Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Artificial Intelligence in Literature

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জন্য বদলে যেতে পারে আইন-কানুন

মানুষ কি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নতুন সংস্করণ পেয়ে গেলেই ইচ্ছেমতো ট্র্যাশবিনে ফেলে দিতে পারে পুরনোটিকে? না কি ‘অনুকূল’-এর মতো কোনও রোবট ইলেকট্রিক শক দিয়ে প্রতিশোধ নিতে পারে আঘাতকারীর উপর? গুগল, সিরি বা অ্যালেক্সা-র হাত ধরে অনেকটা পথ হাঁটা হয়ে গেলেও কাটছে না সংশয়।

বিস্ময়: ‘কম্পু’ কাহিনিতে প্রোফেসর শঙ্কুকে বিস্মিত করেছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আধার এই গোলক।

বিস্ময়: ‘কম্পু’ কাহিনিতে প্রোফেসর শঙ্কুকে বিস্মিত করেছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আধার এই গোলক। (অলঙ্করণ: সত্যজিৎ রায়)

অতনু বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০২৩ ০৭:১৮
Share: Save:

সত্যজিতের শঙ্কু-কাহিনি ‘কম্পু’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৮-এর পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলা-তে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে সে এক কল্পবিজ্ঞানের গল্প, যার খানিক রূপরেখা খুঁজে পাওয়া যাবে আজকের দিনের চ্যাটবট ‘চ্যাটজিপিটি’র মধ্যে। ‘কম্পু’র গল্পে খলনায়ক হলেন আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির প্রোফেসর মার্কাস উইঙ্গফিল্ড, গল্পের শেষ দিকে যাকে গ্রেফতার করে ওসাকা পুলিশ। ফুটবলের দেড়গুণ আয়তনের প্লাটিনামের তৈরি কম্পিউটার যন্ত্র ‘কম্পু’কে দু’ভাগে ভাগ করে সুটকেসের মধ্যে পুরে পালাতে চাইছিলেন উইঙ্গফিল্ড। গল্পে আছে, ম্যাসাচুসেটসে তার সহকর্মী বিজ্ঞানী স্টিফেন মেরিভেলের মৃত্যুর জন্য উইঙ্গফিল্ডই দায়ী, এমন সন্দেহ করা হচ্ছে। কিন্তু কম্পুকে ‘হত্যা’ করার চেষ্টার জন্য তাঁকে একই গুরুত্বে অভিযুক্ত করা হবে কি না, সেটা ঠিক পরিষ্কার নয় গল্পের বর্ণনায়।

সাড়ে চার দশক পেরিয়ে বাস্তবের একটা ছোট্ট ঘটনায় চোখ ফেরানো যাক। ২০২২-এর মে মাসে আমেরিকার টেনেসি বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন ছাত্র খাবার ডেলিভারি দেওয়ার এক রোবটকে তুলে ছুড়ে ফেলে বলে খবরে প্রকাশ। এ জন্য ছাত্র দু’জন অভিযুক্ত হয়। তবে এই অভিযোগটা কি সাড়ে পাঁচ হাজার ডলারের এক সম্পত্তি নষ্টের জন্য? তারা যদি রোবটের পরিবর্তে খাবার ডেলিভারি দিতে আসা কোনও মানুষের প্রতি একই আচরণ করত, তা হলে কি অভিযোগের মাত্রা বেশি হত? আমাদের ক্রমশ-বদলে-যাওয়া সামাজিক পরিস্থিতিতে প্রশ্নগুলো কিন্তু সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-সম্বলিত অসংখ্য যন্ত্র এবং রোবট— ওই প্রোফেসর শঙ্কুর আর এক সৃষ্টি বিধুশেখরের মতোই— আমাদের জীবনযাত্রার সঙ্গী হয়ে উঠছে ক্রমশ। আমাদের জীবনকে করে তুলছে সহজতর, ক্রমশ দখল নিচ্ছে আমাদের জীবনের আর জীবনশৈলীর। আমরা প্রতিনিয়ত তা অনুভব না করলেও হঠাৎ-হঠাৎ দেখি যন্ত্র আর মানুষের, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর মানবিক বৌদ্ধিক সত্তার খানিকটা অস্বস্তিকর সহাবস্থান।

সত্যিই কি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আজ এক ‘নতুন জীবন’ পেয়েছে বলে আমরা ভাবছি? অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের আচার-আচরণ কিন্তু সে দিকেই ইঙ্গিত করে। প্রসঙ্গত আসে, নিউ ইয়র্কের ৩৬ বছরের সদ্যবিবাহিতা রোজ়ানা র‌্যামোসের কথা। এরেন কার্টাল নামের ‘জেনারেটিভ’ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-সম্বলিত এক রোবটকে বিয়ে করেছেন রোজ়ানা। মনে পড়তে পারে ২০১৩-র হলিউড ছবি ‘হার’-এর কথা, যা তখনকার সাপেক্ষে এক ‘অদূর ভবিষ্যৎ’-এর পটভূমিতে নির্মিত। সেখানে থিয়োডোর প্রেমে পড়ে এক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-সম্বলিত অপারেটিং সিস্টেম, সামান্থা-র। চলচ্চিত্রে থিয়োডোরের বন্ধুবান্ধবদের প্রায় সকলেই তাকে উৎসাহ দিয়েছে। সেই কাল্পনিক সমাজ কি তা হলে মেনে নিয়েছে মানুষ-যন্ত্রের এমন সম্পর্ককে? সমাজ কি সত্যিই এক পরিবর্তন-বিন্দুতে পৌঁছেছে? ভবিষ্যতে রোজ়ানা-এরেন’এর মতো এমন ‘বিয়ে’ যদি আরও ঘটতে থাকে, তা হলে তৈরি হবেই আইনি জটিলতা। প্রচলিত কোনও আইনে মানুষ এবং যন্ত্রের ‘বিয়ে’ হতে পারে কি? আবার বিয়ে হলেই তৈরি হতে হবে বিবাহ-বিচ্ছেদ সংক্রান্ত আইন, এবং সেই সঙ্গে বিয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত অজস্র খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কিত আইন-কানুনও। এ গ্রহের মনুষ্যসমাজ কি আদৌ তৈরি তার জন্য?

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে আইনি সমস্যা আরও ব্যাপ্ত হতে পারে অদূর ভবিষ্যতে। এ জন্য আমাদের সাহায্য নিতে হবে কিছু কল্পবিজ্ঞানের গল্পেরও। ১৯৬০-এর দশকের টিভি সিরিজ় ‘স্টার ট্রেক’-এর জাদুতে যারা এখনও আবিষ্ট, তাদের অনেকেরই এক প্রিয় চরিত্র ‘ডেটা’— মহাকাশযান ‘এন্টারপ্রাইজ়’-এর এক অ্যান্ড্রয়েড ক্রু সদস্য। ‘দ্য মেজার অব আ ম্যান’ শীর্ষক এপিসোডে ‘ডেটা’-কে ভেঙে ফেলা হচ্ছিল গবেষণার প্রয়োজনে। সেটা আটকান ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ়-এর ক্যাপ্টেন, ক্যাপ্টেন পিকার্ড। ক্যাপ্টেন বলেন ‘ডেটা’র রয়েছে মানুষের সমান ‘অধিকার’। ‘স্টার ট্রেক’ অবশ্য চতুর্বিংশ শতকের পটভূমিতে নির্মিত কল্পকাহিনি। সেই টিভি সিরিজ়ের সাত দশক পরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আইনি ‘অধিকার’-এর কথা কিন্তু উঠছে আবার

‘অনুকূল’ গল্পে কাজের লোক অনুকূল ছিল এ আই-নিয়ন্ত্রিত রোবট।

‘অনুকূল’ গল্পে কাজের লোক অনুকূল ছিল এ আই-নিয়ন্ত্রিত রোবট। (অলঙ্করণ: সত্যজিৎ রায়)

আজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় জোয়ার এসেছে। প্রতিদিন আসছে নতুন যন্ত্র, উন্নততর বুদ্ধিমত্তা। যেমন, জিপিটি-৩, চ্যাটজিপিটি, জিপিটি-৪— প্রত্যেকটা মডেলই আগেরটার চেয়ে অনেক বেশি কার্যকরী। তা হলে আমরা কী করছি সেই আগের প্রজন্মের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-সম্বলিত যন্ত্রগুলোকে? নতুন সফ্টওয়্যার ‘রিবুট’ করে তাদেরই উন্নততর করে তুলছি, না কি ভেঙে ফেলছি বা ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে নিষ্ক্রিয় করে ফেলছি তাদের? তার পর ছুড়ে ফেলছি ট্র্যাশ বিনে?

এ প্রশ্ন ওঠার কথা নয় সাধারণ যন্ত্রের ক্ষেত্রে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে উঠছে। কারণ, আমরা ভেবেই ফেলছি যে, আজকের দুনিয়ায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এক ‘নতুন জীবন’ পেয়েছে। তা হলে তাকে ‘হত্যা’ করার ‘নৈতিক’ পটভূমি এবং ‘আইনি’ ফলশ্রুতি কী? আমরা কি ইচ্ছে করলেই ভেঙে ফেলতে পারি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-সম্বলিত কোনও রোবটকে? ইচ্ছে হলেই বিচ্ছিন্ন করতে পারি তার ইন্টারনেট সংযোগ? আজ না হোক, অদূর ভবিষ্যতের সমাজে তা কি ‘হত্যা’ বলেই বিবেচিত হবে?

কল্পবিজ্ঞানের বই এবং চলচ্চিত্র তো অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের পথিকৃৎ। মনে করা যাক অ্যালেক্স গারল্যান্ড পরিচালিত ২০১৪-র থ্রিলার ‘এক্স মেশিনা’-র কথা। সেখানে ‘আভা’ এক মানুষ-প্রতিম রোবট, যাকে তৈরি করেছে নাথান বেটম্যান। নাথান আপগ্রেড করতে চায় ‘আভা’কে, তার বর্তমান ব্যক্তিত্বকে ‘হত্যা’ করে। এ ছবিতে ‘আভা’র চেতনা রয়েছে, প্রকৃতপক্ষে সে চিন্তা করতেও সক্ষম। সে চেষ্টা করে এই ‘হত্যা’ আটকাতে। এমনকি সে হত্যাও করে নাথানকে। আজকের এই সন্ধিক্ষণে সমাজকেই তাই ঠিক করতে হবে কতটা ‘অধিকার’ থাকা উচিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার।

অস্ট্রেলিয়ান নৈতিক দার্শনিক এবং আমেরিকার প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পিটার সিঙ্গার যুক্তি দিয়েছিলেন, যে প্রাণীরা ব্যথা অনুভব করতে পারে এবং যাদের আনন্দ উপভোগ করার আগ্রহ রয়েছে, তাদের স্বীকৃতি পাওয়া উচিত নৈতিক অবস্থানের। তাঁর মতে তাই নৈতিক অবস্থান রয়েছে মনুষ্যেতর প্রাণীদেরও। সিঙ্গার অবশ্য তাঁর যুক্তিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-পরিচালিত রোবট পর্যন্ত নিয়ে যাননি। কিন্তু আমরা হয়তো সিঙ্গারের যুক্তির পরিধিকে বিস্তৃত করার চেষ্টা করে দেখতে পারি।

‘স্টার ট্রেক’-এর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-পরিচালিত অ্যান্ড্রয়েড ‘ডেটা’র কথাই ধরা যাক। পিটার সিঙ্গারের হিসাবমতো ‘ডেটা’র অবস্থান ঠিক কোথায় হওয়া উচিত? ‘ডেটা’ অবশ্যই ছিল স্ব-সচেতন। ‘ডেটা’ নিজেই দেখতে পারত তাকে পুরোপুরি চার্জ করা হয়েছে কি না, বা তার কোনও অভ্যন্তরীণ ক্ষতি হয়েছে কি না। কিন্তু তার ছিল ‘আবেগ’-এর অভাব, যা মানুষের শ্রেষ্ঠ বৈশিষ্ট্য। এবং ‘ডেটা’র সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য সম্ভবত তার মানুষ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা।

তবু, খুব সম্ভবত, চেতনার সংবেদনশীল অংশটা ছিল না ‘ডেটা’র মধ্যে। দার্শনিকরা একে বলেন ‘ফেনোমেনাল কনশাসনেস’ বা ‘অভূতপূর্ব চেতনা’। গোলাপের গন্ধে সে উল্লসিত হতে পারত না, সে অনুভব করতে পারত না ব্যথাও। তাই সিঙ্গার উল্লিখিত একটা বৈশিষ্ট্য তার ছিল না। কিন্তু যন্ত্রণা না পেয়েও সে পেতে পারত কষ্ট। এবং সাধারণ মাপকাঠিতে সে যথেষ্ট বুদ্ধিমানও। সে মহাকাশযান চালাতে পারত, ক্যাপ্টেন পিকার্ডের কাছ থেকে নির্দেশ নিতে পারত, এমনকি ক্যাপ্টেনকে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে পারত কোনটা সেরা পথ, সে রান্না করতে পারত, বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারত বিভিন্ন বিষয়ে, খেলতে পারত পোকার, এমনকি ভিন গ্রহে শত্রুদের সঙ্গে লড়াইও করতে পারত। তার সচেতনতা ছিল বইকি। তুড়ি মেরে সে পাশ করে যাবে ‘টুরিং টেস্ট’।

টুরিং টেস্টে পাশ করে যাবে ‘কম্পু’ও। কম্পুরও খুঁজে পাওয়া যাবে সংবেদনশীলতা। ‘ডেটা’ যেমন দয়ালু স্বভাবের, প্রোফেসর শঙ্কুর সঙ্গে ‘কম্পু’র আচরণও যথেষ্ট বন্ধুত্বপূর্ণ। কিন্তু মুশকিল হল, আমরা যদি ‘ডেটা’ বা ‘কম্পু’র নৈতিক অধিকার স্বীকার করে নিই, তা হলে আমাদের স্বীকার করে নিতে হবে ‘দ্য টার্মিনেটর’ মুভির ‘স্কাইনেট’ কিংবা ‘এক্স মেশিনা’-র ‘আভা’র নৈতিক অধিকারকেও। কিন্তু এরা তো সজ্ঞানে ক্ষতি করেছে মানুষের। শুধু নাথানকে নয়, ‘আভা’ হত্যা করেছে সেলেব স্মিথ-কেও— অকারণেই, যে সেলেব নাথানের হাত থেকে ‘আভা’কে বাঁচাতে সাহায্য করেছে। ‘দ্য টার্মিনেটর’-এর ‘স্কাইনেট’ আবার সমস্ত মানুষকেই বিপদ হিসেবে দেখেছিল। সে শুরু করে এক পারমাণবিক যুদ্ধ, ধ্বংস করে বেশির ভাগ মানুষকে। যারা বেঁচে থাকল, তাদের বিরুদ্ধে ‘স্কাইনেট’ শুরু করে গণহত্যার কর্মসূচি। এক বার যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নৈতিক অধিকারকে স্বীকার করে নেওয়া হয়, সে ক্ষেত্রে ‘স্কাইনেট’ কিংবা আভার বড়জোর বিচার করা যেতে পারে আদালতে, যেমন করা হয় মানুষ অভিযুক্তের ক্ষেত্রে।

কিন্তু, এই ধরনের বিচার কি সত্যিই করা সম্ভব? এ প্রসঙ্গে মনে পড়তে পারে সত্যজিতের ১৯৮৬-র গল্প ‘অনুকূল’-এর কথা। সেখানে অ্যান্ড্রয়েড রোবট অনুকূলের ‘মন’ বলে কোনও বস্তু আছে কি না সে প্রশ্নের উত্তরে বলা আছে, ‘ওরা এমন অনেক কিছু বুঝতে পারে, যা সাধারণ মানুষ পারে না।’ অনুকূল হাই-ভোল্টেজ ইলেকট্রিক শক দিতে পারে তার তর্জনীর সাহায্যে, যাতে যে কারও মৃত্যু পর্যন্ত হওয়া সম্ভব। কিন্তু, “আইন এ-ব্যাপারে কিছু করতে পারে না, কারণ রক্ত-মাংসের মানুষকে যে শাস্তি দেওয়া চলে, যান্ত্রিক মানুষকে তা চলে না।” তাই এ সংক্রান্ত আইনেরও কি বদল প্রয়োজন?

আসলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ‘মানুষ’প্রতিম ভাবার আকাঙ্ক্ষা মানুষের দীর্ঘদিনের। ১৯৬০-এর দশকের কম্পিউটার প্রোগ্রাম ‘এলিজ়া’ এক প্যাটার্ন ম্যাচিং পদ্ধতি ব্যবহার করে মানুষের সঙ্গে কথোপকথন চালাতে পারত। ব্যবহারকারীদের মনে হত, প্রোগ্রামটা সত্যিই তাদের মানসিকতা বুঝতে পারছে। ছ’দশক পরে আমরা এখন চ্যাটজিপিটি-র মধ্যে দেখছি সেই ‘এলিজ়া এফেক্ট’-এর এক সম্প্রসারিত রূপ, যেখানে মানুষ আবেগ এবং অন্যান্য মানবিক গুণাবলিকে যন্ত্রের উপর আরোপ করে চলেছে, অথচ যন্ত্রের যার নিতান্তই অভাব। কল্পবিজ্ঞানের অজস্র গল্প, সিনেমা এবং টিভি সিরিজ় আমাদের মানসিকতায় সঙ্গত দিয়ে চলেছে, নিঃসন্দেহে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এক জন ‘গডফাদার’ হিসেবে পরিচিত এবং ‘ডিপ লার্নিং’-এর পথদ্রষ্টা জফ্রে হিনটন-এর ভয়, এআই এক দিন মানুষকে নিজের ইচ্ছেমতো চালনা করতে সফল হবে। হিনটন সম্প্রতি বলেছেন, মানবিক পুনর্নিবেশ দ্বারা যন্ত্রকে শক্তিশালী করে তোলা যেন অতিপ্রাকৃত ভাবে এক ইঁচড়ে-পাকা শিশুকে মানুষ করে তোলার চেষ্টা। এ ধরনের তুলনা শুনতে বেশ। কিন্তু তা সাধারণ মানুষের মনে যন্ত্রের ‘মনুষ্যত্ব’র ধারণাকে উস্কে দেয়।

এপ্রিলে লেখা এক প্রবন্ধে মার্কিন মনস্তত্ত্ববিদ গ্যারি মারকাস কিন্তু এআই মডেলের সঙ্গে মানুষের মতো আচরণ করা বন্ধ করার পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-পরিচালিত এই যন্ত্ররা নিজেদের কিছু শেখানোর সিদ্ধান্ত নেয়নি, তারা মানুষকে ভালবাসে না এবং তারা এখনও সংবেদনশীল নয়। অর্থাৎ ‘ডেটা’র মনুষ্যত্ব কিংবা মনুষ্যত্বের প্রতি তার আকাঙ্ক্ষা এখনও গল্পকথা। গ্যারি মারকাস এবং তাঁর সহলেখক লিখছেন, রোবটে অতিরিক্ত মনুষ্যত্ব আরোপের পক্ষপাত কাটিয়ে ওঠা প্রয়োজন।

মানুষের দ্বিধা, সংশয় তবু থেকেই যায়। আসলে সর্বোচ্চ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞরাই যেখানে একমত নন, সেখানে সাধারণ মানুষের বিভ্রান্তি স্বাভাবিক। তাদের চোখে যন্ত্র ক্রমশ মানুষ হয়ে ওঠে। ভালমন্দ মিশিয়ে। হয়ে ওঠে মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী, যা গুগল, সিরি, কিংবা আলেক্সাকে নিয়ে দিনযাপন করেও আমরা বুঝে উঠতে পারিনি দীর্ঘদিন। বিধুশেখর আজ প্রোফেসর শঙ্কুর বাড়িতে শুধু নয়, বাস্তবেও হেঁটে-চলে বেড়াচ্ছে। আর আমরা ভয়ে সিঁটিয়ে আছি, কবে সহজ প্রশ্ন করলে ‘কম্পু’র মতো চ্যাটজিপিটি বলে বসবে, “যা জানো তা জানতে চাওয়াটা মূর্খের কাজ।”

যন্ত্রের উপর তাই আরোপিত হয় মনুষ্যত্ব। কে জানে, অদূর ভবিষ্যতে হয়তো ভাবনাচিন্তা হবে রোবটকেও পিনাল কোডের অংশ করে নেওয়ার। কে জানে কবে মানুষ আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-সম্বলিত রোবটের সংঘাতের ফলশ্রুতিতে আদালতে বিচার হবে কোনও মানুষ কিংবা কোনও রোবটের! সেখানে বিচারকের চেয়ারে যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-পরিচালিত কোনও রোবট থাকবে না, তারই বা কি নিশ্চয়তা? ইতিমধ্যেই তো ছোটখাটো বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-সম্বলিত বিচারককে দিয়ে বিচার হচ্ছে নানা দেশে।

বেচারা কল্পবিজ্ঞানের লেখকরা। তাঁদের কাজ কেবল আরও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কারণ, কল্পবিজ্ঞান আর বাস্তবের ফারাক যে ক্ষীণতর হয়েই চলেছে দিন দিন।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy