Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
Short story

তৃতীয় নয়ন

আজকাল আমি অদ্ভুত ধরনের কিছু দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি যা আর কেউ দেখতে পায় না।

ছবি: কুনাল বর্মণ।

ছবি: কুনাল বর্মণ।

নন্দিতা বাগচী
শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০২১ ০০:৩৪
Share: Save:

একটা নতুন রোগ হয়েছে আমার। কিন্তু কাউকে বলতে পারছি না। এমনকি নিজের স্ত্রীকেও নয়। তার সঙ্গে অনেক কথাই শেয়ার করি আমি। তিরিশটা বছর এক সঙ্গে কাটানোর পর সে যোগ্যতা অর্জন করেছে সে। তাকে বিশ্বাস করে গোপনতম কথাটিও বলা যায়। পাঁচকান করা স্বভাবে নেই তার। কিন্তু এ কথাটা তাকেও বলতে পারছি না। শুনলেই হয় বলবে আমার দোষ হয়েছে, নয়তো বলবে ডাক্তার দেখাও।

কথাটা খুলেই বলি তবে। আজকাল আমি অদ্ভুত ধরনের কিছু দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি যা আর কেউ দেখতে পায় না। আপনারা হয়তো ভাবছেন যে স্বপ্ন দেখছি আমি। কারণ স্বপ্নই তো একা-একা দেখে মানুষ। যার-যার, তার-তার। কিন্তু কী করে বোঝাই আপনাদের যে, এটা স্বপ্ন নয়। জেগে-জেগেই দেখি আমি। মানে একটা সিনেমা টিভিতে চলতে থাকলে যেমন হয়, তেমনই।

কয়েকটা নমুনা দিই, তা হলে হয়তো বুঝতে পারবেন আপনারা। আমাদের বাড়ির উল্টো দিকের বাড়িটার এক তলায় ভাড়া এসেছে এক নববিবাহিত দম্পতি। বৌটি ভারী সুন্দর দেখতে। রোজ সকাল আটটা নাগাদ বারান্দায় বেরিয়ে এসে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বরকে বাই-বাই বলে সে। বর গাড়িতে বসেই বৌকে উড়ন্ত চুম্বন পাঠায় আর হুস করে বেরিয়ে যায়। বৌটি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়।

জানি খুব উৎসাহ নিয়ে এতটা পড়েছেন আপনারা। তার পর গালাগালিও করতে শুরু করেছেন আমাকে। হাতজোড় করে বলছি আপনাদের, যে কথাটা আমার স্ত্রীকেও বলতে পারছি না, সে কথাটা কি অজানা-অচেনা মানুষদের চট করে বলা যায়? একটু ধৈর্য ধরুন, নিজেকে একটু ধাতস্থ করে নিই আমি, তার পর বলছি।

হ্যাঁ, যে কথা বলছিলাম। ওই ছেলেটির কোথায় অফিস, কী কাজ করে সে, তার শিক্ষাগত যোগ্যতা কী, কিছুই জানি না আমি। উৎসাহও নেই জানার। পরের হাঁড়িতে উঁকি দিতে ভাল লাগে না আমার। কিন্তু ছেলেটা বেরিয়ে যেতেই যে কী হয় আমার কী বলব! দোতলার ঝুলবারান্দায় বসে ওই বাড়িটার ভেতরটা দেখতে পাই আমি। উঁকিটুকি দেওয়া নয়, স্পষ্ট দেখতে পাই ইটের দেওয়ালগুলো ভেদ করে। বিছানাটা ঝাড়ে সে প্রথমে, তার পর অগোছালো জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখে। এক কাপ কফি তৈরি করে খায়। তার পর ঝটপট বাথরুমে ঢুকে পড়ে। কারণ ওদের কাজের মাসি আসে সকাল ন’টায়।

মেয়েটির বয়স সম্ভবত তিরিশের কাছাকাছি। যদিও এটা আমার আন্দাজ। কারণ ওই বয়সের আগে আজকাল মেয়েরা বিয়ে করে না। নয়তো মেয়েদের বয়স বোঝার ক্ষমতা আমার নেই। বিশেষ করে তিরিশ থেকে পঞ্চাশের মেয়েদের একই রকম লাগে আমার।

মেয়েটি পাজামা আর গেঞ্জি পরে থাকে বাড়িতে। যেমন আজকাল মেয়েরা পরে আর কী। তা মেয়েটি বাথরুমে ঢুকে যাবার পর তাকে বিবস্ত্র হতে দেখি আমি। তার স্নানপর্ব, অর্থাৎ সারা গায়ে সাবান মাখা, শ্যাম্পু করা, তোয়ালে দিয়ে গা-মাথা মোছা, সারা গায়ে লোশন মাখাও দেখতে পাই আমি। রোজই দেখি। সিনেমার মতো।

আপনারাই বলুন তো, এ সব কথা কি স্ত্রীকে বলা যায়? আমার ঘাড়ে ক’টা মাথা?

আর একটা উদাহরণ দিই। তা হলে হয়তো আপনাদের কাছে পরিষ্কার হবে ব্যাপারটা। এ বার বর্ষায় যে ইলিশ মাছের আকাল চলছে, সে কথা আপনাদের জানা। পেনশন-ভোগী মানুষ আমি, হাজার-দেড় হাজার টাকা কেজি দরের ইলিশ কেনার ক্ষমতা আমার নেই। তবুও এক দিন এনেছিলাম আটশো গ্রাম ওজনের একটা ইলিশ। আমার গিন্নির ভারী প্রিয়। কালোজিরে-কাঁচা লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে বেগুন সহযোগে চমৎকার একটা ঝোল রাঁধে সে।

তা গিন্নি ঝোলটা রাঁধছে। আমি ঝুলবারান্দায় বসে খবরের কাগজ পড়ছি। এক অপার্থিব খুশবু ছেয়ে ফেলেছে আমাদের বাড়ি-ঘর। আমি হঠাৎ দেখতে পেলাম, আমার গিন্নি দু’চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে কড়াভর্তি ঝোল, কাঁটাসুদ্ধু মাছের গাদা-পেটি সব। বাদ পড়ছে না বেগুনের টুকরোগুলোও। সব শেষে কড়ায় লেগে থাকা তেল, কালোজিরের দানাটানা সর্বস্ব চেটেপুটে খেয়ে ফেলল সে দু’চোখ দিয়ে।

আমার বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটানোর আওয়াজটা স্পষ্ট শুনলাম। আটশো টাকার মাছটা এক বেলাতেই শেষ করে ফেলল গিন্নি! গলাখাঁকারি দিয়ে রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম আমি। দেখলাম, পরিতৃপ্ত মুখে দু’টো বাটিতে ঝোলটা বাড়ছে সে। আমাকে দেখে বলল, “আজ পাতলা ঝোলই রাঁধলাম, বুঝলে, কাল সর্ষে দিয়ে ঝাল রাঁধব। আর কাল একটা চালকুমড়ো এনো তো, মুড়োটা দিয়ে ঘণ্ট করব।”

স্বস্তির শ্বাস ফেলি আমি। কিন্তু আমি একটু আগে যে দৃশ্যটা দেখলাম, সেটা তা হলে কী? আমি তো স্পষ্ট দেখতে পেয়েছি সব খুঁটিনাটি। একটা সিনেমার মতো।

আবারও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে বসে থাকি আমি। হাজার কষ্ট হলেও সহ্য করি মানসিক যন্ত্রণাটা। সেটা লাঘব করার জন্য স্ত্রীকে ডেকে বলতেই পারতাম পুরো ঘটনাটার কথা। কিন্তু তার পরও কি এক ছাদের তলায় থাকতে পারতাম আমরা? আপনারাই বলুন!

আমার ছেলে এসেছিল গত সপ্তাহে। সে বেঙ্গালুরুতে থাকে। মধ্যমেধার ছেলে। জয়েন্টে চান্স পায়নি। পাসকোর্সে বিএসসি পাশ করে কী সব মাল্টিমিডিয়া ট্রেনিং-ফেনিং করে একটা সফ্‌টওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি জুটিয়েছে। সে আর তার দুই বন্ধু মিলে একটা স্টার্ট-আপ কোম্পানি খোলার প্ল্যান করছে। কথাটা গেয়ে গেল এসে।

তার রেন্টাল কারটা এয়ারপোর্টের পথ ধরার পর বিষণ্ণ মনে ঝুলবারান্দায় বসে আছি আমি, তার মা শয্যা নিয়েছে। একমাত্র সন্তান তো, তাই সে যখনই ছুটিতে এসে ক’টা দিন কাটিয়ে ফিরে যায়, আমরা কত্তা-গিন্নি দু’জনেই অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ি।

হঠাৎ দেখি ওই রেন্টাল কারটা ফিরে এল। আমাদের ছেলে ভারী ব্যাকপ্যাকটা নিয়ে গাড়ি থেকে নামল। তার পর দোতলায় উঠে এসে আমায় বলল, “বাবা, তোমায় একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিচ্ছি তো, তাই কোলেটারাল সিকিয়োরিটি হিসেবে কিছু একটা জমা রাখতে হবে। আমাদের এই বাড়ির দলিলটা দাও তো।”

চলমান এক জীবন্ত চলচ্চিত্র আমার চোখের সামনে!

আমি তো খাবি খাচ্ছি। আমার মধ্যবিত্ত বাবা বহু কষ্টে-সৃষ্টে শহরতলিতে একটা জমি কিনে এক তলাটা তুলতে পেরেছিলেন। আমি তাঁর মধ্যবিত্ত ছেলে, এই দোতলাটা তুলেছিলাম। এটাই যে আমার একমাত্র সম্বল। ছেলে যদি ব্যাঙ্কের লোনটা শোধ করতে না পারে! ব্যাঙ্ক যদি বাড়িটা বাজেয়াপ্ত করে নিলাম করে দেয়!

একা বসে ঘামছি আমি। ছেলেকে কী বলব ভেবে পাচ্ছি না। ছেলে বলছে, “তাড়াতাড়ি করো বাবা, ফ্লাইটটা মিস হয়ে যাবে তো!”

আমাদের শোবার ঘর থেকে গিন্নি হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে বলল, “শুনছ, প্লেনে বসে পড়েছে বাবু। যাত্রার মন্ত্রটা এইমাত্র শুনিয়ে দিলাম ওকে।”

ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে আমার। তার মানে এত ক্ষণ যা দেখছিলাম, তা সত্যি নয়! এ কথাটাও গিন্নিকে বলতে পারলাম না আমি। তার নয়নের মণি তার বাবু। এমন অপবাদ কি সে সহ্য করতে পারবে! তার চেয়ে নিজে সহ্য করা ভাল।

কিন্তু এই সহ্যের সীমাটাই পেরিয়ে যাচ্ছে আজকাল। রাতে ভাল ঘুম হয় না। সারা দিন কোনও কাজে মন বসাতে পারি না বলে নিত্যি মুখঝামটা খাচ্ছি গিন্নির। একটা ঘোরের মধ্যে আছি যেন। শুধু এক অনচ্ছ অবলোকন। এই অনিচ্ছাকৃত অদ্ভুত দর্শনের হাত থেকে মুক্তি পাব কী করে জানি না।

নানা কথা ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ে গেল বারাসতের সেই সিদ্ধ পুরুষের কথা। তাঁর কাছে বছরদশেক আগে আমাকে নিয়ে গেছিলেন আমার কোলিগ গোপালবাবু। তখন আমি খুব মনঃকষ্টে ভুগছি। ছেলেটা জয়েন্টে চান্স পায়নি। অনেক খরচা করে নানা প্রাইভেট টিউশনে ভর্তি করে দিয়েছিলাম তাকে। একটা নামকরা ইনস্টিটিউটে কোচিং নিতে যেত সপ্তাহে তিন দিন। নিজেরা সেদ্ধ-ভাত খেয়ে ছেলেকে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার করার স্বপ্ন দেখতাম।

কিন্তু আমাদের ভাগ্যও মধ্যম মানের। ছেলেটা কোথাও চান্স পেল না। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, সহকর্মীদের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছিলাম না আর। মাঝে মাঝে মনে হত গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলে পড়ি সিলিং ফ্যানটা থেকে। নয়তো বাড়ির কাছের রেললাইনে গিয়ে মাথা পেতে দিই।

তখনই আমার কোলিগ গোপালবাবু আমায় নিয়ে গেলেন বারাসতের সেই বাবাঠাকুরের কাছে। তিনি ধ্যান শেখালেন, প্রাণায়াম শেখালেন। বললেন, “মধ্যরেখার ষষ্ঠচক্রে অবস্থিত তৃতীয় নয়নকে জাগ্রত করো। তা হলেই তোমার মনের ক্ষত আরোগ্যলাভ করবে, তোমার সব মানসিক যন্ত্রণার অবসান হবে।”

কয়েকটা মাস তাঁর উপদেশ মতো চলার পর স্বাভাবিক হয়ে উঠলাম আমি আবার। আত্মীয়-বন্ধুদের সঙ্গে সহজ ভাবে মিশতে পারলাম। আর ভাবতে শিখলাম, ‘দিস ইজ় নট দি এন্ড অব দি ওয়ার্ল্ড’। যে কথাটা আমার ছেলে আমাকে প্রায়ই বলত।

কিন্তু আজ দশ বছর পর আবার একটা অন্য রকম অনুভূতি আমাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে তুলেছে। তাই গতকাল সকালে আবার আমি বাবাঠাকুরের কাছে গেছিলাম। গিন্নি কোথায় যাচ্ছি জিজ্ঞেস করায় বলেছিলাম, পেনশনের ব্যাপারে কিছু সমস্যা হচ্ছে, তাই অফিস যেতে হচ্ছে। সে কলহপ্রিয় হলেও কুচুটে নয়। তাই অবিশ্বাস করেনি।

বাবাঠাকুর সব শুনে বললেন, “তোমার তৃতীয় নয়নটি জাগ্রত হয়ে আছে কয়েক বছর ধরে। তাই এই সব উদ্ভট আর বিভ্রান্তিকর মায়ার ঘোরে আছ। তাকে স্তিমিত করা প্রয়োজন, অন্যথায় তোমার মানসিক অবস্থার অবনতি হবে।”

তার পর তিনি কিছু বিধান দিলেন, “ল্যাভেন্ডার গন্ধযুক্ত তেল কব্জিতে লাগিয়ে অথবা ওই গন্ধের মোমবাতি জ্বালিয়ে রোজ ধ্যান করতে হবে দু’বেলা। বেগুনি ফল ও আনাজ খেতে হবে। রাতে আট ঘণ্টা ঘুম। সন্ধের পর টিভি দেখা বা সোশ্যাল মিডিয়ায় থাকা বারণ। কোনও কূটকচালিতে অংশ নেওয়া চলবে না। মন ভাল থাকে এমন বই পড়তে হবে। যে সব বন্ধুর সংস্পর্শে এলে মন ভাল থাকে, তাদের সঙ্গে মিশতে হবে আর প্রাণ খুলে হাসতে হবে।”

এখন রোজই ধ্যান করছি দু’বেলা। বেগুনপোড়া, বেগুনভাজা খাচ্ছি। মহার্ঘ বেগুনি আঙুরও জোগাড় করেছি অনলাইন ফলবিক্রেতার কাছ থেকে। ল্যাভেন্ডার অয়েল আনিয়ে নিয়েছি। আট ঘণ্টা ঘুমোচ্ছিও। টিভি দেখা বন্ধ করে দিয়েছি তো সেই কবেই। আর কূটকচালি আমি কোনও দিনই পছন্দ করি না।

কিন্তু বাবাঠাকুরের বাকি তিন-চারটে উপদেশ পালন করতে পারছি না আমি। বই পড়ায় মন বসাতে পারছি না মোটেই। প্রাণ খুলে হাসতে ভুলে গেছি বলে রপ্ত করতে কষ্ট হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়া ব্যাপারটাও পুরোপুরি এড়াতে পারছি না। আর এমন কোনও বন্ধুও খুঁজে পাচ্ছি না যার সংস্পর্শে এলে মন ভাল লাগে। কারণ পিতা-মাতা-সখা-বন্ধু-পুত্র-কন্যা স্থানীয় মানুষদের সংস্রব ব্যাপারটা লুপ্ত হয়ে গেছে এখন পৃথিবী থেকে। সকলেরই তৃতীয় নয়ন জাগ্রত হয়ে থাকে আজকাল। সেই একচক্ষুসর্বস্ব নিশাচরেরা তাদের তৃতীয় নয়নে সবুজ আলো জ্বেলে বসে থাকে সারা রাত। মায়ার ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে।

অন্য বিষয়গুলি:

Short story Nandita Bagchi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy