স্বাধীনতার ১০০ বছরে, ভারতে ইচ্ছামৃত্যু বৈধ হওয়ার দু’দিনের মধ্যে, মেট্রো রেলের আত্মহত্যাকামীদের জন্য নতুন নিয়ম আনল রাজ্য সরকার। এই নিয়ম অনুযায়ী, যে কেউ এসে ঝাঁপ দিয়ে মরে গিয়ে মেট্রোর আভিজাত্য ক্ষুণ্ণ করতে পারবে না। একমাত্র যোগ্য ব্যক্তিরাই ঐতিহ্যশালী মেট্রো রেলের চাকায় মরবার সুযোগ পাবেন। মেট্রোয় গলা দিতে চাইলে প্রথমে একটা ফর্ম ফিল আপ করতে হবে। ফর্মটি সরকারের ফেসবুক-ওয়ালে পাওয়া যাবে। আবেদনপত্র পূরণ করে ১০০ টাকার সঙ্গে জমা দিতে হবে (তপশিলি জাতি ও উপজাতির জন্য ৫০ টাকা)। মৃত্যুপ্রার্থীদের একশো নম্বরের লিখিত পরীক্ষা দিতে হবে। দশ নম্বরের অবজেক্টিভ প্রশ্ন থাকবে সাধারণ জ্ঞানের ওপর। ষাট নম্বরের টীকা প্রশ্ন থাকবে জীবন-মৃত্যু-মনস্তত্ত্ব ও দর্শন বিষয়ে। যে স্টেশনে আত্মহত্যা করতে চান, সেই স্টেশন যে মনীষীর নামে, তাঁর উপরে প্রবন্ধের জন্য ত্রিশ নম্বর বরাদ্দ। লিখিত পরীক্ষায় পাশ করলে এম.এস.সি (মেট্রো রেল সুইসাইড কাউন্সিল)-র ইন্টারভিউয়ে ডাকা হবে। তার পর, প্রতিটি স্টেশনে সকাল-সন্ধেয় দুজন হিসেবে, নির্বাচিতদের আত্মহত্যায় সাহায্য করা হবে। তাঁদের সে দিন টিকিট কাটতে হবে না। বিশেষ কমিটি সুইসাইড নোটও যত্ন করে লিখে দেবে। মৃতের পরিবার আজীবন নিখরচায় মেট্রোর প্ল্যাটফর্মে এসে এসকালেটরে যত বার খুশি ওঠানামা করতে পারবেন। আত্মহত্যা করতে গিয়ে ভয় পেলে, পেছন থেকে ধাক্কা দেওয়ার জন্য রোবট রাখা হবে। কারণ, রোবটের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ খাটে না। বিরোধীরা মুখ বেঁকিয়ে বলেছেন, এ সবই হল নতুন অরাজনৈতিক শাসক দল ‘বঙ্গীয় আদর্শ পার্টি’ (বাপ)-এর গিমিক। এ ছাড়া, ফেসবুকের নির্দিষ্ট লিংক-এ ক্লিক করলে ফর্মের জায়গায় মিলছে একটা বড় কুকুরের ছবি! সরকার বলেছে, প্রকল্পটির জনপ্রিয়তা আন্দাজ করে, লঞ্চ করা মাত্র দুষ্কৃতীরা সাইট হ্যাক করেছে!
সালমান হায়দার, বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ
লিখে পাঠাতে চান ভবিষ্যতের রিপোর্ট? ঠিকানা:
টাইম মেশিন, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। অথবা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in
‘আমিই সারা রাত বাজিয়ে দেব!’
আশির দশকের শুরু। তখন কলেজের ছাত্র। গানবাজনা ভালবাসতাম। শীতকাল জুড়ে এখানে-ওখানে ‘ফাংশন’, মানে, গানের জলসা হত। যতগুলোয় সম্ভব হাজির থাকার চেষ্টা করতাম। দমদম গোরাবাজারে সম্মিলনী ক্লাবের এক জলসায় খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে। গান শেষে যখন উনি গাড়ির কাছাকাছি, ভাবলাম, এই সুযোগ। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছিলাম। আমার মাথায় হাত রেখে সে দিন কিছু বলেছিলেন কি না, মনে নেই। শুধু মনে আছে, জলসার উদ্যোক্তারা যখন বলছিলেন, হেমন্তদা, টাকাটা গুনে নিন, তখন উত্তর এসেছিল, ‘আরে না না, আপনারা কি কম দেবেন নাকি!’
এ সময় আমাদের পাড়ায় থাকতে এলেন প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়, রেডিয়োর তবলচি। বিখ্যাত গায়ক শৈলেন দাসের সঙ্গে তবলা বাজাতেন। প্রদীপদার উদ্যোগেই আমাদের পাড়ায় শুরু হল রাতভর ধ্রুপদী সঙ্গীতের আসর। বহু বিখ্যাত শিল্পীর কাছাকাছি আসতে পেরেছি তখন। এক রাতে সাবির খান তবলা বাজাচ্ছেন, সঙ্গে নাচে আর এক শিল্পী। তবলা আর নাচ দুই-ই জমে উঠেছে, হঠাৎ ঢং, ঢং, ঢং... পাশের কারখানার মস্ত ঘড়ি সশব্দে জানান দিল, রাত বারোটা। তবলচি আর নৃত্যশিল্পী, দুজনের তালেরও বারোটা বাজল। গোড়ায় ভ্যাবাচ্যাকা, পরে এক চোট হাসি। শেষে ফের গোড়া থেকে নাচ শুরু।
এ ভাবেই এ.টি. কানন, মালবিকা কানন, মহাপুরুষ মিশ্র, শ্যামল বসু, আলি হোসেন বা শ্রীকান্ত বাকড়ে-কে সামনে থেকে দেখা। দমদম টাউন হল-এ জলসা, শ’খানেক মিটার দূরে একটা বাড়িতে শিল্পীদের রাখা হয়েছিল। তবলিয়া শ্যামল বসুকে সেখান থেকে মঞ্চে নিয়ে আসার দায়িত্ব আমার। গিয়ে বললাম, চলুন। উনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘গাড়ি কোথায়?’ একশো মিটার দূরে মঞ্চে যাওয়ার জন্য গাড়ি! ঢোক গিলে বললাম, না, মানে, এইটুকু রাস্তা... উনি আমার দিকে না তাকিয়ে, তবলায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, ‘ফাংশনটা তবে এই ঘরেই হোক!’ শেষ পর্যন্ত অবশ্য পায়ে হেঁটেই গিয়েছিলেন, অপূর্ব তবলা-লহরায় মাত করেছিলেন।
আশির দশকে রবীন্দ্র সদনে এক অনুষ্ঠানে সেতার বাজাচ্ছেন উস্তাদ বিলায়েত খান।
সে বারই ভোর রাতে শ্রীকান্ত বাকড়ে-র গলায় কবীরের ভজন শুনেছিলাম, আর আলি হোসেন আর সোহনলাল শর্মার সানাই-হারমোনিয়ামের অসাধারণ যুগলবন্দি।
এমনই এক বার, বিলায়েত খান সাহেবের মুখোমুখি। ওঁর দেখভালের দায়িত্বে আমি। শুনেছিলাম উনি খুব মুডি, তাই খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম। হঠাৎ হাত নেড়ে কাছে ডাকলেন। ‘বেটা, একটা ভাঁড় হবে!’ ভাবলাম, চা খাবেন। বললেন, ‘বেটা, বিড়ির ছাই ফেলব বলে ভাঁড় খুঁজছি।’ এনে দিলাম। একটা বড় বাক্স থেকে বেশ বড় সাইজের একটা বিড়ি বের করলেন (পরে জেনেছিলাম, ওগুলো দেরাদুন বিড়ি)। এর মধ্যে ওঁর তিন শিষ্য এসে হাজির। ওদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে, আমাকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ বললেন, ‘বেটা, বাজনা শুনবি?’ আমি মাথা নাড়লাম, হ্যাঁ! শুরু হল বাজনা। শুনতে ভালই লাগছিল, যদিও কিচ্ছু বুঝিনি। ওঁর ছাত্ররা মাঝেমধ্যে ‘কেয়াবাত, কেয়াবাত’ বলে উঠছিল। আমি চুপ। খানসাহেব আমার মনের অবস্থা বুঝেছিলেন নিশ্চয়ই, হঠাৎ দেখি, বাজাতে শুরু করেছেন, ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি...’ আমার চোখমুখ উজ্জ্বল, উনিও খুশি। সামান্য একটা ছেলের জন্য অত বড় এক শিল্পীর অমন স্নেহের কথা ভাবলে এখনও গায়ে কাঁটা দেয়। সেই রাতে আর এক বার তাঁর বিরাট মনের পরিচয় পেয়েছিলাম। অনুষ্ঠান চলাকালীন শোনা গেল, খুব বড় আর এক শিল্পী না-ও আসতে পারেন। আমরা ভয়ে কাঁটা। খানসাহেব শুনে আশ্বস্ত করেছিলেন, ‘কেউ না এলে, আমি সারা রাত বাজিয়ে দেব।’
সে রাতে, বিলায়েত খান স্টেজে, দুজন বিদেশি দেখি গেটের কাছে দাঁড়িয়ে। কেতায় ইংরেজি বলার লোভ সামলাতে না পেরে সোজা গিয়ে বললাম, ইয়েস প্লিজ! ওঁরা পরিষ্কার বাংলায় বললেন, ‘কাল আনন্দবাজারে বিজ্ঞাপন দেখলাম, এখানে একটা রাগসংগীতের অনুষ্ঠান হচ্ছে। তাই চলে এলাম।’ আমি তো থতমত, আপনারা, মানে বাংলায়...! ওঁরা জানালেন, বাংলা নিয়ে পড়তেই এ দেশে এসেছেন, ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ার থেকে। বললেন, ‘আমাদের ইংরেজিটা একটু আলাদা, ওই তোমাদের আইতাসি-যাইতাসির মতো।’ আমি শুনে হাঁ! বেশ কিছু দিন পর, মেট্রো সিনেমা হল-এর পাশে ফের ওই দুজনের সঙ্গে দেখা। ওদের সঙ্গে বাংলায় বেশ কিছু ক্ষণ কথা বলেছিলাম। সে দিন বিদেশিদের মুখে অনর্গল বাংলা শোনার জন্য মেট্রো চত্বরে বেশ ভিড় জমে গিয়েছিল।
প্রদীপদাকে এক বার বললাম, ক্লাসিকাল কিছুই বুঝি না, একটা রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যা করলে হয় না? উনি হেসে বলেছিলেন, ‘এখন যে-সব গান তোমার ভাল লাগে, সেগুলো সাধারণ চকলেট। ক্লাসিকাল ভাল লাগতে শুরু করলে টের পাবে ক্যাডবেরির স্বাদ।’ কিন্তু আমাকে অবাক করে সত্যিই একটা রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যা করেছিলেন। সে বার আমার ভার পড়েছিল শ্রীমতী পূরবী দত্তকে নিয়ে আসার। পুরো রাস্তাটা জড়সড়, মাথা নিচু করে পার করে দিয়েছিলাম। সে সময় শিল্পীদের খাবারের প্যাকেট দেওয়ার চল ছিল। মনে আছে, মঞ্চে শিল্পী চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় গাইছেন ‘বলি ও আমার গোলাপবালা’, পূরবীদি তন্ময় হয়ে শুনছেন, মাথাও দোলাচ্ছেন। ঠিক তখনই আমাদেরই কেউ এক জন ওঁর দিকে এগিয়ে দিলেন ডিম-পাউরুটি, সঙ্গে দু-চার পিস মিষ্টি। খুব বিরক্ত হয়ে হাত নেড়ে ওঁর সেই খাবার প্রত্যাখ্যানের দৃশ্য আজও চোখে ভাসে। ওঁর চোখমুখ যেন বলতে চাইছিল, কে হে তুমি এলে আমার সাধনায় ব্যাঘাত ঘটাতে!
সুবীর বসু, ইস্ট মল রোড, কলকাতা
subirbose1@gmail.com
আশির দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?
লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 80’s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান
এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy