়া? ইতনা জলদি কাহে কো?” হেসে প্রশ্ন করল রাজুয়া।

“আমার বাপ এসেছে হেডকোয়ার্টারে,” কটমট করে রাজুয়ার দিকে তাকাল তারক। “লাশটা মর্গে জমা করেই ছুটতে হবে সেখানে। বুঝেছিস বুরবাক? জলদি গাড়িতে ওঠ!” ছুটে গিয়ে ড্রাইভারের সিটে বসে তারক। ভোঁ-ও-ও স্টার্ট দেওয়ার শব্দ। একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বেরিয়ে গেল মর্গের লজ্‌ঝড়ে ভ্যান।

দুপুর সোয়া বারোটা। বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিটের এ পার থেকে ও পার সাজিয়ে রাখা লোহার ব্যারিকেড। জলকামান আর অনেকগুলো প্রিজ়ন ভ্যান দাঁড়িয়ে লাইন দিয়ে। কাঁদানে গ্যাসের বেঁটে বেঁটে বন্দুক আর ঢাল হাতে বিশাল পুলিশ-বাহিনী। র‌্যাফ, স্পেশ্যাল কমব্যাট ফোর্স... সব মিলিয়ে পুরোদস্তুর যুদ্ধ পরিস্থিতি! একটু বাদেই এসে পৌঁছবে প্রধান বিরোধী দলের মিছিলটা। এখানেই আটকাতে হবে সেটাকে। রাস্তাঘাট থমথমে, ফাঁকা। পুলিশের গাড়িগুলো ছাড়া যানবাহনের চিহ্নমাত্র নেই। ব্যারিকেডের এক কোণে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল সুনীল। স্পেশ্যাল কমব্যাট ফোর্সের কনস্টেবল সুনীল যাদব। দৈত্যাকৃতি চেহারা। নজর দূরে, ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার মোড়ে। কখন মিছিলটা বাঁক নেয় মোড়ের মাথায়। এমন সময় বুকপকেটে সাইলেন্ট অ্যান্ড ভাইব্রেশন মোডে থাকা মোবাইলের কম্পন। বের করতেই স্ক্রিনে মজিদসাহেবের নম্বর। কানে তুলে মিনিটদুয়েকের কথা। মুহূর্তে টান টান সুনীলের শরীরী ভাষা! “মিছিলটা সামলেই এসে রিপোর্ট করছি স্যর!” দূরে মোড়ের মাথায় বাঁক নিচ্ছে বিশাল মিছিলটা। লাইনটা ছেড়ে দিল সুনীল।

বিকেল তিনটে। পুলিশ ট্রেনিং স্কুলের বিশাল প্র্যাকটিস গ্রাউন্ড। মাঠের মাঝখানে দোজো, মানে মার্শাল আর্টের রিং। দোজোর চারপাশে গোল হয়ে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে থাকা শিক্ষার্থীরা। সবার পরনে মার্শাল আর্টের ঢোলা সাদা পোশাক বা ‘গি’। কোমরে বাঁধা বিভিন্ন রঙের মোটা কাপড়ের বেল্ট। দোজোর মাঝখানে এসে দাঁড়াল এস আই সন্তোষী তামাং। ফর্সা ছিপছিপে চেহারা। উচ্চতা টেনেটুনে বড়জোর পাঁচ ফুট এক কি দুই। একই রকমের পোশাক পরনে। কোমরে রিভার্স নট কায়দায় বাঁধা কালো বেল্ট। সন্তোষী। এই পুলিশ স্কুলের কমব্যাট ট্রেনার। শিক্ষার্থীরা সবাই জাপানি কায়দায় মাথা ঝুঁকিয়ে বাও করল তাদের ট্রেনারকে। একই কায়দায় প্রত্যুত্তর দিল সন্তোষী।

“জেমস!” দোজোর মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাঁক দিল সন্তোষী। উঠে এল জেমস মান্ডি। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেরা। জঙ্গলমহলের জনজাতিভুক্ত ছেলে। হাইট কমসে কম পাঁচ ফুট দশ কি এগারো। ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। পাথরে কোঁদা শরীর। ঢোলা পোশাকের আড়াল থেকেও যেন ফেটে বেরোচ্ছে পেশিগুলো। রিঙের মাঝখানে এসে সন্তোষীর মুখোমুখি দাঁড়াল জেমস। ফের এক বার জাপানি কায়দায় পরস্পরকে ‘বাও’ করল দু’জন।

“কাম অন জেমস,” হাতের ইশারায় প্রতিদ্বন্দ্বীকে সমরে আহ্বান করল সন্তোষী। খাঁচা থেকে ছাড়া পাওয়া বাঘের মতো সন্তোষীর দিকে এগিয়ে এল জেমস। একে অপরকে তাক করে চক্রাকারে রিংয়ের মধ্যে ঘুরতে লাগল দুই যোদ্ধা। ঘুরতে ঘুরতেই সন্তোষীর শরীর লক্ষ্য করে বার বার ছুটে আসছিল জেমসের মারাত্মক ‘কিক অ্যান্ড পাঞ্চ’গুলো। প্রতি বারই নিপুণ দক্ষতায় একদম শেষ মুহূর্তে মারগুলো এড়িয়ে যাচ্ছিল সন্তোষী। ক্রমশ হতাশ হচ্ছিল জেমস। আর সেই হতাশা ক্রমাগত পরিণত হচ্ছিল অন্ধ ক্রোধে। বার বার ব্যর্থ হতে হতে এক সময় ধৈর্যের সব বাঁধ ভেঙে গেল জেমসের। খ্যাপা মোষের মতো সন্তোষীর দিকে তেড়ে এল জেমস। ওর বিশাল শরীরটার আড়ালে যেন ঢাকা পড়ে গেল সন্তোষী। আর ঠিক তখনই সেই চরম মুহূর্ত! ডান হাতের কনুইটা দিয়ে জেমসের বুক আর পেটের ঠিক মাঝখানে সোলার প্লেক্সাসের জায়গাটায় হাতুড়ির মতো আঘাত হানল সন্তোষী। ব্যস! ওই একটা মারেই ফুসফুস থেকে সব হাওয়া বেরিয়ে গেল জেমসের। বিশাল শরীর হালকা হয়ে গেল তুলোর মতো। পায়ের তলায় মাটি নেই যেন। কাঁধের ওপর দিয়ে নিখুঁত জুডোর প্যাঁচে জেমসকে মাটিতে আছড়ে ফেলল সন্তোষী। পরমুহূর্তেই পাক্কা মার্শাল আর্ট যোদ্ধার কায়দায় হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল জেমসের বুকের ওপর। মুষ্টিবদ্ধ ডান হাত তাক করা জেমসের মুখে। মাটিতে শুয়ে বেদম হাঁপাচ্ছিল জেমস। হাপরের মতো ওঠানামা করছিল বুকটা। ওকে স্বাভাবিক হতে সময় দিল সন্তোষী।
“আর ইউ ওকে জেমস?”

“ইয়েস ম্যাডাম,” হাঁপাতে হাঁপাতে ঘাড় নাড়ল জেমস। মাটি ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সন্তোষী। আস্তে আস্তে জেমসও। বাকি শিক্ষার্থীদের দিকে ঘুরে তাকাল সন্তোষী। তার পর বলল, “প্রাচীন কালে চিনের শাওলিন মার্শাল আর্ট যোদ্ধারা এই টেকনিকটাকে বলতেন ‘ইয়ান’ আর ‘ইন’। ইয়ান মানে শান্ত সমুদ্রের জল আর ইন মানে ভয়ঙ্কর ঢেউ। শত্রু আক্রমণ করলে প্রথমে তাকে শান্ত জলের মতো ভিতরে আসতে দাও। তার পর ভয়ঙ্কর ঢেউ হয়ে তাকে শেষ আঘাতটা করো। বুঝেছ সবাই?”

“ইয়েস ম্যাডাম!” প্রত্যুত্তর দিল শিক্ষার্থীরা।

এই সব কথার ফাঁকে রিংয়ের পাশে এসে দাঁড়াল এক ডিউটি কনস্টেবল, “অফিসে আপনার ফোন এসেছে ম্যাডাম।”

“তোমরা প্র্যাক্টিস করো, আমি আসছি এখনই,” শিক্ষার্থীদের নির্দেশ দিয়ে রিং ছেড়ে বেরিয়ে এল সন্তোষী। এক ধারে রাখা কিটব্যাগটা খুলে তোয়ালেটা বের করে হাতমুখ মুছতে মুছতে এগিয়ে গেল অফিসের দিকে।

রিসেপশন টেবিলে ক্রেডল থেকে নামিয়ে রাখা ল্যান্ডলাইনের রিসিভার। ফোনটা তুলতেই অনেক দিন আগে শোনা এবং ভীষণ চেনা সেই গম্ভীর গলার আওয়াজ, “আমি কলকাতায় এসেছি সন্তোষী। একটা স্পেশ্যাল মিশনে। এই মিশনে তোমার হেল্প চাই আমার। হেডকোয়ার্টার থেকে প্রায়র ইন্টিমেশন লেটার তোমার ডিপার্টমেন্টে পৌঁছে যাবে কালকেই। তুমি কাল ফার্স্ট আওয়ারেই হেডকোয়ার্টারে এসে আমাকে রিপোর্ট করো। ও কে?”

“ও কে স্যর।”

কেটে গেল লাইনটা।

রিসিভারটা ক্রেডলে নামিয়ে রেখে অফিসঘর থেকে বেরিয়ে এল সন্তোষী। মুখে কিঞ্চিৎ চিন্তার ছাপ। সেই দু’-তিন বছর আগে তো সব কিছু ছেড়েছুড়ে চলে গেছিলেন রুদ্রস্যর। এ ভাবে হঠাৎ ফিরে এলেন কেন? ই‌জ় দেয়ার সামথিং ভেরি সিরিয়াস? সেই অন্বেষা মিত্র কেসটার চেয়েও? হায়ার সেকেন্ডারির স্কুলছাত্রী অন্বেষাকে ধর্ষণ করার জন্য তুলে নিয়ে যায় বড়লোকের চারটে বখাটে ছেলে। তার আগেই মৃত্যু হয় মেয়েটির। এর ঠিক আগে বাংলার একটা নটোরিয়াস গ্যাংয়ের সঙ্গে গুলির লড়াইয়ে মারা যায় রুদ্রস্যরের টিমের কনস্টেবল গোপাল। অত্যন্ত ডাকাবুকো আর দুঃসাহসী গোপালের রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে টিমে ঢুকেছিল সন্তোষী। ও রকম এক জন লোকের বদলে একটা মেয়ে? দ্বিধা ছিল টিমে সবার মনে। অনেক লড়াই করে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হয়েছিল। সল্ভড হয়েছিল অন্বেষা মিত্র মার্ডার কেস। সন্তোষীর ওপর টিমের সবার ভরসা বেড়ে গেছিল কয়েক গুণ। সবচেয়ে বেশি রুদ্রস্যরের। সন্তোষীর ভাল লাগছিল ভেবে যে, ওর ওপর সেই ভরসাটা আজও রয়েছে স্যরের। এত দিন পর হেডকোয়ার্টারে ওকে ডেকে পাঠানোর ব্যাপারটা সেটাই প্রমাণ করে। কাল ফার্স্ট আওয়ারেই পৌঁছে যেতে হবে। ট্রেনিং গ্রাউন্ডের দিকে দ্রুত পা চালাল সন্তোষী তামাং।

দক্ষিণ কলকাতার পুলিশ গেস্ট হাউসটার ছোট ওয়ান রুম ফ্ল্যাট। সিঙ্গল বেডের ওপর এ দিক-ও দিক ছড়ানো প্রচুর জিনিসপত্র। জামাকাপড়, মিনারেল ওয়াটারের বোতল, একটা স্মার্টফোন, অ্যাশট্রে, সিগারেটের প্যাকেট, লাইটার, একটা নাইন মিলিমিটার পিস্তল, একটা পয়েন্ট থ্রি টু কোল্ট রিভলভার। সারা ঘর সিগারেটের ধোঁয়ায় ধোঁয়াময়। বিছানার মাঝখানে উপুড় হয়ে থাকা রুদ্র। পরনে ট্র্যাকস্যুট। সামনে খোলা ল্যাপটপ। রুদ্রর চোখ ল্যাপটপের স্ক্রিনে। অনেক দিন অভ্যেস নেই, ফলে ঝালিয়ে নিতে হচ্ছে ভাল রকম। বিকেলবেলা হেডকোয়ার্টার থেকে এখানে এসেই বসে পড়েছে যন্ত্রটা নিয়ে। কাল থেকেই এটার কাজ যাবে বেড়ে। প্রচুর ডেটা, ডকুমেন্টেশন, মেল, প্রিভিয়াস এনকোয়ারি রিপোর্টের সফ্‌ট কপিতে ভরে যাবে ডেটাবেস। ল্যাপটপের নীচে ডিজিটাল টাইমারটার দিকে তাকাল রুদ্র। রাত ন’টা বেজে দশ। আজকের মতো অনেক কাজ হয়েছে এটা নিয়ে। মোটামুটি সড়গড় হয়ে এসেছে ব্যাপারটা। যন্ত্রটা বন্ধ করে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল রুদ্র। দু’টো আগ্নেয়াস্ত্রর মধ্যে প্রথমে হাতে তুলে নিল রিভলভারটা। কোল্ট পয়েন্ট থ্রি টু। বরাবরই ওর খুব পছন্দের অস্ত্র। ব্যারেল আনলক করে বুলেট চেম্বারের মধ্যে নজর চালাল ভাল করে। নাঃ, একদম স্মুদ আছে বুলেট হোলগুলো। কোথাও অসমান কিছু নেই। রিভলভারটা বিছানায় রেখে তুলে নিল পিস্তলটা। ব্যারেলের পাশে বোতামে চাপ দিতেই হড়াত করে খুলে এল ম্যাগাজ়িন। ফের ভেতরে ঢুকিয়ে দু’হাতের শক্ত মুঠোয় ধরে নাক বরাবর তুলে ধরল অস্ত্রটা। ঠিকঠাকই আছে এম পয়েন্ট টিপটা। কাল সময় পেলে চাঁদমারিতে গিয়ে ভাল করে

দেখে নিতে হবে হাতেকলমে। ল্যাপটপ, ফোন, আর্মস, এগুলো সব আজ বিকেলেই হাতে পেয়েছে। কাজে নামার আগেই সব ঝালিয়ে নেওয়া দরকার। কাল ফার্স্ট আওয়ারেই চলে আসবেন মজিদসাহেব। চলে আসবে সুনীল, তারক, সন্তোষীরাও। দ্য সেম ওল্ড টিম অন অ্যান অ্যাবসলিউটলি

নিউ মিশন! আজ একটু তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়া দরকার। ইন্টারকমে নীচের ক্যান্টিনে রাতের খাবার অর্ডার করে মোবাইলটা তুলে নিয়ে শ্রীপর্ণার নম্বর ডায়াল করল রুদ্র। ও পারে পর্ণার গলা, “কে?”

অন্য বিষয়গুলি:

Short story
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy