Advertisement
২৬ ডিসেম্বর ২০২৪
Culture

বালিকা ও যুবতীরা তাঁকে ঘিরে নাচে

একশো বছর আগে পত্রপত্রিকায় এমনই ব্যঙ্গ হয়েছিল ষাটোর্ধ্ব রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। কারণ তিনি ও তাঁর পুত্রবধূ নৃত্যকলাকে সংস্কৃতির পরিসরে এনেছিলেন। তার আগে ভদ্রসমাজে নাচকে ভাল চোখে দেখা হত না।

আজ ও শান্তিনিকেতনে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উদযাপনের অন্যতম অঙ্গ নৃত্যকলা।

আজ ও শান্তিনিকেতনে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উদযাপনের অন্যতম অঙ্গ নৃত্যকলা।

শুভাশিস চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০২৪ ০৮:৪৯
Share: Save:

বরযাত্রী নিয়ে মাদার (একটি পুরুষ চরিত্র) র‌ওনা দিয়েছিল বিয়ে করবে বলে। পথে দেখা গেল অশুভ লক্ষণ। এর পর তো আর এই বিয়ে হতে পারে না। ফলে বিয়ে ভাঙল, মাদার চিরকালের জন্য অবিবাহিত থেকে গেল। তার এমন শোকের শরিক তরুণ-তরুণীরা গ্রামের পিরতলায় যে নৃত্যে শামিল হয়, তার কেন্দ্রে থাকে একটি লাল শালু জড়ানো লম্বা বাঁশ। এই দণ্ডটিই মাদারের প্রতীক। সেটিকে নিয়ে ভক্ত নৃত্যশিল্পীরা নানা ধরনের কসরত দেখায়, নাচে। বেজে চলে ঢাক ঢোল। ‘দেখব সবাই মাদার নাচন/ ভরব হৃদয় বাসর,/ বাজাবি ঢাক বাজাবি ঢোল/ বাজাবি রে কাঁসর’— মাদার নাচের এই গানের রচয়িতা আব্দুর রসিক খান। বাংলার রাঢ় অঞ্চলে এই সে দিনও অতি জনপ্রিয় ছিল এই উৎসব।

‘চাঙ’ নৃত্য ঝাড়গ্রাম অঞ্চলের লোধাদের আনন্দ উদ্‌যাপনের উপচার। তাঁদের শীতলা ঠাকুর হলেন ‘বসন্তবুড়ি’, বনদেবতার নাম ‘বড়াম’— এই দুই পুজোতেই ‘চাঙ’ আবশ্যিক, বিয়ের আসরেও। হাঁটুর উপর মালকোঁচা মারা ধুতি, কোমরে গামছা, খালি পায়ে বৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে চলে নাচ, হাতে খঞ্জনির মতো দেখতে ‘চাঙ’ নামের বাদ্যযন্ত্র: ‘এ দাঁড়ারে কে আসুছি/ ওলাওঠা বুড়ি/ বসন্ত মে বুড়ি…’। লোধা জনজাতিদের এই নাচে যেমন ‘চাঙ', তেমনই সাঁওতালদের ‘ভুয়াং’ নাচে আবশ্যক বাদ্যযন্ত্রটির নাম ‘ভুয়াং’। দুর্গাপূজার দশমীর দিনে পুরুষেরা মাথায় ময়ূরপুচ্ছ আর গলায় ফুলের মালা পরে এই বিষাদের নৃত্যে অংশ নেয়। সঙ্গে গান: “ওটা দিশম…ধূদদেনা/ গাঙ্গির চাউরী”— এর অর্থ, আমাদের সামনে শুধুই কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকার।

বৃহত্তর কার্শিয়াং ও কালিম্পং অঞ্চলের তিব্বতিরা কাঠের মুখোশ পরে ‘সিঙ্গীছম’ নৃত্যে অংশগ্রহণ করে। এই দ্বৈত নৃত্যে দুই শিল্পী মিলে একটি সিংহ সাজে। সামনের শিল্পীর হাতে ধরা সিংহের মুখোশ। সিংহ-চর্ম গায়ে চাপিয়ে মূলত পায়ের চলনে এই নাচের উৎকর্ষ ফুটে ওঠে। এক‌ই ভাবে চমরি গাই বা ইয়াক সেজে যে নাচ, তার নাম ‘ইয়াছম’, ময়ূর নৃত্যের নাম ‘মেপাছম’। দার্জিলিঙে জনপ্রিয় ‘ডাইনি নাচ’। লামাদের গুম্ফায় বিশেষ তিথিতে ডাইনির মুখোশ পরে এই নাচে বীভৎস-রসের‌ই প্রাধান্য।

বঙ্গদেশে অনেক নৃত্যেই শিল্পীর হাতে থাকে রুমাল। মুসলমানদের জারি নাচে ও গম্ভীরা নাচের পৈরীদের হাতে ওই বস্ত্রখণ্ডটি আবশ্যিক। গড়বেতা অঞ্চলে গোষ্ঠীবদ্ধ ভাবে ‘রুমাল নৃত্য’ করা হয়। পুরুষেরাই ঘাগরা পরে তরুণী সেজে ঘরের ছেলে ভগবান রামচন্দ্রের দুঃখে কাতর হয়ে উঠে গান করেন: “পঞ্চবটীর বনে রাম বাঁধলে কুড়েখানি/ কাল হয়ে এল সোনার হরিণী/ ‘মৃগ ধরে দাও’ বলে জনকনন্দিনী।” প্রভু শ্রীরামের (পরভু শিরাম) বন্দনা না করে পশ্চিম রাঢ় অঞ্চলের ‘কাঠি নাচ’ শুরু‌ই হয় না।

বীরভূমের রায়বেঁশে নৃত্যকে পুনরুদ্ধার করেছিলেন ব্রতচারী আন্দোলনের পথিকৃৎ গুরুসদয় দত্ত। শক্তিশালী জনগোষ্ঠীর আচরণীয় কৌশলকে বলে ‘বিশা’, তার থেকে ‘বেশে’; সেকালে জমিদারদের বলা হত ‘রায়’— তাদের আশ্রিত বিশেষ জনগোষ্ঠী ‘রায়বেশে’ পরিচয় পেয়েছিল। এদের‌ই নাচ ‘রায়বেঁশে’, যেখানে হাতের মুদ্রায় ধনুর্বাণ চালনা থেকে শুরু করে নানা ধরনের দৈহিক কসরত প্রদর্শিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমন্ত্রণে গুরুসদয় দত্ত শান্তিনিকেতনে রায়বেঁশের দল নিয়ে গিয়েছিলেন। তবে লাভপুরের জমিদারবাড়ির সন্তান তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, গুরুসদয় দত্তের ‘ব্রতচারী নৃত্যালি’ নিয়ে তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন: “দত্ত সাহেবের প্রতাপে ইস্কুলে-ইস্কুলে, গ্রামে-গ্রামে তখন রায়বেঁশে নৃত্যের ঢোল বাজতে লেগেছে— উকিল নাচছে, মোক্তার নাচছে, ডেপুটি নাচছে, সাব-ডেপুটি নাচছে, দারোগা নাচছে, চৌকিদার নাচছে, হাকিম নাচছে, আসামী নাচছে, রায়বাহাদুর নাচছে, রায়সাহেব নাচছে, জমিদার নাচছে, ধনী নাচছে, হেড মাস্টার নাচছে, সেকেণ্ড মাস্টার নাচছে, ছাত্র নাচছে— সে এক অত্যদ্ভুত কাণ্ড। না নেচে পরিত্রাণ নাই।”

তারাশঙ্করের এই আপাত-কঠোর মন্তব্যে ‘নৃত্য’ বিষয়ে সে কালের শিক্ষিত ভদ্রসমাজের উন্নাসিক মানসিকতা বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়। ‘নির্মল আনন্দ উপভোগের উপযোগী নৃত্যকলার প্রতি শিক্ষিত সমাজের এই অবহেলা সমাজের পূর্ণাঙ্গ বিকাশের দিক থেকে গুরুতর ত্রুটি’ বলেই মনে করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর কাছে নৃত্য নিতান্ত বিনোদনের উপায়মাত্র ছিল না, যেমনটা তাঁর ঠাকুরদাদার কাছে ছিল। ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকার ১৮৪০-এর ২৯ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় জানা যাচ্ছে, দ্বারকানাথ ঠাকুর বেলগাছিয়া বাগানবাড়িতে বাইজি নাচের আসর বসিয়েছিলেন। আরও আগে, ফ্যানি পার্কস তাঁর একটি লেখায় ‘নিকি’ নামের জনৈক বাইজির প্রশংসা করে জানিয়েছেন, রাজা রামমোহন রায় তাঁর মানিকতলার বাগানবাড়িতে নিকি নর্তকীর নাচ উপভোগ করেছিলেন।

নিম্নস্তরের বিলাসের বাইরে মানবচিত্তে নাচের যে আর কোনও স্থান থাকতে পারে, সে বোধ ঊনবিংশ শতাব্দীর নাগরিক শিক্ষিত সমাজ সম্পূর্ণ হারিয়েছিল। এরই বিপ্রতীপে নৃত্যকলার সম্মান অক্ষুণ্ণ ছিল, আজও আছে—গ্রামসমাজে। ভারতীয় লোকনৃত্যের ব্যাপক প্রচলনের পরিচয়ে তার প্রমাণ মেলে। শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর প্রথম থেকে নৃত্যকলাচর্চার ব্যবস্থা করতে না পারলেও রবীন্দ্রনাথ ছাত্রদের নিয়ে নাটকের অভিনয়ের সময় গানের সঙ্গে নিজে উৎসাহের সঙ্গে নেচেছেন, অন্যদের‌ও উৎসাহিত করেছেন। ‘অচলায়তন’ নাটকের শোনপাংশুরা যখন যে-যার নিজের মতো নেচে যেতেন, তখন পিয়ার্সন সাহেব তাঁর দেশজ নাচের ঢঙে ওই দলের সঙ্গে নাচে যোগ দিয়েছিলেন।

কবি নৃত্যের সংজ্ঞা খুঁজেছেন এ ভাবে, “আমাদের দেহ বহন করে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ভার, আর তাকে চালনা করে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গতিবেগ। এই দুই বিপরীত পদার্থ যখন পরস্পর মিলনে লীলায়িত হয় তখন জাগে নাচ। দেহের ভারটুকুকে দেহের গতি নানা ভঙ্গিতে বিচিত্র করে জীবিকার প্রয়োজনে নয়, সৃষ্টির অভিপ্রায়ে দেহটাকে দেয় চলমান শিল্পরূপ। তাকে বলি নৃত্য।” সে কালের সামাজিক বিরুদ্ধাচরণের কথা জেনেও ‘শান্তিনিকেতনে তিনি গড়ে তুলতে পেরেছিলেন নাচের একটি প্রাণবান আন্দোলন’।

এই আন্দোলনের প্রথম যুগটি ১৯০৮ থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত অতিবাহিত হয়। এই পর্ব বিধিবদ্ধ কোন‌ও নিয়মের দ্বারা পরিচালিত হয়নি। আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্বের প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেন রবীন্দ্রনাথের পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী। তিনি বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের মধ্যে নৃত্যচর্চার ব্যবস্থা করলেন। সেটা ১৯২৪ সাল। ঠিক একশো বছর আগে ‘গরবা’ নাচ দিয়ে এখানকার মেয়েদের নৃত্যশিক্ষা শুরু হয়। নন্দলাল বসুর দুই কন্যা গৌরী দেবী ও যমুনা দেবী, ক্ষিতিমোহন সেনের কন্যা অমিতা সেন, রবীন্দ্রনাথের নাতনি নন্দিতা দেবী প্রমুখ ছিলেন সেই দলে, যাঁরা মধ্যবিত্তের নিষেধের তোয়াক্কা না করে গরবা নৃত্যে অংশগ্রহণ করেন। প্রতিমা দেবী নিজে নাচতে পারতেন না, কিন্তু তাঁর আগ্রহ, উৎসাহ, পরিচালন-ক্ষমতা, ব্যবস্থাপনায় এই পর্বে মূল আন্দোলনটি গড়ে উঠেছিল। পূত্রবধূর উৎসাহে রবীন্দ্রনাথ জীবনের শেষ পনেরো বছরে নৃত্যাভিনয়ের উপযোগী ‘নটীর পূজা’, ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘চণ্ডালিকা’, ‘শ্যামা’, ‘মায়ার খেলা’কে ভিন্ন আকারে সাজিয়েছিলেন। বাস্তবে রবীন্দ্রনাথ‌ই ভদ্রসমাজের মেয়েদের নৃত্যকলায় অংশগ্রহণ বিষয়ে আমাদের মানসিক অচলায়তন ভাঙতে তৎপর হয়েছিলেন। আজ সর্বত্র নাচের অনুষ্ঠানে মেয়েরা দাপটের সঙ্গে অংশ নেয়, টিভিতে নাচের রিয়েলিটি শোয়ে মেয়ের গুণগান শুনে পিতামাতার অশ্রুসজল চোখে ক্যামেরা জ়ুম করে দর্শককেও কাঁদানো হয়। এই দিনটির জন্য কম অপমান সহ্য করেননি রবীন্দ্রনাথ!

কিছু-কম একশো বছর আগে নোবেলবিজয়ী, প্রায় সত্তর-ছোঁয়া বিশ্বকবিকে তাঁর নৃত্য আন্দোলনের ‘পুরস্কার’ দিয়েছে বাঙালি! কী ভাবে? পড়ে নেওয়া যাক ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘সবুজ বাসনা’ শিরোনামে এই সংবাদটি: “শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বৃদ্ধ হইয়াছেন, কিন্তু তাঁহার বিলাস-বাসনা এখনও ‘সবুজ’ রহিয়াছে। শুনা যায়, তিনি বিশ্বভারতীতে নৃত্যের ক্লাস খুলিয়াছেন। বালিকা ও যুবতীগণ তাঁহাকে মধ্যে রাখিয়া ঘিরিয়া নৃত্য করে। তিনি তাহার এক চলচ্চিত্র (সিনেমা ফিল্ম) উঠাইয়াছেন। সেই চিত্রে দেখা যায় তিনি মধ্যে বসিয়া আছেন। তাঁহাকে ঘিরিয়া যুবতীগণ নৃত্য করিতেছে ও তিনি তাল দিতেছেন— দূরে তবলচী তবলা বাজাইতেছে। তিনি সরলচিত্ত সংসারানভিজ্ঞ বালিকাগণকে এ কি শিক্ষা দিতেছেন!”

অন্য বিষয়গুলি:

Shantiniketan Rabindranath Tagore
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy