ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ
নিস্তব্ধ দুপুর। চিংড়িঘাটা রোড পেরিয়ে মেট্রোপলিটন হাউজ়িং সোসাইটির দুর্গামন্দিরের সামনে এসে দাঁড়াল কলকাতা পুলিশের জিপটা। অপেক্ষারত লোকাল ইনফর্মারের সঙ্গে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দু’-একটা কথা বলে নিলেন ডিউটি অফিসার সর্বজ্ঞ ধর। তার পর ড্রাইভারকে দক্ষিণ দিকের রাস্তাটা ধরার নির্দেশ দিলেন। কিছু ক্ষণের মধ্যেই উদ্দিষ্ট ঠিকানায় এসে দাঁড়াল গাড়িটা। লিফট ধরে তিনতলায় উঠে এ বার অভিযোগকারীর ফ্ল্যাটে প্রবেশ করলেন সর্বজ্ঞবাবু।
বেশ পরিচ্ছন্ন সাজানো-গোছানো ড্রইংরুম। সোফা, ল্যাম্পশেড, ওয়াল মাউন্টেড টিভি, ফলস সিলিং, সুদৃশ্য ঝাড়বাতি প্রভৃতির সুন্দর সহাবস্থান বেশ আধুনিকতার ছোঁয়া এনেছে ঘরটায়। জানালার পাশে টুলে বসে থাকা বয়স্ক মানুষটির দিকে প্রথমেই নজর গেল এস আই ধরবাবুর।
“আমি থানায় ফোনটা করেছিলাম। আসলে এত সাডেনলি ঘটনাটা ঘটে গেল...” মাঝবয়সি এক ভদ্রলোক নিজের পরিচয় দিয়ে তাঁর সামনে এসে দাঁড়ালেন। তার পর লোকটির দিকে ইশারা করে বললেন, “ওই যে কালপ্রিট। অনিমেষ বসু...”
“আমি দেখছি,” বলে কাঁচা-পাকা দাড়িওয়ালা মানুষটার সামনে গিয়ে বসলেন মিস্টার ধর। দৃষ্টি বিনিময় হতেই একটু যেন সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন মানুষটি। নিজেকে সামলে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললেন, “কোনও রকম খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে আমি কাজটা করিনি। ভাল ভাবে ধরলে এটাকে এক ধরনের বদখেয়াল আর খারাপ ভাবে প্রতিশোধ বলা যেতে পারে।”
“প্রতিশোধ? কিসের প্রতিশোধ?” একটু কড়া স্বরে বললেনসাব-ইনস্পেক্টর।
“সুদীপ আমার ছোটবেলার বন্ধু,” অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে কথাটা শুরু করলেন দোহারা চেহারার মানুষটি, “কোন্নগর হেমেন্দ্রনাথ বিদ্যাপীঠ। ক্লাসে প্রায় জনা পঞ্চাশেক ছাত্র ছিল। আমি ছিলাম চেহারায় খাটো, একটু দুর্বল। আর সুদীপ ছিল শক্তসমর্থ, ডানপিটে। আমাকে সব সময় উত্ত্যক্ত করত ও। ক্লাসে পেছন থেকে মাথায় চাঁটি মারা, টিফিন কেড়ে নেওয়া, বইয়ের পাতা ছিঁড়ে দেওয়া। ওর ভয়ে কুঁকড়ে থাকতাম আমি।”
“তাই বলে পঞ্চাশ বছর পর বন্ধুর বাড়ি এসে তাকে আচমকা চড় মারতে শুরু করবেন আপনি, প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য?” বেশ রাগত ভঙ্গিতেই কথার মাঝে ঢুকে পড়লেন সুদীপববুর ছেলে সৌরীশ।
“যে ছেলেটা স্কুল জীবনের দশটা বছর আমার উপর অত্যাচার করে গেল, তার বদলে তাকে সামান্য দুটো চড় মেরেছি, এটা আমার অপরাধ?”
“শুনুন, তাঁর নি-রিপ্লেসমেণ্ট হয়েছে কয়েক মাস আগে। না হলে তিনিই প্রতিশোধটা নিয়ে নিতেন। তা ছাড়া আমরা যদি পুলিশে খবরনা দিয়ে আইনটা হাতে তুলে নিতাম তা হলে...”
“আপনার বাবাকে কী এক বার ডাকা যেতে পারে...”
দুজনের কথোপকথনে ছেদ টেনে কথাটা বললেন সাব-ইনস্পেক্টর।
“আসলে উনি এত আপসেট হয়ে পড়েছেন যে...” সৌরীশবাবু শোবার ঘরের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, “তাই ডাক্তারের পরামর্শে একটা হালকা ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ওঁকে রেস্টে রাখা হয়েছে...”
“অফিসার, সুদীপ যে আমার বন্ধু ছিল তার অকাট্য প্রমাণ কিন্তু আমার কাছে আছে। স্কুলের ছাত্রদের একটা গ্রুপ-ফোটো, আমার মাধ্যমিকের অ্যাডমিট কার্ড...” একটুও ভয় বা অনুশোচনা লক্ষ করা যাচ্ছিল না অনিমেষবাবুর কথাবার্তায়।
ভদ্রলোকের কথাটা টেনে নিয়েই সৌরীশ বললেন, “আমরা তো প্রথমটায় কিছুই বুঝতে পারিনি। ভেবেছিলাম পুরনো বন্ধু, বাবার সঙ্গে গল্পগুজব করতে এসেছেন। এর আগেও দু’দিন এসেছিলেন। কিন্তুএ ভাবে যে অতর্কিতে আক্রমণকরে বসবেন...”
“ঠিক আছে, আমরা ব্যাপারটা দেখছি,” বলে অনিমেষবাবুকে নিয়ে বিদায় নিলেন সর্বজ্ঞবাবু।
মিনিট দশেকের মধ্যেই থানায় এসে পৌঁছলেন ওঁরা। নিজের কেবিনে ঢুকে দুটো চায়ের অর্ডার দিলেন এস আই। নিজস্ব অভিজ্ঞতায় তিনি বুঝে গেছেন যে, লোকটি আর যা-ই হোক পেশাদার অপরাধী নয়। একটু নরম ভাবে তাই বয়স্ক মানুষটিরউদ্দেশে বললেন, “এ বার বলুন আপনার বিস্তৃত পরিচয়। ঠিক কী কারণে এই সব অপকর্ম করে বেড়াচ্ছেন আপনি...”
“আগেই বলেছি আমি এক জন সিনিয়র সিটিজেন। মাঝারি মাপের অফিসার হিসেবে একটা আধা-সরকারি সংস্থা থেকে বছর দুয়েক হল অবসর নিয়েছি। এই আমার আইডেন্টিটি কার্ড,” চায়ে চুমুক দিয়ে অনিমেষবাবু বলে চললেন, “রিটায়ারমেন্টের পর থেকে জীবনটাকে নিয়ে একটু নতুন করে ভাবতে শুরু করলাম। বাল্যকাল, বয়ঃসন্ধি, যৌবন, মধ্যবয়স— নানা সময়ের স্মৃতি ঘাঁটতে-ঘাঁটতে অদ্ভুত এক বিষণ্ণতা গ্রাস করতে লাগল আমায়। দেখলাম ভয় পেতে-পেতে আর ভয়কে পেরোতে-পেরোতেই জীবন কেটে গেছে আমার। তাই চলার পথে যারা আমাকে ভয় দেখিয়েছে বা দমিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে, তাদের একটা তালিকা তৈরি করলাম।”
“বেশ ইন্টারেস্টিং!” একটু কৌতুক নিয়েই বললেন ইন্সপেক্টর।
“অবসরের পর অঢেল সময়। স্ত্রী হাঁটুর সমস্যায় বাড়িতেই থাকে প্রধানত। ছেলে চাকরিতে উচ্চপদে প্রতিষ্ঠিত। স্ত্রী-পুত্র নিয়ে কলকাতায় থাকে। জীবনটাকে রিওয়াইন্ড করে দেখার ইচ্ছে জাগল আমার। বাবার বদলির চাকরির সূত্রে বিভিন্ন জায়গায় বাল্যকাল কেটেছে আমার। তার পর কলেজের সময়টা, জীবনে চার বার চাকরি বদল করেছি। পুরনো জায়গাগুলো ঘুরতে-ঘুরতে দেখলাম প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব প্রত্যেকেই ভুলে গেছে আমায়। এর পরে অদ্ভুত একটা খেয়াল চাপল মাথায়। এমনিতে আমি খুব নিরীহ প্রকৃতির মানুষ। আমার ছোটখাটো চেহারা বা ভালমানুষি ভাবটার জন্য যারা আমাকে আঘাত করেছেন, তাদের বর্তমান ঠিকানা, হাল-হকিকত জোগাড় করতেশুরু করলাম।”
“বাঃ, বেশ থ্রিলারের মতো শোনাচ্ছে আপনার অ্যাক্টিভিটি...” সর্বজ্ঞবাবু একটু হেসে বললেন, “প্রথম শিকার কে হল?”
“আমার বৌমা জয়তী। এক্কেবারে বাড়ি থেকেই হাতেখড়ি...”
“সে কী! বৌমা! কেন এবং কী ভাবে?” স্পষ্ট কৌতূহল নিয়েই প্রশ্নটা ছুড়লেন ইন্সপেক্টর।
“বৌমা শিক্ষিতা, সচ্ছল পরিবারের মেয়ে। কিন্তু বড্ড মেজাজি ও একরোখা। ওর সঙ্গে মত না মিললেই নানা ভাবে ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে অপদস্থ করার চেষ্টা করত। খুব খারাপ লাগত আমার। তাই ওর সম্বন্ধে কিছু খোঁজখবর জোগাড় করলাম। জানতে পারলাম কলেজে পড়াকালীন একটি ছেলের সঙ্গে ওর প্রেমঘটিত সম্পর্ক ছিল। তাই আরও কিছু তথ্য জোগাড় করে, গলার আওয়াজ বদল করে ছেলেটির বাবা সেজে দিনকয়েক ফোন, মিসড কল, কয়েকটা বেনামি চিঠি, ব্যস! বৌমার উটকো রাগ বা তেজটা কমে গেল ধীরে ধীরে। আমার ছেলের কাছে সারেন্ডার করল ও। অবশ্য আমি ছেলেকেও কিছুটা হিন্ট দিয়ে রেখেছিলাম। সে-ও সুন্দর ভাবে জিনিসটাকে ট্যাকল করে সাংসারিক শান্তি ফিরিয়ে আনল।”
“আপনার কি মানসিক কোনও সমস্যা আছে? মানে এই যে ভিন্ডিকটিভ একটা অ্যাটিটিউড...”
“না। এখন পারিবারিক শান্তি আছে। রাতে ভাল ঘুম হয়। আমার আচরণটাকে বার্ধক্যের দুষ্টুমি আখ্যা দিতে পারেন। ডিটেকটিভ বইয়ের পোকা ছিলাম এক সময়। ভেবেছিলাম রহস্য, অ্যাডভেঞ্চারের গল্প লিখব ছোটদের জন্য। সংসারের চাপে আর হয়ে ওঠেনি।”
একটু হাসলেন সাব ইনস্পেক্টর ধরবাবু। অনিমেষবাবুকে জরিপ করে একটু কড়া স্বরে বললেন, “আপনার এই হিট লিস্টে আর কত জন আছে?”
“আরও দু’-এক জন আছে,” অনিমেষবাবু একটু হেঁয়ালি করেই বললেন, “তবে হিট লিস্ট বলা ঠিক হবে না। ঠাকুর বলে গিয়েছিলেন না, একটু ফোঁস করতে! আমি ওই ফোঁসটুকুই করতে চাইছি। মানুষগুলোকে কৃতকর্মের জন্য একটু প্রায়শ্চিত্ত করিয়ে নেওয়া...”
একটা সিগারেট ধরালেন ইনস্পেক্টর। মানুষটির দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “ভাবছি কোন ধারায় আপনার বিরুদ্ধে মামলা করব, আইপিসি ৫১১ না আইপিসি ৩০৭...”
“ইন্ডিয়ান আইপিসি-তে ক্রাইমের যে ডেফিনিশনটা আছে তাতে আমার অ্যাক্টিভিটিটা ক্রাইমের পর্যায়ে ফেলা যাবে না। যেমন ধরুন, বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে হাসি-ঠাট্টার মাঝেও একে-অপরকে মৃদু ধাক্কাধাক্কি হয়, বাবা-মা ছেলেকে পড়ানোর সময়ও তো দু’-একটা চড়থাপ্পড় মারে। তা ছাড়া আমার ক্ষেত্রে তো এভিডেন্সই নেই। যদি বলি সুদীপই প্রথম আক্রমণ করেছিল! আত্মরক্ষার খাতিরে আমি...”একটু চিবিয়ে কথাগুলো বললেন অনিমেষবাবু।
“বাব্বা, বেশ আটঘাট বেঁধেই তো কাজে নেমেছেন। আইন-কানুনও কিছুটা পড়া আছে দেখছি।”
প্রশংসা শুনে একটু যেন আবেগপ্রবণ হয়ে উঠলেন অনিমেষবাবু। দৃষ্টি সঙ্কুচিত করে বললেন, “লড়াইয়ে যখন নেমেছি তখন আত্মরক্ষার উপায়গুলো তো জেনে রাখতেই হবে।”
চেম্বারের বাইরে ভারী বুটের পদচারণা শোনা যাচ্ছিল। এরই মধ্যে ঊর্ধ্বতনের ডাক আসায় এক জন কনস্টেবলকে দাঁড় করিয়ে সর্বজ্ঞবাবু কিছু ক্ষণের জন্য ঘরের বাইরে গেলেন। ফিরে এসে ডেস্কটপ খুলে অনিমেষবাবুর সম্বন্ধে তথ্য পুলিশ পোর্টালে আপলোড করলেন। তার পর থানার ফোটোগ্রাফারকে দিয়ে মানুষটির ছবি তোলালেন। ছবিগুলোকে পুলিশের ওয়েবসাইটে দিয়ে ফের চায়ের অর্ডার দিলেন। তার পর একটু ধীর ভাবে বললেন, “ছবি-সহ আপনার এই আপলোডেড ডেটা এখন পৌঁছে যাবে সব থানায়। আমাদের সাইবার-সেল ডেটা সিনক্রোনাইজ় করে দেখবে। পাস্ট হিস্ট্রি যদি থাকে, কিছু ক্ষণের মধ্যে খবর পাওয়া যাবে।”
“তা হলে শেষ পর্যন্ত আমাকে অপরাধীর তালিকাতেই ফেলে দিলেন আপনি,” একটু উষ্মা নিয়েই কথাটা বললেন অনিমেষবাবু।
“অনেক বছর তো এই লাইনে আছি। কত কেস ঘাঁটছি,” মিস্টার ধর সতর্ক দৃষ্টি মেলে বললেন, “একটা সাধারণ মানুষ কখন যে অপরাধ করে ফেলে সে নিজেও জানে না। এই ধরুন আপনার ক্ষেত্রেই।প্রথমে ফলস ফোন, বেনামি চিঠি। সাকসেস পাওয়ার পর গায়ে হাত তুললেন এক জনের। এর পর যদি প্রতিহিংসার জন্য কাউকে ছুরি-টুরি দিয়ে আঘাতও করে ফেলেন... এক জন ওয়েল-উইশার হিসাবে বলছি, আপনি এক জন সাইকায়াট্রিস্টের সাহায্য নিন। অন্ধকার দিকটা নয়, জীবনের আলোময় দিকে নজরটা ঘুরিয়ে ফেলুন। আপনি মনেশান্তি পাবেন।”
এর পর জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে জানা গেল যে আপাতত আরও দু’জন আছেন অনিমেষবাবুর তালিকায়। এক জন হচ্ছেন ইঞ্জিনিয়ার সত্য বরাট। মালদায় চাকরিরত অবস্থায় তিনি অনিমেষবাবুকে নানা ভাবে অপদস্থ করার চেষ্টা করেন। এক বার ইয়ার-এন্ডিংয়ের সময় নাকিপাইপ ও স্পেয়ার পার্টসের স্টক মেলানোর নামে প্রায় চুরির অপরাধে ফাঁসিয়ে দিচ্ছিলেন অনিমেষবাবুকে। দ্বিতীয় জন এক জন মাঝারি মাপের শিল্পী। উজ্জ্বল সেন। যৌবনে অনিমেষবাবুর আঁকা ছবিগুলো নিয়ে তিনি একটা আর্ট-এগজ়িবিশন করিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু অনেক দিন তৈলমর্দন করার পরও অনিমেষবাবুর সেই সাধ পূরণ হয়নি।
সব কিছু শোনার পর কিছু ক্ষণ চুপ করে থাকলেন সর্বজ্ঞবাবু। তার পর বললেন, “দেখুন অনিমেষবাবু, রিটায়ারমেন্টের পর আইডল ব্রেনে অনুচিত কিছু কাজ করার প্রতি আপনার আগ্রহ জন্মেছে। জীবনযুদ্ধে আমাদের প্রত্যেককেই কম-বেশি প্রতিকূল নানা পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। সময়ের চাপে আমরা সেগুলো ভুলেও যাই। কিন্তু কবর খুঁড়ে সেগুলোকে বার করে আপনি যে ভাবে রিভেঞ্জ নেওয়ার চেষ্টা করেছেন, এটা খুব একটা স্বাভাবিক ঘটনা নয়...”
“ইনস্পেক্টর,” অনিমেষবাবু সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ওই ফোঁসটুকু যদি সময় মতো করতে পারতাম তা হলে হয়তো খানিকটা হলেও পাল্টে যেত জীবনটা। একটা বাঁকানো শিরদাঁড়া নিয়ে কুঁজো হয়ে পথ চলতে হত না। ধরুন আমার সামান্য কুবুদ্ধিটার জন্য তো আমার ছেলে সাংসারিক শান্তি ফিরে পেয়েছে...”
“আপনি আবার ছবি আঁকা বা লেখালিখির কাজ শুরু করুন না!”
“সন্ধে হয়ে আসছে,” অনিমেষবাবু জানালার দিকে তাকিয়ে বললেন, “এখন বলুন কী ভাবে আমাকে অব্যাহতি দেবেন?”
“আপনার ব্যাপারটা নিয়ে ও সি আর অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারের সঙ্গে কথা হয়েছে আমার। তারা ব্যাপারটাকে আরও খতিয়ে দেখতে বলেছে...” সর্বজ্ঞবাবু শরীরটাকে একটু পিছনের দিকে হেলিয়ে বললেন, “আমি সে সব দিকে যাব না। অফিস, কমপ্লেনার আমি ম্যানেজ করে নেব। তা ছাড়াসাইবার-সেল থেকে কোনও অ্যালার্ম-কল বা মেল আমার কাছে আসেনি। অর্থাৎ পুলিশের খাতায় এর আগে নাম ওঠেনি আপনার। কিন্তু একটা মুচলেকা আপনাকে দিতে হবে। লিখতে হবে যে, ভবিষ্যতে আপনি উদ্ভট ও বিপজ্জনক এই সব খেয়াল থেকে নিজেকে দূরে রাখবেন।”
ধরবাবুর বাড়িয়ে দেওয়া সাদা পৃষ্ঠাটায় সুন্দর হস্তাক্ষরে অনিমেষবাবু মুচলেকাটা লিখলেন। তার পর নমস্কার জানিয়ে বললেন, “এই যে আপনি চাকরির সূত্রে শহরের ল অ্যান্ড অর্ডার সামলাচ্ছেন, সত্যি বলুন তো, শিরদাঁড়া সোজা রেখে কাজ করতে পারেন? কত রকম এক্সটার্নাল চাপের মধ্যে পড়তে হয় আপনাদের... নিজেকে বাঁচাতে আঙুলটা কখনও যদি একটু বাঁকাতেই হয়, তাতে অসুবিধে কী...”
মাথা ঝুঁকিয়ে এস আই সামান্য হাসলেন। ধীর ভাবে বললেন, “থিঙ্ক অ্যাবাউট ইয়োর পজ়িটিভ সাইডস। জীবনে যাঁদের কাছে উপকৃত হয়েছেন, তাঁদের স্মৃতি রোমন্থন করুন। তাঁদের কাছাকাছি আসার চেষ্টা করুন। ক্রিয়েটিভ কিছু করুন। আশা করি কিছু দিনের মধ্যেই আপনার আর্ট এগজ়িবিশনের নেমন্তন্ন পাব।”
স্মিত হেসে সুইংডোরটা খুলে বেরিয়ে গেলেন অনিমেষবাবু।
প্রায় মাসখানেক কেটে গেছে। কেন জানেন না অনিমেষবাবুর মুখটা সর্বজ্ঞবাবুর মানসপটে ভেসে ওঠে বার বার। বয়োজ্যেষ্ঠ ওই ভদ্রলোক কী কোনও শিক্ষা দিয়ে গেলেন তাকে? শিরদাঁড়া সোজা করে এগিয়ে চলার শিক্ষা? দিনকয়েক আগের ঘটনা। স্থানীয় এক কাউন্সিলারের ছেলে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে নাইট-পার্টি করার সময় ভাঙচুর চালায় একটি ক্লাবে। এর আগেও কয়েকটা ক্ষেত্রে দৌরাত্ম্য চালিয়েছে ভিকি, কিন্তু উপরতলার চাপে ছেড়ে দিতে হয়েছে তাকে। তাই এ বার একটু অন্য পন্থা অবলম্বন করেছেন ধরবাবু। এক কনস্টেবলের সঙ্গে আত্মীয়তার সূত্রে বিরোধী দলের এক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। প্রেস ও মিডিয়ার লোকজনকেও অন্য একটি সোর্স মারফত খবর দেওয়া হল। বিরোধীরা থানা ঘেরাও করল এবং বিভিন্ন নিউজ় চ্যানেলে সম্প্রচারিত হল ঘটনাটি। অবশেষে গ্রেফতার করা হল ছেলেটিকে। একটু ঘুরপথে হলেও কাজটা করে মনে শান্তি পেলেন এস আই। ঘটনাটার কথা বেশ ছড়াল চার দিকে। কাগজে লেখালিখিও হল।
সে দিন দুপুরে কী একটা কাজে অফিসের বাইরে বেরিয়েছিলেন সর্বজ্ঞবাবু। হঠাৎই মোবাইলের স্ক্রিনে স্ত্রীর নম্বরটা ফুটে উঠল। এই ভরদুপুরে কী হল আবার! তাড়াতাড়ি সবুজ বাটনটা টিপতেই শুনলেন এক জন ভদ্রলোক ফুল, মিষ্টি ইত্যাদি নিয়ে তার কোয়ার্টারের বাইরে অপেক্ষা করছেন। চেহারার বর্ণনা আর নামটা শুনে নিশ্চিন্ত হলেন এস আই সাহেব। তাঁর অভিজ্ঞতা বলছে মানুষটাকে নিয়ে আর দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। স্ত্রীকে তিনি তাই বললেন, “দরজা খুলে ভদ্রলোককে ড্রইংরুমে বসাও। একটু কোল্ড ড্রিঙ্ক থাকলে দাও। এই গরমে এত কষ্ট করে... উনি আমার পরিচিত মানুষ। আমি আসছি।”
ফোনটা কেটে তড়িঘড়ি নীচে গিয়ে সদর দরজাটা খুলে দিলেন সর্বজ্ঞবাবুর স্ত্রী। দেখলেন, কাঁচা-পাকা দাড়িওয়ালা বয়স্ক ভদ্রলোক আর দাঁড়িয়ে নেই সেখানে। চৌকাঠের পাশে একটা ফুলের তোড়া, মিষ্টির প্যাকেট আর রঙিন কাগজে মোড়া একটা উপহার রাখা আছে। কাগজের মোড়কে একটি আঁকা ছবি।
আবার ফোন এল সর্বজ্ঞবাবুর স্ত্রীর। উষ্মা সহকারে মিসেস ধর বলে চললেন, “কে বলো তো ওই ভদ্রলোক, একগাদা মিষ্টি, ফুল আর নিজের আঁকা একটা ছবি রেখেদিয়ে উধাও হয়ে গেলেন। পুলিশের সঙ্গে ঘর করে কত রকম যে অভিজ্ঞতা হচ্ছে...”
মৃদু হাসলেন ধরবাবু। এক অন্য রকম আনন্দে ভরে উঠল তাঁর মনটা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy