প্রণয়: সরলা দেবী চৌধুরাণীর (ডান দিকে) প্রতি গাঁধীজির (বাঁ দিকে) টান ছিল অপ্রতিরোধ্য ও জটিল
দিনটি ছিল শনিবার। সকাল ন’টা। তারিখ ৯ জানুয়ারি ১৯১৫। এস এস আরবিয়া বোম্বাই বন্দর ছুঁল। জাহাজ থেকে নেমে এলেন ছেচল্লিশের এক খর্বকায় যুবক। প্রায় কুড়ি বছর পরে আবার তল্পিতল্পা গুটিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন তিনি। পিছনে তাঁর অবগুণ্ঠনবতী স্ত্রী। সেই সকালে এই দম্পতির জন্য বেশ বড় একটা ভিড় জমেছে। তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে জাহাজঘাটায় নেমে জনতার ভিড়ে প্রায় বন্দি হয়ে গেলেন তিনি। বাইরে অপেক্ষমাণ মোটর অবধি পৌঁছবার আগে মালায় মালায় তিনি প্রায় ঢেকে গেছেন। জনতার হর্ষধ্বনি আর অভিনন্দনের মধ্যে দিয়ে যুবক এবং তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে এগিয়ে চলল মোটর।
তিনি মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী। এ বার দেশের মাটিতে শুরু হল তাঁর কর্মকাণ্ড, যা চলেছিল পরবর্তী তেত্রিশ বছর ধরে। ১৯১৫-তে ফেরার পর তিনি চষে বেড়িয়েছিলেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত, প্রায় পাঁচ বছর ধরে দেশের মানুষের নাড়ির সন্ধান করেছিলেন, তিন তিনটি আন্দোলনের মাধ্যমে ভিত মজবুত করেছিলেন স্থানীয় সত্যাগ্রহ আন্দোলনের, এবং দেশ তন্নতন্ন করে চষে বেড়াবার মধ্যেই তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আলাপ হল ঠাকুরবাড়ির মেয়ে সরলা দেবী চৌধুরাণীর।
১৯০১-এর কংগ্রেস অধিবেশনে যদিও সরলাকে দেখেছেন গাঁধী, তবু আলাপ জমে উঠল ১৯১৯-এর অক্টোবরে, যখন তিনি লাহৌরে গিয়ে সরলা ও তাঁর স্বামী রামভুজ দত্তচৌধুরীর বাড়িতে অতিথি হলেন। গৃহকর্তাটি তখন জেলবন্দি, তবু ছেলে, সৎ-ছেলেরা, শাশুড়ি ও ভৃত্যদের নিয়ে সরলার বড় সংসারে সাদরে গ্রহণ করল অতিথিকে। অপ্রতিরোধ্য এক আকর্ষণে জড়িয়ে পড়ছিলেন গাঁধী, যে তাগিদে আবার ফিরে এলেন ১৯২০ সালের জানুয়ারিতে। লাহৌর থেকে বেরিয়ে পড়লেন পঞ্জাব, গুজরাতের প্রত্যন্ত গ্রামে। এ বার তাঁর যাত্রাসঙ্গিনী সরলা। হেঁটে হেঁটে দু’জনে পেরিয়ে যাচ্ছেন একের পর এক গ্রাম। কৃষকরা অবাক হচ্ছে সরলার অভিজাত চেহারা, কথাবার্তায়। ‘মাতাজি’ বলে তারা সম্বোধন করছে স্বর্গের দূতীর মতো এই নারীকে। এই প্রথম গাঁধীর সফরসঙ্গী এক জন মহিলা, যিনি গাঁধীর পরিচিত মহিলাদের সকলের চেয়ে অন্য রকম। এবং যাঁর ঝুলিতে ইতিমধ্যেই বাংলায় রাজনৈতিক আন্দোলনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা।
কী ছিল দু’জনের পারস্পরিক সম্পর্কে? নিছক রাজনৈতিক বন্ধুত্ব? রোম্যান্স, না কি যৌনতা? কামনাবাসনার নিষিদ্ধ আবেগও কি ছুঁয়ে ছিল এই সম্পর্ককে, যেমনটা হালের অনেক গবেষক ইঙ্গিত করেছেন? বুঝতে গেলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে আরও আগে, গাঁধীর গাঁধী হয়ে ওঠার পর্বের শুরুর দিনগুলিতে।
১৮৮২ সালে, তেরো বছর বয়সে গাঁধীর বিয়ে হয় কস্তুরবার সঙ্গে। বয়ঃসন্ধির দৈহিক উদ্দীপনায় বার বার উপগত হয়েছেন স্ত্রীর সঙ্গে। যৌনমিলনের আতিশয্যে ঠিক সময়ে উপস্থিত হতে পারেননি মৃত্যুপথযাত্রী বাবার শয্যার পাশে, যা পরে তীব্র অনুশোচনা ও অপরাধবোধের জন্ম দেয় তাঁর মধ্যে। এ সব কথা শুধু আত্মজীবনীতেই লেখেননি গাঁধী, ১৯৩৫-এ গর্ভনিরোধ আন্দোলনের নেত্রী মার্গারেট স্যাঙ্গারের সঙ্গে দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে অকপটে জানিয়েছিলেন, কী ভাবে প্রথম জীবনে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বহু বার স্ত্রীকে যৌনমিলনে বাধ্য করেছিলেন। সম্ভোগের ইচ্ছে সংযত করে যদি স্ত্রীর শিক্ষার দিকে একটু নজর দিতেন, তা হলে এত দিনে কস্তুরবার শিক্ষার ভিত বেশ মজবুত হয়ে যেত— একটু ‘উইশফুল থিংকিং’-এর মতো করে বলেছিলেন গাঁধী। চতুর্থ সন্তান দেবদাসের জন্মের পর একত্রিশ বছর বয়সে গাঁধীর বোধোদয় হয়, এর পর স্ত্রীর শারীরিক সংস্রব ত্যাগ করেন তিনি। ১৯০৬-এ সাঁইত্রিশ বছরে ব্রহ্মচর্য গ্রহণ করলেন গাঁধী। কেন এই প্রতিজ্ঞা? সত্যান্বেষী গাঁধী যৌনতা-সংক্রান্ত সত্যটিকে চিহ্নিত করে ফেললেন। যৌন প্রবৃত্তি এক প্রবল শক্তি, বীর্যক্ষরণে শারীরিক শক্তির অপচয় আর আত্মিক শক্তিক্ষয় হয়, তাই খুব সতর্ক হয়ে কঠোর শৃঙ্খলার সঙ্গে এই প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে তবেই পুরুষের পক্ষে আধ্যাত্মিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে দেশ ও জাতির সেবা করা সম্ভব। এই বিশ্বাসে গাঁধী যে শুধু নিজের জীবনচর্যায় বদল আনলেন তা-ই নয়, আশা করলেন দক্ষিণ আফ্রিকায় টলস্টয় ফার্মের সংসারী আবাসিকরাও যৌন প্রবৃত্তিকে মোটেই প্রশ্রয় দেবেন না। পুত্র হরিলালের বিয়ের পর নববিবাহিত দম্পতির যৌনজীবনের বিষয়টিও গাঁধী নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন, যা পুত্রের সঙ্গে বিরোধের একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
বীর্যপাতের কুফল বিষয়ক ভূত এই যে মাথায় ঢুকল, পরবর্তী প্রায় পঞ্চাশ বছর এই অবসেশন কাজ করে চলেছে গাঁধীর জীবনে। ঘুমে কিংবা জাগরণে, কখনও বীর্যক্ষরণ হওয়াকে নৈতিক পরাজয় বা আধ্যাত্মিক স্খলনের মতো ঘটনা বলে মনে করতেন তিনি। মার্গারেট স্যাঙ্গারের সঙ্গে কথোপকথনে তাই তিনি যে যৌনমিলনকে শুধু রিরংসা বলে মনে করেছেন, আদর্শ দাম্পত্যের উদাহরণ হিসেবে প্রকাশচন্দ্র রায় ও অঘোরকামিনীর কথা বলেছেন— যাঁরা মধ্যবয়সে এক দিন বাকি জীবনটুকু পরস্পরকে আর কখনও স্পর্শ করবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেন— সে নিতান্ত স্বাভাবিক। তা সত্ত্বেও মানুষ গাঁধীরও শরীর জাগত কখনওসখনও। যখন উচ্চ রক্তচাপ, অনাহারজনিত দুর্বলতা এবং অতিরিক্ত কাজের চাপে অসুস্থ গাঁধীকে বাধ্যতামূলক বিশ্রামের দাওয়াই দিয়েছিলেন ডাক্তার, গীতাপাঠের মধ্যে দিয়ে নির্লিপ্তি অবলম্বন করতে হয়েছিল কিছু দিনের জন্য, তখনও। ১৯৩৬-এ আর এক গাঁধী-ঘনিষ্ঠ প্রেমা কণ্টককে লেখা চিঠিতে রয়ে গেছে জাগ্রত অবস্থায় বীর্যপাত হয়ে যাওয়ার সমস্যার কথা। ১৯৩৮-এ মীরাবেনকে লেখা চিঠিতেও রয়ে গেছে শরীর জাগার প্রমাণ। এপ্রিলের এক নিষ্ঠুর রাতে জাগ্রত অবস্থায় স্বমেহন ও বীর্যপাত কী ভাবে যন্ত্রণায় বিদীর্ণ করেছিল তাঁকে, ‘এক নীচ, নিদারুণ নোংরা, উৎপীড়ক অভিজ্ঞতার’ মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল, যার ফলে তাঁর আত্মপ্রত্যয় ও রাজনৈতিক লক্ষ্য প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছিল, এই অভিজ্ঞতা ‘হরিজন’ পত্রিকায় সবিস্তারে লিখবেন বলে প্রায় স্থির করে ফেলেছিলেন গাঁধী। রাজাগোপালাচারী কোনওক্রমে তাঁকে নিরস্ত করেন।
নিবৃত্তিমার্গের প্রধান অন্তরায় নারী। ‘মেয়েরা যে নরকের দ্বার’, এই যুক্তিতেই যৌনকর্মীর কাজকে ঘৃণ্য জীবিকা মনে করতেন তিনি, কারণ তারা নাকি পুরুষকে পাপপঙ্কে ডুবিয়ে নষ্ট করে। ১৯২৫ সালে ‘নবজীবন’ পত্রিকায় লেখেন যে, জীবনে অন্তত তিন বার গণিকার শরীরী ফাঁদে প্রায় ধরা পড়েছিলেন তিনি, তিন বারই কোনওমতে রামনাম জপ করে পরিত্রাণ পান। ১৯২০ সালে বরিশালের কয়েকজন যৌনকর্মী কংগ্রেসে যোগ দিতে চাইলে গাঁধী আপত্তি করে বলেন, এই ব্যবসা না ছাড়লে আন্দোলনে যোগদান সম্ভব নয়। বিকল্প রুজি না থাকা এই মহিলারা যে পুরুষের তৈরি আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার ক্রীড়নকমাত্র, তা গাঁধী ভেবে দেখেননি এক বারও, তাদের অসহায়ত্ব উপলব্ধি করা দূরস্থান।
সহধর্মিণী: গাঁধীপত্নী কস্তুরবা
নারীকে ‘অবজেক্ট অব ডিজ়ায়ার’ ভাবার এই প্রবণতা দক্ষিণ আফ্রিকা পর্ব থেকেই গাঁধীর মধ্যে প্রকট। টলস্টয় ফার্মের এক তরুণ যখন দু’টি তরুণীকে উত্যক্ত করছিল, তখন ছেলেটিকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য গাঁধী স্বহস্তে মেয়ে দু’টির চুল কেটে দেন, তাদের অনিচ্ছাসত্ত্বেও। কারণ, তা হলে ছেলেটি আর দেখনসুখ ভোগ করতে পারবে না তার চোখ দিয়ে। মেয়ে দু’টি যে চুল কাটতে অনিচ্ছুক, গাঁধী তা ধর্তব্যের মধ্যেই আনেননি, বরং বিধান দিয়েছিলেন, ছেলেটি যাতে বিরক্ত করতে সাহস না পায়, এমন কোনও জুতসই ইঙ্গিত মেয়ে দু’টির আগেই দেওয়া উচিত ছিল।
এই পর্যন্ত এসে ফিরে তাকানো যাক গাঁধী ও সরলার সম্পর্কের দিকে। গাঁধীর পরিব্যাপ্ত জীবনের নানা পর্যায়ে সমাগত বহু নারীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের রসায়ন নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। সরলার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটির স্বরূপ বোঝার জন্য অন্যতম উপাদান সরলাকে লেখা গাঁধীর পত্রগুচ্ছ। আজ থেকে ঠিক একশো বছর আগে একান্ন বছরের প্রৌঢ় গাঁধী প্রায় প্রতিদিন নাগাড়ে চিঠি লিখেছেন সরলাকে, যার থেকে তাঁর জটিল মনস্তত্ত্বকে কিছুটা হলেও বোঝা সম্ভব। গাঁধী স্পষ্ট লিখেছেন সরলা বিহনে কতটা কাতর বোধ করছেন তিনি, ‘ভালবাসা’ জানাতেও ভোলেননি চিঠির শেষে। সম্বোধনে এসেছে নৈকট্য। ‘আমার প্রিয়তমা সরলা’-র সঙ্গে হয়তো জন্মান্তরের সম্বন্ধ ছিল তাঁর, এমনও ভেবেছেন চিঠির পরিসরে। চিঠিগুলি থেকে সন্দেহের অবকাশ নেই, সরলা সম্পর্কে গভীর এক আকর্ষণ বোধ করছিলেন গাঁধী। সম্ভ্রান্ত পরিবারের বহুগুণান্বিতা, রাজনৈতিক ভাবে সক্রিয় সরলা যখন নিজে স্বেচ্ছায় তুলে নিলেন খদ্দরের আদর্শ প্রচারের ভার, বিভিন্ন পার্টিতে রেশমের বদলে পরে যেতে শুরু করলেন মোটা খসখসে খদ্দরের অঙ্গাবরণ, দৃশ্যতই গাঁধী কিছুটা বিহ্বল ও বেসামাল হয়ে গেছিলেন। বিশেষত একই সময়ে গাঁধীর আর এক স্নেহধন্যা, শ্রমিক মেয়েদের নেত্রী অনসূয়া সরাভাই যখন ওই মোটা কাপড় পরতে রাজি হননি কিছুতেই!
পরম আহ্লাদে গাঁধী চিঠি লিখেছেন তাঁর বহু দিনের সহযোগী হারম্যান ক্যালেনবাখকে— আশ্চর্য এক রমণীরত্নের সন্ধান পেয়েছেন তিনি, যার সঙ্গে হারম্যানের আলাপ করাবার জন্য আর তর সইছে না তাঁর। এই চিঠিতেই সরলাকে ‘স্পিরিচুয়াল ওয়াইফ’ বলে উল্লেখ করেছেন গাঁধী। তিনি কি এ ভাবে বৈধতা খুঁজছিলেন নতুন-পাওয়া সম্পর্কের? সরলার স্বামী রামভুজ কী ভেবেছিলেন এ সম্পর্কের বিষয়ে, তার হদিশ কোথাও নেই। তবে গাঁধীর পরিবার পরিজন ও অনুগামীরা অনেকেই সরলার এই বাড়বাড়ন্তে বিশেষ খুশি হননি, তার প্রমাণ অজস্র। ক্যালেনবাখকে সরলার কথা বলেছিলেন যেমন উচ্ছ্বসিত ভাবে, সম্ভবত সেই ভঙ্গিতেই গাঁধী চিঠি লেখেন সুহৃদ রাজাগোপালাচারীকে, যাঁকে তিনি বলতেন ‘দ্য কিপার অব মাই কনশেন্স’।
প্রত্যুত্তরে ‘ফ্লেশ’, ‘লাস্ট’, এ সব শব্দে রাজাগোপালাচারী তাঁকে রীতিমতো ভর্ৎসনা করেন কড়া ভাষায়, বুঝিয়ে দেন শয়তান ভর করেছে গাঁধীকে, তাঁর স্নেহশীল ব্যবহারের সুযোগ নিয়ে তাঁর দাক্ষিণ্যের অপব্যবহার করছেন সরলা। ইংরেজি-শিক্ষিতা ‘আধুনিক’ মেয়েরা ছিল রাজাজির নাপসন্দ, পশ্চিমি আদবকায়দাদুরস্ত ‘মোহিনী’ সরলার সঙ্গে তিনি তুলনা করেছিলেন প্রভাতসূর্যের মতো কস্তুরবার। পাঠকের মনে পড়তে পারে সূর্যমুখীর সঙ্গে কুন্দনন্দিনীর বঙ্কিমি তুলনা। যাই হোক, এই ভর্ৎসনার পর গাঁধী আধ্যাত্মিক বিবাহের প্রস্তাব স্থগিত রেখেছিলেন, তবে সরলাকে তখনই ছাড়তে পারেননি। তাঁর রাতের স্বপ্নে ঘুরেফিরে এসেছেন সরলা। একটি চিঠিতে গাঁধী বলছেন— ‘পণ্ডিতজিকে (রামভুজ) যেমন করেছিলে, তেমনই আমাকেও জাদু করেছ তুমি, এখনও আমার রাতের স্বপ্নে হানা দাও’ (‘ইউ স্টিল কনটিনিউ টু হন্ট মি ইভন ইন মাই স্লিপ’) ।
গাঁধী তাঁর স্ত্রীর চেয়ে হয়তো একটু বেশিই স্পেস দিয়েছিলেন সরলাকে, কিন্তু এই সম্পর্কও সাম্যের জমিতে প্রতিষ্ঠিত ছিল না, অন্তত গাঁধীর মানসে। গাঁধী উপলব্ধি করেছিলেন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের শক্তিস্বরূপিণী মাতাজি হয়ে ওঠার ক্ষমতা সরলার আছে। দেশ ও জাতির জন্য এই মহৎ কর্মযজ্ঞে ধীরে ধীরে নিজের ইচ্ছেমতো গড়েপিটে খাঁটি সোনায় পরিণত করবেন সরলাকে, এমনই আশা ছিল তাঁর। প্রতি চিঠিতেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন গাঁধী, দেশগঠনের এই যজ্ঞে শামিল হওয়া রামভুজের সম্মতিসাপেক্ষ, যেমনটি পিতৃতান্ত্রিক সমাজের প্রত্যাশা। এবং শেষে রাজনীতির প্রাণকেন্দ্রে শক্তিস্বরূপিণী হয়ে আত্মপ্রকাশের প্রক্রিয়াটির চূড়ান্ত নিয়ন্তা গাঁধী স্বয়ং। তাই প্রতিটি চিঠির শেষে তিনি স্বাক্ষর করেছেন ‘তোমার বিধানদাতা’ (‘ইয়োর ল-গিভার’) হিসেবে। এক বারও এই অমোঘ উচ্চারণ থেকে একচুল বিচ্যুতি ঘটেনি।
আর সরলা? রামচন্দ্র গুহর বই থেকে জানা যাচ্ছে, ১৯২০-র অক্টোবরে আমদাবাদে গিয়ে তিনি গাঁধীর প্রতীক্ষায় কাটালেন অনেক দিন। গাঁধী তখন আসন্ন অসহযোগের জনসংযোগের জন্য পথে পথে ঘুরছেন। অদর্শনে অস্থির সরলা তখন স্নানঘরের নিভৃতিকেই বেছে নেন অশ্রুমোচনের জায়গা হিসেবে। দেখা হল না। অপেক্ষাক্লিষ্ট সরলা লাহৌরে ফিরে গিয়ে লিখলেন গাঁধীকে— ‘যদি ভালবাসাই হয় আপনার মনের কথা, তবে সোজাসাপটা বলুন, আমাকে মিস করছেন, বিচ্ছেদের যন্ত্রণা ভোগ করছেন আমারই মতো, অপেক্ষা করছেন সেই ভোরের জন্য যখন আমাদের আবার দেখা হবে।… আর যদি প্রেম না-ই থাকে, তবে স্পষ্ট বলে দিন সে কথা…।’
হাউইয়ের মতো জ্বলে ১৯২০ সালের শেষে হঠাৎই ফুরিয়ে গেল এই সম্পর্ক। প্রেম ও সংঘাতে দীর্ণ গাঁধী সরে গেলেন নিজস্ব কক্ষপথে, যা সরলার কক্ষপথ থেকে অনেক দূরে। বছরের শুরুতে পায়ের যন্ত্রণা ও নার্ভাস ব্রেকডাউনের যুগপৎ আক্রমণে বিপর্যস্ত যে মানুষটি প্রিয়তমা সরলাকে লেখেন ‘আই অ্যাম আ স্পেন্ট বুলেট’, সেই কথাকে অপ্রমাণ করে তিনি আয়োজন করেছেন একের পর এক সুবিশাল কর্মযজ্ঞের, নেতৃত্ব দিতে আর দাঙ্গা মেটাতে ছুটে বেড়িয়েছেন দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত, এবং জীবনের শেষ পনেরো বছরে আরও গভীর ভাবে জড়িয়ে পড়েছেন যৌনতা সংক্রান্ত জটিল মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষানিরীক্ষায়।
সেই এক্সপেরিমেন্টের অংশ হিসেবে তিরিশের দশকের শেষ দিক থেকে সেবাগ্রামের আশ্রমে মেয়েদের সঙ্গে এক শয্যায় শোওয়ার প্রথা চালু করেন গাঁধী, ব্রহ্মচর্যের অস্ত্র ধোপে টেকে কি না দেখতে। যে এক্সপেরিমেন্টে অংশ নিতে হয়েছিল গাঁধীর তরুণী ডাক্তার সুশীলা নায়ারকেও। ১৯৪৪-এ কস্তুরবার মৃত্যুর পর সব দিক থেকেই আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন গাঁধী। রাজনৈতিক ভাবে তখন সম্পূর্ণ প্রান্তিক অবস্থান তাঁর, কোনও দলই তাঁর কথা গ্রাহ্য করে না, শারীরিক ভাবেও দুর্বল গাঁধীকে গ্রাস করছে একাকিত্ব। এই অবস্থায় আবার যৌনতা বিষয়ক আত্মপরীক্ষা শুরু করলেন গাঁধী, ১৯৪৬-এ নোয়াখালি পর্বেও নগ্ন অবস্থায় উনিশ বছর বয়সি, সম্পর্কে নাতনির শয্যাসঙ্গী হতে লাগলেন সাতাত্তরের বৃদ্ধ, এই বিশ্বাস থেকেই যে যৌন তাড়না নিয়ন্ত্রণ করে আবার নৈতিক শক্তি ফিরে পাবেন তিনি।
ভাবলে আশ্চর্য লাগে, বিংশ শতকে মেয়েদের জাতীয় আন্দোলনে শামিল করার পথ দেখালেন যে মানুষটি, তিনিই আবার ঠিক করে দিলেন ঠিক কোন ধরনের মেয়েরা কতখানি এবং কোন কাজে বাইরের জগতে অংশ নেবে। মেয়েদের যোগদানের পরিসর চিহ্নিত করে তিনিই তৈরি করলেন আধুনিক পিতৃতন্ত্রের নতুন শৃঙ্খল। নিজের যৌনতাকে পরখ করার নানা নিরীক্ষাতেও মেয়েদের ব্যবহার করলেন খেলনার মতো। নিয়ন্ত্রকের স্ব-আরোপিত ভূমিকা থেকে কখনওই তিনি নেমে আসতে পারলেন না।
অথচ সুযোগ ছিল। ১৯০৬-এর বিলেতবাসের পর্বে গাঁধী নিজের চোখে দেখেছিলেন ভোটাধিকারের দাবিতে কী ভাবে প্রচলিত দস্তুর ভেঙে হাউস অব কমন্সে গলা ফাটাচ্ছেন ইংরেজ মেয়েরা, সামান্য জরিমানা দিয়ে মুক্তির বদলে বেছে নিচ্ছেন গারদখানার স্বেচ্ছানির্বাসন। সাফ্রেজিস্টদের এই সরব হওয়া, করে দেখানোর লড়াইকে কুর্নিশ জানিয়ে ভূয়সী প্রশংসা করেন তিনি। কিন্তু ভারতীয়রা যাকে ‘কালা কানুন’ বলত, দক্ষিণ আফ্রিকার সেই বৈষম্যমূলক এশিয়াটিক ল অ্যামেন্ডমেন্ট অর্ডিন্যান্স নির্দেশিকার প্রতিবাদে, ইংরেজ সাফ্রেজিস্ট মহিলাদের উদাহরণ দিয়েও, গাঁধী সংঘবদ্ধ হতে ডাক দেন শুধু পুরুষদেরই। মেয়েদের আন্দোলনে শামিল করার জন্য পাক্কা আরও ছ’বছর ভাবতে হয়েছিল তাঁকে। ১৯১৩-তে বারো জন পুরুষের সহগামিনী হয়ে ফিনিক্স ফার্ম থেকে ট্রান্সভাল সীমান্ত অবধি রওনা হলেন চার মহিলা— যাঁদের মধ্যে ছিলেন কস্তুরবা নিজেও— রামচন্দ্র গুহ যাকে বলেছেন ‘অ্যান এক্সট্রাঅর্ডিনারি ট্রান্সগ্রেসিভ অ্যাক্ট ফর দ্য মিডল ক্লাস ইন্ডিয়ান উইমেন অব দিস টাইম’। সীমান্ত পেরিয়ে যাবার লক্ষ্যে একশো সাত বছর আগের সেই ঐতিহাসিক যাত্রার প্রতীকী মূল্য ছিল অনন্য। গাঁধী-নির্দেশিত পথে সেই প্রথম জয়যাত্রা, যা পরবর্তী চার দশকে দুর্নিবার গতিতে এগিয়ে গিয়েছিল। গাঁধী এগিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর নিজস্ব সত্যের খোঁজে, রক্তাক্ত হতে হতে। তাঁর সেই পদচারণার বৈভবে কখনও কখনও ঢাকা পড়ে যায় তাঁর সহগামিনীদের কথা।
গাঁধীর যাত্রাপথ তাই নিঃসঙ্গ একলা পথিকের, যেখানে পিছনে পড়ে থাকে বিস্মৃতির পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ। সে পথে হাঁটতে গিয়ে সেই পথিকের আর মনে পড়ে না টলস্টয় ফার্মে চুল কেটে দেওয়ার মুহূর্তে সেই মেয়ে দু’টির কী মনে হয়েছিল, গাঁধীর ডাকে ‘মাতাজি’ হয়ে উঠতে না পেরে সরলার কী মনে হয়েছিল, গাঁধীর নগ্ন শয্যাসঙ্গী হওয়ার ‘সুযোগ’ পেয়ে উনিশ বছরের মনুর কী মনে হয়েছিল, একদা কাঁটাতারের ট্রান্সভাল সীমান্ত পেরনো, পরবর্তী জীবনে স্বামীর ঔদাসীন্য পেতে অভ্যস্ত-হয়ে-যাওয়া ‘অশিক্ষিত’ স্ত্রী কস্তুরবার মৃত্যুমুহূর্তে ঠিক কী মনে হয়েছিল। প্রতি মুহূর্তে বিস্মৃত হতে হতে একাকী ভগ্নস্বাস্থ্য ন্যুব্জদেহ সেই পথিক তাঁর যষ্টি সম্বল করে অনন্তযাত্রায় পাড়ি দিয়েছিলেন।
তথ্যসূত্র: ডেভিড আর্নল্ড, গাঁধী; ডেভিড হার্ডিম্যান, গাঁধী ইন হিজ় টাইম অ্যান্ড আওয়ার্স; রামচন্দ্র গুহ, গাঁধী: দ্য ইয়ার্স দ্যাট চেঞ্জড দ্য ওয়ার্ল্ড ১৯১৪-১৯৪৮; জেরাল্ডিন ফোর্বস, লস্ট লেটার্স অ্যান্ড ফেমিনিস্ট হিস্টরি: দ্য পলিটিক্যাল ফ্রেন্ডশিপ অব মোহনদাস কে গাঁধী অ্যান্ড সরলা দেবী চৌধুরাণী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy