ছবি: বৈশালী সরকার
আধ-খাওয়া বিড়ির কাউন্টারটা লোচনকা এগিয়ে দিল। বাঁ হাত দিয়ে হাতটা সরিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল বসন্ত। চিড়বিড় করে জ্বলছে মাথাটা। তার কী দোষ? শরীরটা লম্বা হয়ে গেছে বলে? শুধু একটু লম্বা হয়ে গেল বলে আর তাকে রাধা সাজাবে না মাধবজ্যাঠা? কিন্তু গুরুদাস কৃষ্ণই থাকবে! আর বসন্তর জায়গায়
রাধা সাজবে নেত্য! রাগটা নিজের রাধা না সাজার জন্য অতটাও নয়, যতটা নেত্যর রাধা সাজার জন্য। গুরুদাসের পাশে অন্য কেউ রাধা? হনহন করে পা ফেলে বসন্ত সাজঘরের দিকে গেল।
“দ্যাকো কাণ্ড! বসন্তকে আর রাধা করবেনি মাধব। বারণ করলুম ওকে এখেনে নিয়ে আসতে। কেউ শুনলুনি কো! এখন দ্যাকো, কী ঝামেলা করে!” আধ-খাওয়া বিড়িটা পাশে বসা রঘুর হাতে ধরাল লোচনকা।
লোচনকে সবাই কাকা বলে এই দলে। নয়-নয় করে দশ বছরে পা দিল ওদের হরিনামের দল। লোচন খোল বাজায়। আর রঘু হারমোনিয়াম। গত পাঁচ বছর ধরে এই দলে গুরুদাস কৃষ্ণ সাজে আর বসন্ত রাধা। দু’জনেই ছেলে। এ বছর গুরুদাস নয়ে পড়ল। বসন্ত দশে। কিন্তু গুরুদাসের মুখখানা কচি কচি। দেখলে মনে হয় বড় জোর সাত। বসন্তটা মাথা চাড়া দিয়েছে ভালই। চোয়াল শক্ত মনে হয় এখনই। রাধা সাজা আর হবে না ওকে দিয়ে। আগের বছর থেকেই গাঁইগুঁই করছিল মাধবজ্যাঠা। এই গরমে সাফ সাফ না বলে দিয়েছে। আজ ওদের শীতলডাঙায় গান। বারোয়ারি বেশ ভাল টাকায় বায়না করেছে ওদের। এই গরমের মরসুমটাতেই ওদের রোজগার। চোত, বোশেক, জষ্টি। ব্যস। বর্ষায় আর শীতে কে-ই বা হরিনাম শোনে!
“ওকে রাধা করলে কিসনোর চেয়ে মাথায় উঁচু হয়ে যাবে যে!” বলে রঘু দাঁত বের করে হেসে বলল। কাঁধের গামছাটা হাতে নিয়ে মুখ মুছতে মুছতে উঠে গেল লোচনকা।
সাজঘরে ঢুকে গুরুদাসের হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে দরজার কাছে নিয়ে এল বসন্ত। মন দিয়ে চুলে ময়ূরের পালক আটকাচ্ছিল গুরুদাস। আচমকা বসন্তর টানাটানিতে হাত থেকে ময়ূরের পালক খসে গেল। বাঁশিটা গুরুদাসের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বসন্ত কাতর হয়ে বলল, “দেখ গুরু, তুই নেত্যর সঙ্গে খবরদার নাচবিনি বলে দিচ্ছি। তুই তো আমার কিসনো। আমি তোর রাধা। তুই ওর সঙ্গে নাচবি কেনে? বল... মাধবজ্যাঠা যাই বলুক... তুই নাচবিনি। খুলে ফ্যাল সব।” গুরুদাসের পিঠের দিকে নীল ওম লেখা বাহারি চাদরটা টেনে খুলতে যায় বসন্ত।
“ছাড়... ছাড় বলচি আমাকে। তোর কী? তোকে দল থেকে বাদ দিয়েচে বলে তোর রাগ। সব বুঝি আমি। ছাড় আমাকে... জ্যাঠা দ্যাকো... সব ছিঁড়ে দিল!” গুরুদাস এক ঝটকায় সরিয়ে নিল নিজেকে। গোলমাল শুনে মাধবজ্যাঠা ছুটে এল হাঁ হাঁ করে।
“মুখপোড়া, বজ্জাত ছেলে! তোকে নিয়ে এলুম মায়া করে। ভাবলুম দলের সঙ্গে থাক। এসে আবার ঝামেলা শুরু করলি? আজ মেরেই ফেলব তোকে।” হাতের তালপাতার পাখার বাঁটটা দিয়ে সজোরে দু’ঘা কষাল বসন্তর পিঠে। ঝটকা দিয়ে ঘুরে গিয়ে পাখার বাঁটটা হাতে ধরে ফেলে বসন্ত চিৎকার করে উঠল, “না! তাও তুই নাচবিনি গুরু! আমি তোর রাধা— তুই নাচবিনি অন্য কারু সঙ্গে...” গলা ভেঙে যায় বসন্তর।
“ওরে আমার রাধা রে! আহাহাহা! যেন যমুনা থেকে উঠে এল এই— আধদামড়া ছেলে— রাধা! বেরো এখান থেকে বলচি!” ধাক্কা দিতে দিতে বসন্তকে সরিয়ে নিয়ে যায় মাধবজ্যাঠা, “এই, এই দে বাঁশিটা, দে বলছি... এটা তোর কাছে কেনে... অ্যাঁ? দে... দে!” বাঁশিটা বসন্তর
হাত থেকে কেড়ে নিতে চায় মাধবজ্যাঠা। এক ধাক্কায় জ্যাঠাকে মাটিতে ফেলে দিয়ে বাঁশি নিয়ে একছুটে পালাল বসন্ত।
“কী রাক্কুসে ছেলে রে বাবা! সকি সাজবে, সকি! গ্যাঁজা, মদ, বিড়ি টেনে টেনে চোয়াড়ে মুখ, সকি সাজবে! এই রঘু, ও যেন ধারেকাছে না আসে গানের সময়...” ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়ায় মাধবজ্যাঠা।
সন্ধের আলো জ্বলার আগেই আসর সাজিয়ে শুরু হল নামগান। দুধের বাচ্চা থেকে শুরু করে অশীতিপর বুড়োবুড়ি। সবাই চাটাই, চটের বস্তা পেতে বসেছে আসরের চারপাশে। কী মনোরম পরিবেশ! বাঁশির সুরে মেতে উঠছে আসর। সঙ্গে হারমোনিয়াম, খোল, খঞ্জনি আর মাধবজ্যাঠার দরাজ গলার গান। সঙ্গে গলা মেলাচ্ছে রঘু, গুরুদাস আর নেত্য। কৃষ্ণের সাজে গুরুদাস, রাধার সাজে নেত্য। ঘুরে ঘুরে নেচে যাচ্ছে আসর জুড়ে।
হরিবাসরের আসর ছেড়ে বাঁ দিকে বটগাছটার নীচে একটু অন্ধকার দেখে বাঁশি হাতে বসে আছে বসন্ত। এ আসর তার বহু দিনের চেনা। রজনীগন্ধা আর গুলঞ্চ ফুলের মালা সারি সারি দিয়ে সাজানো আসর। মাঝে তুলসীমঞ্চের নিচে গৌর-নিতাইয়ের পট। চারিদিকে সাদা সাদা টিউব লাইটের আলো। আসরের চার কোণে বাঁশ পুঁতে তার গায়ে গোছা গোছা সাদা টিউবলাইট আর সবার ওপরে একটা জোরালো সবুজ আলো। টিউবলাইটের গায়ে বড় বড় গাছের পাতা লাগানো আছে পোকাগুলোকে আলোর গায়ে আটকে রাখার জন্য। বসন্তর মনে পড়ল সন্ধেবেলা তার বাড়ির দাওয়ার কোণে লণ্ঠনের চার পাশে ঝুলিয়ে রাখা গাছের ডাল। সন্ধে হলেই দাওয়ার দু’কোণে লণ্ঠন জ্বালিয়ে পাশে গাছের ডাল ঝুলিয়ে দেয় তার মা। সন্ধে গড়িয়ে গেলে ওই অল্প আলোর নীচে অ্যালুমিনিয়ামের থালায় রাতের খাবার বেড়ে দেয় মা। বাপটা মরে গেল আগের বছর। জ্বরে ভুগছিল অনেক দিন ধরে। ওষুধ খেল কত দিন। মা’র নাকছাবি বন্ধক দিয়ে ওষুধ এনেছিল বসন্ত। তা-ও মরে গেল এক দিন ভোরবেলা। যখন প্রথম প্রথম রাধা সাজত বসন্ত, মাথায় দেওয়ার একটা লাল রঙের ঝিলমিল ওড়না এনে দিয়েছিল বাপ। নতুন সেই লাল ওড়নাটা মাথায় দিয়ে কপালে চন্দনের ফোঁটা লাগিয়ে লাল শাড়ি পরে গুরুদাসের সঙ্গে রাধা হয়ে নাচত ও। জাল-জাল লাল ওড়নায় সোনালি সোনালি চাঁদ-তারা। বাপ মরে গেল। দিদির বিয়ের সময় দিদির মাথায় ওড়নাটা পরিয়ে মা সাজিয়ে দিল দিদিকে। ওড়নাটা নিয়ে চলে গেল দিদি। যাক। তারও তো রাধা হওয়ার দিন শেষ হয়ে গেল!
বাঁশিটা দু’হাতে লম্বালম্বি ধরে ঠোঁটে আর নাকে ছোঁয়ায় বসন্ত। খুব কষ্ট হচ্ছে বুকের ভেতরটায়। এতগুলো বছর সে আর গুরুদাস রাধা-কৃষ্ণ সেজে পাড়ায় পাড়ায় নাচ-গান করে বেরিয়েছে। কত দূর দূর যেতে হয়েছে ওদের। কখনও দু’রাত্রি-তিন রাত্রি গান। মাধবজ্যাঠা ঠিক করে দিত পালা। সবচেয়ে প্রিয় পালা ছিল নৌকোবিহার। রাধা আকুল হয়ে কৃষ্ণকে বলছে নদী পার করে দেওয়ার জন্যে। কানে ভেসে আসে বসন্তর— ‘পার করো পার করো সখা, পার করে দাও / আমি যে অবলা নারী বেলা বয়ে যায়।’
চোখ থেকে দরদর করে জল নামে বসন্তর। এই সুর কী করে ভুলবে সে? কৃষ্ণ তো তারই কৃষ্ণ। অন্য কেউ রাধা কী করে হবে? এই আকুতি তো তারই আকুতি। ও দিকে আসরে কৃষ্ণ নেচে নেচে গাইছে— ‘সব সখিরে পার করিতে নেব চারি আনা / আর তোমার বেলায় নেব সখি, তোমার কানের সোনা। সখি গো, আমি প্রেমের ঘাটের মাঝি / তোমার কাছে পয়সা নেব না।’
এ তো মাধবজ্যাঠারই গলা। কী করে পারল জ্যাঠা তার জায়গায় নেত্যকে রাধা সাজাতে! পয়সার জন্যে। তাকে আর রাধা মানাবে না, জ্যাঠা বলল। তা হলে এত কষ্ট কেন হচ্ছে তার? সে আর রাধা নয় তো! তা হলে এই সুর শুনে এত কান্না কেন পাচ্ছে এখন? কেন পায়ের পাতা দুটো তালে তালে নেচে উঠছে এখনও? এখন তো আর রাধা নয় ও। তা হলে এই কান্না কার? এই সব কষ্ট, সব আনন্দ কার? বাঁশিটা হাতে শক্ত করে ধরে হু হু করে কাঁদতে থাকে বসন্ত।
আসরে গানের তাল পাল্টেছে তখন। সাঁওতালি সুরে বাজছে ‘রাখালিয়া বাঁশি রে, পাগল করিলি রে, ঘরের বাহির করলি আমারে’।
বসন্ত দেখল গুরুদাসের হাতে বাঁশি। তার মানে ওটা পুরনো বাঁশি। সাজের বাক্সে ছিল। ওটা তো ভাঙা। নতুন বাঁশি তো তার হাতে! বসন্ত জানে এর পর কী হবে। রাধা রাগ করে কৃষ্ণের বাঁশি কেড়ে নেবে। আর কৃষ্ণ কাকুতি-মিনতি করে বাঁশি ফেরত চাইবে। কত মজা করত ওরা এই সময়টায়। গুরুদাস দুই হাত পেতে বাঁশি চাইত ওর কাছে। আর বসন্ত তখন বাঁশির মালিক। রাধা তখন বাঁশির মালিক। বাঁশি ছাড়া তো কৃষ্ণ অচল! তাই রাধা তখন পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী। আর কৃষ্ণের তো অত শক্তি! তাও সে রাধার কাছে হাত পাতে কেন? বসন্ত জিজ্ঞেস করেছিল মাধবজ্যাঠাকে। মাধবজ্যাঠা বলেছিল, হাত তো পাততেই হবে— সে যে ভালবাসে রাধাকে। রাধা যে ভালবাসে তাকে। তাকে তো হাত পাততেই হবে রাধার কাছে। জ্যাঠা বুঝিয়ে দিল। বসন্ত বোঝে সব। হু হু করে চোখের জল নামে। ভিজে যায় ওর জামার হাত।
আসরে তখন হাঁটু গেড়ে বসে দু’হাত পেতে বাঁশি ভিক্ষা করছে কৃষ্ণ। সনৎকাকার বাঁশিতে করুণ সুর— ‘রাধে, তুমি না করিলে দয়া, কে করিবে গো?’
রাতের হাওয়া, আলো আর বাঁশির সুর বুকের মধ্যে মোচড় দিচ্ছে যেন! বসন্ত উঠে দাঁড়াল বাঁশি নিয়ে। তার পর টলতে টলতে দর্শকদের মাঝখান দিয়ে বাঁশি হাতে ছুটে গেল আসরের দিকে। কৃষ্ণ তখনও কেঁদে যাচ্ছে... ‘রাধে, তুমি না করিলে দয়া, কে করিবে গো?’
বাঁশি হাতে আসরের মাঝখানে দৌড়ে এল রাধা। নীল রঙের গেঞ্জি আর কালো রঙের হাফপ্যান্ট পরা রাধা। বাঁশিটা দু’হাতে ধরা মাথার কাছে। ঘেমে যাওয়া কালো শরীর আর কালো কালো পা ঘুরে ঘুরে নাচতে লাগল কৃষ্ণের পাশে।
চমকে নেত্য সরে গেল দু’পা। গুরুদাস কী বুঝল কে জানে, দম-দেওয়া কলের পুতুলের মতো নাচতে লাগল। মাধবজ্যাঠা গান বন্ধ করে হতভম্ব হয়ে গেল। শুধু রঘুর হারমোনিয়াম বাজতে লাগল জোরে। সনৎ বাঁশি আর লোচনকা খোল বাজিয়ে গেল চোখ বন্ধ করে। গুরুদাসের ঠোঁটের কোণে তখন এক চিলতে হাসি! মাথার ওপরে দু’হাতে বাঁশি তুলে নিয়ে কৃষ্ণের চার দিকে ঘুরে ঘুরে নাচতে লাগল রাধা। ও দিকে মহাপ্রভুর আরতি চলছে আসরের অন্য কোণে। ঝাঁঝর, কাঁসরঘণ্টার তাল ছাপিয়ে উদ্দাম সুরে বাজছে হারমোনিয়াম আর খোল। কোনও তাল আর সুর মিলছে না কারও সঙ্গে, তবু সব বেমানান শব্দ আর তাল যেন জুড়ে জুড়ে আছে একে অপরের সঙ্গে। মিলছে না জেনেও কেউ কাউকে এক বারের জন্যেও ছেড়ে যেতে চাইছে না! রঘুর হারমোনিয়ামে খুব দ্রুত লয়ে যে সুর বাজছে, খুব চেনা সেই কথাগুলোই বিড়বিড় করে গাইতে লাগল দু’জনে— গুরুদাস আর বসন্ত— কৃষ্ণ আর রাধা! অপূর্ব মনোহর সে দৃশ্য!
আসর ঘিরে সবাই হাঁ করে তাকিয়ে রইল। একটা দশ বছরের কালোপানা ছেলে চোখ বন্ধ করে মাথায় বাঁশি তুলে ঘুরে ঘুরে নাচছে কৃষ্ণের চার পাশে। দু’চোখের ধারায় ভেসে যাচ্ছে বুক। রজনীগন্ধা আর গুলঞ্চের গন্ধ হাওয়ার তোড়ে এসে লাগছে সবার নাকে। সনৎকার বাঁশিতে তখন আনন্দের সুর— ‘যুগল ভাঙা হবে না আর, এমনি ঠাকুর সবাই দেখুক... ও প্রেম, আমাদের এমনি ঠাকুরযুগল...’
ছবি: বৈশালী সরকার
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy