কবিতাবান্ধব: বুদ্ধদেব বসু ও বিষ্ণু দে (ডান দিকে)। তাঁদের বন্ধুত্বে পারস্পরিক সম্ভ্রম আর শ্রদ্ধার সঙ্গে ছিল নির্ভরতাও।
বিষ্ণু দে নিশ্চয়ই কারও ছদ্মনাম! মনে হয়েছিল বুদ্ধদেব বসুর। যাঁর সঙ্গে বিষ্ণু দে-র গভীর বন্ধুত্বের শুরু হয়েছিল তাঁদের দু’জনেরই লেখালিখির সূত্রপাতের সময় থেকে। যদিও সাহিত্য সম্পর্কে তাঁদের দু’জনের ভাবনা ছিল একেবারে আলাদা। বুদ্ধদেব মনে করতেন, শুধু তা-ই পবিত্র, যা ব্যক্তিগত। আর সময়, সমাজ, রাজনীতির তাপ এড়িয়ে বিষ্ণু দে-র কবিতা পড়াই যাবে না। তাঁদের অনুরাগীদের মধ্যেও দু’টি দলই তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এক দলকে বলা হত ‘বৌদ্ধ’, অন্য দলের নাম ছিল ‘বৈষ্ণব’। মতাদর্শের দিক থেকে এমন ভিন্ন মেরুর দু’জন লেখকের সখ্য এখন অকল্পনীয় মনে হয়। এই সম্পর্কের চর্চা বাংলা সাহিত্যের যে কোনও পাঠকের কাছে যেমন আনন্দের, তেমনই বিষাদেরও। এমন একটি মেধাবী ও আনন্দময় সম্পর্কের অবসান হয়েছিল নির্মম ভাবে। একটি চিঠির সূত্রে। তার পর তা আর কোনও দিনই জোড়া লাগেনি।
বুদ্ধদেব তখন ঢাকায় ‘প্রগতি’ পত্রিকা বার করছেন। তাঁর মধ্যে যে একটা প্রচারক-সত্তা ছিল, তার লালন শুরু হচ্ছে তখন। নানা জায়গা থেকে লেখা পাচ্ছেন, লেখা ভাল লাগলে তা ছেপেই শুধু শান্ত হতে পারছেন না, সেটা নিয়ে আলোচনা করছেন, লেখকের সঙ্গে কথা বলছেন। লেখা পাঠালেন বিষ্ণু দে-ও। একটি গল্প। নাম ‘পুরাণের পুনর্জন্ম’। বুদ্ধদেব তখনও তাঁকে চিনতেন না। লেখা ভাল লাগল তাঁর, কিন্তু মনে হল লেখক ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন। বিষ্ণু দে-কে লেখা চিঠিতে তাই জানালেন তিনি, ‘গল্পটি আমাদের বিশেষ ভালো লাগিয়াছে।... কিন্তু আপনাকে আমরা ছদ্মনামধারী বলিয়া সন্দেহ করি। যদি তা-ই হয়, তবে আপনার আসল নামটি দয়া করিয়া আমাদের জানাইবেন।’ যদিও, বুদ্ধদেব লেখককে ভরসা দিয়েছিলেন এই বলে যে, ‘...আপনি যদি ইচ্ছা করেন, তবে আপনার যথার্থ নাম যাহাতে পাঠকবর্গের কেহ জানিতে না পারেন সে বিষয়ে আমরা বিশেষ যত্নবান থাকিব।’ এই চিঠি পেয়ে বিষ্ণু দে স্বভাবতই বিপন্ন ও বিচলিত হয়েছিলেন। এতটাই যে, তিনি লিখেছিলেন, গল্পটি তাঁর স্বনামেই লেখা, তা প্রমাণের জন্য তিনি বাবাকে দিয়ে চিঠি লেখাতেও প্রস্তুত! লজ্জিত হ়ন বুদ্ধদেব। পরের চিঠিতেই জানিয়েছিলেন যে, বিষ্ণু দে-র হাতের লেখা, লেখার ভঙ্গি ও সবুজ কালি কোনও ‘পূর্বপরিচিত সাহিত্যিক বন্ধুর অনেকটা অনুরূপ বলেই আমরা আপনার বিরুদ্ধে নাম-ভাঁড়ানোর অভিযোগ এনেছিলুম।’ ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলেন বুদ্ধদেব এবং লিখেছিলেন ‘... বাবাকে দিয়ে আর না লেখালেও চলবে!’ এ ভাবেই শুরু বন্ধুত্বের।
এই বন্ধুত্বের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ছিল, সম্ভ্রম ছিল, নির্ভরতা ছিল। বুদ্ধদেব ‘প্রগতি’র জন্য শুধু লেখা নয়, অনেক বার অর্থসাহায্যও চেয়েছেন বিষ্ণু দে-র কাছে। কখনও লিখছেন, ‘মার্চের প্রথম সপ্তাহেই সেই কুড়ি টাকা পাঠাতে পারবেন? সুবিধে হয়। আর পাঁচ টাকার কথা বলছিলেন— কি হ’ল?’ দুই বন্ধুর আগ্রহ ও সামর্থ্যই যে ‘প্রগতি’ চালু রেখেছিল, তা তাঁদের সেই সময়ের লেখা আর চিঠি থেকে বোঝা যায়। ‘প্রগতি’ ছিল সেই সময়ে বিষ্ণু দে-র সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য লেখার জায়গা। মজার কথা হল, এত লেখা তিনি পাঠাতেন যে, বুদ্ধদেবকে এক বার মরিয়া হয়ে এমনও লিখতে হয়েছিল,
‘...কিন্তু প্রগতিতে আর কত ছাপাবো বলুন তো? অন্য কোনো কাগজে কিছু-কিছু দিন না!’
ঢাকা থেকে কলকাতা আসার পর দু’জনের বন্ধুত্ব গভীরতর হল। তার একটা বড় কারণ, দু’জনেই রিপন কলেজে কাজ পেলেন। সহকর্মী হয়ে দু’জনের বন্ধুত্ব ডানা মেলল নানা ভাবে। রিপন কলেজে বুদ্ধদেবের পড়ানোর অভিজ্ঞতা যে সুখের হয়নি, তা সবচেয়ে ভাল বোঝা যায় বিষ্ণু দে-র কথা থেকেই। শ্যামলকৃষ্ণ ঘোষকে তিনি বলেছিলেন যে, রিপন কলেজের ছাত্রসংখ্যা তখন ছিল দু’হাজার। বড় ক্লাসে গলা ছেড়ে পড়াতে প্রাণান্ত হতে হয়। পাশের ঘরেই হয়তো ক্লাস নিচ্ছেন বুদ্ধদেব বসু। বিষ্ণু দের অভিজ্ঞতা, ‘বেচারা বুদ্ধদেব। পাশের ঘরে তাঁর অবস্থা দেখে মায়া হয়। মনে হয় যেন হাবুডুবু খাচ্ছেন।’ কিন্তু বিষ্ণু দে ছিলেন বলে রিপন কলেজে অধ্যাপনাপর্ব বুদ্ধদেব বসুর কাছে বিশেষ স্মরণীয় হয়ে থেকেছে সারা জীবন। এই আশ্চর্য সান্নিধ্যের বর্ণনা বুদ্ধদেব বসুর ভাষায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে। পবিত্র হয়ে উঠেছে। কখনও কলেজ আগেই ছুটি হয়ে যেত, তাঁরা কলেজ থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফিরতেন এক সঙ্গে। ইচ্ছে করেই এমন ট্রাম ধরতেন যা অনেকটা ঘুরপথে, অনেকটা সময় নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছবে। ফাঁকা ট্রামে তাঁরা সিগারেট বিনিময় করতেন, এবং অবশ্যই বিষ্ণু দে পকেট থেকে বার করতেন ‘...তাঁর স্বগৃহরচিত মিঠে পানের ছোট্ট খিলি... যাতে ঠোঁট লাল অথবা রসনা লালায়িত হয় না, শুধু একটি ঈষৎমিষ্ট সুগন্ধী স্বাদ ছড়িয়ে পড়ে সারা মুখে।’ এক ঘণ্টা সেই মসৃণ ভ্রমণ শেষে বিষ্ণু দে লেক মার্কেটে নেমে যান। কিন্তু তখনও তাঁদের কথা ফুরোয়নি। দু’জনেই জানতেন সে দিন হয়তো সন্ধেবেলা তাঁদের আবার দেখা হবে, বুদ্ধদেবের বাড়ির দরাজ আড্ডায়।
সেই সময়ের বাংলায় ‘পরিচয়’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে লেখকদের একটি গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল। বিষ্ণু দে-র সূত্রেই বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে এই গোষ্ঠীর যোগাযোগ হয়। বিষ্ণু দে নিজেই বলেছিলেন যে, বুদ্ধদেব বসুর কবিতা ‘পরিচয়’ পত্রিকায় তাঁর মাধ্যমেই প্রথম ছাপা হয়। বুদ্ধদেব যদিও এই গোষ্ঠীর সঙ্গে বেশি দিন থাকতে পারেননি।
কিন্তু পত্রিকার সঙ্গে জড়িয়ে থাকার আবেগ বুদ্ধদেবের পিছু ছাড়েনি। ১৯৩৫ সালে তিনি বার করলেন বাংলা ভাষায় এখনও পর্যন্ত অপ্রতিদ্বন্দ্বী কবিতার পত্রিকা ‘কবিতা’। তাঁর লক্ষ্য ছিল কবিতাকে সসম্মানে সুনির্বাচিত পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়া। তিনি নিজেই ‘সসম্মানে’ আর ‘সুনির্বাচিত’ কথা দু’টি লক্ষ করতে বলেছিলেন। আর এই লক্ষ্য পূরণে তাঁর প্রধান উৎসাহদাতা ছিলেন দু’জন— বিষ্ণু দে আর সমর সেন। বিষ্ণু দে-র প্রধান অনেকগুলি কবিতাই ছাপা হয়েছে ‘কবিতা’য়। কয়েকটি গদ্যও। ছাপা হয়েছে তাঁর কবিতা নিয়ে বুদ্ধদেবের একাধিক আলোচনা। ‘চোরাবালি’-র মুগ্ধ পাঠক ছিলেন বুদ্ধদেব। এতটাই ছিল তাঁদের সখ্য যে, বিষ্ণু দে-র প্রথম কবিতার বইও ছাপা হয়েছিল বুদ্ধদেবের উদ্যোগে। তাঁর নিজের প্রকাশনা ‘গ্রন্থকার মণ্ডলী’ থেকে বুদ্ধদেব ১৯৩৩ সালে বার করেছিলেন বিষ্ণু দের ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত ‘বাংলা কাব্যপরিচয়’ সঙ্কলনে বিষ্ণু দে-র কবিতা ছিল না। বুদ্ধদেব ‘কবিতা’ পত্রিকায় এটা নিয়ে ‘রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত রুচি’-র কঠোর সমালোচনা করেছেন।
শুধুই লেখালিখির দিক থেকেই নয়, পারিবারিক সম্পর্কও গভীর ছিল তাঁদের। প্রতিভা বসুর লেখা পড়েও তা টের পাওয়া যায়। ‘জীবনের জলছবি’-তে লিখেছিলেন তিনি— ‘বিষ্ণু দে দেখতে অত্যন্ত সুন্দর ছিলেন। গলার স্বর খুব নিচু ছিল। যেদিন আসতেন কী যে গুনগুন করে বলতেন, বুদ্ধদেবের অট্টহাসিতে ঘর ফেটে যেত।’ বুদ্ধদেবের ছোট মেয়ে দময়ন্তী বা রুমিকে নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন বিষ্ণু দে।
এখানে একটা কথা মনে রাখা দরকার। সাহিত্য সম্পর্কে দু’জনের বিবেচনার মধ্যে যে দূরত্ব ছিল, তার ছায়াও কিন্তু তাঁদের কাজে মাঝে মাঝেই পড়েছে। ১৯৫৪ সালে ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ সঙ্কলন প্রকাশ করেছিলেন বুদ্ধদেব বসু। কিন্তু বিষ্ণু দে-র হয়তো মনে হয়েছিল, কোনও ঘরানার কবিতা এখানে পূর্ণ গুরুত্ব পায়নি। ১৯৬৩ সালে বিষ্ণু দে তাই বার করলেন আর একটি সঙ্কলন, ‘একালের কবিতা’। খেয়াল করতেই হয় যে, সুকান্ত ভট্টাচার্য এবং অরুণ মিত্রর কবিতার সংখ্যা বিষ্ণু দে-র সঙ্কলনে উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে। আবার, তারও আগে, ১৯৪৮ সালে বিষ্ণু দে নিজে বার করেছিলেন একটি পত্রিকা, ‘সাহিত্যপত্র’। এই পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই বুদ্ধদেবের একটি বইয়ের সমালোচনায় বিষ্ণু দে এমন কিছু কঠোর মন্তব্য করেছিলেন যে, অভিমানী বুদ্ধদেব একটি চিঠিতে বিষ্ণু দে-কে লিখেছিলেন, ‘আপনার রিভিয়ুতে যে কোনো আনুকূল্য প্রকাশ পাবে না তা তো আমি জানি...’ বিষ্ণু দে বিব্রত হয়েছিলেন, প্রত্যুত্তরে ক্ষমাও চেয়ে নিয়েছিলেন। লিখেছিলেন, ‘আমি দুঃখিত যে সেটা স্পষ্টই জানাই। কিন্তু আমার আশা যায়নি আজও যে আপনার এ ভুল বোঝা সাময়িক মাত্র। আপনি নিশ্চয়ই এর ঊর্ধ্বে। ক্ষমা করবেন এ বিশ্বাস রইল।’
স্বাভাবিক ভাবেই ব্যাপারটা এখানেই মিটে যায়।
কিন্তু দু’জনের সম্পর্ক চিরতরে নষ্ট হয়ে গেল ১৯৬১ সালে। রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষে প্যারিসের ‘টু সিটিজ়’ পত্রিকায় বুদ্ধদেবের একটি লেখা ছাপা হল। সেই লেখাটির সূত্র ধরে কলকাতায় তুলকালাম হয়েছিল। প্রচার করা হল যে, বুদ্ধদেব দেশের বাইরের পাঠকের কাছে রবীন্দ্রনাথকে খাটো করেছেন। বুদ্ধদেব তখন দেশের বাইরে। তিনিই লিখেছেন, ‘...ফিরে এসে দেখি আমাকে নিয়ে ছাপার অক্ষরে তাণ্ডব চলছে।’ আক্রমণ এতটাই ধারালো হয়েছিল যে, বুদ্ধদেব সপরিবার ভীত ও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। সবচেয়ে দুঃখের আর বিস্ময়ের কথা এই যে, বিষ্ণু দে ও চঞ্চলকুমার চট্টোপাধ্যায় ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় একটি চিঠি লিখেছিলেন এই ভাষায়— ‘বুদ্ধদেব সম্প্রতি বোদলেয়ার, র্যাঁবো প্রভৃতি কবিদের লেখা পড়তে শুরু করেছেন— ভালো কথা, কিন্তু অস্থানে কুস্থানে এই নবীন উৎসাহের জ্ঞানের প্রয়োগ বিশেষ করিয়া ফরাসী দেশে বা আমেরিকায় রবীন্দ্রনাথকে হেয় প্রতিপন্ন করিবার জন্য প্রয়োগে আমরা মর্মাহত।’ এই চিঠি প্রকাশের পর দু’জনের মধ্যে যোগাযোগ প্রায় নিভে যায়, শুধু একটি চিঠি পাওয়া যাচ্ছে যেখানে বুদ্ধদেব একটি সঙ্কলনের জন্য বিষ্ণু দে-র কাছে লেখা চাইছেন। কিন্তু একে অন্যের পক্ষে বা বিপক্ষে কেউই আর কখনও কোনও কথা বলেননি। আগাগোড়া সৃজনশীল একটি সম্পর্কের এমন নীরব ও শীতল পরিণতিতে ক্ষতি হয়েছে বাংলা সাহিত্যেরই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy