বাজারে ঢুকে হকচকিয়ে গেলেন নিরুপম। ছোটবেলায় হরির লুঠ দেখেছেন। সেই স্মৃতি মনে পড়ে গেল।
অন্য দিন দোকানদার বেচে, খরিদ্দার যাচাই করে কেনে। আজ আর দেখাশুনোর বালাই নেই, যে যা পারছে থলিতে ঢোকাচ্ছে।
গোপাল চেনা লোক। কোনও রকমে কাছাকাছি পৌঁছে বললেন, “দাও হে, দু’কেজি আলু আর এক কেজি পেঁয়াজ।”
গোপাল আড়চোখে তাকাল, “বেশি করে কিনে রাখুন মেসোমশাই, যে কোনও সময় বাজার বন্ধ হয়ে যাবে।”
“বন্ধ? কী সাংঘাতিক! কেন?”
“শোনেননি, ‘করুণা’ না কী যেন এক খারাপ রোগ এসেছে। ভীষণ ছোঁয়াচে। বাজার খোলা থাকলে লোক জমবে। আর লোক জড়ো হলেই অসুখ ছড়াবে।”
গোপালের দৃষ্টিতে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে করুণাও ছিল বোধহয়। গায়ে মাখলেন না নিরুপম। তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে হাঁটা দিলেন। খবরটা রমলাকে না জানালেই নয়।
পিঙ্কি ফিরল সবার আগে। ওর ছিল আজ পরীক্ষার শেষ দিন।
ঘরে ঢুকে কাঁধের ব্যাগটা সোফার উপর ছুড়ে দিয়ে চিৎকার করে উঠল, “ডিসগাস্টিং!”
রমলা কাছে গেলেন, “কী হল?”
“কী আবার! পরীক্ষা পোস্টপোন্ড।”
নিরুপম জানতে চাইলেন, “কবে হবে কিছু বলেছে?”
জবাব না দিয়ে গজগজ করতে করতে বাথরুমে ঢুকল পিঙ্কি।
নিরুপম রমলার দিকে তাকালেন, “মেজাজ গরম কেন?”
“বুঝলে না? পরীক্ষা শেষ হলে কোথায় যাবে, কী কী করবে, বন্ধুদের সঙ্গে সব প্ল্যান করা আছে। পরীক্ষা পিছোনোয় সব ভন্ডুল।”
পিউ এল একটু পরেই। ওরও স্কুল ছুটি হয়ে গেছে।
“কবে খুলবে কিছু জানা গেল?”
“আপাতত অনির্দিষ্টকাল বন্ধ।”
শোবার ঘরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিল পিউ। তার পর, মনে হল, ঋষির সঙ্গে ফোনে কথা বলতে শুরু করল।
ঋষি ফিরল দুপুর পার করে।
“এত দেরি হল?”
পিউয়ের প্রশ্নের জবাবে ঋষি বলল, “আর বোলো না। অফিসের মাথাটা তো ফিলাডেলফিয়ায়। সেটা দেখতে পাওয়া যায় না বলে লেজের দিকে তাকিয়ে থাকে এখানকার সবাই। লেজ যে দিকে নড়বে, ডিসিশনও সে দিকে।”
“কী ডিসিশন হল? ছুটি?”
নিরুপমের দিকে তাকিয়ে ঋষি বলল, “না বাবা। ছুটি এরা সহজে
দেয় না। ওয়ার্ক ফ্রম হোম। বাড়ি থেকেই কাজ।”
ঋজু ফিরল সবার পর। ওর পৃথিবীটা বাইশ গজেই আটকে আছে। ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে ঢুকেছে। ক্রিকেটও নাকি আজকাল কেরিয়ার। একটু নাম করতে পারলেই আইপিএল। আর এক বার আইপিএল-এ নাম উঠলে... এ সব অবশ্য ওদের মুখে শোনা। নিরুপম বোঝেন না।
“কী ঋজুবাবু? কী খবর?”
জুতোর ফিতে খুলতে খুলতে ঋজু বলল, “কাল থেকে অ্যাকাডেমিও বন্ধ। কেস জন্ডিস।”
মস্ত ড্রয়িং-কাম-ডাইনিং রুম দেখেই ফ্ল্যাটটা পছন্দ হয়েছিল নিরুপমের। রমলা ঠাট্টা করে বলতেন, “বুড়ো বয়সে ফুটবল খেলার শখ হয়েছে। ঘরের দু’পাশে গোলপোস্ট পুঁতে দিলেই হয়।”
নিরুপম জবাব দিতেন না। কিন্তু দুপুরে সবাই যখন বেরিয়ে যায়, রমলা তাঁর প্রিয় সিরিয়াল চালিয়ে পা ছড়িয়ে বসেন, ড্রয়িংরুমটা তার বিশালতা নিয়ে নিরুপমকে মুখ ভেঙায়। খবরের কাগজগুলো সঙ্গে নিয়ে ব্যালকনিতে উঠে যান নিরুপম।
আজ বিকেলে এক পশলা ঝড়বৃষ্টি হয়েছে। রমলা সিরিয়াল চালিয়েও বন্ধ করে দিয়েছেন। খবরের কাগজগুলো পড়ে আছে, এখনও উল্টে দেখা হয়নি। টিভির খবরটায় এক বার চোখ লাগিয়েছিলেন। সেখানে আক্রান্ত ও মৃত রোগীর সংখ্যা, যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে, দেখেই চোখ সরিয়ে নিয়েছেন।
এবং তার পরই সোফায় এসে বসেছে ঋষি, ঋজু, পিউ এবং পিঙ্কি।
কালোর মাকে বলে তেলেভাজা করিয়েছেন রমলা। মুড়ি মেখেছেন নিজের হাতে। মস্ত বাটিটা সবার মাঝখানে। সবাই একটু একটু করে তুলে মুখে ঢোকাচ্ছে। নিরুপম বসেছিলেন এক ধারে। ব্যালকনির দরজাটা খুলে দিয়ে এলেন। এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া ঢুকল ঘরে।
সোফায় বসতে বসতে আড়চোখে রমলার দিকে তাকালেন। রমলার কথাগুলো মনে পড়ল। এত দিন পর তাঁর সাধের ড্রয়িংরুম ভরে উঠল।
ঋষিকে চিন্তিত দেখাচ্ছিল। “কাল বাবার সঙ্গে আমিও যাব বাজারে। জিনিসপত্র স্টক করে রাখতে হবে।”
“তা হলে তো একটা লিস্ট করে ফেলতে হয়,” নিরুপম বললেন।
রমলা বললেন, “ও আমার করা হয়ে গেছে। সারা দুপুর আমি আর পিউ মিলে ফর্দ করে ফেলেছি। একটা মাসকাবারি, অন্যটা মাছমাংস, কাঁচাবাজার। কাল বেরোবার সময় হাতে ধরিয়ে দেব।”
পিঙ্কি পাশ থেকে ফোঁস করে উঠল, “আমারও দু’-একটা জিনিস অ্যাড করার আছে।”
“ঠিক আছে, লিস্টে ঢুকিয়ে দিস।” ঋষি বলল।
পিউ এত ক্ষণ চুপ করে ছিল। এ বারে মুখ খুলল। “কী বিচ্ছিরি ভাইরাস! বড় বড় সায়েন্টিস্টকে ঘায়েল করে ফেলল! না একটা ওষুধ, না একটা ভ্যাকসিন!”
“শোনা যাচ্ছে, মানুষের ল্যাবরেটরিতে তৈরি এই ভাইরাস। বেরিয়ে এসে স্রষ্টার উপরেই দাঁতের ধার পরখ করেছে।”
আলোচনাটা গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে দেখে ঋজু কথা ঘোরাল। “আজ আমাদের ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে খুব মজা হয়েছে।”
“কী রকম?”
“ট্রেনার শ্যামলদা প্রথমেই সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং নিয়ে জ্ঞান দিলেন। তার পর একগোছা মাস্ক সকলের সামনে ছড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘পরে ফ্যালো’।”
“ভালই তো বলেছেন।”
“আরে শোনোই না তার পর কী হল। মুখোশ পরে তো ট্রেনিং শুরু হল। সবারই কিছু না কিছু ভুল হচ্ছে, এ দিকে শ্যামলদা ধরতেই পারছেন না ভুলটা কার। পুলক ভুল করলে রকিব বকুনি খাচ্ছে, শেষে এমন হল যে ভুল করছে, সে-ই হাসতে শুরু করছে। কারণ শাস্তি তো সে পাবে না।”
ঋষি তাড়াতাড়ি ঋজুকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল, “ভাল মনে পড়েছে, মাস্ক। আর স্যানিটাইজ়ার। ও দু’টোও লিস্টে ঢুকিয়ে দিয়ো।”
“ক’টা আর মাস্ক লাগবে! এখন তো আর বেরোনো হচ্ছে না।”
পিউয়ের দিকে তাকিয়ে ঋষি বলল, “কেনাকাটা করতে বেরোতে তো হবেই। তা ছাড়া, কাজের লোক আসবে, গ্যাস সাপ্লাই করে যে ছেলেটা, সে-ও আসবে। বাইরের লোক আসা তো বন্ধ করা যাবে না। পারলে বাড়িতেও মাস্ক পরে থাকা উচিত।”
এত ক্ষণ চুপ করে থেকে অন্যদের কথা শুনছিলেন নিরুপম। এ বার বলে উঠলেন, “আবার মুখোশ?”
সবাই ঘুরে তাকাল।
পিউ প্রশ্ন করল, “আবার মানে?”
নিরুপম উত্তর দিলেন না।
ঝড় উঠলে কোনও কোনও গাছের হাত-পা ভাঙে। কেউ আবার গোড়া থেকে উপড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ব্যালকনিতে বসে আহত ও নিহত গাছগুলিকে দেখছিলেন নিরুপম। বিকেলের ঝড়ের ফল। দেখতে দেখতে হঠাৎ মনে হল, ভাঙা গাছগুলোরও কি প্রেশার-শুগার-হাঁপানি, কোনও কো-মর্বিডিটি ছিল!
পিউ এসে বসল পাশে।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে পিঙ্কি-ঋজু শুতে চলে গেছে। নীরবতা একটু একটু করে ঢেকে দিচ্ছে চারপাশ।
নিরুপম জানেন কেন এসেছে পিউ। প্রশ্নটা জিইয়ে রেখেছে। একান্তে জিজ্ঞেস করবে বলে।
“তখন তো কথাটার উত্তর দিলেন না। এ বার বলুন। ‘আবার মুখোশ’ কেন বললেন? মুখোশ তো এখনও পরাই হয়নি!”
“ঠিক বলছ তো? ভেবে বলছ?”
পিউ বুঝতে না পেরে অন্ধকারে নিরুপমের মুখ পড়বার চেষ্টা করল।
“এই যে অসময়ে কেউ কিছু তোমাকে জিজ্ঞেস করলেই তুমি ফোঁস করে ওঠো— এখন বিরক্ত কোরো না তো, দেখছ না খাতার পাহাড়!— তোমার এই খাতার বান্ডিল কি একটা মুখোশ নয়?”
পিউ ঢোক গিলল, “আর আপনার ছেলে? তার কোনটা মুখোশ?”
“ল্যাপটপ। কম্পিউটার। কাজ। কিংবা কাজের অছিলা।”
“পিঙ্কি? ঋজু?”
“পিঙ্কির জগৎ ওর সেলফোনের দু’ইঞ্চি বাই তিন ইঞ্চির খোপে আটকে গেছে। ঋজুর মুখোশ ওর বাইশ গজ। তোমার শাশুড়ির পৃথিবী থেকে সিরিয়াল সরিয়ে নিয়ে এক বার দেখো না কী রিঅ্যাকশন হয়!”
“আপনারও তো মুখোশ খবরের কাগজ। দিনরাত কাগজে মুখ আড়াল করে বসে আছেন।”
“কী করি বলো! তোমাদের সবার মুখোশে ধাক্কা খেতে খেতে মনে হল, আমারও একটা মুখোশ দরকার। খুঁজতে খুঁজতে পেয়েও গেলাম। দু’টোর জায়গায় তিনটে করে খবরের কাগজ নিতে শুরু করলাম। আমার নিজস্ব পৃথিবী তৈরি হয়ে গেল।”
কোথা থেকে এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া ভেসে এল।
আঁচলটা গায়ে জড়াতে জড়াতে পিউ বলল, “রাত করবেন না। আপনার আবার ঠান্ডার ধাত।”
নিরুপম গাঢ় গলায় বললেন, “আজ সন্ধেয় ড্রয়িংরুমটা কেমন ভরে উঠেছিল দেখেছ? আর... আর কারও মুখে কোনও মুখোশ ছিল না।”
শেষের পরে...
মারণ-ভাইরাসের ছায়া পৃথিবীর উপর থেকে সরে গেছে। স্কুল খুলে গেছে। খাতার পাহাড় নিয়ে পিউ হিমশিম খাচ্ছে। ঋষি ফিরে গেছে ল্যাপটপের আড়ালে। পিঙ্কির হাত থেকে সেলফোন সরানো যাচ্ছে না। ঋজুর ক্রিকেট অ্যাকাডেমিও আবার সেই আগের মতোই।
বড় ড্রয়িংরুমের এক পাশে বসে রমলা টিভি সিরিয়ালে ডুবে আছেন। অন্য পাশে এক কোণে বসে রোজকার খবরের কাগজ মুখস্থ করে চলেছেন নিরুপম।
ভাইরাস নেই।তাই প্রয়োজন নেই মুখোশের। মুখোশ খুলে ফেলেছে সকলে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy