বাংলা ভাষায় কবিগুরুর অবদান অনস্বীকার্য।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘দুর্বল, ক্ষুদ্র, হৃদয়হীন, কর্মহীন, দাম্ভিক, তার্কিক’ এই জাতিটিকে বাড়তি বিড়ম্বনামুক্ত করতেই বোধহয় জটিল-কুটিল ‘বাঙ্গালী’কে সেই কবে সহজতর ‘বাঙালি’ হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তবে আবেগসর্বস্ব এই জাতিটি নিজচরিত্রের ছিচকাঁদুনে সঙ্গদোষেই মিটিং-মিছিলে ক্রন্দনক্লান্ত বিপ্লবী হয়ে টিয়ারগ্যাসকে করে ফেলেছিল ‘কাঁদুনে গ্যাস’। কবিগুরু এই বাড়তি আবেগের ডানা ছেঁটে যুক্তিনিষ্ঠ পথে বলেছিলেন ‘কাঁদুনে নয়, কাঁদানে গ্যাস। এই গ্যাস কাঁদে না, কাঁদায়।’ রামকিঙ্কর বেজ নিজের জীবনের লৌকিক উপাদান থেকেই প্রত্যক্ষ করে ‘ভিস্যুয়াল’কে দেখেছিলেন ‘চাক্ষিক’ রূপে। সেই চাক্ষিক বাঙালি, ভাষার গতিপ্রকৃতি দেখে আজ উপলব্ধি করে এক দুয়োরানির সুয়োরানিতে রূপান্তর। রবীন্দ্রনাথই দিকনির্দেশ করেছিলেন— “বানানের ছদ্মবেশ ঘুচিয়ে দিলেই দেখা যাবে, বাংলায় তৎসম শব্দ নেই বললেই হয়। এমন কি, কোনো নতুন সংস্কৃত শব্দ আমদানি করলে বাংলার নিয়মে তখনই সেটা প্রাকৃত রূপ ধরবে।” সেই ‘ভগ্নতৎসম’তে অভ্যস্ত হতে হতেই বাঙালি সমস্ত ‘অভ্যাস’কে ‘অভ্যেস’ করে আপন করে নিয়েছে।
এখানেই কবি কিঞ্চিৎ চিন্তিত এবং শঙ্কিত ছিলেন। বাংলা বানানের অবাধ স্বাধীনতা, তার তাত্ত্বিক রূপ থেকে লৌকিক গড়নে বিস্তার, এই স্বতঃপ্রণোদিত প্রবাহে স্বেচ্ছাচারিতা না প্রাধান্য পায়! কবি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন অনুভব করলেন। বুঝেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সময়ে অভিভাবক হিসেবে অবতীর্ণ হওয়া ভীষণ জরুরি। পরে দেবপ্রসাদ ঘোষকে লেখা এক চিঠিতে কবি সেই কথাই বলেছিলেন— “...বাংলা বানানের নিয়ম বিধিবদ্ধ করবার জন্য আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছিলুম। তার কারণ এই যে, প্রাকৃত বাংলার ব্যবহার সাহিত্যে অবাধে প্রচলিত হয়ে চলেছে কিন্তু এর বানান সম্বন্ধে স্বেচ্ছাচার ক্রমশই প্রবল হয়ে উঠছে দেখে চিন্তিত হয়েছিলুম।... এ রকম অব্যবস্থা দূর করবার একমাত্র উপায় শিক্ষা-বিভাগের প্রধান নিয়ন্তাদের হাতে বানান সম্বন্ধে চরম শাসনের ভার সমর্পণ করা।”
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রথম প্রফেসর দীনেশচন্দ্র সেন ১৯৩২ সালে অবসর গ্রহণ করলে কর্তৃপক্ষ খগেন্দ্রনাথ মিত্রকে ‘রামতনু লাহিড়ী অধ্যাপক’ পদে নিয়োগ করে। রবীন্দ্রনাথকে ‘পার্ট-টাইম প্রফেসর’ পদে আমন্ত্রণ জানানো হয়— “ড. রবীন্দ্রনাথ টেগোর ওয়াজ় ইনভাইটেড টু অ্যাকসেপ্ট অ্যান এনগেজমেন্ট উইথ দ্য ইউনিভার্সিটি ফর টু ইয়ার্স উইথ এফেক্ট ফ্রম দ্য ফার্স্ট অগস্ট, নাইন্টিন থার্টি টু, ফর ডেলিভারিং আ কোর্স অব লেকচার্স ইচ ইয়ার অন সিলেক্টেড টপিকস উইথ বেঙ্গলি লিটারেচার অ্যান্ড লিটারেচার ফর দ্য বেনিফিট অ্যান্ড গাইডেন্স অব পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্টস অ্যান্ড ফর কো-অপারেটিং উইথ দ্য ইউনিভার্সিটি ইন প্রোমোটিং স্টাডি অ্যান্ড রিসার্চ ইন বেঙ্গলি ইন দ্য ইউনিভার্সিটি। ড. রবীন্দ্রনাথ টেগোর ওয়াজ় রেকগনাইজ়ড অ্যাজ় আ পার্ট
টাইম প্রফেসর।”
বিষয়টি কিন্তু একেবারেই মসৃণ ভাবে ঘটেনি। এই নিয়ে চাপা একটা অসন্তোষ, গুঞ্জন কবির কানে এসেছিল। কবি তাই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে চিঠিতে লিখেছিলেন— “বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শ্রেণীতে আমাকে নিযুক্ত করা হয়েছে বলে দেশে একটা অসন্তোষ সৃষ্টি করা হোলো।... আমার দেশের লোকে অনেকে আমার প্রতি নিষ্ঠুর, তাদের নির্মমতাকে জাগরূক করে তোলবার উপলক্ষ্য দিচ্চি বলে মন আমার সঙ্কোচ বোধ করচে।... আমার শরীর এখন ক্লান্ত, বন্ধুর পথে নিরন্তর আঘাত সহ্য করে চলার শক্তি নেই— এই কারণে শঙ্কিত হয়েচি। কি করা কর্তব্য যথার্থ বন্ধুভাবে সে কথা চিন্তা কোরো পরামর্শ দিয়ো।” (২১/০৭/১৯৩২)
শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তৎক্ষণাৎ প্রত্যুত্তরে (২৪/০৭/১৯৩২) কবিকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, “দু-চারজন সঙ্কীর্ণমনা কি বলেচে না বলেচে সে দিকে আমাদের নজর দিলে চলবে না। আমার পক্ষে একথা বলা ধৃষ্টতা, যে আমাদের দেশে কোনও ভাল কাজে নামতে গেলেই প্রথমত অল্পবিস্তর বাধাবিপত্তি হবেই হবে, কিছু অসঙ্গত আলোচনাও হবে।... যে কাজের জন্য আপনার সাহায্য ভিক্ষা করেচি, সে কাজ যথার্থ দেশের মঙ্গলকারক, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকট হতে এইরূপ সংস্কারের দাবী আপনি বহুকাল করে এসেছেন।... আপনি দ্বিধাশূন্য মনে এই আহ্বান গ্রহণ করুন, এই আমার প্রার্থনা।”
প্রসঙ্গক্রমে ইতিপূর্বে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে কবিকে ‘ডক্টরেট’ উপাধি প্রদান নিয়ে টালবাহানার ইতিহাস তখনও খুব পুরনো নয়। কবির নোবেলপ্রাপ্তির সংবাদ পাওয়ার পরদিনই বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেটের অধিবেশনে কবির তড়িঘড়ি ‘ডক্টরেট’ উপাধি দানের বিষয়টিকে অনুমোদন করা হয়। যদিও ‘গীতাঞ্জলি’র বিশ্বজয়ের আগে সিন্ডিকেটের সভায় স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায় প্রয়োজনীয় সমর্থন পাননি। নীরদ সি চৌধুরী তীব্র ভাষায় কটাক্ষ করে বলেছিলেন,
“...কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কপটতার কথা বলি। তখনই ইহার কর্তারা তাঁহাকে ‘ডক্টরেট’ দিলেন বটে, কিন্তু উহাকে বাধ্য হইয়া দেওয়া ভিন্ন আর কিছু বলা চলে না। রবীন্দ্রনাথের নিন্দুকদের মধ্যে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা অল্পসংখ্যক ছিলেন না। যে-ব্যক্তি ডিগ্রিধারী নয়, এমন কি এন্ট্রান্স পরীক্ষাও পাশ করে নাই, তাঁহারা সেই ব্যক্তির বাংলা ভাষার জ্ঞান পর্যন্ত আছে তাহাও স্বীকার করিতে প্রস্তুত ছিলেন না।” অতএব এই অভিজ্ঞতার নিরিখে কবিমনে দ্বিধাদ্বন্দ্ব হওয়াটা একেবারেই অমূলক নয়।
যাই হোক, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সদর্থক ভূমিকা গ্রহণ করলেন। রাজশেখর বসুকে সভাপতি এবং চারুচন্দ্র ভট্টাচার্যকে সম্পাদক নির্বাচিত করে ১৯৩৫ সালের নভেম্বর মাসে বানান সংস্কার সমিতি পথ চলা শুরু করল। সমিতির বিশিষ্ট সদস্যদের মধ্যে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, প্রমথ চৌধুরী, বিধুশেখর ভট্টাচার্য, সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার, খগেন্দ্রনাথ মিত্র, বিজনবিহারী ভট্টাচার্য প্রমুখের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ১৯৩৬ সালের মে মাসে সমিতি বানান সম্পর্কিত নিয়ম ও বিধান সংবলিত একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে এবং ভূমিকায় শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কবির প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে লেখেন, “কিছুকাল পূর্বে রবীন্দ্রনাথ চলিত বাংলা ভাষার বানানের রীতি নির্দিষ্ট করিয়া দিবার জন্য কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুরোধ করেন। গত নভেম্বর মাসে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বানানের নিয়ম-সংকলনের জন্য একটি সমিতি গঠন করেন।” বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ সেই বছরেরই সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত হয়।
ভাষার গতিশীল প্রবাহের প্রতিই যে তাঁর বরাবর আস্থা বা ঝোঁক, এ কথাটা কবি অনেক ভাবেই বলেছেন। এমনকি তদ্ভব বা ভগ্নতৎসম বা প্রাকৃত শব্দের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান সমিতির থেকেও দেহাতি নিরক্ষর জনজাতির চলমান জীবনপ্রবাহের অনুষঙ্গে গঠিত শব্দ তাঁকে স্বস্তি প্রদান করেছে। দেবপ্রসাদ ঘোষকে লেখা আর একটি চিঠিতে (১২/০৬/১৯৩৭) কবি সেই কথাই দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, “তৎসম শব্দে আমি নমস্যদের নমস্কার জানাব। কিন্তু তদ্ভব শব্দে অপণ্ডিতদের অধিকারই প্রবল, অতএব আমার মতো মানুষেরও কথা চলবে, কিছু কিছু চালাচ্ছিও। যেখানে মিলছি নে সেখানে আমি নিরক্ষরদের সাক্ষ্য মানছি। কেননা অক্ষরকৃত অসত্যভাষণের দ্বারা তাদের মন মোহগ্রস্ত হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় বানান সমিতির চেয়েও তাদের কথার প্রামাণিকতা যে কম তা আমি বলব না।” নোম চমস্কি তো ভাষা সম্পর্কে সেই কথাই বলেছেন, “ইট ক্যারিজ় দ্য ওয়েল্থ অব ট্র্যাডিশন অ্যান্ড হিস্ট্রি— দ্য ওরাল হিস্ট্রি।”
১৯৩৮ সালের শেষার্ধে কবি ‘বাংলাভাষা-পরিচয়’ গ্রন্থে তাঁর এই সামগ্রিক ভাবনাটিই বিস্তৃত ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। আগামীর জন্য কবির দেওয়াল লিখন ছিল একেবারে সুস্পষ্ট, “... সাধু ভাষা তাকেই আসন ছেড়ে দিয়ে ঐতিহাসিক কবরস্থানে বিশ্রামলাভ করবে। সেই কবরস্থান তীর্থস্থান হবে, এবং অলংকৃত হবে তার স্মৃতিশিলাপট।”
মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যে মধুকবি সংস্কৃত আশ্রিত যে সব ক্রিয়াপদ নির্মাণ করেছেন, যেমন, ‘জিজ্ঞাসিলা’, ‘বিহারিতেছিলা’, ‘আরম্ভিল’, ‘নীরবিলা’, ‘আক্রমিছে’, ‘আচ্ছাদিছে’, ‘উলঙ্গিয়া’, ‘বিমুখিবে’, ‘আক্ষেপিয়া’ ইত্যাদি কাব্যদেহকে ভারাক্রান্ত করেছে। রবীন্দ্রনাথও এই প্রয়োগকৌশল সম্পর্কে বিশেষ প্রসন্ন ছিলেন না। কবি তাই বলেছিলেন “মাইকেল মধুসূদন... বিস্তর নূতন সংস্কৃত শব্দ অভিধান থেকে সংকলন করেছিলেন। অসামান্য কবিত্ব শক্তি সত্ত্বেও সেগুলি তাঁর নিজের কাব্যের অলংকৃতিরূপেই রয়ে গেল, বাংলাভাষার জৈব উপাদানরূপে স্বীকৃত হল না।” বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষাকে এই ভারমুক্ত করে এনেছিলেন মুক্তির সুবাতাস। তিনিও সংস্কৃত শব্দভান্ডারের কাছেই ঋণী, কিন্তু সেখান থেকে ‘যথোচিত উপকরণ সংগ্রহ’ করে বাংলায় আত্তীকরণ করেছিলেন বলেই ‘সবগুলিই বাংলাভাষা সহজে গ্রহণ করেছে, আজ পর্যন্ত তার কোনটিই অপ্রচলিত হয় নি।’ এমনকি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সাহেবদেরও কবি রেয়াত করেননি, “পণ্ডিতে ফৌজে মিলিয়া বাংলার বানান বাঁধিয়া দিয়াছিল।... কিন্তু ফোর্ট উইলিয়ামের বর্তমান দণ্ডকারীদের জিজ্ঞাসা করি— সংস্কৃত নিয়ম মতেও কি সোণা কাণ বিশুদ্ধ বানান? বর্ণন হইতে যদি বানান হয়, তবে কর্ণ হইতে কি কাণ হইবে?”
রবীন্দ্রনাথ ‘বাংলাভাষা-পরিচয়’ গ্রন্থে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার পথ প্রশস্ত করতে উপযুক্ত পারিভাষিক শব্দ গঠনের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। এ ক্ষেত্রেও কবি অকৃপণ ছিলেন না। তবে বিজ্ঞান বিষয়ক পারিভাষিক শব্দ গঠনে কবির সেজদা হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর ১৮৭৩ সালে লেখা ‘প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের স্থূল মর্ম’ বইটির কথা স্বতন্ত্র ভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। যদিও হেমেন্দ্রনাথ বইটি মুদ্রিত আকারে দেখে যেতে পারেননি। তাঁর প্রয়াণের (১৮৮৪) বেশ কয়েক বছর পর ১৮৯৭ সালে তাঁর পুত্র ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর বইটি প্রকাশ করেন। সেখানে বহু পারিভাষিক শব্দের সঙ্গে পরিচয় হল, যেমন, Opaque হল অস্বচ্ছ, Focus অধিশ্রয়, Screw ঘূর্ণিকা, Amber তৃণমাণ, Optics দৃষ্টিবিদ্যা, Pupil মণিচ্ছিদ্র, Density সান্দ্রতা ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথ বললেন, Analysis বিকলন, Calculation সংখ্যান, Dissolved প্রলীন, Population প্রজন, Symmetry সস্মিতি। কবির অনবদ্য প্রয়োগ নৈপুণ্যে Footpath হল একায়ন, Body Guard ঐকাঙ্গ, Out of order ভিন্নক্রম। এই তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতেই পারে।
তবে পরিভাষা বিষয়ে হেমেন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথের মধ্যবর্তী পর্বে কবির জ্যোতিদাদার কথা উল্লেখ করতেই হয়। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ক্ষণজীবী ‘সারস্বত সমাজ’-এর ১২৮৯ বঙ্গাব্দের ২ শ্রাবণের প্রথম অধিবেশনে নিয়মাবলিতে পাওয়া যায়, “(ক) বঙ্গভাষায় পাশ্চাত্য সাহিত্য-দর্শনের অনুশীলন করিতে হইলে যে সকল নূতন কথাসৃষ্টির প্রয়োজন হয়, তাহা আলোচিত ও নির্ধারিত হইতে পারে এবং তৎসঙ্গে বঙ্গভাষায় সর্বাঙ্গসম্পূর্ণ একখানি অভিধানও সঙ্কলিত হইতে পারে। (খ) বিদেশীয় ভাষার শব্দসমূহ বাঙ্গালা অক্ষরে প্রকাশ করিতে হইলে, নূতন যে সকল অক্ষরের আবশ্যক হয়, তাহা সৃষ্টি করিয়া প্রচলিত করা যাইতে পারে।” এমনকি ‘ভারতী’-তে লিখিত সুচিন্তিত একটি প্রবন্ধেও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বিদেশি তথা পাশ্চাত্য শিক্ষার ক্ষেত্রে পরিভাষার অভাব ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে বিশেষ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে বলে উল্লেখ করেন, “যাঁহারা কিছুমাত্রও বঙ্গভাষা ও বঙ্গসাহিত্যের অনুশীলন করিয়াছেন, তাঁহারাই দেখিতে পাইবেন যে, বঙ্গভাষা এখনও এতদূর পরিপুষ্ট হয় নাই যে আমাদের সকল ভাব ঐ ভাষায় স্পষ্ট করিয়া প্রকাশ করা যাইতে পারে।... পাশ্চাত্য জ্ঞানের সহিত দিন দিন আমাদের যতই পরিচয় বাড়িতেছে, ততই আমরা আমাদের ভাষার দারিদ্র্য
অনুভব করিতেছি।”
রবীন্দ্রনাথ ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে নিজের তুলনা করে বলেছিলেন, “তিনি যেন ভাষা সম্বন্ধে ভূগোলবিজ্ঞানী, আর আমি যেন পায়ে-চলা পথের ভ্রমণকারী।” কবির এই ‘পায়ে-চলা’ চলতি পথেই চলিত ভাষা প্রাকৃত জীবনের গন্ধ মেখে আজও স্বচ্ছন্দে প্রবহমান। ভাষার এই স্বচ্ছন্দ গতিপথ প্রদানে নদীগর্ভ সংস্কারের মতোই বানান-সংস্কারও ছিল একটি ভীষণ প্রয়োজনীয় এবং যুগান্তকারী পদক্ষেপ। মণীন্দ্রকুমার ঘোষ কবির বানানকীর্তি সম্পর্কে অসাধারণ ভাবে বলেছেন, “হ্রস্ব-ই কারের প্রতিষ্ঠা, ঙ-কে একক মর্যাদা দান, বর্গ-জ এর প্রাধান্য স্থাপন, মূর্ধন্য-ণ এর নির্বাসন, বিসর্গ বিসর্জন, ও-কারের আবাহন, ই-কার ও কারের দু’-একটি বাংলা সন্ধি।” বাংলা বানান সাম্রাজ্যের প্রথম বিপ্লবী তিনিই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy