Advertisement
২০ ডিসেম্বর ২০২৪
Mental Depression

সাফল্যের কারখানায় অবসাদের সাইরেন

শহরের নাম কোটা। না, রাজস্থানের এই শহরে পর্যটকদের কোনও আগ্রহ নেই। এখানে ভিড় করেন ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জয়েন্ট-প্রত্যাশীরা।

প্রেমাংশু চৌধুরী
শেষ আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৫:৫৪
Share: Save:

দিনটা ছিল দীপাবলির পরে প্রথম রবিবার। বিশ্বকাপ ফাইনালের ম্যাচ চলছে। রোহিত শর্মা-বিরাট কোহলিরা চাপের মুখে। কোচবিহারের সুজয় বাড়িতে কয়েক দিনের ছুটি কাটিয়ে কোটা-য় ফিরে এসেছে। দাদা ছাড়তে এসেছিল। ফিরে যাচ্ছে। দ্বাদশ শ্রেণির সুজয় আবার হস্টেলে একা। উত্তরবঙ্গের কোচবিহার থেকে সুদূর রাজস্থানের কোটা শহরে। লক্ষ্য একটাই। কোনও নামকরা সরকারি মেডিক্যাল কলেজে সুযোগ পাওয়া।

ক্রিকেট ম্যাচ দেখছ না? প্রশ্ন করায় ম্লান হেসে সুজয় বলেছিল, “মাঝে মাঝে ল্যাপটপে স্কোর দেখছি। পরে হাইলাইটস দেখে নেব। গোটা ম্যাচ বসে দেখার সময় নেই। পড়াশোনার খুব চাপ। বুঝতেই পারছেন, বাবা-মা এত লক্ষ টাকা খরচ করে কোটায় পড়তে পাঠিয়েছে। নিট-এ ভাল র‌্যাঙ্ক করতে না পারলে ভাল মেডিক্যাল কলেজে সুযোগ মিলবে না। খুব চাপ।”

নাম ও ছবি প্রকাশ করা যাবে না— এই শর্তে ‘সুজয়’ কথা বলতে রাজি হয়েছিল। নামটা তাই বদলে দিতে হল। নাম বদল হলেও অবশ্য গল্পটা বদলায় না। রাজস্থানের তৃতীয় বৃহত্তম শহর কোটা এই একটাই গল্প বলে। এই একই চাপ। সুজয়দের জীবন এখানে শহরের কোল ঘেঁষে থাকা চম্বল নদীর ঢেউয়ের মতো ধীরেসুস্থে বয়ে যায় না। ট্রেডমিলে ছোটে। যেখানে বিশ্রামের উপায় নেই। হয় নেমে যাও, না হলে ছুটতে থাকো। সুজয়রা এখানে মাস ফুরোলে সহপাঠীদের আত্মহত্যার সংখ্যা গোনে। আগের বছরের থেকে আত্মহত্যা বেশি হল কি না, তার হিসাব কষে। আবার নতুন আত্মহত্যার খবরের অপেক্ষায় প্রেশার কুকারের মতো দম বন্ধ হয়ে বসে থাকে।

রাজস্থানে বেড়াতে যাওয়া পর্যটকদের তালিকায় কোটা জায়গা পায় না। কিন্তু গোটা দেশে যে সব বাবা-মা তাঁদের ছেলে বা মেয়েকে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার করার স্বপ্ন দেখেন, তাঁরা এ শহরের নাম এক কথায় চেনেন। শহর না বলে কারখানাও বলা যায়। ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পড়ুয়া তৈরির কারখানা। কোটা-য় এক সময় রেয়ন, টায়ার, রাসায়নিক শিল্প ছিল। এখন কোটা-র সব থেকে বড় শিল্প একটাই। কোচিং সেন্টার। ডাক্তারি পড়ার প্রবেশিকা পরীক্ষা নিট এবং ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার প্রবেশিকা পরীক্ষা জেইই-র জন্য প্রস্তুতিতে প্রশিক্ষণের মক্কা।

গোটা দেশের পড়ুয়ারা দল বেঁধে কোটা-র বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে পড়তে আসে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে গুজরাত, উত্তরপ্রদেশ থেকে বিহার, অসম থেকে মধ্যপ্রদেশ, অরুণাচল থেকে ঝাড়খণ্ড, মহারাষ্ট্র থেকে হরিয়ানা, উত্তরাখণ্ড থেকে দক্ষিণ ভারত—কোনও রাজ্য বাকি নেই। প্রায় শ’খানেক কোচিং সেন্টার রয়েছে কোটা-য়। অ্যালেন, বনসল ক্লাসেস, রেজ়োন্যান্স, মোশন, আকাশ, কেরিয়ার পয়েন্ট—নানা রকম নাম। কোটা জংশন স্টেশনে নামলেই শুধু কোচিং সেন্টারের বিজ্ঞাপন। স্কুলপড়ুয়া ছেলে বা মেয়ে-সহ পরিবার দেখলেই অটোওয়ালা জিজ্ঞেস করবে, “অ্যালেন? বনসল? না কি মোশন?”

মাধ্যমিক বা দশম শ্রেণির পরেই ভর্তি শুরু হয়। আলাদা করে স্কুলে ভর্তির দরকার নেই। কোচিং সেন্টার থেকেই স্থানীয় স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়। নিয়মের খাতিরে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার জন্য। তবে সেই সব স্কুলের বাস্তবে কোনও অস্তিত্ব নেই। সবটাই কাগজে-কলমে। কোটা-র পড়ুয়াদের ভাষায় ‘ডামি স্কুল’। পড়াশোনা হয় আসলে কোচিং সেন্টারেই। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত। সাত থেকে আট ঘণ্টা ধরে। তার পরে হস্টেলে ফিরে আরও সাত-আট ঘণ্টা।

কত ছাত্রছাত্রী পড়তে আসে কোটা-য়? কোচিং সেন্টারের কর্তারা বলছেন, বছরের যে কোনও সময় দুই থেকে আড়াই লক্ষ ছাত্রছাত্রী কোটা-র এই সব কোচিং সেন্টারে পড়াশোনা করে। অন্তত ৪ হাজার হস্টেল রয়েছে কোটা শহরে। রয়েছে ৪০ হাজার পেয়িং গেস্ট বা পিজি-তে থাকার ব্যবস্থা। কোটা-র ভাষায় ‘রেসিডেন্সি’। কোনও হস্টেলে ২৫ থেকে ৩০ জন, কোথাও ১০০ জনের থাকার বন্দোবস্ত। এক কামরার ঘর। খাট, আলমারি, বইয়ের আলমারি, পড়ার টেবিল-চেয়ার, এসি বা কুলার। হস্টেলেই খাওয়াদাওয়ার বন্দোবস্ত। এই কোচিং সেন্টারগুলিকে কেন্দ্র করেই পুরনো কোটার পাশে গড়ে উঠেছে নতুন কোটা। তার এক দিকে কোচিং সেন্টারের অট্টালিকা। অন্য দিকে রাজীব গান্ধী নগর, মহাবীর নগর, জওহর নগর, বিজ্ঞান নগর, তালওয়ান্ডী, ল্যান্ডমার্ক সিটি, কোরাল পার্ক—নতুন নতুন জনবসতি। সেখানে প্রতিটি রাস্তায়, অলিগলিতে শুধুই হস্টেল, পিজি, লাইব্রেরি। সব মিলিয়ে অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকার অর্থনীতি। ছাপার ভুল নয়। ১০ হাজার কোটি টাকাই।

কত খরচ হয় কোটা-র কোচিং সেন্টারে পড়তে? কোচিং সেন্টারের সুনাম অনুযায়ী বছরে সওয়া এক লক্ষ থেকে দেড় লক্ষ টাকা ফি দিতে হয়। তার সঙ্গে হস্টেলের খরচ মাসে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা। পিজি-তে থাকলে একটু কম। একাদশ, দ্বাদশ শ্রেণির দু’বছর নিট বা জেইই-র জন্য প্রস্তুতি নিতে খরচ অন্তত ৫ থেকে ৬ লক্ষ টাকা। তার সঙ্গে ছুটিছাটায় বাড়ি আসা-যাওয়া, বাবা-মায়ের দেখতে আসার খরচ। অনেক পড়ুয়ার মা বা অবসর নেওয়া দাদু-ঠাকুমারা পড়ুয়াদের সঙ্গে ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকেন। স্বচ্ছল, ব্যবসায়ী পরিবার হলে বাবা-মা দু’জনেই সন্তানের সঙ্গে দু’তিন বছর কোটা-য় থেকে যান। অনেকেই প্রথম বার ভাল র‌্যাঙ্ক করতে পারে না। তাই উচ্চ মাধ্যমিকের পরের বছরও নিট, জেইই-র পরীক্ষায় বসে। দু’বছরের জায়গায় তিন বছরের কোচিং। পাল্লা দিয়ে খরচও বাড়ে।

এখান থেকেই তৈরি হয় চাপ। দিনে ১৫-১৬ ঘণ্টা ধরে পড়াশোনার চাপ। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়নোর চাপ। বাবা-মায়ের প্রত্যাশার চাপ।

ডাক্তারি পড়তে হলে নিট, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে হলে জেইই-মেন ও জেইই-অ্যাডভান্সড’এ ভাল র‌্যাঙ্ক করার চাপ। কোচিং সেন্টারে অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতার চাপ। বাবা-মা’কে কোচিং সেন্টারে এত টাকা ফি, হস্টেলের খরচ গুনতে হচ্ছে বলে অপরাধবোধের চাপ। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করেও ভাল র‌্যাঙ্ক করতে না পারার আশঙ্কা থেকে চাপ তৈরি হয়। ভাল র‌্যাঙ্ক করতে না পারলে আবার মোটা টাকা ডোনেশন দিয়ে বেসরকারি মেডিক্যাল বা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হতে হবে। ওই সব কলেজে পড়লে ক্যাম্পাস ইন্টারভিউতে চাকরি মিলবে কি না, তার নিশ্চয়তা নেই। সেই ভাবনাও চাপ বাড়ায়। তার সঙ্গে থাকে মাধ্যমিকের পরেই ষোলো-সতেরো বছর বয়সে বাড়ি থেকে প্রথম বার দূরে থাকার জন্য মন খারাপ। অবসাদ মনের দোরগোড়ায় কড়া নাড়তে থাকে।

আর তার পরিণতি? ২০২৩ সালে এখনও পর্যন্ত ২৯ জন কোটা-র পড়ুয়া আত্মহত্যা করেছে। ২০২২-এ সংখ্যাটা ছিল ১৫। ২০২০, ২০২১-এ কোভিডের জন্য বেশির ভাগ সময়টাই অনলাইন ক্লাস হয়েছে। তার আগে ২০১৯-এও কোটা-র ১৮ জন পড়ুয়া আত্মহত্যা করেছে। ২০১৮-য় ২০ জন এই পথ বেছে নিয়েছিল। এখনও পর্যন্ত ওই বছরেই কোটা-য় সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছিল। ২০২৩ তাকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। কোটা হয়ে উঠেছে ‘সুইসাইড সিটি’।

চিন্তা বেড়েছে সব মহলে। পড়ুয়াদের ঘিরে কোটা ১০ হাজার কোটি টাকার অর্থনীতি। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে অন্তত দুই লক্ষ মানুষের রুটিরুজি তার উপরে নির্ভরশীল। সেই কোটা-র গায়ে ‘সুইসাইড সিটি’-র তকমা লেগে গেলে গোটা অর্থনীতিই ভেঙে পড়তে পারে। রাজস্থান সরকার উঠেপড়ে লেগেছে। খোদ মুখ্যমন্ত্রী হস্তক্ষেপ করেছেন। কোচিং সেন্টারে রাশ পরানোর আইন, উচ্চ পর্যায়ের কমিটি, কোটা পুলিশ স্টুডেন্ট সেল, হেল্পলাইন— সব চেষ্টা করা হচ্ছে। কোচিং সেন্টারগুলোকে বলা হয়েছে, পড়ুয়াদের চাপ দেওয়া চলবে না। রবিবার পরীক্ষা নেওয়া বন্ধ করে, পুরো ছুটি দিতে বলা হয়েছে। বসানো হয়েছে মনোবিদ। কোটা জেলা প্রশাসন কোচিং সেন্টারের প্রধান, হস্টেল মালিকদের নিয়ে বৈঠক করছে। হস্টেল কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। কে রাতের খাবার খেতে ক্যান্টিনে এল না? কার মুখ থমথমে? কে ঘরে বন্দি থাকছে? কে ক্লাসে যাচ্ছে না? নজর রাখো। মা-বাবাকে ফোন করো। চলে আসতে বলো। দরকার হলে ছেলে বা মেয়েকে কিছু দিনের জন্য বাড়িতে নিয়ে যেতে বলো। হস্টেলের সিলিং ফ্যানে বসছে ‘অ্যান্টি সুইসাইড ডিভাইস’। স্প্রিং থেকে ফ্যান ঝুলছে। কেউ ফ্যানে ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়ার চেষ্টা করে ফ্যান মেঝের দিকে নেমে আসবে। ব্যালকনিতে গ্রিল লাগানো হচ্ছে। ছাদের দরজায় তালা ঝুলছে। কোনও ভাবেই আত্মহত্যা রোখা যাচ্ছে না।

কোটা-য় এসে অনেক কষ্টে এক নামকরা কোচিং সেন্টারের উচ্চপদস্থ কর্তার সাক্ষাৎ মিলল। ‘নাম লেখা যাবে না’, ‘অন-রেকর্ড কিছু বলব না’ এই শর্তে কথা বলতে রাজি হলেন। তিনি বলছিলেন, বেশি আত্মহত্যার ঘটনা দেখা যাচ্ছে মেডিক্যাল পড়তে চাওয়া নিট পরীক্ষার্থীদের মধ্যে। কারণ দেশে মেডিক্যাল কলেজে ১ লক্ষের মতো আসন। তার মধ্যে ৫০ হাজার মতো সরকারি কলেজে। এই সরকারি এবং নামকরা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়ার হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। কারণ বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে পড়ার খরচ সরকারি কলেজের তুলনায় দশ গুণ বেশি। আর ইঞ্জিনিয়ারিং? ওই কর্তার বক্তব্য, সেখানে চাপটা অন্য জায়গায়। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে এখন দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ১২ লক্ষের বেশি আসন। তার মধ্যে প্রতি বছর মেকানিক্যাল, সিভিল, ইলেকট্রিক্যাল, কেমিক্যালের মতো কোর্সে ৪ লক্ষের বেশি আসন ফাঁকা পড়ে থাকে। প্রতিযোগিতাটা আসলে জেইই-অ্যাডভান্সড পরীক্ষায় উতরে আইআইটি-তে সুযোগ পাওয়ার। ২৩টি আইআইটি-তে ১৭ হাজারের মতো আসন। আইআইটি-তে সুযোগ না পেলে এনআইটি, ট্রিপলআইটি প্রতিষ্ঠান। দুই মিলিয়ে ৩১ থেকে ৩২ হাজারের মতো আসন। তাতেও না পেলে রাজ্যের নামজাদা সরকারি, বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে কম্পিউটার সায়েন্সে সুযোগ পাওয়ার লড়াই। কারণ ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে সবাই ক্যাম্পাস প্লেসমেন্টে চাকরি পাচ্ছে না। গত বছরের হিসাব বলছে, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোতে বছরে ৮-৯ লক্ষ পড়ুয়া ভর্তি হলেও শেষ বছরে গিয়ে মাত্র সওয়া চার লক্ষ পড়ুয়া ক্যাম্পাস ইন্টারভিউতে চাকরি পাচ্ছে।

অতএব ইঁদুরদৌড়। মহারাষ্ট্রের নাসিকের মেয়ে মিথিলা কোটার বিখ্যাত কোচিং সেন্টারের ‘ড্রপার’ ব্যাচের ছাত্রী। গত বছর উচ্চ মাধ্যমিকের সঙ্গে নিট-এ বসেও সুযোগ মেলেনি। এ বছর কোনও কলেজে ভর্তি না হয়ে ‘ড্রপ’ দিয়েছে। শুধুই নিট-এর জন্য পড়াশোনা করছে। বাবা সরকারি চাকুরে। মিথিলা বলছিল, “ঠাকুর্দার ইচ্ছে ছিল নাতনি ডাক্তার হবে। স্কুলে ফার্স্ট হতাম। সবাই ভাল বলত। কোটায় ভর্তি করে দিল। এখানে এসে দেখলাম, আমার মতো বা আমার থেকেও ভাল বহু বহু ছাত্রছাত্রী রয়েছে।” কোচিং সেন্টার কি খুব চাপ তৈরি করে? মিথিলা জবাব দেয়, “ওরা সবচেয়ে মেধাবীদের ছেঁকে নিয়ে ‘স্টার’ নামে আলাদা ব্যাচ তৈরি করে। তাদের দিকে বাড়তি নজর থাকে। কারণ ওরাই র‌্যাঙ্ক করবে। বিজ্ঞাপনে ওদের ছবি বেরোবে। বাকিদের প্রতি মাসে কোচিং সেন্টারের পরীক্ষা অনুযায়ী লিডার, অ্যাচিভার, পারফর্মার, নানা রকম ব্যাচ করা হয়। ওখানেই বোঝা যায় কে এগিয়ে, কে পিছিয়ে। সপ্তাহের সোম থেকে শনি সাত-আট ঘণ্টা ক্লাস। প্রতি সপ্তাহে ইন্টারনাল টেস্ট। মাসের শেষ রবিবার মক টেস্ট। তাতে কোচিং সেন্টারে কে কোনর‌্যাঙ্কে রয়েছে, তা বোঝা যায়। বাবা-মায়ের কাছেও এই র‌্যাঙ্ক পৌঁছে যায়। এখানে যে রকম প্রতিযোগিতা, দু’নম্বর কম পেলেই র‌্যাঙ্ক পিছিয়ে যায়। বাড়ি থেকে চাপ আসতে শুরু করে। মা-বাবাকে দোষ দিই কী করে? এতগুলো টাকা খরচ করছে আমার পিছনে!” মিথিলা কোচিং সেন্টারগুলোকেও দোষ দিতে নারাজ। তার উত্তর, “ওরা চাপ দিয়ে পড়িয়ে আমাকে তৈরি করবে বলেই তো এখানে ভর্তি হয়েছি। এখন ‘এত চাপ দেওয়া হচ্ছে কেন’ বলে কী লাভ!”

রাজীব গান্ধী নগরের এক ‘প্রিমিয়াম এসি গার্লস হস্টেল’-এর সামনে দেখা মিলল দুর্গাপুরের বিপুল চট্টোপাধ্যায়ের। বেসরকারি সংস্থার অ্যাকাউন্ট্যান্ট। মেয়ে সামনের বার জেইই-মেন পরীক্ষায় বসছে। অফিসে ছুটি নিয়ে মেয়েকে দেখতে এসেছিলেন। বাড়ি ফেরার আগে মুখে দুশ্চিন্তা। “জানি এখানে কোচিং সেন্টারে পড়াশোনার খুব চাপ। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লে কিছু একটা চাকরি পাবে। এমনি কলেজে অনার্স নিয়ে পাশ করলে তো চাকরি পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। সরকারি চাকরির সুযোগও দিন দিন কমছে।”

আর মেয়ের দেখাশোনা?

“ওর মা সকাল-বিকেল ফোন করে খোঁজ নেয়। মেয়ে ফোন না ধরলেই হস্টেলের ওয়ার্ডেনকে ফোন করি। চার পাশে যে সব ঘটনা ঘটছে! বড্ড চিন্তা হয়।”

নভেম্বরে এক রাতে উত্তরপ্রদেশের নিশা যাদবকে তার বাবা এমনই ফোন করে রোজকার মতো খোঁজ নিয়েছিলেন। নিশা ফোন ধরে কথাবার্তাও বলেছিল। তার পরে রাতে কেমন সন্দেহ হওয়ায় তার বাবা যখন দ্বিতীয় বার ফোন করেন, মেয়ে আর ফোন ধরেনি। ওয়ার্ডেনকে ফোন করা হয়। তত ক্ষণে নিশার দেহ গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলছে। কোটা-য় চলতি বছরের ২৯তম আত্মহত্যা। মাত্র সাত দিন আগেই বাবা মেয়েকে দেখে গিয়েছিলেন। মেয়ে জওহর নগরের হস্টেল বদলে মহাবীর নগরের হস্টেলে উঠেছিল। বাবা কিছুই বুঝতে পারেননি, মেয়ের মনের মধ্যে কী চলছে! নিশার মৃত্যুর ঠিক দু’দিন আগেই কোটা-র ওয়াকফ নগরে উদ্ধার হয়েছিল বীরভূমের নলহাটির ফরিদ হুসেনের ঝুলন্ত দেহ। পরিবারের জমির একটা অংশ বিক্রি করে সেই টাকায় কোটা-র কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়েছিল ফরিদ। ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। দিন দশেক ধরে মাকে ফোনে বলছিল, ভাল লাগছে না।ফেরার ট্রেনের টিকিট কাটারও চেষ্টা করছিল। বাড়ি ফেরার টিকিট না পেয়ে ফরিদ না-ফেরার দেশের ট্রেন ধরে ফেলল।

কোটা-র তালওয়ান্ডীতে রাধাকৃষ্ণ মন্দির। মন্দিরের ভিতরের দেওয়ালে শুধু পড়ুয়াদের প্রার্থনা লেখা। ইংরেজি, হিন্দি, নানা ভাষায়। অনেক দরগা, মাজার বা মন্দিরে যেমন মানুষ কিছু প্রার্থনা করে সুতো বেঁধে আসে, ঠিক তেমন। কেউ লিখেছে, ‘ঠাকুর, কানপুরের আইআইটিতে পাইয়ে দাও, প্লিজ’। কেউ কোনও মতে নিট-এ পাশ করার প্রার্থনা করে গিয়েছে। কেউ ব্যর্থতার অপরাধবোধ থেকে লিখে গিয়েছে, ‘মাম্মি, পাপা, স্যরি, মুঝে মাফ কর দেনা।’ কেউ লিখেছে, ‘ঠাকুর, বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণ করে দাও।’ কেউ শুধুই ঈশ্বরের কাছে পড়াশোনায় মন বসার প্রার্থনা রেখে গিয়েছে।

মন্দিরের পুরোহিত ত্রিলোক শর্মা গল্প শোনান, অনেক বছর আগে কেউ এখানে দেওয়ালে প্রার্থনা লিখে গিয়ে নিট-এ প্রথম হয়েছিল। তার পর থেকে সকলের বিশ্বাস জন্মে গিয়েছে। রোজ তিন-চারশো পড়ুয়া আসে। অভিভাবকরাও ভিড় করেন। মন্দিরের দেওয়ালে প্রার্থনা লিখে যান। দু’তিন মাস পর পর দেওয়ালগুলো ভরে গেলে চুনকাম করাতে হয়।

উত্তরপ্রদেশের রামপুরের মনজ্যোত সিংহ মন্দিরের দেওয়ালে নয়, নিজের হস্টেলের ঘরের দেওয়ালে স্টিকি নোটসের তিনটি হলুদ কাগজ সেঁটে রেখে শেষ কথা লিখে গিয়েছিল। একটিতে ‘স্যরি’। দ্বিতীয়টিতে ‘হ্যাপি বার্থডে পাপা।’ তৃতীয়টিতে—‘আমি যা করছি, নিজের ইচ্ছায় করছি। প্লিজ় আমার বন্ধুদের বা মা-বাবাকে বিরক্ত করবেন না।’ অগস্ট মাসের এই আত্মহত্যা কোটা-কে নাড়িয়ে দিয়েছিল। কারণ উচ্চ মাধ্যমিকে ৯৩ শতাংশ নম্বর পাওয়া মনজ্যোত আত্মহত্যার খবর শুনলে হাসতে হাসতে সহপাঠীদের বলত, ‘আমি এর পরে লাইনে আছি’। সে যে হাসতে হাসতে মনের কথাই বলছে, কেউবুঝতে পারেনি।

অগস্ট মাসের এই আত্মহত্যার ঘটনার পরেই কোটা পুলিশের স্টুডেন্টস সেল তৈরি হয়। চালু হয় হেল্পলাইন। স্টুডেন্টস সেলের প্রধান, জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার চন্দ্রশীল ঠাকুর বলছিলেন, আত্মহত্যার ‘টাইমফ্রেম’-টা বদলে গিয়েছে। আগে পরীক্ষার আগে আতঙ্কে বা ফলপ্রকাশের পরে আশানুরূপ র‌্যাঙ্ক না হলে কোটায় আত্মহত্যার ঘটনা ঘটত। কোভিডের আগে পর্যন্ত এমনটাই দেখা যেত। যেমন, ২০১৭-র এপ্রিলে কলকাতার অরিজিৎ প্রামাণিকের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয়েছিল মহাবীর নগরের একটি হস্টেলে। জেইই-মেন পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে ভেঙে পড়েছিল অরিজিৎ। বাবা-মা ছেলের সঙ্গে দেখা করতে রওনা হয়েছিলেন। এসে পৌঁছনোর আগেই সব শেষ। এখন জুন-জুলাই-অগস্টেও আত্মহত্যা ঘটছে। দেখা যাচ্ছে, কোটায় কোচিং সেন্টারে ভর্তির দু’মাসের মধ্যেও অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। কোভিডের পরে এই প্রবণতা বেড়েছে।

কারণ? কোটার একটি কোচিং সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত মনোবিদ বলছেন, কোভিডের সময় সবাই ঘরবন্দি ছিল। অনলাইন পড়াশোনা করেছে। সে সময় পড়াশোনাও ঠিকমতো হয়নি। তার পরে আচমকা কোটায় এসে প্রবল পড়াশোনার চাপে অনেকেই হাবুডুবু খাচ্ছে। এমনিতেই সিবিএসই, আইএসসি বা রাজ্যের উচ্চ মাধ্যমিক বোর্ডের সঙ্গে জেইই-অ্যাডভান্সড বা নিট পরীক্ষার বিস্তর ফারাক। দুটো পুরোপুরি আলাদা চ্যালেঞ্জ। আগে সব কোচিং সেন্টারে একটা ছাঁকনি পরীক্ষা হত। দেখা হত, কারা সেই চ্যালেঞ্জ নিতে তৈরি। এখন যে আসছে, ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। অনেকে দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণির শহর থেকে কোটায় আসছে। সেখানকার স্কুলে ছেলে বা মেয়ে ফার্স্ট হলেই বাবা-মা ধরে নিচ্ছেন, তাঁদের সন্তান ডাক্তার হতে পারে। পড়ুয়াটি কোটা-য় এসে টের পাচ্ছে, এখানেই তাঁদের থেকে হাজার হাজার মেধাবী ছাত্রছাত্রী। কিন্তু তখন আর ফেরার পথ নেই। কারণ কোচিং সেন্টারগুলো গোড়াতেই পুরো ফি নিয়ে নেয়। তার উপরে বাবা-মায়ের ইচ্ছেপূরণের দাবি। কোচিং সেন্টারের পরীক্ষায় খারাপ নম্বর পেলে মা-বাবা আরও খাটতে বলছেন। কত টাকা খরচ হচ্ছে, রোজ মনে করিয়ে দিচ্ছেন। খারাপ র‌্যাঙ্ক করলে আরও লক্ষ লক্ষ টাকা ডোনেশন দিয়ে বেসরকারি কলেজে ভর্তি করাতে পারবেন না— এ কথা বলে শাসাচ্ছেন। সন্তানের আদৌ ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার মতো মেধা রয়েছে কি না, তা ভাবছেন না।

কার কাছে এই দুঃখের কথা বলে সুজয়, রোহিত, মিথিলারা? বন্ধুবান্ধব? কোটায় কেউ কারও বন্ধু নয়।

জওহর নগরের মোড়ে ছোট্ট রেস্তরাঁর বোর্ডে লেখা, ‘মা কে হাত জ্যায়সা খানা’! রবিবার বিকেলে এক দল পড়ুয়া হস্টেলের খাবার ছেড়ে মুখের স্বাদ বদলাতে এসেছে। কেউ কারও সঙ্গে বিশেষ কথা বলছে না। মনে পড়ল সুজয়ের কথা। সুজয় বলছিল, “এখানে কেউ কারও বন্ধু হয় না। সবাই সবার প্রতিযোগী। বাড়ি থেকে বলে দেয়, কারও সঙ্গে বেশি মেলামেশা করবি না। আড্ডা মারবি না। ফোকাস নড়ে যাবে।” রেস্তরাঁয় আলু পরোটা খাচ্ছিল আসানসোলের ছেলে রোহিত। চোখে মোটা কাচের চশমা। নামটা বদলে দিতে হল সতেরো বছরের পড়ুয়ার অনুরোধে। তবে একাকিত্বটা অস্বীকার করল না রোহিত, “এখানে দু’-এক জন বাদ দিলে কারও সঙ্গে বন্ধু হয় না। সবাই পড়াশোনায় ব্যস্ত। একে অন্যের প্রতিযোগী। স্কুলের মতো নয় যে, এক জন আর এক জনকে নোটস দিয়ে সাহায্য করবে। তাই মন খারাপ করলেও কথা বলার কেউ নেই।”

সমস্যাটা উড়িয়ে দিচ্ছেন না কোটা হস্টেল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নবীন মিত্তল। অগস্ট থেকে পড়ুয়াদের মন ভোলাতে তাঁরা প্রতি রবিবার হস্টেলপাড়ায় কোনও না কোনও অনুষ্ঠানের আয়োজন করছেন। গানের ব্যান্ড আসছে। গানবাজনার প্রতিযোগিতা, স্ট্যান্ড-আপ কমেডি, গেট-টুগেদার, সব মিলিয়ে ছুটির দিন ‘সানডে’-কে ‘ফান ডে’ করে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। হস্টেলে সিসিটিভি বসানো হয়েছে। রাতে খাওয়ার সময় সবার হাজিরা নেওয়া হচ্ছে। কেউ খেতে না নামলে ঘরে গিয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। কাউন্সেলিংয়ের বন্দোবস্ত করা হচ্ছে। মিত্তলের বক্তব্য, এই আত্মহত্যার ঘটনার জন্য শুধু কোটাকে দোষ দেওয়া যায় না। গোটা দেশেই এমন ঘটনা ঘটছে। আসল সমস্যা হল যোগ্য প্রার্থীর তুলনায় মেডিক্যাল কলেজ, আইআইটি-তে সীমিত আসন। ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোট সে তরী!

তিন-চার দশক আগে কোটা শহরে একটি-দু’টি করে কোচিং সেন্টার ডানা মেলতে শুরু করেছিল। কোটা-র এল এন মাহেশ্বরীর ছেলে রাজেশ মাহেশ্বরী বাড়িতে কয়েক জন ছাত্রকে পড়াতেন। তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্রদের অঙ্ক করিয়ে বিক্রমকুমার বনসল সুনাম কুড়োন। পড়ুয়াদের ভিড় বাড়ে। এক জায়গায় ফিজ়িক্স, অন্য জায়গায় কেমিস্ট্রি পড়তে গিয়ে পড়ুয়াদের সময় নষ্ট হচ্ছে বুঝে রাজেশ কোচিং সেন্টার শুরু করেন। প্রথমে বাবার নামে সংস্থার নাম ‘এল এন’ নাম রাখা হয়েছিল। পরে তা বদলে হয় অ্যালেন। এখন কোটা-র দুই লক্ষ পড়ুয়া পড়াশোনা করলে তার মধ্যে সওয়া এক লক্ষই অ্যালেন-এর ছাত্রছাত্রী। শুধু কোটাতেই অ্যালেন-এর ২৩টি ক্যাম্পাস। একই ভাবে বিক্রম বনসল তৈরি করেন বনসল ক্লাসেস। সাফল্য আসতে শুরু করে। কোটা-র পড়ুয়ারা সর্বভারতীয় পরীক্ষায় প্রথম সারিতে জায়গা পেতে থাকে। গোটা দেশের নজর ঘুরে যায় রাজস্থানের এই শহরের দিকে। পড়ুয়ারা ভিড় করতে শুরু করে। কোটার শিক্ষক-শিক্ষিকারা একের পর এক কোচিং সেন্টার খুলতে শুরু করেন। এখন কোটা-র বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অন্তত চারশো জন আইআইটি-র প্রাক্তনী, প্রায় একশো জন এমবিবিএস ডিগ্রিধারী শিক্ষক-শিক্ষিকা পড়াচ্ছেন। এক সময় কোটা-তে পড়েই তাঁরা মেডিক্যাল কলেজ, আইআইটি-তে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। আবার কোটাতেই ফিরে এসেছেন তাঁরা। কেউ নিজেই নতুন কোচিং সেন্টার খুলে ফেলেছেন। কোটা তাঁদের ছেড়ে দিলেও তাঁরা কোটা ছাড়তে পারেননি।

এমনই এক নতুন কোচিং সংস্থার প্রতিষ্ঠাতার দেখা মিলল কোটা ছেড়ে আসার আগে। তিনি বলছিলেন, যে শিক্ষার্থী পশ্চিমবঙ্গ বা বিহারের মফস্সলের পড়াশোনা করছিল, সে মেধাবী হলেও ওখানে বসে আইআইটি, মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সুযোগ পেত না। কারণ সেখানে তাকে ঠিকমতো ‘গাইড’ করার কেউ নেই। কোটা এই মেধা ও সুযোগের সেতুবন্ধন করছে। তাকে সেই মফস্সলের স্কুল থেকে আইআইটি বা মেডিক্যাল কলেজ পর্যন্ত পৌঁছে দিচ্ছেন কোটার শিক্ষক-শিক্ষিকারা। কোটাকে তাই ‘সুইসাইড সিটি’ বলে ভাবলে ভুল করবেন। কোটা ইচ্ছেপূরণের শহর। মেধা ও অধ্যবসায়ের ডানায় ভর করে জীবনে ওড়ার রানওয়ে। কোটা কারখানা নয়। স্বপ্ন সত্যি হওয়ার ঠিকানা।

অন্য বিষয়গুলি:

Student Death Kota
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy