Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪

ঠান্ডা যুদ্ধের প্রোফেসর শঙ্কু

সিডনি গটলিয়েব। মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ-র জন্য কখনও তৈরি করেন বিষ-ছুঁচ তৈরির পিস্তল, কখনও মগজ ধোলাইয়ের জন্য অজান্তে লোককে খাইয়ে দেন এলএসডি। কিন্তু সফল হন না একটিতেও। সোমেশ ভট্টাচার্য

ছবি: সুমন চৌধুরী

ছবি: সুমন চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

ন রম বিছানার ধারে প্রায় টান হয়ে বসেছিল তরুণীটি। বুকের ভিতর মৃদু কাঁপুনি। হাভানার এই ভিলায় টানা সাতটা মাস প্রেমিকের সঙ্গে কাটিয়ে গিয়েছে সে। ভালবাসার তীব্র আশ্লেষ শরীরে-মনে। পেটে এসেছে সন্তান। কিন্তু তার মুখ দেখা হয়নি। জন্মের পরেই তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

আজ সে ফিরেছে সব হিসেব বুঝে নিতে। সময় হয়ে এল।

এতগুলো দিন মার্কিন মুলুকে কাটিয়ে ফেরা। খানিক নিভৃত সময়, পানাহার, একটু সোহাগ— ঝটপট ভ্যানিটি ব্যাগের মুখ খুলে ভিতরে হাত চালায় মেয়েটি। আয়না খুঁজছে? শেষ বারের জন্য ভুরু এঁকে নিতে চায় বুঝি? ঠোঁটে বুলিয়ে নেবে লিপস্টিক? ক্রিমের ডিবে?

হ্যাঁ, সেই ডিবেটাই তো। ব্যাগের ভিতরে দ্রুত হাতড়াচ্ছে মেয়েটি। আহ, এই তো! ক্রিমের ভিতরে ডোবানো দুটো নিরীহ ক্যাপসুল, যার একটা শুধু মিশিয়ে দিতে হবে পানীয়ে, আর তার পরেই... দ্রুত প্যাঁচ ঘুরিয়ে মুখ খুলে ডিবের ভিতরে আঙুল চালিয়ে দেয় তরুণী।

কিন্তু কোথায় ক্যাপসুল? পাগলের মতো ডিবের নীচে, কোণে, চারপাশে আঙুল ঘোরায় মেয়েটি। নেই! তবে কি গলে ভূত? মিশে গেল ক্রিমে?

হিমস্রোত নামে তরুণীর শিরদাঁড়া বেয়ে। খুন না করেই কি তবে খুনের ষড়যন্ত্রে ফেঁসে যাবে? কেউ কি তাকে নজর রাখছে আড়াল থেকে?

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঝ়ড়ের মতো দরজায় এসে দাঁড়ায় তার তরুণ প্রেমিক। গায়ে জলপাই পোশাক। জোব্বা দাড়ির ফাঁকে চওড়া হাসি। এসেই টান হয়ে শুয়ে পড়ে বিছানায়। পকেট থেকে একটা চুরুট বের করে ছুড়ে দেয় ঠোঁটের ফাঁকে। তার পর দাঁতে চেপে ধরে বলে— ‘আমায় মারতে এসেছ?’

হাসতে-হাসতেই বলে।

‘হ্যাঁ’— সোজা প্রেমিকের চোখে চোখ রেখে বলে মেয়েটি।

‘তুমি আমায় মারতে পারবে না। কেউই পারবে না,’ বলে কোমরের গোঁজ থেকে .৪৫ কোল্ট পিস্তল বের করে তরুণীর হাতে ধরিয়ে দেয় সে। পুরো লোডেড।

কয়েকটা নিশ্চল মুহূর্ত।

যাকে মারবে বলে ‘বিষকন্যা’ করে পাঠানো হয়েছে তাকে, সেই ফিদেল কাস্ত্রো তার সামনে।

একা, নিরস্ত্র, হাসিমুখ।

পিস্তলটা বিছানায় নামিয়ে রাখে মারিতা লোরেঞ্জ। মুখ নিচু করে বসে থাকে খানিক। এবং দিন কয়েকের মধ্যে কিউবা ছেড়ে চলে যায়।

ফিদেলকে খুনের যে অগুনতি চক্রান্ত হয়েছিল, এটা তারই একটা। কিন্তু কে পাঠিয়েছিল বিষকন্যাকে?

কে আবার, সিআইএ!

১৯৫৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিলাসবহুল এক মার্কিন ক্রুজে মারিতার কিউবায় আসা। ‘এল কমান্দান্তে’র সঙ্গে এক রাতের জাহাজি প্রেম, পরের দিন দেশে ফিরে গেলেও প্রাইভেট প্লেনে তাকে ফের হাভানায় উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া এবং সাত মাস ঘরকন্নার পরে দেশে ফিরে মারিতার অভিযোগ, ফিদেল তার সদ্যোজাত সন্তানকে হাপিস করে দিয়েছে— কিছুই সিআইএ’র অজানা ছিল না। তারাই তার রাগ-ঘৃণা উসকে তুলে হাতে গুঁজে দিয়েছিল বিষ ক্যাপসুল।

কোন বিষ?

পটাসিয়াম সায়ানাইড? যা খেলে নাকি নিমেষে লোকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে? স্বাদটুকু পর্যন্ত বলে যেতে পারে না? না, ওটা ভুল ধারণা! ওতে দমবন্ধ হয়ে মুখে গ্যাঁজলা তুলে মরতে অন্তত পনেরো মিনিট!

তার চেয়ে অনেক সহজে মারার জন্য তত দিনে মেরিল্যান্ডের ফোর্ট ডেট্রিক-এ মার্কিন সেনা ল্যাবরেটরিতে ৪৫ কিলো শেলফিশের দেহরস ছেঁকে এক গ্রাম বিষ বানিয়ে ফেলেছেন জৈব-রাসায়নিক অস্ত্র তৈরির কর্ণধার সিডনি গটলিয়েব। সরাসরি তা জিভে ছুঁইয়ে দিতে পারলে তো কথাই নেই। যদি তা না-ও পারা যায়, চুলের মতো সরু আর এক ইঞ্চির তিন ভাগের এক ভাগ লম্বা ছুঁচের মাথায় এক ফোঁটা বিষ মাখিয়ে ছুড়ে দিলেই হল। নো রক্তপাত, নো ঝঞ্ঝাট!

শঙ্কুর অ্যানাইহিলিন পিস্তল মনে পড়ে যাচ্ছে কি, যা দেগে দিলে শিকার স্রেফ উবে যায়? ঝামেলা হল, গটলিয়েবের বিষ-ছুঁচ মোটেও শঙ্কুর অ্যানাইহিলিনের মতো কাজে এল না। সিআইএ’র বাছাই বন্দুকবাজেরা জানিয়ে দিলেন, এ বড্ড পলকা জিনিস। অত সূক্ষ্ম ছুঁচ সামান্য হাওয়ায় কেটে যায়। টার্গেটে লাগে না। এর চেয়ে বুলেট অনেক কাজের জিনিস!

সিডনি গটলিয়েবের জীবনের এ এক আজব ট্র্যাজেডি। ১৯৫৩ থেকে শুরু করে প্রায় দু’দশক ধরে আমেরিকার রাসায়নিক যুদ্ধাস্ত্র তৈরির অন্যতম কাণ্ডারী, কিন্তু ঝুলিতে সাফল্য নেই বললেই চলে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রায় শেষ লগ্নে, ১৯১৮ সালের অগস্টে নিউ ইয়র্কে তাঁর জন্ম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর সময়ে, ১৯৩৯-এ তিনি ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিনে কৃতী ছাত্র। যুদ্ধে যেতে চান। বাদ সাধল বাঁকা পায়ের পাতা, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ক্লাব ফুট’। সেনাবাহিনী তাঁকে নিতে নারাজ। সিডনি আর কী করেন? পরের বছর ডিসটিংশন নিয়ে পাশ করে ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে জৈব-রসায়নে গবেষণা করতে চলে গেলেন তিনি। সেখানেই দেখা মার্গারেট মুর-এর সঙ্গে। ব্রিটিশ ভারতে ধর্মপ্রচারে যাওয়া এক মিশনারির মেয়ে তিনি, জন্ম ভারতেই। সংসার পাতলেন দুজনে।

সিআইএ-তে যোগ দেওয়ার সুযোগ এল ১৯৫১ সালে। তত দিনে ‘কোল্ড ওয়র’ শুরু হয়ে গিয়েছে। কমিউনিস্ট জুজুর ভয়ে কাঁপছে ব্রিটেন-আমেরিকা। সোভিয়েত থেকে চিন, কিউবা, যেখানেই কমিউনিস্ট, শেষ করতে হবে— এই হল ব্রত। ১৯৫৩ সালে জন্ম নিচ্ছে ব্রিটিশ ডাবল-এজেন্ট জেম্‌স বন্ড।

প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারের দফতর থেকে কাস্ত্রোকে সরানোর সবুজ সঙ্কেত মিলল। শুরু হয়ে গেল ‘অপারেশন মংগুজ’। কিন্তু একেবারে মেরে ফেললে লোকটা উলটে ‘শহিদ’ হয়ে উঠতে পারে! ওকে বরং বেইজ্জত করতে হবে। গটলিয়েব তাই বানিয়ে ফেললেন থ্যালিয়াম মাখানো জুতো, যা পায়ে দিলেই লোম-টোম সব খসে পড়বে। কাস্ত্রো প্রায়ই বলেন, দাড়িটাই তাঁর ‘ব্যাজ অব অনর’। সেই দাড়িটাই খসে যাবে! কিন্তু সেই জুতো তাঁর পদযুগল পর্যন্ত পৌঁছল না!

কোই বাত নেহি! বটুলিনাম বিষ মাখিয়ে এক বাক্স চুরুট বানিয়ে পাঠালেন গটলিয়েব। কিন্তু যে লোকটার হাতে পাঠানো হয়েছিল, বাক্স সমেত সে-ই গায়েব হয়ে গেল। মাঝখান থেকে এই ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে কাস্ত্রো চুরুট ফোঁকাই ছেড়ে দিলেন। তাতেই নাকি তাঁর আয়ু গেল আরও বেড়ে! বিষ ছোড়া ঝর্না-কলম, বিষাক্ত সুইমস্যুটও তৈরি করে রেখেছিলেন গটলিয়েব। কাজে আসেনি।

খতম-তালিকার এক নম্বরে কাস্ত্রো ছিলেন ঠিকই, ছিল আরও কিছু তাবড় নামও। কঙ্গোয় প্রথম গণতান্ত্রিক সরকার গড়ে ফেলা প্যাট্রিস লুমুম্বাকে মারতে বিষ-ছুঁচ পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তত দিনে ঠিক হয়ে গিয়েছে, সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সোভিয়েত ঘেঁষা লুমুম্বাকে নিকেশ করা হবে। তাই ছুঁচ আর ছোড়া হল না।

ইরাকের যে ছোট্ট কমিউনিস্ট-বিরোধী দলকে হাওয়া দিয়ে বাড়িয়ে সাদ্দাম হুসেনের জন্ম দেওয়া হবে, সেই বাথ পার্টির হয়েই আগের জেনারেল আব্দুল কাসেমকে খুনের ছক কষল সিআইএ। গটলিয়েব তৈরি করে দিলেন বিষ-মাখানো রুমাল। যদিও কাসেম আদৌ রুমাল ব্যবহার করেন কি না, সেটা কেউ জানত না। কিন্তু বাগদাদি পোস্ট অফিসের তখন যা গোলমেলে দশা, রুমালটাই গেল হারিয়ে।

মজার ব্যাপার, পরদেশিদের বেলায় ফসকে গেলেও মার্কিনিদের ক্ষেত্রে গটলিয়েবের নিশানা কিন্তু অব্যর্থ! অবশ্য তাঁদের জন্য প্রাণঘাতী বিষ নয়, বরাদ্দ বুদ্ধি-স্মৃতি বিকল করা, স্থান-কাল গুলিয়ে দেওয়া মাদক লাইসারজিক অ্যাসিড ডাইথাইলামাইড, ওরফে ‘এলএসডি’।

গ্রীষ্মের একটা ঝলমলে উইকএন্ডে স্বামী জিমের সঙ্গে পশ্চিম ভার্জিনিয়ায় গটলিয়েবের খামারবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন স্যালি হার্টম্যান। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই সিক্রেট সার্ভিসে। স্যালি ন্যাশনাল সিকিয়োরিটি এজেন্সির, জিম সিআইএ-তে। জিমের বস ‘আঙ্কল সিড’ অর্থাৎ সিডনি গটলিয়েব।

কিছু দিন আগে থেকে দুজনের খিটিমিটি চলছিল। মা হতে চান স্যালি। কিন্তু জিমের সোজা কথা, মা হতে গেলে চাকরি ছাড়তে হবে। কিন্তু সে দিনটা যেন আলাদা। সারা রাস্তা দুজনে হাসাহাসি, খুনসুটি করতে-করতে গিয়েছেন। এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে অন্য হাতে স্যালিকে বারবার কাছে টেনেছেন জিম। খামারে ছাগল পালেন গটলিয়েব দম্পতি। সুস্বাদু মাংস আর ওয়াইন পরিবেশিত হয় ডিনারে। স্যালি কখনওই বেশি ওয়াইন খান না। সে দিনও বড় জোর দু’গ্লাস খেয়েছিলেন। তার পরে আর কিছু স্পষ্ট মনে নেই।

বাড়ি ফিরেও রাতভর জেগে বসে স্যালি। কীসের যেন প্রচণ্ড একটা আতঙ্ক। ঘুমোতে পারছেন না কিছুতেই। সময় মুছে যাচ্ছে। তাঁকে সম্মোহন করা হয়েছে বলে মজা করতে থাকেন জিম। শেষে জর্জ ওয়াশিংটন হাসপাতালে স্যালিকে ভর্তি করাতে হয়। ইলেকট্রিক শক দেওয়ার কথাও ধোঁয়া-ধোঁয়া মনে পড়ে স্যালির। কাজের চাপে জিম আসতে পারেন না। গটলিয়েব মাঝে-মাঝে এসে তাঁকে দেখে যান।

বছর ঘুরে ১৯৫৭-র বসন্তে যখন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান স্যালি, তাঁর জীবন থেকে কী যেন চিরকালের মতো হারিয়ে গিয়েছে। জিমের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। জীবনে ফের প্রেম আসে। এক প্রাক্তন ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টার, নাম ফ্রেড। এই ফ্রেডই আবিষ্কার করেন, সে দিন আসলে স্যালির কী হয়েছিল।

শুধু ফ্রেড নন, নতুন সেই আবিষ্কারে স্তম্ভিত হয়ে যায় গোটা আমেরিকা। ১৯৭৭ সালের অগস্টে জানা যায় এত দিন সঙ্গোপনে লুকিয়ে রাখা প্রজেক্ট ‘এমকেআলট্রা’-র কথা। যার একটাই উদ্দেশ্য, চড়া মাত্রার এলএসডি দিয়ে অন্যের মস্তিষ্ককে দুমড়ে-মুচড়ে নিজের বশে আনা, যা খুশি করিয়ে নেওয়া। এক কথায়— মগজধোলাই।

একের পর এক বয়ান সামনে আসতে থাকে। মার্কিন সেনেট তদন্ত কমিশন বসায়। জেলবন্দি, মাদকাসক্ত, চিত্রকর, গোয়েন্দার বউ, কে নেই গিনিপিগ তালিকায়? অন্তত ১৪৯ জন। কেউ পাগল হয়ে গিয়েছেন, আত্মহত্যা করেছেন কেউ।

প্রশ্ন উঠে গেল ফ্রাঙ্ক ওলসন-এর আত্মহত্যা নিয়েও। ১৯৫৩-র ২৮ নভেম্বর দোতলা থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন ফোর্ট ডেট্রিক-এর ব্যাকটিরিয়োলজিস্ট ওলসন। শোনা যায়, তার দশ দিন আগে এক পার্টিতে তাঁকে নিজে হাতে এক গ্লাস ওয়াইন খাইয়েছিলেন গটলিয়েব। তাতেও কি মেশানো ছিল এলএসডি?

গটলিয়েবের প্রাণশক্তি প্রবল। নিজে এলএসডি খেয়েছেন কয়েকশো বার। তা বলে পুরোদস্তুর খলনায়ক নন। ১৯৭২ সালে অবসর নেওয়ার পরে সস্ত্রীক ভারতে এসে দেড় বছর কুষ্ঠ প্রতিষ্ঠান চালিয়েছেন। ১৯৯৯ সালে মৃত্যু ইস্তক তাঁকে অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়নি।

আসলে সিআইএ-র মনোবিদ জন গিটিঙ্গার-এর কথাটাই হয়তো ঠিক— ‘গটলিয়েব চাইছিলেন যে ভাবেই হোক কিছু একটা আবিষ্কার করতে। কীই বা করতে পারতেন? যুদ্ধটা যে আমাদের কাছে কখনওই শেষ হয়নি।’

অন্য বিষয়গুলি:

Professor Shonku Fidel Castro
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE