ছবি: মহেশ্বর মণ্ডল
মা পড়ে গিয়েছেন! মাথা ঘুরে?’’ ফোনে আর্তনাদ করে উঠলেন ধীরাজ স্যর।
‘‘কোথায়?’’ আমরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
‘‘বাথরুমে। বিরাট ইনজুরি। আমি যাই,’’ ফোন ছেড়ে ব্যাগ কাঁধে ঝোলালেন ধীরাজ স্যর।
শ্রীতমা ম্যাডাম উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে বললেন, ‘‘সাবধানে যাবেন। এত টেন্সড হবেন না। বাড়িতে কেউ নিশ্চয়ই কিছু ব্যবস্থা করছেন।’’
‘‘কেউ নেই। সেটাই তো চিন্তার। একা বাবা। এইট্টি আপ। প্রায় অথর্ব,’’ বললেন ধীরাজবাবু।
‘‘আপনার বৌ? টুকু, পাপান?’’
‘‘কেউ নেই। শ্বশুরমশাই অসুস্থ। বউ সেখানে। ছেলে-মেয়ে স্কুলে। আমি আসি, দেরি করা ঠিক নয়।’’
ধীরাজ স্যরের ছুটে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মায়ের স্মৃতি মনে এল আমার। আচমকা এক রাত্তিরে কলকাতার ভাড়াবাড়িতে এসে মেজদার ছেলে বুড়ো শুকনো মুখে জানাল, ‘‘ঠাম্মা অসুস্থ। কালনা হাসপাতালে ভর্তি। অবস্থা ভাল নয়।’’
‘‘বলিস কী? কী হয়েছে মায়ের?’’ আমি আঁতকে উঠে জিজ্ঞাসা করি।
‘‘ডাক্তারবাবুরা বলল, সেরিব্রাল অ্যাটাক।’’
কিছু ক্ষণ বোবা হয়ে গেলাম। তার পর নিজেকে সংবরণ করতে পারলাম না। ‘‘মা গো...’’ বলে শিশুর মতো কেঁদে ফেললাম।
পর দিন সকালের ট্রেনেই গেলাম হাসপাতালে। মায়ের তখন সামান্য জ্ঞান। কথা জড়ানো। আমাকে দেখে বললেন, ‘‘বাবা! আমার বাবা এসেছে! আমার বাবা!’’
বিকেলেই ট্রান্সফার লিখে দিলেন ডাক্তারবাবুরা। বললেন, সিরিয়াস কন্ডিশন। সিভিয়ার ব্রেন হেমারেজ। ওঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা ওই হাসপাতালে নেই।
অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে মাকে নিয়ে ছুটলাম কল্যাণীর গাঁধী হসপিটালে। আট দিন পরও কোমা কাটল না। ওখানকার ডক্টর আগরওয়াল বললেন, ‘‘চিকিৎসা যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। বাড়ি নিয়ে যান। কোমায় আচ্ছন্ন থাকতে-থাকতেই চলে যেতে পারেন। আবার সুস্থ হয়েও উঠতে পারেন। সে আপনাদের ভাগ্য। সব রকমের ওষুধপত্র দেওয়া আছে।’’
তার পর দিদির কাছে ছ’মাস, কালনায়। গ্রামের বাড়িতে মেজদার কাছে আরও দু’বছর। মৃত্যুর আগে ইচ্ছে ছিল আবার আমার কাছে নিয়ে আসার। হয়ে ওঠেনি। আড়াই বছরের যাবতীয় খরচ চালালেও কলকাতার এক কুঠুরির ফ্ল্যাটে নিয়ে এসে মায়ের দেখাশোনা করা সম্ভব ছিল না। সে আক্ষেপ আজও আছে।
‘‘মা’র মেজর হার্ট ব্লকেজ। ভাইকে খবর দিয়েছি। কী হবে, কে জানে,’’ পর দিন স্কুলে এসে আর্দ্র স্বরে জানালেন ধীরাজস্যর।
‘‘ভর্তি করালেন হাসপাতালে?’’ আমরা জিজ্ঞেস করলাম।
‘‘না। কী করে করাব, ভাই আসুক আগে, ’’ বললেন ধীরাজ স্যর।
আমরা অবাক।
‘‘আমার ভাই বিরাজ। সে কাল রওনা দিচ্ছে ভোপাল থেকে। আগে আসুক। একটা আলোচনা করে তার পর ব্যবস্থা।’’
‘‘কিসের আলোচনা?’’
এই কোন হসপিটালে ভর্তি করাব, এই আর কী!’’
আমরা আরও অবাক। বললাম, ‘‘এখনও ডাক্তার দেখাননি তা হলে?’’
অবাক হলেন ধীরাজ স্যর, ‘‘এই দেখো। যত্ত বোকা-বোকা কথা! ডাক্তার দেখাব না কেন? উনিই তো বললেন হার্ট ব্লকেজের কথা। বললেন, পেস মেকার বসাতে হতে পারে। ইমিডিয়েটলি নার্সিং হোমে ভর্তি করানোর কথাও বললেন।’’
‘‘তা হলে?’’
‘‘ভাই আসুক আগে!’’ বলে ব্যাগ থেকে জলের বোতল বার করে জল খেলেন। একটি বড় শ্বাস ফেলে বললেন, ‘‘বাব্বা! যা ধকল যাচ্ছে!’’
‘‘কী ধকল?’’ প্রশ্ন করলেন শ্রীতমা ম্যাডাম।
‘‘এই যে মাকে নিয়ে যা চলছে।’’
‘‘কী চলছে?’’
‘‘আর কী! এক বার মায়ের কাছে যাচ্ছি। এক বার ভাইকে ফোন করছি। এক জন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। অন্য জন ‘আসছি, আসছি’ করে সময় কাটাচ্ছেন। সঙ্গে ডাক্তার-বদ্যি। দৌড়ঝাঁপ। পাল্লা দিয়ে টাকার শ্রাদ্ধ।’’
তা বলে এমন পেশেন্টকে বাড়িতে ফেলে রাখলেন? ভর্তি করিয়ে দিতে পারতেন। ডাক্তারবাবু তো বলেও দিয়েছেন ভর্তির কথা...’’
‘‘চুপ করুন! জানেন, সেখানে কত চার্জ? অ্যাডমিশন ফিজ়ই নিয়ে নেবে কয়েক হাজার!’’
‘‘তাতে কী?’’
‘‘তার উপর পেস মেকার বসানোর খরচ জানেন? আমি কি একা দেব না কি!’’
‘‘এখন দিয়ে দিতেন। পরে ভাই এলে আন্ডারস্ট্যান্ডিং করে নিতেন।’’
‘‘হুঁ!’’ ব্যঙ্গের হাসি জড়ালেন ধীরাজ স্যর, ‘‘চেনেন না তো ওকে।’’
রাত গড়াতে বিরাজ এসে পৌঁছল। সঙ্গে পিচকুন, মিলি, ওদের মা। সকলেরই উদ্ভ্রান্ত চাহনি। বিধ্বস্ত শরীর। মুখ শুকনো।
ঘরে ঢুকেই অসাড় ননীবালার বিছানায় গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল সকলে। তার পর একচোট কান্নাকাটি— কেউ নিঃশব্দে, কেউ মৃদু সানাই বাদনের মতো।
খেয়ে উঠে দু’ভাই আলোচনায় বসল। হ্যান্ডসাম, স্মার্ট বিরাজ কেন্দ্রীয় সরকারি আমলা। স্কুলমাস্টার বড়দার তুলনায় মাইনে বেশ মোটা। পাঁচ বছর গুজরাটে কাটিয়ে এখন মধ্যপ্রদেশে। কলকাতায় নিজভূমে পোস্টিং নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
‘‘ডাক্তার কী বললেন?’’ বিরাজের প্রশ্ন।
‘‘একই কথা। ম্যাসিভ হার্ট ব্লকেজ। ইমিডিয়েটলি বিএমআরআই-তে ভর্তি করান। পেস মেকার চাই।’’
‘‘প্যাকেজ বললেন কিছু?’’
‘‘দেড় লাখ। আনুষঙ্গিক আরও প্রায় দেড়।’’
‘‘নিয়ার অ্যাবাউট থ্রি!’’ একটু ক্ষণ চুপ বিরাজ। তার পর বলল, ‘‘শোন, ডাক্তাররা লোক বুঝে প্যাকেজের গল্প শোনায়। তোকে চেনেন ডাক্তারবাবু। জানে শিক্ষক মানুষ। মাস গেলে যথেষ্ট রোজগার। দাঁও মারা যাবে। চুপ করে থাক। চল, অন্য কোনও ডাক্তারের পরামর্শ নিই। ভেরিফাই না-করে ওদের খপ্পরে পড়ার মানে হয় না। ব্যাটারা ডাকাত!’’
‘‘কার পরামর্শ নিই? সময়ও গড়াচ্ছে!’’ ধীরাজ উৎকণ্ঠিত।
‘‘আর কোনও ডাক্তার নেই আশেপাশে? শিবানন্দে? কস্তুরীটাও তো ভাল শুনেছি। বড়-বড় ডাক্তার আছেন। ভিতরের ব্যবস্থাও ভাল।’’
কিন্তু একই কথা বললেন সেখানকার ডাক্তাররাও। প্যাকেজের হেরফেরও সামান্য।
দমবার পাত্র নয় বিরাজ, ‘‘আচ্ছা, সেনপল্লিতে এক জন কার্ডিয়োলজিস্ট আছেন না? ওঁর কাছে এক বার নিয়ে গেলে হয় না? লাস্ট চান্স। ক্ষতি কী?’’
না বলতে পারেন না ধীরাজ, ‘‘তাই চল।’’
হার্ট পরীক্ষার সাত-সতেরো যন্ত্রপাতি নেই দাসবাবুর চেম্বারে। তবু ইসিজি-টা করিয়েই চোখ কপালে তুললেন ডাক্তারবাবু। বললেন, ‘‘কন্ডিশন ইজ় ভেরি সিরিয়াস। এক্ষুনি হসপিটালাইজ়ড করুন। দেরি করে ফেলেছেন বড্ড।’’
অগত্যা পর দিনই ডক্টর লাহিড়ির অ্যাডভাইস মতো বিএমআরআই-তে ভর্তি করানো ঠিক হল। কিন্তু কে কত দেবে, তা নিয়ে আরও এক বার পরামর্শ করে নিল দু’জনে। জানা গেল, আর্থিক দিক দিয়ে দু’জনেই আপাতত চাপে, দু’জনেরই ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ বেড়েছে প্রচুর। নামকরা সব ইংলিশ মিডিয়াম। তবু একটা রফাসূত্র বেরল। ধীরাজ স্যরের চেয়ে একটু বেশি কন্ট্রিবিউট করবে বিরাজ। যেহেতু ওর রোজগার তুলনায় বেশি।
বিএমআরআইয়ে মাকে ভর্তি করিয়ে দিয়ে দু’ভাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ননীবালা দেবীকে ওটি-তে ঢোকাতে-ঢোকাতে হাত নেড়ে ইশারা করলেন ডক্টর লাহিড়ি। অর্থাৎ, আমার হাতে এসে পড়েছ বাছারা, আর দুশ্চিন্তার কিছু নেই। সে দিকে তাকিয়ে দু’ভাইয়ের চোখ ছলছল করে উঠল।
ওটির বাইরে অপেক্ষা করতে করতে মা-কে নিয়ে কত স্মৃতি ভেসে আসে দু’জনেরই মনে! পিঠোপিঠি দু’ভাইয়ে লাগাতার হাঙ্গামা বাধত। চাকরির কারণে বাবা বাইরে থাকতেন অধিকাংশ সময়। সবই সামলাতে হত ননীবালা দেবীকে। তাঁর ধৈর্য ও সহ্যশক্তি অসীম। হাজার রেগে গেলেও কারও গায়ে হাত তোলেননি কখনও। ভুলিয়ে-ভালিয়ে ঠিক করতেন দু’জনকে। তার পর দু’জনের গালেই হামি খেতেন। তবে দুই মল্লযোদ্ধা শান্ত।
দু’জনেরই এক অভিযোগ ছিল মা ননীবালার প্রতি। বড় বলত, মা বেশি ভালবাসেন ছোটকে। ছোট বলত উল্টোটি। তুমুল ঝগড়া চলত। ননীবালা প্রসঙ্গ পাল্টে ফ্যাসাদে ফেলার চেষ্টা করতেন দু’জনকেই। মুচকি হেসে বলতেন, ‘‘তোরা কে আমায় বেশি ভালবাসিস, প্রমাণ দে...’’ মায়ের কোল জাপটে মাকে হামি খেয়ে ভালবাসার প্রমাণ দেওয়ার কাজে লাগত দু’জনে। মা বলতেন, ‘‘উঁহু। কেউ বেশি, কেউ কম নয়। দু’জনেই সমান। আমারও ঠিক তাই। বোকার দল, মা-সন্তানের স্নেহ-ভালবাসার কম-বেশি হয় কখনও!
কোথা দিয়ে দেড় ঘণ্টা কেটে গেল। ডক্টর লাহিড়ি বিষণ্ণ মুখে বেরিয়ে এলেন ওটি থেকে। ওদের সামনে এসে বললেন, স্যরি। ইট’স টু লেট। বহু চেষ্টা করেও পারলাম না...’’
শ্রাদ্ধকর্মের তিন দিন আগে ফের তুমুল তর্ক বাধল দুই ভাইয়ে। তর্কের বিষয়, মায়ের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে কে কত কন্ট্রিবিউট করবে।
বড় : তুই আর এর মধ্যে আসিস না ছোট। আমার ইচ্ছে, পুরো খরচটাই আমি দিই। মা আমাদের জন্যে অনেক করেছেন। আমরা কতটুকু করেছি?’’
ছোট : না, আমিই দেব যা খরচ-খরচা লাগে। এ-ব্যাপারে অন্তত কোনও ভাগ-বাঁটোয়ারায় যেতে চাই না। এত দিন অনেক করেছিস তোরা। অসুস্থ মা’কে সঙ্গ দিয়েছিস, সুখে-দুঃখে পাশে থেকেছিস। আমি সেটুকু থেকেও বঞ্চিত। অন্তত এই সুযোগটা কাজে লাগাতে দে আমায়।
বড় : চুপ কর! আজেবাজে কথা বলিস না। আমি দেব!
ছোট: তুই চুপ কর! বাজে তুই বকছিস। তোর ছোটবেলার স্বভাব। আজ পর্যন্ত ছাড়তে পারিসনি। আমি দেব সব!
বড় : না, আমি!
ছোট : না, আমি!
ঘরের দুই বৌ, তাদের ছানাপোনা, বৃদ্ধ বাবা, সকলে ছুটে এল রণাঙ্গনে। থামানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু এ যুদ্ধ সহজে থামবে বলে মনে হচ্ছে না! দু’জনেই মা-অন্ত প্রাণ কি না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy