Advertisement
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
corona virus

বাংলার কলেরা ঠেকাতেই চালু হল সঙ্গরোধ

সে উনিশ শতকের কথা। নীল চাষ তুঙ্গে, রাস্তা তৈরির জন্য বিভিন্ন জেলখানা থেকে নিয়ে আসা হল কয়েদিদের। তখনও লোকের বিশ্বাস, মহামারি ছড়ায় দূষিত আবহাওয়া থেকে। পুরো দেশকে আটকানোর দরকার নেই, বিশেষ একটি দলকে সঙ্গরুদ্ধ করলেই হল!

প্রজিতবিহারী মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০২০ ০০:৩৪
Share: Save:

সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল, কিন্তু বাজারে একটিও দোকান খুলল না। যে বাজারে সকাল-সন্ধে হাজার মানুষের আসা যাওয়া, সেখানে এখন পাখি চরে বেড়াচ্ছে। পথে লোকজনেরও দেখা নেই। দেখলে মনে হবে যেন সব নাগরিক এক সঙ্গে শহরটা পরিত্যাগ করেছেন। বাস্তবও কিছুটা সেই রকম। অজানা মহামারির আতঙ্কে বহু মানুষই শহর ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। যাঁরা পড়ে আছেন, তাঁরাও ভয়ের চোটে একঘরে হয়েছেন।

দৃশ্যটা কিন্তু ২০২০ সালের কোভিড-১৯ আক্রান্ত কোনও শহরের নয়। এটি ১৭২৯ সালের বৈশাখ মাসে মুঘল রাজধানী দিল্লির দৃশ্য। তার বিবরণ দিয়েছেন সমকালীন ইতিহাসবিদ সৈয়দ গোলাম হোসেন তাবতাবাই। আজকের দিনে বসে তাবতাবাইয়ের সেই বিবরণ পড়লে গায়ে কাঁটা দেয়। প্রায় তিনশো বছর আগের এই বর্ণনায় যেন হাল আমলের ছবি। তবে মুঘল আমলের এই বিবরণের সঙ্গে আজকের সঙ্গরুদ্ধ শহরগুলোর একটা প্রকাণ্ড ফারাক রয়েছে। আর সেটা রাষ্ট্রের ভূমিকা সংক্রান্ত।
মুঘল কেন, ইংরেজ শাসন পত্তনের পরেও মহামারির সময় সরকারি ভাবে সারা শহর বা দেশ জুড়ে সঙ্গরোধ বা কোয়ারান্টাইন লাগু করার উদাহরণ বিরল। যাও বা দু-একটি উদাহরণ মেলে, তা হল দেশে নবাগত কোনও বিশেষ একটি দলকে সঙ্গরুদ্ধ করার দৃষ্টান্ত। গোটা শহর বা দেশকে সঙ্গরুদ্ধ করার নমুনা নয়। যেমন অটোমান সাম্রাজ্যে বার বার প্লেগ দেখা দেওয়ার ফলে অনেক সময় পশ্চিম এশিয়ার যাত্রীদের কিছু দিন সঙ্গরুদ্ধ রাখা হত। ১৭৪৯ সালে উইলিয়াম প্লাইস্টেড নামে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক কর্মচারী কলকাতা থেকে বসেরা, বাগদাদ ইত্যাদি হয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন কালে ফ্রান্সের মার্সেই শহরে কিছু দিন সঙ্গরুদ্ধ হন। সেই বৃত্তান্ত তিনি তাঁর যাত্রার আখ্যায়িকাটিতে লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন।

এরও পরবর্তী কালে ১৮০২ সালে যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতীয় ফৌজ মিশরে নেপোলিয়নের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী হয়ে ভারতে ফিরল, আবারও পশ্চিম এশিয়ায় প্লেগ। ফলে তাঁদের কিছু দিন মুম্বইয়ের বাইরে কসাই দ্বীপ বা ‘বুচার্স আইল্যান্ড’-এ সঙ্গরুদ্ধ রাখা হয়েছিল।

এই ধারার পরিবর্তনের সূত্রপাত ঘটে এই বাংলাদেশেই। ১৮১৭ সালে যশোর জেলায় দেখা দেয় এক নতুন ব্যাধি। আক্রান্ত ব্যক্তিরা হঠাৎ করে ঘন ঘন ভেদবমি ও মলত্যাগের মধ্যে দিয়ে অতি দ্রুত মৃত্যুমুখে পতিত হতেন। যদিও আমাদের এই বঙ্গভূমি বহু কালই পেটের নানান ব্যামোর সঙ্গে সুপরিচিত, ১৮১৭ সালের আগে সে সব রোগ কখনও এত মারাত্মক রূপে আবির্ভূত হয়নি। তাই এই নতুন ব্যাধির নতুন নাম রাখা হয় ‘এশিয়াটিক কলেরা’। যশোর থেকে প্রথমে কলকাতা, তার পর বাকি মহাদেশে এবং তারও পরে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এই ভয়ানক এশিয়াটিক কলেরা।

কলেরা বা ওলাওঠার এই দ্রুত অনুকীর্ণতারও একটা স্পষ্ট কারণ ছিল। উনিশ শতকের গোড়ার দিকটা ছিল বিশ্বায়নের প্রথম স্তর। বাষ্পচালিত জাহাজে দূর-দূরান্তে ভ্রমণ হয়ে উঠেছিল অনেক সহজ ও দ্রুত। সেই সহজতা ও দ্রুততার সুবিধে নিয়েই নানা ইউরোপীয় দেশ অন্যান্য মহাদেশগুলোতে সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু করেছিল। এদের মধ্যে অন্যতম অবশ্যই ইংরেজ সাম্রাজ্য। এই সাম্রাজ্য বিস্তারের কারণ এবং ফল দুইই ছিল বাণিজ্য। কাঁচামাল সস্তায় কেনা ও তৈরি জিনিস বৃহত্তর বাজারে বিক্রি করা, এই দুটিই ছিল সাম্রাজ্যবাদের মূল মন্ত্র।

যশোর তখন নীল চাষের অন্যতম কেন্দ্রস্থল। আর সেই ব্যবসায় আকৃষ্ট হয়ে নানা দিক থেকে বহু মানুষ তখন যশোরবাসী হচ্ছেন। এই ব্যবসার সুবিধের জন্যই ইংরেজ সরকার নতুন সড়ক তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন। আর সেই সড়ক নির্মাণের কাজে লাগানো হয় বিভিন্ন জেল থেকে নিয়ে আসা কয়েদিদের। এই সড়ক তৈরিতে কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যেই প্রথম দেখা দিল ভয়ানক কলেরা। আর এই বাণিজ্যিক পথ ধরেই তা ছড়িয়ে পড়ল সারা পৃথিবীতে। সাম্রাজ্য আর বাণিজ্যের যৌথ ভাবে তৈরি জাল যেমন পৃথিবীটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধতে থাকে, সেই জাল বেয়েই আবার কলেরার মতো ভয়ানক ব্যাধি দ্রুতগতিতে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

রোগবালাই: সে কালে ইউরোপীয় কার্টুনে কলেরা মহামারিকে ‘ভারতীয়’ করে তোলা হয়েছিল এ ভাবেই

১৮১৭ থেকে ১৮২১ পর্যন্ত বারে বারে হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হতে থাকেন কলেরায়। আজকের বিজ্ঞানীরা এই সময়টিকে ‘প্রথম কলেরা প্যানডেমিক’ নামে আখ্যায়িত করে থাকেন। তবে এই বিষয়ে একটি বড় ঐতিহাসিক ধাঁধা হল যে, এই মারাত্মক এবং বিধ্বংসী ব্যাধির মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও ইংরেজ সরকার কেন সঙ্গরোধের কোনও প্রচেষ্টা করেনি। ঔপনিবেশিক বাংলাকে সঙ্গরুদ্ধ করে দিলে তো তাদের নিজের দেশ রক্ষা পেয়ে যেত। কিন্তু ইংরেজরা তা করলেন না। বরং চিরাচরিত, প্রাক-ঔপনিবেশিক রীতি অনুযায়ী তাঁরা চেষ্টা করলেন আক্রান্ত মানুষদের চিকিৎসার সুযোগের মাধ্যমে কিছুটা সুবিধেও দিতে। প্রধান সড়কগুলির ধারে ধারে স্থাপিত হল কয়েকটি চিকিৎসাকেন্দ্র। গ্রামাঞ্চলে অস্থায়ী ভাবে কয়েকজন চিকিৎসকও নিযুক্ত করা হল। কিন্তু সঙ্গরোধ নিয়ে জিগির তখনও ওঠেনি।

সেই জিগির উঠল মাত্র ১০ বছর পরে, ১৮৩০-৩১ এ, যখন ‘দ্বিতীয় কলেরা প্যানডেমিক’ শুরু হল। এবং আশ্চর্যের বিষয়, তা মেনেও নেওয়া হল। ইউরোপে এবং পরবর্তী কালে আমেরিকায় একাধিক দেশ, এবং দেশের মধ্যে অনেক শহর, গ্রামগঞ্জ পর্যন্ত নিজের নিজের চৌহদ্দির মধ্যে সঙ্গরোধ জারি করতে থাকল। মহামারির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রের চিরাচরিত কার্যপ্রণালীতে হঠাৎই এসে গেল আমূল পরিবর্তন। যেখানে এত কাল মহামারির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রাষ্ট্র কেবল কিছুটা দান-খয়রাত করে আর কিছুটা প্রার্থনা করে আর্ত নাগরিকদের প্রতি তাদের দায়িত্ব মেটাত, এ বার সেই রাষ্ট্র হয়ে উঠল অনেক বেশি সক্রিয়। সঙ্গরোধের মাধ্যমে মহামারিকে প্রতিহত করতে সামাজিক জীবনের আনাচে-কানাচে ঢুকে পড়তে সচেষ্ট হল সে।
কেন রাষ্ট্রের ভূমিকাতে এই পরিবর্তন এল? এমন তো নয় যে এর আগে কখনও মহামারি ঘটেনি বা রাষ্ট্রকে তার মোকাবিলা করতে হয়নি। তবে কেন অবশেষে উনিশ শতকের তৃতীয় দশকে এসেই রাষ্ট্রের চিন্তাধারা ও কর্মকাণ্ড বদলে গেল? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের দেখতে হবে রাষ্ট্রশক্তির ভিত্তিটি কী ভাবে আঠেরো শতকের শেষার্ধ থেকে পরিবর্তিত হতে থাকে। ওই সময় পর্যন্ত যে কোনও রাষ্ট্রের ক্ষমতা স্থাপিত ছিল মূলত প্রাণহরণের অধিকারের উপর। লোকে রাজাকে শ্রদ্ধা করত, মেনে চলত, কর্জ দিত, কারণ এ সব না করলে রাজা গর্দান নিতেন। সেই অধিকার তাঁর ছিল এবং সেই অধিকার প্রয়োগের জন্য তাঁকে জবাবদিহি করতে হত না। মানুষের প্রাণপাত করার মধ্যে দিয়েই রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের কর্ণধার— অর্থাৎ রাজা— ক্ষমতায় বজায় থাকতেন।

আঠেরো শতকের শেষ দিক থেকে শিল্প বিপ্লবের চাপে রাষ্ট্রশক্তির এই ভিত নড়ে যায়। মানুষ— বিশেষত নতুন ভাবে প্রতিপত্তিশালী ব্যবসায়ী এবং সদ্যোজাত মধ্যবিত্ত শ্রেণি— রাজার প্রাণহরণের নিরঙ্কুশ অধিকার আর মেনে নিতে চাইলেন না। ফ্রান্সে এই নতুন বুর্জোয়া গোষ্ঠী স্বয়ং রাজারই গর্দান নিয়ে বসলেন। তাঁদেরই জিগির টেনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও বিপ্লবীরা রাজশক্তিকে সম্পূর্ণ নাকচ করে নতুন গণরাষ্ট্র সৃষ্টি করলেন। এই সব যুগান্তকারী ঘটনার মধ্যে দিয়েই তৈরি হয় নতুন এক ধরনের রাষ্ট্রশক্তি।

এই নতুন রাষ্ট্রশক্তি নিজেকে প্রাণহরকের চাইতে বরং এ বার জীবনের রক্ষাকর্তা হিসেবে প্রতিপন্ন করল। দাবি করল, রাজ্য শাসনের অধিকার জন্মাবে মানুষের প্রাণ নিয়ে নয়, বরং নাগরিকদের জীবন রক্ষা এবং প্রতিপালন করার মধ্যে দিয়ে।
যে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের জীবন রক্ষা করতে অক্ষম বা উদাসী, সেই রাজশক্তির ক্ষমতায় থাকার অধিকার নেই।
এই নতুন দাবির মধ্যেই কিন্তু লুকিয়ে ছিল অভুতপূর্ব আর এক রাষ্ট্রীয় আকাঙ্ক্ষা। প্রাক-আধুনিক রাষ্ট্রের ক্ষমতা যে হেতু মৃত্যুমুখী ছিল, নাগরিকদের সামাজিক জীবন নিয়ে তার চিন্তার অবকাশ ছিল সীমিত। নতুন আধুনিক রাষ্ট্রশক্তি কিন্তু ঠিক তার উল্টো। মানুষের জীবন রক্ষার স্বার্থে সে ক্রমশ সামাজিক জীবনের বিভিন্ন অঙ্গের নিয়ন্ত্রণে প্রবৃত্ত হল। গৃহস্থ কোথায় গৃহনির্মাণ করবেন, তার নিয়ম তৈরি হল। কত বয়সে কাকে বিয়ে করা যাবে সে বিষয়ে আইন হল। মোদ্দা কথায়, সমাজের বিভিন্ন রীতিনীতি, প্রথা, আচার, সবই এ বার রাষ্ট্র নিজেই নির্ধারণ করতে সচেষ্ট হল। আর এর অনেকটাই করা হল জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে।
ঘটনাচক্রে, এই সময়ে আবার নতুন রাষ্ট্রশক্তির সাহায্যে বিবর্তিত হল নতুন চিকিৎসা ভাবনা। প্রাক-আধুনিক চিকিৎসা ভাবনায় রোগের সংক্রামকতার তেমন কোনও সুগঠিত ধারণা ছিল না। বরং চিকিৎসকদের ধারণা ছিল, প্লেগ কিংবা কলেরার মতো রোগের উৎস দূষিত পরিবেশ। তাবতাবাই ১৭২৯ সালের ব্যাধির বিষয়ে লিখেছেন, এই রোগের কারণ ছিল একটি উৎকট দুর্গন্ধ। দুর্গন্ধটি প্রথম প্রকাশ পায় পটনা শহরে। তার পর বাতাসে ভেসে ইলাহাবাদ হয়ে তা পৌঁছয় দিল্লিতে, এবং দিল্লি পেরিয়ে অবশেষে লাহৌরে। প্রতিটি স্থানেই এই গন্ধের পিছু-পিছুই দেখা দেয় মারাত্মক রোগ।

ইউরোপের মধ্যযুগেও আমরা দেখতে পাই একই রকমের ধারণা। চিকিৎসকেরা এবং শিক্ষিত মানুষও মনে করতেন, কোনও অজ্ঞাত কারণে পরিবেশ দূষিত হয়ে এক ধরনের বিষ প্রসব করে। এই বিষই উৎসস্থান থেকে পরে ছড়িয়ে পড়ে দূরদূরান্তের মানুষকে আক্রান্ত করে। বিষাক্ত বাতাসকে ইউরোপীয় চিকিৎসকরা ‘মাইয়াস্মা’ নাম দিয়েছিলেন। এই বিষাক্ত বাতাস থেকেই মহামারি, ফলে এক জন থেকে আর এক জনের শরীরে সরাসরি সংক্রমণের কোনও সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না। আর তাই সঙ্গরোধেরও কারণ দেখা দেয়নি। রোগ যদি সত্যি দূষিত পরিবেশ থেকে জন্মায় এবং পরে আবহাওয়ার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, তা হলে আর মানুষের যাতায়াত, চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করে কী হবে?

১৮৩০-এর পরেই এই ধারণা দ্রুত পাল্টাতে থাকে। তত দিনে সংবাদপত্রের প্রচার বহুল হয়েছে, সাম্রাজ্যের কারণে দূরদূরান্তের দেশগুলির মধ্যে সংবাদ আদান-প্রদান শুরু হয়েছে। সেই সুবাদে ইউরোপের সংবাদপত্রগুলোর দৈনিক খবর থেকে এটুকু প্রমাণ হয়ে যায় যে বাংলা থেকে ধীরে ধীরে কলেরা বিশ্বময় ছড়াচ্ছে পণ্য ও যাত্রীবাহী জাহাজে চেপে, বাতাসের ডানায় ভর দিয়ে নয়। এ থেকেই উঠে আসতে থাকে সংক্রমণের ধারণা, সেই ধারণার দ্বারাই লালিত হয় সঙ্গরোধ লাগু করার যৌক্তিকতা। এই সময় থেকে ধীরে ধীরে আধুনিক জনস্বাস্থ্যের ধারণাও গড়ে উঠতে থাকে। ১৮৩০-এর পরে কলেরার আতঙ্কে ত্রস্ত ইউরোপীয় রাজ্যগুলো একে একে সঙ্গরোধ জারি করতে থাকে।

প্রাক-আধুনিক রাষ্ট্রগুলোর সীমান্ত প্রায়শই ছিল আবছা ভাবে মাপা। প্রধান নদীপথ বা স্থলপথে টোল আদায়কারী কয়েকটা চৌকি ছাড়া তেমন কোনও পাহারারও ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু সঙ্গরোধ সফল করতে, সীমান্তে বসল নতুন পাহারা। দেশের মধ্যেও নতুন সমস্ত আইনকানুন জারি হল। মানুষের সামাজিক জীবনে রাষ্ট্র উঁকি মারা শুরু করল। ডাক্তার, প্রতিবেশী, আত্মীয় ইত্যাদির উপর রাষ্ট্রকে খবর দেওয়ার নতুন দায়িত্ব বর্তাল। আর্তের চিকিৎসা কিংবা মৃতের সৎকার এত দিন ছিল আত্মীয়-প্রতিবেশীদের কর্তব্য, এ বার তার সঙ্গে যুক্ত হল রাষ্ট্রকে সূচিত করার দায়িত্ব।

চিকিৎসকের কর্তব্যেও এল পরিবর্তন। রোগীর রোগ উপশম করা ছাড়াও এ বার তিনি হয়ে উঠলেন সরকারি তথ্যসংগ্রহের অন্যতম সরঞ্জাম। উনিশ শতকের শেষের দিকে তাই আমরা দেখতে পাই, অনেক ক্ষেত্রে রোগীর আপনজনেরা ডাক্তার ডাকতে ভয় পাচ্ছেন, পাছে ডাক্তারের মাধ্যমে রাষ্ট্র রোগীর সংক্রামক রোগের খবর পেয়ে যায় এবং রোগীকে জোর করে সংক্রামক রোগের হাসপাতালে অবরুদ্ধ রাখে। এই সব পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই ধীরে ধীরে আধুনিক রাষ্ট্র তার স্বরূপ ধারণ করতে শুরু করল।

তবে রাষ্ট্রশক্তির এই নতুন চেহারার পাশাপাশি দেখা গেল আরও দু’টি জিনিস। শ্রেণিদ্বন্দ্ব ও বর্ণবিদ্বেষ। একের পর এক দেশে দেখা গেল সঙ্গরোধকে কেন্দ্র করে শ্রেণিদ্বন্দ্বের ছবি। কখন সঙ্গরোধ লাগু হবে, কাকে সঙ্গরুদ্ধ করা হবে আর কাকেই বা তার আওতার বাইরে রাখা হবে এই সব নিয়ে বাধতে লাগল শ্রেণিতে শ্রেণিতে বিভেদ। বিশেষ করে ফুটে উঠল যাঁদের পেটের দায়ে দিনের পর দিন বাড়ি বসে থাকা সম্ভব নয় তাঁদের সঙ্গে মধ্যবিত্তদের বিবাদ। মধ্যবিত্তরা মনে করলেন খেটে-খাওয়া মানুষগুলো দায়িত্বজ্ঞানহীন, সংক্রমণের চলমান বাহক। ও দিকে শ্রমজীবী মানুষরাও দেখলেন, সংক্রমণের ভয়ে তাঁদের অনাহারে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে কুণ্ঠিত নয় মধ্যবিত্তরা। ইতিহাসবিদ চার্লস রোজ়েনবার্গ তাই লিখেছেন, উনিশ শতকে কলেরা আসলে শ্রেণিদ্বন্দ্বের প্রকৃষ্ট মাপকাঠি হয়ে উঠেছিল।

আসলে বেশির ভাগ আধুনিক রাষ্ট্র নিজেকে ক্রিকেটের আম্পায়ারের মতো বিভিন্ন শ্রেণিদ্বন্দ্বের মীমাংসাকার হিসেবে দেখতে ভালবাসে। তবে মহামারির সময় সেই দাবিটি টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে যায়। রাষ্ট্রকে তড়িঘড়ি ঠিক করতে হয় তার কাছে কার জীবনের দাম বেশি: অনাহারে মরণমুখ শ্রমজীবী, না কি সংক্রমণের আতঙ্কে ত্রস্ত মধ্যবিত্ত। হাসপাতালের সীমিত স্থানই বা পাবে কে? কোথায় কবে তৈরি হবে নতুন হাসপাতাল? আর কোন এলাকা বাদ পড়বে? সহজ করে বললে, রাষ্ট্রকে ঠাহর করতে হয় যে মহামারির টালমাটাল অবস্থায় কার পাশে দাঁড়াবে রাষ্ট্রশক্তি আর কার দিক থেকে হাত গুটিয়ে নেবে। ফলে, মহামারির চাপে আধুনিক রাষ্ট্রের একটা নির্মম, পক্ষপাতদুষ্ট রূপ হঠাৎ প্রকট হয়ে পড়ে। নিরপেক্ষতার মুখোশটা যেন চাপা পড়ে যায় ‘ফেস মাস্ক’-এর তলায়।

উনিশ শতকে অবশ্য আধুনিক রাষ্ট্রকে আর একটা চাপও সামলাতে হয়। ফ্রান্স, ব্রিটেন, আমেরিকার মতো অনেক আধুনিক রাষ্ট্রই এই সময় ধীরে ধীরে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের টিকে থাকার ক্ষমতা নির্ভর করে অনেকটাই তার শ্রেণি-নিরপেক্ষ ভাবমূর্তির বিশ্বাসযোগ্যতার উপর। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মানুষ যদি রাষ্ট্রের নিরপেক্ষতার উপর আস্থা হারায়, তা হলে গণ-অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা দেখা দেয়। সেই বিপদ থেকে কিছুটা হলেও রাষ্ট্র উদ্ধার পায় বর্ণবিদ্বেষের হাত ধরে।

উনিশ শতকে মহামারির কালে এই বর্ণবিদ্বেষ মোটেই কঠিন ছিল না। ঔপনিবেশিক যুগে ইউরোপীয়রা এমনিতেই নিজেদের অন্যদের থেকে উন্নত মনে করতেন। তার উপর আবার কলেরা যে বঙ্গভূমি থেকে আমদানি হয়েছে এটাও তত দিনে চিকিৎসক, রাজনীতিবিদ এবং সাংবাদিকদের মিলিত প্রয়াসে বহুল প্রচার লাভ করে ফেলেছে। তাই মহামারির কালে বর্ণবিদ্বেষ সহজেই হয়ে ওঠে সমাজ জীবনের অঙ্গ। এমনকি তৎকালীন ব্যঙ্গচিত্রে কলেরা বা মহামারিকে প্রায়শই চিত্রিত করা হত ধুতি আর পাগড়ি-পরা মূর্তিতে। দিল্লির বাসস্ট্যান্ডে ঘরে ফিরতে-চাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের ভিড় দেখে আজকের মধ্যবিত্তদের আঁতকে ওঠা সেই ঐতিহ্যেরই অঙ্গ।

তবে আমেরিকাতে এই বর্ণবিদ্বেষের চেহারা ছিল একটু আলাদা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাতে যে হেতু উনিশ শতকে তেমন বেশি ভারতীয় দেখা যেত না, এবং যে হেতু সেখানে মহামারির আবির্ভাব ঘটেছিল মূলত দরিদ্র আইরিশ অভিবাসীদের জাহাজে চেপে, তাই সেখানে গণ-আক্রোশের মুখে পড়তে হয় এই সব আইরিশদেরই। সেই মর্মান্তিক স্মৃতি আজও বহন করছে ‘কানাডা গ্রস আইল’ নামক দ্বীপ। এই দ্বীপে আয়ারল্যান্ড থেকে আসা হাজার হাজার গরিব অভিবাসীকে সঙ্গরোধ করে রাখা হত। যাঁরা মহামারিতে আক্রান্ত তাঁরা তো মরতেনই, উপরন্তু সুস্থ ব্যক্তিরাও অনাহারে বা সংক্রমিত রোগের জেরে মৃত্যুমুখে পতিত হতেন। আজও অনেক আইরিশ এই দ্বীপটিকে তীর্থস্থান মনে করেন।

এই বর্ণবিদ্বেষের ছায়াতেই আধুনিক রাষ্ট্রের নির্মমতা কিছুটা চাপা পড়ে যায়। গতর-খাটানো গরিব মানুষও সংখ্যালঘু বা বিদেশিদের ঘাড়ে পরিস্থিতির দায় চাপিয়ে, রাষ্ট্রকে রক্ষাকর্তা মনে করতে শেখে। যে রাষ্ট্র তার জীবিকা ও স্বাস্থ্যের দায়িত্ব এড়িয়ে চলে, সেই রাষ্ট্রের ধ্বজা হাতেই সে ভিনদেশীদের ঠেঙাতে উদ্যত হয়। তাই দরিদ্র ইংরেজ শ্রমিক সে দিন ভারতীয় বা ইহুদি ঠেঙিয়েই খুশি ছিল। আর দরিদ্র মার্কিন মানুষেরা শান্তি খুঁজেছিল আইরিশদের প্রহার করে। আর এই সবের মাঝেই মহামারি-আক্রান্ত আধুনিক রাষ্ট্র গণনা করেছিল, কার জীবনের দাম বেশি আর কার জীবন পরিহার্য।

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Lock down Quarantine Epidemic
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy