Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

কবিতা লেখেন আম্রপালী

নগরনটী। পরে ভিক্ষুণী। তাঁর কবিতাতেই নারীর নিজস্ব স্বর। অশ্বঘোষ এই শহর এখনও তাঁকে বাঁকা চোখে দেখে! কেউ খেয়াল রাখে না, নিজের শখে রূপোপজীবিনী তিনি হননি। গোটাটাই ছিল গণরাজ্যের খেয়ালখুশি।আম্রপালী ভিক্ষায় বেরিয়েছিলেন। মুণ্ডিত মস্তক, পরণে কাষায় বস্ত্র। ঠোঁটে বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি মন্ত্র। এক বাড়ি থেকে ভিক্ষা নিয়ে বেরিয়ে আসছিলেন, কানে এল অন্য কথা। এক যুবক আর এক জনকে বলছে, ‘দেখে লাভ নেই ভাই।

শেষ আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

এই শহর এখনও তাঁকে বাঁকা চোখে দেখে! কেউ খেয়াল রাখে না, নিজের শখে রূপোপজীবিনী তিনি হননি। গোটাটাই ছিল গণরাজ্যের খেয়ালখুশি।

আম্রপালী ভিক্ষায় বেরিয়েছিলেন। মুণ্ডিত মস্তক, পরণে কাষায় বস্ত্র। ঠোঁটে বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি মন্ত্র। এক বাড়ি থেকে ভিক্ষা নিয়ে বেরিয়ে আসছিলেন, কানে এল অন্য কথা। এক যুবক আর এক জনকে বলছে, ‘দেখে লাভ নেই ভাই। বুড়ি হয়েছে, চুল পেকেছে, চামড়া ঝুলেছে। অথচ এক সময় বৈশালী কাঁপিয়েছে!’ তিনি যে নগরনটী ছিলেন, এই পুরুষেরা ভুলতেই পারে না।

নগরনটী? সে তো পুরুষেরই অবদান। শিশু আম্রপালী তাঁর মা-বাবাকে কখনও দেখেননি। শুনেছেন, এক আমগাছের নীচে পড়ে ছিলেন তিনি। বাগানের মালি তাঁকে ঘরে নিয়ে আসেন, কন্যাস্নেহে লালন পালন করেন। আমগাছের নীচে শুয়েছিলেন বলে নাম হল আম্রপালী। জন্মপরিচয় জানা নেই, বাগানের সেই মালিকেই বাবা বলে জানেন তিনি। কেন, মহাভারতের শকুন্তলাও তো কণ্বমুনিকে নিজের বাবা বলেই জানত।

শকুন্তলার মতো ভাগ্য অবশ্য তাঁর নয়। একাকী কোনও দুষ্মন্ত আসেনি গোপন পাণিপ্রার্থী হয়ে। আম্রপালীর জন্য রোজ ভিড় করত একাধিক রাজপুত্র, মন্ত্রিপুত্র, বণিক।

সকলেই এই সুন্দরীকে স্ত্রী হিসেবে পেতে চায়, কে তাকে দখল করবে তা নিয়ে লেগে গেল বিবাদ। বড়লোকের ছেলেপুলেরা কোনও দিনই নিয়মনীতির তোয়াক্কা করে না, আমবাগানেই লেগে গেল অসিযুদ্ধ। বিবদমান সেই ধনীপুত্রেরা এ বার বিচারকের দ্বারস্থ হল।

গণরাজ্য হিসাবে বৈশালীর খ্যাতি আছে, এখানে সবাই পরস্পরের কথা শুনে সিদ্ধান্ত নেয়। বিচারক রায় দিলেন, ‘মারামারিতে কাজ নেই। ও তা হলে সকলের হোক!’ সে দিন থেকেই তিনি বহুভোগ্যা নগরনটী। আম্রপালী ঠেকে শিখেছেন, গণরাজ্য শুধুই পুরুষের, নারীর কোনও অধিকার নেই।

অধিকার তাঁকে দিয়েছিলেন এক জনই। কুশীনগর যাওয়ার পথে গোতম বুদ্ধ তাঁর ভিক্ষুসঙ্ঘ নিয়ে পৌঁছেছিলেন বৈশালীতে। আগেও বহু বার এসেছেন, এই নগরী তাঁর পরিচিত।

কিন্তু এ বার কোথাও না গিয়ে উঠলেন আম্রপালীর উপবনে। আম্রপালীও সেখানে গেলেন, পর দিন সঙ্ঘকে তাঁর ভবনে আহারের নিমন্ত্রণ করে এলেন।

বাগান থেকে সে দিনের ফেরাটা এখনও মনে আছে তাঁর। তিনি ফিরছেন, পুরুষেরা রথে চেপে বুদ্ধদর্শনে যাচ্ছেন। সুন্দরী নগরনটী এমনি এমনি ফিরে যাবে? হবে না কিছু খেলা? আম্রপালীর রথ ছুটছে, কোনও পুরুষের রথ ইচ্ছা করে বেঁকে তাঁর সামনে, কোনও ঘোড়া আচমকা চাবুক খেয়ে সামনের পা দুটো এমন ভাবে ওপরে তুলে দিল, আম্রপালীর রথ ছিটকে পড়ে যাওয়ার অবস্থা। ছুটন্ত রথে ‘ইভটিজিং’-এর কৌশল এই সব পুরুষের করায়ত্ত।

কিন্তু আম্রপালী আজ দমবেন না। তিনি আর সেই মেয়ে নন, যাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিতে হবে বহুবল্লভা জীবন। আক্রমণ শুরু করতে হবে প্রথমেই।

সামনে যে রথ আসছে, তার অক্ষের সঙ্গে অক্ষ, চক্রের সঙ্গে চক্র স্বেচ্ছাকৃত ভাবে ঘষটে দিচ্ছেন আম্রপালী। একটা সময় চিৎকার উঠল, ‘আম্রপালী, এ রকম করছ কেন?’ গণিকার উত্তর, ‘আগে যেতে দাও। কাল সকালে ভিক্ষুসঙ্ঘকে নিয়ে গোতম আমার বাড়িতে ভাত খেতে আসবেন।’ ফের রথারূঢ় পুরুষদের চিৎকার, ‘আম্রপালী, লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে এই নেমন্তন্ন আমাদের ছেড়ে দাও। আমরা সভাগৃহে ওঁদের আহার করাব।’ ঘোড়া ছোটাতে ছোটাতে আম্রপালী উত্তর দিলেন, ‘সারা বৈশালী নগর আমাকে দিলেও সেটি হবে না।’ গণরাজ্যের পুরুষরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করল, ‘ইস, একটা মেয়ে, তায় গণিকা, তার কাছে হেরে গেলাম।’

এই জয়ের পর দিনই আম্রপালী প্রব্রজ্যা নিয়ে ভিক্ষুণী হন। জয়? পরাজয়? এ সবের বাইরেও তো আছে নারীর নিজস্ব স্বর। ভিক্ষুণী বেশে থাকলেও তাঁর পক্বকেশ, শিথিল স্তন নিয়ে ঠাট্টা করবে বৈশালী নগরী? দর্পণে নিজেকে দেখেও সে দিন শান্তি পাননি তিনি। দুঃখ জানিয়েছিলেন গোতমকেও: ‘একদিন আমার চুল ছিল ভ্রমরের মতো কালো। আজ তা শনের নুড়ি। সত্যবাদী বুদ্ধ বলেন, কোনও তফাৎ নেই।’ কখনও বা ‘এক দিন আমার ঘাড় ছিল সুশ্রী ও মসৃণ। আজ বেঁকেচুরে একসা। সত্যবাদী বুদ্ধ বলেন, কোনও তফাৎ নেই।’

এটাই কুড়িটি স্তবকে লেখা আম্রপালীর কবিতা। কোনও বৌদ্ধ নির্বাণের কথা নেই। কিন্তু নারীর নিজস্ব স্বর জানিয়ে দেয়, আজ যে সৌন্দর্য থাকে, কাল তা থাকে না। তবু হা-হুতাশ করো না। সত্যবাদী বুদ্ধ বলেন, কোনও তফাত নেই। সবই অনিত্য।

এই পালি কবিতা তাই আজও ক্লাসিক!

অন্য বিষয়গুলি:

Amrapali
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE