Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

তানপুরা মিশল বিটলসের সুরে

চার জন ভারতীয় শিল্পী বাজিয়েছিলেন ‘সার্জেন্ট পেপার্স লোনলি হার্টস ক্লাব ব্যান্ড’ অ্যালবামের গানের সঙ্গে। এই জুনেই ৫০ বছর পূর্ণ হল জনপ্রিয় সেই অ্যালবামের। সম্রাট মুখোপাধ্যায় চার জন ভারতীয় শিল্পী বাজিয়েছিলেন ‘সার্জেন্ট পেপার্স লোনলি হার্টস ক্লাব ব্যান্ড’ অ্যালবামের গানের সঙ্গে। এই জুনেই ৫০ বছর পূর্ণ হল জনপ্রিয় সেই অ্যালবামের। সম্রাট মুখোপাধ্যায়

চারমূর্তি: রিংগো স্টার, লেনন, ম্যাককার্টনি, হ্যারিসন।

চারমূর্তি: রিংগো স্টার, লেনন, ম্যাককার্টনি, হ্যারিসন।

শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০১৭ ১২:৩০
Share: Save:

ভোরের আলো ফুটছে সবে। হঠাৎ থরথর কেঁপে উঠল গোটা পাড়া। পশ্চিম লন্ডনের চেলসি-তে অভিজাত মানুষ আর সেলেব্রিটিদের বসবাস। সেখানে এমন উপদ্রব! সমস্ত বাড়ির জানলা খুলে গেল। হচ্ছেটা কী?

জানলা খুলতেই দমকা হাওয়ার মতোই যেন ঘরে ঢুকে পড়লেন চার যুবক। হাতে গিটার, ড্রামস, পিয়ানো। আছে তানপুরা, তবলাও। তাঁরা গাইছেন: ‘...উই আর সার্জেন্ট পেপার্স লোনলি হার্টস ক্লাব ব্যান্ড/ উই হোপ ইউ উইল এনজয় দ্য শো/ উই আর সার্জেন্ট পেপার্স লোনলি হার্টস ক্লাব ব্যান্ড/ সিট ব্যাক অ্যান্ড লেট দ্য ইভনিং গো...।’ পাড়ায় কাদের আগমন ঘটেছে, বুঝতে বাকি রইল না কারও।

১৯৬৭ সাল। মুক্তির অপেক্ষায় বিটলস-এর অষ্টম অ্যালবাম। চেলসিতে মার্কিন গায়ক ক্যাস এলিয়টের ফ্ল্যাটে এক ভোরে হাজির চারমূর্তি। হাতে নতুন অ্যালবামের ডিস্ক। ফ্ল্যাটের খোলা জানলায় বসানো হল বড় বড় স্পিকার। তার পর তুমুল আওয়াজে চালানো হল গান। বিটলস না হয়ে অন্য কেউ এ কাজ করলে সে দিন নির্ঘাত পুলিশ ডাকতেন বাসিন্দারা।

দেশ-বিদেশের কনসার্টে গাইতে গাইতে তখন ক্লান্ত জন লেনন, পল ম্যাককার্টনি, জর্জ হ্যারিসন ও রিংগো স্টার। ‘লাইভ’ অনুষ্ঠানে অরুচি ধরে গিয়েছে। জন লেননের আলটপকা মন্তব্য— ‘বিটলস যিশুর থেকেও বেশি জনপ্রিয়’— কাল হয়েছিল। বিটলস ঈশ্বর-বিরোধী, নিন্দার ঝড় বয়ে গেল। ভ্যাটিকান থেকেও উঠল প্রতিবাদ। আমেরিকায় বিপুল জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও অনুষ্ঠান বয়কট করলেন বহু শ্রোতা। স্টেডিয়াম অর্ধেকও ভরল না।

লেনন-ম্যাককার্টনিরা ঠিক করলেন, অনুষ্ঠানে আর গাইবেন না। ছুটি নেবেন তিন মাস, যেমন ইচ্ছে কাটাবেন— শুধু গানের ধারেকাছে নয়। জর্জ হ্যারিসন এলেন পণ্ডিত রবিশঙ্করের কাছে, সেতারের তালিম নিতে। ম্যাককার্টনি গেলেন কেনিয়া ঘুরতে। সেখান থেকে লন্ডনে ফেরার উড়ানে তাঁর মাথাতেই প্রথম ভাবনাটা আসে। কেমন হয়, যদি বিটলস আর বিটলস না থাকে? এডওয়ার্ডীয় জমানার ব্যান্ডের মতো গান গায়? প্রস্তাব লুফে নিলেন লেনন। হ্যারিসনকে জানাতে তিনিও রাজি।

অ্যালবামের ১৩টি গানের প্রায় অর্ধেক লিখে ফেললেন ম্যাককার্টনি, বাকিটা লেনন ও হ্যারিসন। লন্ডনের অ্যাবে রোড স্টুডিয়োয় শুরু হল রেকর্ডিং। প্রযোজকরা বললেন, এই অ্যালবামের জন্য যত টাকা লাগবে, ঢালা হবে। যত দিন, যত ঘণ্টা দরকার, স্টুডিয়ো ভাড়া নেওয়া হবে। প্রতি দিন প্রায় ভোর অবধি চলত কাজ। মোট ৪০০ ঘণ্টা ভাড়া করতে হয়েছিল স্টুডিয়ো। সেই যুগে অ্যালবামের জন্য খরচ হয়েছিল ২৫,০০০ পাউন্ড!

ওই রেকর্ডিংয়ে হ্যারিসনের লেখা ‘উইদিন ইউ উইদাউট ইউ’ গানটির জন্য বাজিয়ে হিসেবে ডাক পড়ল চার ভারতীয় শিল্পীর। আন্না জোশী ও অমিত গুজ্জর বাজালেন এসরাজ। বুদ্ধদেব কানসারা ছিলেন তানপুরায়, নটবর সিংহ তবলায়। বিটলস-এর ওই অ্যালবাম খ্যাতির শিখরে পৌঁছলেও সেই চার ভারতীয় শিল্পীর নামটুকুও জানত না কেউ। এমনকী, অ্যালবামের কোথাও ওই শিল্পীদের কোনও উল্লেখ পর্যন্ত ছিল না। লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মাইক জোন্স সম্প্রতি অ্যাবে রোড স্টুডিয়োর নথিপত্র ঘেঁটে খুঁজে বার করেছেন চার শিল্পীর পরিচয়। আন্না জোশী ও অমিত গুজ্জর আগেই মারা গিয়েছেন। অশীতিপর বুদ্ধদেব কানসারা ও নটবর সিংহ এখনও জীবিত। গত ৯ জুন বিটলস-ভক্তদের দাবি মেনে মঞ্চে তোলা হয়েছিল এই দুই বিস্মৃত শিল্পীকে, তাঁদের জন্য আয়োজিত এক ফিলহার্মনিক কনসার্টে।

ড্রামের গায়ে অ্যালবামের নাম

কানসারা জানিয়েছেন, ‘সার্জেন্ট পেপার্স’-এর জন্য যখন ডাক এল, তিনি তখন এক গুরুদ্বারার থিতু বাজিয়ে। বন্ধু নটবরকে তিনিই হ্যারিসনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। হ্যারিসন যখন তাঁদের অ্যালবামে বাজানোর প্রস্তাব দিলেন, কানসারার বিশ্বাসই হয়নি। কারণ, বিটলসের বিশ্বজোড়া খ্যাতি। ওই গানটির জন্য দুটি সেশনে তানপুরা বাজিয়েছিলেন কানসারা। সেশন-প্রতি ২০ পাউন্ড হিসেবে পেয়েছিলেন মোট ৪০ পাউন্ড। হ্যারিসনের ওই গান শুরুই হচ্ছে তানপুরা আর তবলার মূর্ছনায়। গানের সুর, তাল, ছন্দ— সবেতেই আদ্যন্ত ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ছাপ। হ্যারিসনের এই ভারত-প্রীতির হাত ধরেই পরের বছর হৃষীকেশে এক ধর্মগুরুর আশ্রমে পৌঁছে গিয়েছিলেন লেনন, ম্যাককার্টনি, হ্যারিসন আর রিংগো স্টার।

ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে, ১৯৬৭-র জুনে আমেরিকায় মুক্তি পেল ‘সার্জেন্ট পেপার্স লোনলি হার্টস ক্লাব ব্যান্ড’। যেমন অদ্ভুত নাম, তেমনই বিচিত্র অ্যালবামের কভার। সেখানে বিটলস-এর সবাই ব্যান্ড-বাজিয়েদের মতো রংবেরঙের পোশাকে দাঁড়িয়ে। তাঁদের পিছনে ইতিহাসের বহু বিখ্যাত চরিত্র। যেন কালের সীমারেখা ভেদ করে তোলা এক গ্রুপ ফোটো।

দোকানে আসতে না আসতেই হট কেকের মতো বিকোতে শুরু করল অ্যালবাম। বিটলস-এর ‘ফুরিয়ে যাওয়া’ নিয়ে যে সব কাগজ গাদা নিউজপ্রিন্ট খরচ করছিল, তারাই এ বার পালটে ফেলল সুর। আসলে রক থেকে পপ, সাইকিডেলিয়া থেকে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত— সার্জেন্ট পেপার্স অ্যালবামে সব সুরই মিশে ছিল। আদ্যন্ত ছক-ভাঙা এই অ্যালবামটিকে বিশেষ কোনও ‘জ্যঁর’ বা ধারায় ফেলা যায় না।

ব্রিটেনের পরে আমেরিকা। সেখানেও সাফল্যের ধারা অব্যাহত। এ পর্যন্ত শুধু ব্রিটেনেই ৫১ লক্ষ রেকর্ড বিক্রি হয়েছে ওই অ্যালবাম! আমেরিকায় সংখ্যাটা ১ কোটি ১০ লক্ষ, সারা বিশ্বে ৩ কোটি ২০ লক্ষ! পরের বছরই ঝুলিতে চার-চারটে গ্র্যামি। তৈরি হল নতুন শব্দ ‘বিটলম্যানিয়া’।

বিতর্কও কম হয়নি। অভিযোগ ওঠে, বেশ কয়েকটি গানের কথা বেশ সন্দেহজনক। তাতে মাদক সেবনে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। ‘লুসি ইন দ্য স্কাই উইথ ডায়মন্ডস’ গানটাতে নাকি এলএসডি সেবনের দিকে ইঙ্গিত। গানটি লেননের লেখা। তাঁর মাদকাসক্তির কথা কারও অজানা নয়। কিন্তু লেনন বললেন, তাঁর শিশুপুত্রের আঁকা একটি ছবিই দেখেই তিনি এ গান লিখেছিলেন। কথা উঠেছিল ‘ফিক্সিং আ হোল’, ‘আ ডে ইন দ্য লাইফ’, ‘উইথ আ লিটল হেল্প ফ্রম মাই ফ্রেন্ডস’, ‘লাভলি রিটা’, ‘বিয়িং ফর দ্য বেনিফিট অব মিস্টার কাইট’-এর মতো গানের বাণী নিয়েও। সব ক’টিই নাকি আকারে-ইঙ্গিতে মাদক সেবনের কথা বলছে। খোদ বিবিসি কয়েকটি গান তাদের রেডিয়োর জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

সার্জেন্ট পেপার্স-এর সাফল্য দীর্ঘস্থায়ী হলেও বিটলস অবশ্য দীর্ঘায়ু হতে পারেনি। স্বপ্নযাত্রার ইতি ঘটে বছর দশেকের মাথাতেই। বিটলস-এর জনপ্রিয়তা বোঝাতে গিয়ে যে লেনন বলেছিলেন, ‘আমাদের চার জনের চারটি মোমের পুতুল পাঠিয়ে দিলেই কনসার্টে শ্রোতারা খুশি হয়ে যাবে,’ সেই তিনিই প্রথম বিটলস ছাড়েন, ১৯৭০-এ। একে একে বাকিরা।

বিটলস ভেঙে গিয়েছে বহু বছর। তবু ‘বিটলম্যানিয়া’ আজও অক্ষত।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE