দার্শনিক-পণ্ডিত সীতানাথ তত্ত্বভূষণের ছোট মেয়ে সুখময়ী গান শিখছেন ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে যুক্ত সঙ্গীতগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। পাশের ঘরে সুখময়ীর ছেলে বাঁশিতে নিখুঁত তুলে নিচ্ছে সে সুর। শুনে সুরেন্দ্রনাথ অবাক, কে এমন সুন্দর বাঁশি বাজায়! ছাত্রীর ছেলে বাজাচ্ছে শুনে তাকে ডেকে পাঠালেন। খুশি হয়ে একটা গৎও তুলিয়ে দিলেন। এই ছেলেটিই পরবর্তী কালের বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সুবিনয় রায় (৮ নভেম্বর ১৯২১-৯ জানুয়ারি ২০০৪)। কমবয়সে বাঁশি বাজাতেই ভালবাসতেন, অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন পারিবারিক সুহৃদ প্রফুল্ল (বুলা) মহলানবীশের বাঁশি শুনে।
ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জের মালুচি গ্রামে আদি নিবাস, জন্ম কলকাতায়, এক ব্রাহ্ম পরিবারে। বাবা, রসায়নবিদ ও সাহিত্যসেবী বিমলাংশুপ্রকাশ রায় চাকরি করতেন বার্ড কোম্পানিতে। মা সুখময়ী মেডিক্যাল কলেজের মেয়েদের হোস্টেলের সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন, পরে শান্তিনিকেতনে মেয়েদের হোস্টেল ‘শ্রীভবন’-এর সুপার। বড় মাসি সুধাময়ী রবীন্দ্র-জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো সঙ্গীত-ব্যক্তিত্বদের কাছে তালিম নিয়েছিলেন মা-মাসিরা, তাঁদের সূত্রেই সুবিনয় পেয়ে যান গানের ভুবনের ঠিকানা। তা ছাড়া ব্রাহ্ম জীবনচর্যার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে ছিল সঙ্গীত।
মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সিটি কলেজে ভর্তি হলেও ১৯৩৭-৩৮ নাগাদ শান্তিনিকেতন চলে গেলেন সঙ্গীতের অদম্য টানে, আর তখনই বুঝি নির্দিষ্ট হয়ে গেল তাঁর সঙ্গীতময় ভবিষ্যৎ। শিক্ষাভবনে ভর্তি হলেন আইএসসি পড়তে। শান্তিনিকেতনে শৈলজারঞ্জন মজুমদার রসায়ন পড়ান, আবার গানও শেখান। সুবিনয় ভাল গাইতে পারেন দেখে তাঁকে তালিম দিতে শুরু করেন। তাঁর সৌজন্যেই স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে গান শেখারও সুযোগ হয়ে গেল ‘বর্ষামঙ্গল’-এর মহড়ায়। রবীন্দ্রনাথকে সামনে দেখার বিস্ময়াবিষ্ট অভিজ্ঞতার কথা সুবিনয় ভুলতে পারেন না— “একটা গেরুয়া রঙের জোব্বা পরে প্রথম যেদিন এলেন রবীন্দ্রনাথ, আমি মোহিত হয়ে যাই। বড়-বড় চোখ, দুধে-আলতায় রং আর কী স্নিগ্ধ ব্যবহার। এক-একদিন গান লিখতেন আর নিজেই সুর করে শেখাতেন। এখনও মনে আছে, তিনি শিখিয়েছিলেন, ‘মন যে কেমন করে হল দিশাহারা’, ‘সঘন গহন রাত্রি’, ‘ওগো সাঁওতালি ছেলে’, ‘আজি ঝর ঝর মুখর বাদর দিনে’ ইত্যাদি ১৬টি গান।” এখানে উল্লিখিত ‘মন যে কেমন করে’ গানটি হল ‘রিমিকি ঝিমিকি ঝরে’। এই অসামান্য গানগুলি রবীন্দ্রনাথের এই সময়কারই রচনা।
শান্তিনিকেতনে সে সময় সুবিনয় গান শেখেন কবির প্রিয় ভাইঝি ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী মানে বিবিদি ও সমরেশ চৌধুরীর কাছে। সমরেশ চৌধুরীর কাছে যদি পেলেন গায়নের ইশারা, বিবিদির কাছে গান-নির্বাচন, চর্চার দিকনির্দেশ। ‘রবীন্দ্রনাথের যে সব গানে রাগরাগিণীর বেশ স্পষ্ট ছাপ আছে, সেগুলি চর্চা বেশি করে করো’— বিবিদির এই উপদেশ শিরোধার্য করেছিলেন সুবিনয়। আর সঙ্গত ভাবেই সুবিনয়ের গায়নে মেলে সমরেশ চৌধুরীর গাইবার শান্ত, নরম ভঙ্গিটি। বন্ধু রূপে পেলেন এস্রাজ-শিল্পী অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায়কে, যাঁর কাছে সুবিনয় শিখলেন ধ্রুপদ।
১৯৪১-এ কবির মহাপ্রয়াণের আগেই কলকাতা ফিরেছিলেন সুবিনয়, ২২ শ্রাবণে দীর্ঘ শোকযাত্রায় শামিল হলেন। ১৯৪০ সালে, রবীন্দ্রনাথ তখন বেঁচে, বুলা মহলানবীশ কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত-শিক্ষায়তন ‘গীতালি’। উদ্বোধনী ভাষণ দিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু এই শিক্ষাকেন্দ্র স্থায়ী হয়নি। ১৯৪১-এর ৮ ডিসেম্বর শুভ গুহঠাকুরতা ও সুজিতরঞ্জন রায়ের একান্ত উদ্যোগে কলকাতায় তৈরি হল রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ‘গীতবিতান’। ভবানীপুরের এক ভাড়াবাড়িতে যাত্রা শুরু। অধ্যক্ষ শান্তিনিকেতনে প্রশিক্ষিত অনাদিকুমার দস্তিদার, যিনি কলকাতায় এসে রবীন্দ্রগানের প্রচার ও প্রসারে নিজেকে নিয়োজিত করে ছিলেন। উত্তর কলকাতাতেও একটি শাখা খোলা হল সুবিনয়ের বাড়িতে, ১ ভুবন সরকার লেনে। দায়িত্বও নিতে হল সুবিনয়কে। এ দিকে সমরেশ চৌধুরী সঙ্গীত-ভবন ছেড়ে দেওয়ায় ইন্দিরা দেবীর আহ্বানে সুবিনয় সেখানে যোগ দেন শিক্ষক হিসেবে। বছরখানেক পর কলকাতায় ফিরে চাকরি নেন প্রেসিডেন্সি কলেজের স্টাটিস্টিক্যাল ল্যাবরেটরিতে। এটিই ১৯৫৩ সালে বরানগরে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের ‘আম্রপালি’-তে উঠে যায়, নাম হয় ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট।
সুবিনয়ের সঙ্গীতচর্চা কিন্তু থেমে থাকেনি। ধ্রুপদ শিখলেন বিষ্ণুপুর ঘরানার রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে, খেয়াল-ঠুংরি সুখেন্দু গোস্বামী ও সার্বিক উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তীর কাছে। আর এক সঙ্গীত-ব্যক্তিত্ব সুরেশ চক্রবর্তীর সঙ্গীত-সান্নিধ্যও পেয়েছিলেন। তিনিই সুবিনয়কে নিয়ে যান বেতারে, অডিশন দেওয়ান। বেতারের সঙ্গে আমৃত্যু যোগ ছিল সুবিনয়ের।
১৯৪৫-এ অনাদিকুমার দস্তিদারের পরিচালনায় সুবিনয়ের প্রথম রেকর্ড কলম্বিয়া কোম্পানিতে, ‘এই করেছ ভাল’ ও ‘তুমি ডাক দিয়েছ’। পরের বছর দ্বিতীয় রেকর্ড, ‘এলেম নতুন দেশে’ ও ‘গোপন কথাটি রবে না’। প্রথম রেকর্ডে নিবেদনের আকুলতাসমৃদ্ধ পূজার গান, দ্বিতীয়টিতে ভিন্ন মেজাজের নাট্যগীতি— ‘তাসের দেশ’-এর গান। দু’টি রেকর্ডেই ছিল নিশ্চিত প্রতিশ্রুতির স্বাক্ষর। তার পর বিভিন্ন সময় তাঁর রেকর্ড প্রকাশিত হয় প্রধানত হিন্দুস্থান কোম্পানি থেকে— রবীন্দ্রসঙ্গীত ও নানা রচয়িতার ব্রহ্মসঙ্গীত। শেষ দিকে কিছু গান করেন গ্রামোফোন কোম্পানিতে।
প্রথম থেকেই তাঁর কণ্ঠ সুরঋদ্ধ, অভিব্যক্তি আতিশয্যহীন, সূক্ষ্ম অলঙ্করণে তাঁর নৈপুণ্য প্রশ্নাতীত। গায়ন শান্ত, নিবিড়। অথচ সে সময় শিল্পী হিসেবে প্রাপ্য খ্যাতি পাননি, বরং দক্ষ প্রশিক্ষক রূপে সুপরিচিত হন। পঙ্কজকুমার মল্লিকের মতো শিল্পী তখন বয়ঃকনিষ্ঠ সুবিনয়ের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেছিলেন, তাঁর প্রশিক্ষণে রেকর্ডও করেছিলেন, ‘তিমির অবগুণ্ঠনে’, ‘আঁধার অম্বরে’, ‘খরবায়ু বয় বেগে’ আর ‘নাই নাই ভয়’, অথচ রেকর্ডে ট্রেনার হিসেবে সুবিনয়ের নাম ছিল না। সুবিনয় একাধিক প্রতিষ্ঠানে গান শিখিয়েছেন— গীতবিতান, দক্ষিণী, গীতবীথি। শিক্ষক হিসেবে খুবই নিয়মনিষ্ঠ ও কড়া প্রকৃতির ছিলেন। প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে সুবিনয় শিল্পীরূপে যোগ্য সমাদর লাভ করেন। শ্রোতারা উপলব্ধি করেন শুদ্ধতার প্রতিমূর্তি সুবিনয় কী ভাবে স্বরলিপিকে মেনেই স্পর্শ করেন রবীন্দ্রগানের গভীরতা। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘স্বরলিপিসুদ্ধ রবীন্দ্রনাথের গান যদি শুধু পুঁথিবদ্ধ হয়ে থাকত, যদি তা সুবিনয় রায়দের মতো গায়কদের গলায় ধ্বনিত না হত, তা হলে আমাদের জীবনের অনেকটাই কি শূন্য হয়ে যেত না?’
ইন্দিরা দেবীর উপদেশ মেনেই সুবিনয় বেশি করে নজর দিয়েছিলেন রাগ-রাগিণীর প্রত্যক্ষ প্রভাবযুক্ত দুরূহ চালের রবীন্দ্রসঙ্গীতে। ধ্রুপদ অঙ্গের ‘আজি মম মন চাহে’ (বাহার, চৌতাল), ‘ভক্তহৃদিবিকাশ’ (ছায়ানট, সুরফাঁকতাল), ‘জাগে নাথ জোছনারাতে’ (বেহাগ, ধামার) কিংবা খেয়াল অঙ্গে ‘তব প্রেমসুধারসে’ (পরজ, ত্রিতাল), ‘আজি মম জীবনে’ (আড়ানা, ঢিমা ত্রিতাল) ইত্যাদি গান অনায়াস স্বাচ্ছন্দ্যে প্রাণবন্ত করেছেন তিনি। ‘যদি প্রেম দিলে না’ ও ‘এরা পরকে আপন করে’ তালবদ্ধ হলেও সাধারণত মুক্তছন্দেই গাওয়া হয়, সুবিনয় তালে গেয়েই হৃদয় স্পর্শ করেন। আবার মুক্তছন্দে ‘অন্ধজনে দেহ আলো’ বা ‘এ কি করুণা’ও প্রার্থিত মাত্রা পায়। ‘পূজা’ পর্যায়ের আরও কিছু স্মরণীয় গান, ‘গভীর রজনী নামিল’, ‘এমনি করে ঘুরিব’, ‘সদা থাকো আনন্দে’ বা ‘এ কি লাবণ্যে’। তবে শুধু ‘পূজা’-র জটিল চলনের গানেই নয়, ‘প্রেম’-এর ‘আমার আপন গান’, ‘এই উদাসী হাওয়ার’, ‘যুগে যুগে বুঝি’, ‘ওগো স্বপ্নস্বরূপিণী’ গানে যেমন স্বপ্নের মায়াজাল বুনে দেন, আবার ‘প্রকৃতি’-র ‘হেরিয়া শ্যামল ঘন’, ‘শ্রাবণবরিষণ পার হয়ে’ গানে নিবিড় ছবি আঁকেন।
বিভিন্ন রচয়িতার ব্রহ্মসঙ্গীত— দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জাগো সকল অমৃতের’, মনমোহন চক্রবর্তীর ‘অনন্ত অপার তোমায়’ প্রভৃতি গানে ব্রহ্মসঙ্গীতের অজানা খনির সন্ধান দেন।
রবীন্দ্রগানে যন্ত্র-ব্যবহারে তাঁর কোনও গোঁড়ামি ছিল না। বলতেন, গানের মেজাজ অনুযায়ী যে কোনও যন্ত্র সংযত ভাবে বাজতে পারে। তাঁর ‘এ কি সুধারস’ গানে অ্যাকর্ডিয়ানও বেজেছে।
তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্পর্কিত ভাবনার ফসল ‘রবীন্দ্রসংগীত সাধনা’ (১৯৬২) গ্রন্থ। প্রাঞ্জল ভাবে বুঝিয়েছেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের গায়কি, স্বরলিপি, স্বরসাধনা বিষয়ে। বিবাহ করেন শিশু-সাহিত্যিক অমরেন্দ্রনাথ দত্তের কন্যা ইন্দিরাকে। তাঁর দুই পুত্রের মধ্যে সুরজিৎ প্রয়াত, সুরঞ্জন রবীন্দ্রসঙ্গীত-শিল্পী।
বিশ্বভারতী-র দেশিকোত্তম, রাজ্য সঙ্গীত আকাদেমি পুরস্কার প্রভৃতি সম্মানে ভূষিত সুবিনয় রায় দেশে-বিদেশে নানা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। শেষ অনুষ্ঠান ২০০০-এ রবীন্দ্রসদনে।
২০০৪-এর ৯ জানুয়ারি তাঁর প্রয়াণদিবস। রয়ে গেল জন্মশতবর্ষে উপনীত এই শিল্পীর অসংখ্য অতুলনীয় গান, যে-গান শুনে শঙ্খ ঘোষের মনে হয়েছিল ‘জলের ঢেউয়ের তরল তান তুলে’ মনের ‘ভিতরদেশটাকে’ ছুঁয়ে যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy