তোমার অফিসে এখন খুব কাজের চাপ যাচ্ছে, না গো?’’ চায়ের কাপ টেবিলে রাখতে রাখতে জিজ্ঞেস করল অদিতি।
সুজয় ঝুঁকে পড়ে মোজা খুলছিল। মাথা না তুলেই বলল, ‘‘কই, না তো! তেমন কিছু না।’’
‘‘তা হলে আজকাল ফিরতে এত দেরি হয়?’’
আজ খুব কাহিল লাগছে সুজয়ের। ভিড় দেখে একটা মেট্রো ছেড়ে দিয়েছিল। পরের যেটা এল, সেটায় আরও বেশি ভিড়। মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবী বাঙালি এই ধরনের পরিস্থিতিতে চিরকাল চরম সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। এই ট্রেনটায় উঠবে, নাকি এটাও ছেড়ে দিয়ে পরেরটার জন্য অপেক্ষা করবে? গতকাল যা করেছিল। কিন্তু তার ফল ভাল হয়নি। দুটো ছেড়ে দেওয়ার পর যে তিন নম্বর ট্রেনটা এল, সেটা একেবারে গলা অবধি ঠাসা। দরজা নিয়মমাফিক খুলল এবং বন্ধ হল, কিন্তু একটা লোকও উঠতে পারল না! ফলে আজ আর রিস্ক না নিয়ে সুজয় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ওই থিকথিকে ভিড়ে কোনও মতে দাঁড়ানোর জায়গা করতে পেরেছিল বটে, কিন্তু চারপাশের চাপে প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড়! নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। ধস্তাধস্তি করে নিজের স্টেশনে নামার পর সামনের খালি চেয়ারটা দেখে তাই আর লোভ সামলাতে পারেনি। ঠান্ডা হাওয়ায় বসে একটু জিরিয়ে নেওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল। মিনিট দশেক বাদে যখন উঠবে উঠবে করছে, পরের ট্রেনটা এসে ঢুকল। বেশ ফাঁকা ফাঁকা। দেখেই মেজাজ গরম হয়ে গেল। আগেরটা ছেড়ে দিলেই ওটায় আসতে পারত!
মেট্রো স্টেশনের বাইরে এসে সুজয় দেখল, অটো স্ট্যান্ডে লম্বা লাইন। সামনেই সার দিয়ে দাঁড়িয়ে খালি অটো, কিন্তু একটাও যাবে না! রাস্তায় নাকি ‘হেব্বি জ্যাম’। আগে সে যানজট ‘কিলিয়ার’ হোক। মিনিট দশেক ধৈর্য ধরে অপেক্ষায় থাকার পর অবশেষে সচল হল জমে ওঠা ভিড়। একের পর এক অটো যাত্রী তুলে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সুজয় লাইনের মাথায় পৌঁছতেই অটো শেষ। ওর পিছনে তখন আরও তিন জন। তারা কিছুক্ষণ উসখুস করে, হঠাৎ বলা–কওয়া নেই, হাত দেখিয়ে একটা চলন্ত বাস থামিয়ে উঠে চলে গেল। আর ঠিক তখনই একটা খালি অটো এসে দাঁড়াল। একা, ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে থাকা সুজয়ের সামনে। তখন আর উঠে লাভ নেই। ভর্তি না হলে ছাড়বে না। তা হলে কি বাস ধরে নেবে? না কি পরের মেট্রোর যাত্রীরা আসা অবধি অপেক্ষা করবে? এই সব ভাবতে ভাবতে দাঁড়িয়েই রইল সুজয়, এবং শেষ পর্যন্ত বাড়ি ফিরতে দেরি!
কিন্তু এত কিছু তো সবিস্তারে বৌকে বলা যায় না। সুজয় চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, ‘‘হুঁ, ওই
আর কী! হাফ ইয়ারলি ক্লোজিং আসছে তো...’’
আর কিছু বলল না অদিতি। একটু ক্ষণ সামনে দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেল। পরের প্রশ্নটা এল রাতে খেতে বসে। হঠাৎ অদিতি জিজ্ঞেস করল, ‘‘আচ্ছা, ঈশিকা মানে কী গো?’’
মন দিয়ে চারাপোনার কাঁটা বাছছিল সুজয়। এই ব্যাপারটায় ও ছোট থেকেই অদক্ষ। যে কারণে চিংড়ি বা পমফ্রেট, ভেটকির মতো এক কাঁটার মাছ ওর বেশি পছন্দ। নিদেনপক্ষে একটু বড় মাপের রুই কাতলা। কিন্তু অদিতি ফরমান জারি করেছে, চারাপোনা ছাড়া বাড়িতে কিছু আসবে না। কারণ, চারাপোনা সস্তা, সুস্বাদু এবং মাথা আর চোখের জন্য নাকি খুব উপকারী। সুজয়ের অ্যাকাউন্টিংয়ের পেশায় যেহেতু মাথা আর চোখেরই বেশি ব্যবহার হয়, কাজেই চারাপোনা। কাঁটা বাছতে ব্যস্ত ছিল বলে সুজয় প্রথমে ঠিকমতো শুনতে পায়নি, বুঝতেও পারেনি। ও বলল, ‘‘উঁ? কিসের মানে?’’
‘‘ঈশিকা। কী মানে গো নামটার?’’
‘‘‘কে জানে! আজকাল লোকে কত রকমের অদ্ভুত নাম দেয়!’’ অন্যমনস্ক ভাবে বলল সুজয়।
‘‘তোমার অফিসের নতুন রিসেপশনিস্ট মেয়েটির নাম ঈশিকা বলেছিলে না?’’
অদিতির গলা শান্ত। কিন্তু সেই নিস্তরঙ্গ প্রশান্তির নীচে বহমান এক লাভাস্রোতের গন্ধক-গন্ধ চিনতে ভুল করল না সুজয়। গত আড়াই বছরের বিবাহিত জীবনেও এই একটি বিদ্যে মোটামুটি রপ্ত করেছে। কোন কথার কী মানে, তার সব রহস্য বুঝে উঠতে না পারলেও, কখন ওর বউ অন্য কোনও মেয়েকে জড়িয়ে ওকে সন্দেহ করছে, এটা ও এখন আন্দাজ করতে পারে। এখনই যেমন, দুইয়ে দুইয়ে নিখুঁত চার হল। দেরিতে বাড়ি ফেরার কারণ অফিসে কাজের চাপ কি না— সন্ধের সেই সমবেদনাসূচক প্রশ্ন এবং এখন অফিসের নতুন রিসেপশনিস্ট মেয়েটির নামের অর্থ জানার অদম্য ইচ্ছে, এই দুইয়ের মধ্যে যোগসূত্রটি জ্বলজ্বলিয়ে উঠল সুজয়ের অন্তর্নয়নের সামনে। এমন পরিস্থিতি হলে সুজয় চিরকাল যা করে, এ বারও তাই করল। শুনতে না পাওয়ার ভান করে সরে গেল বৌয়ের সামনে থেকে, হাত ধোয়ার অছিলায়।
কিন্তু ভাতের শেষ গরাসটা তাড়াহুড়োয় খেতে গিয়ে একটা কাঁটা ঢুকে গিয়েছে দাঁতের ফাঁকে। বার বার কুলকুচি করে তাকে বার করতে গিয়ে সুজয়ের মনে পড়ে গেল, কবে থেকে চারাপোনা আনার হুকুম হয়েছে। প্রতিবেশী রঞ্জিতদা এক দিন এই বাড়িতে চা আর তোপসে মাছভাজা খেতে খেতে বলল, ‘‘বাহ্, দিব্যি মাছ। তুমি তো ভিতরকণিকা থেকে মাছ নাও, তাই না?’’
রান্নাঘরে ছিল, তাও রঞ্জিতদার কথার অসামঞ্জস্য ধরা পড়ে গিয়েছিল অদিতির সতর্ক অ্যান্টেনায়। হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে এসে মিষ্টি হেসে বলেছিল, ‘‘ভিতরকণিকা? সে তো উড়িষ্যায়!’’
রসিক রঞ্জিতদা হাহা করে হেসে বলেছিল, ‘‘আরে বাজারে যে মেয়েটা এই ছোট মাছগুলো নিয়ে বসে, তার নাম কণিকা। দেখতে শুনতে বেশ ভাল। আর বেশ ইয়ে, মানে গভীর টাইপ। তাই বাজাড়ুরা নাম দিয়েছে ভিতরকণিকা।’’
খিলখিলিয়ে হেসে উঠেছিল অদিতি। সুজয় প্রমাদ গুনেছিল। কোনওমতে বলেছিল, ‘‘কুচো চিংড়ি, পমফ্রেট, এই সব মাছ ওর কাছে ভাল পাওয়া যায়। দামও কম নেয়।’’
কিন্তু অদিতি আর রঞ্জিতদার সমবেত হাসির তোড়ে ভেসে গিয়েছিল সুজয়ের কথা। পরের রবিবারই সুজয়ের সঙ্গে বাজারে গিয়েছিল অদিতি। সরেজমিন পরিদর্শনের পর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, মাছের বাজারের মুখেই যে বুড়ো লোকটা চারাপোনা নিয়ে বসে, রোজ তার থেকেই মাছ কেনা হবে। বাজারের ভিতরে আর ঢুকতেই হবে না। সময় বাঁচবে তাতে। এবং গোটা ব্যবস্থাটা অবশ্যই সুজয়ের মাথা এবং চোখের স্বাস্থ্যের কথা ভেবে।
ধুত্তেরি, খামোকা ঝামেলায় পড়ল! দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা কাঁটাটা জিভের ডগা দিয়ে ঠেলে
বার করার চেষ্টা করতে করতে
ভাবল সুজয়।
******
আপনাকে তো বললাম, ও ভাবে কারও ফোন নম্বর দেওয়া হয় না।
কথাটা বলে রিসেপশনের লোকটা অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এক পা পিছিয়ে এসে চারদিকে আড়চোখে এক বার দেখল সুজয়। না, কেউ দেখেনি ওর হেনস্থা। অবশ্য হেনস্থার আর কী আছে! লোকটা দুর্ব্যবহার করেনি। ভদ্র ভাবে জানিয়ে দিল, ফোন নম্বর দেওয়া হয় না। খবরের কাগজের অফিসের সেটাই হয়তো দস্তুর। কিন্তু সুজয় এখন কী করবে? ফিরে যাবে? ‘বৌয়ের শরীর খারাপ, ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাব’ অজুহাত দিয়ে আজ তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরিয়েছে। ব্যাপারটা এতই গুরুতর এবং জরুরি। কিন্তু এরা তো নম্বরই দিতে চাইল না!
এ বার? এমন কে আছে, যে ওকে ত্রিকালদর্শী পঞ্চাননের খোঁজ দেবে? শুনে মনে হয় এটা ছদ্মনাম। আসল লোকটার হদিস চাই ওর। যে লোকটা এই কাগজে দৈনিক রাশিফল লেখে। ভাবতে ভাবতে সুজয় থমকে গেল। রিসেপশনের লোকটা ওর পাশ দিয়ে হেঁটে গেটের বাইরে গিয়ে সিগারেট ধরাল। কোনও কিছু না ভেবে সুজয় সটান লোকটার সামনে দাঁড়িয়ে গেল হাতজোড় করে, ‘‘স্যর, একটু হেল্প করুন। সংসারে তুমুল অশান্তি। বাড়ি ঢুকতে ভয় করে। প্লিজ় একটু বুঝুন। পঞ্চাননবাবুর মোবাইল নম্বরটা
ভীষণ দরকার।’’
সাংসারিক অশান্তির কথা বললে নরম হয় না, এমন পাষাণহৃদয় বাঙালি বোধহয় নেই। লোকটা প্রথমে একটু হকচকিয়ে গেলেও সামলে নিল। চোখ সরু করে সুজয়কে জরিপ করতে করতে বলল, ‘‘হুঁউউ, তাই তো দেখছি!’’
******
‘‘বলুন, আপনার সমস্যাটা বলুন।’’
প্রশ্নটা শুনে একটু ঘাবড়ে গেল সুজয়। ওর সামনে বসা এই গোলগাল, ভারী চেহারার, কপালের মাঝামাঝি মস্ত বড় লাল টিপ পরা মহিলাই কি ত্রিকালদর্শী পঞ্চানন!
ত্রিকালদর্শী না হোন, মহিলা অন্তর্যামী। আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বললেন, ‘‘আমি আপনার সব ডিটেলস নিয়ে স্যরকে দেব। যা বলার উনিই বলবেন।’’
সুজয় অকারণে এক বার গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, ‘‘ওই ফর্মেই সব ডিটেলস দিয়েছি। আলাদা করে আর কিছু বলার নেই।’’
মহিলা অবিশ্বাসী চোখে বললেন, ‘‘হুঁ, আপনি পাশের ঘরে অপেক্ষা করুন।’’
ছোট একটা ঘর। যে দরজা দিয়ে সুজয় ঢুকল, তার উল্টো দিকে একটা টকটকে লাল রঙের দরজা। দু’পাশে দেওয়াল ঘেঁষে সার দিয়ে চেয়ার পাতা। যদিও আর কোনও দর্শনপ্রার্থী নেই এখন। ফাঁকা ঘরে এসি চলছে বিনবিনিয়ে। সুজয় গিয়ে এক ধারে বসল। জ্যোতিষীদের চেম্বারও আজকাল ডাক্তারদের মতো হয়েছে কে জানত! প্রথমে রিসেপশনে ৫০১ টাকা ফিজ় জমা দিয়ে, ফর্ম নিয়ে ভর্তি করতে হল। তাতে নিজের নাম, ঠিকানা, বয়স, পড়াশোনা, আর পেশার সঙ্গে পারিবারিক ডিটেলসও দিতে হল। আগে কোনও বড় রোগ, অপারেশন হয়েছে কি না, ক্রনিক অসুখবিসুখ কিছু আছে কি না, সে সবও। সবই যদি জানিয়ে দিই, তা হলে ত্রিকালদর্শী কী দেখবেন, আর কীই বা বলবেন! লিখতে লিখতে ভাবছিল সুজয়।
টুং করে একটা বাজনা বাজল। সিলিংয়ের কাছে একটা ছোট্ট স্পিকার ঝুলছে। তাতে শোনা গেল নারীকণ্ঠ, ‘‘সুজয় সোম, আপনি এ বার সামনের দরজা দিয়ে গর্ভগৃহে প্রবেশ করুন।’’
গর্ভগৃহ আবার কী! সে তো দেবস্থানে থাকে! মন্দিরে! ভাবতে ভাবতে লাল দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল সুজয়। অসংখ্য ঠাকুর-দেবতার ছবি ঝোলানো একটা ঘর। ভারী হয়ে আছে ধূপের ধোঁয়া। টেবিলের উল্টো দিকে একটা লোক হাসি-হাসি মুখে বসে। সুজয় লাফিয়ে উঠল। ‘‘ধুসস শালা, তুই! শেষে তুই!’’
পঞ্চা দাঁত বের করে হাসছে। পঞ্চানন সরকার। ওর ছোটবেলার বন্ধু। পুরনো পাড়া, পুরনো স্কুল। হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায় ফেল করে বাপের মারের ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিল। পাড়ায় রটেছিল, পঞ্চা নাকি সাধু হয়ে গিয়েছে।
‘‘জব্বর ফেঁদে বসেছিস দেখছি!’’ বসতে বসতে বলল সুজয়।
‘‘আমি তো তোর নামধাম দেখা ইস্তক ভাবছি, আমাকে দেখে প্রথম কোন খিস্তিটা দিবি,’’ খিকখিক করে হাসল পঞ্চা। ‘‘কিন্তু তোর কেসটা কী? তুই তো জ্যোতিষীর সামনে হাত পাতার ছেলে নয়! কী হয়েছে?’’
খিঁচিয়ে উঠল সুজয়। ‘‘হবে আবার কী! রোজ রাশিফলে ‘বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক’ আর ‘পরনারীতে মন’ লেখার জন্য তুই আমার এই কর্কট রাশিকেই পাস! আমার বৌ রোজ সকালে উঠে সে সব পড়ে, আর সন্দেহে সন্দেহে জেরবার করে দেয়! আমি তো ভেবেছিলাম ত্রিকালদর্শী পঞ্চাননকে এসে পা ধরে বলব, আর যাই করুন, কর্কট রাশির ঘাড়ে ওই সব আর চাপাবেন না। শালা জীবনে মেয়ে বলতে ওই একটা বউ, সেটাই সামলে উঠতে পারি না, আবার পরনারীতে মন! তুই পারিস মাইরি পঞ্চা!’’
******
সুজয়ের জীবনের উপর থেকে সন্দেহের কুদৃষ্টি এখন সরে গিয়েছে। ও মাঝে মাঝেই কাগজ খুলে দেখে, ত্রিকালদর্শী পঞ্চানন এখন কর্কট রাশির জাতক সম্পর্কে ‘বাড়তি খরচ এড়িয়ে চলুন’ আর ‘শরীরের যত্ন নিন’ জাতীয় নিরাপদ সাবধানবাণী ছাড়া খালি ভাল ভাল কথা লেখেন। এখন মাঝে মাঝে সুজয়ের ফিরতে দেরি হলেও বৌ কিছু বলে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy