ছবি: দীপঙ্কর ভৌমিক।
ডোংরির আড্ডায় ফোনটা পকেটে রেখে পাথরের মতো চোখে সামনে বসা গ্যাং-এর তিন বিশ্বস্ত সহচর হানিফ, আফসর আর টিড্ডি ফরিদের দিকে তাকাল কালিয়া উসমান। “আভি আভি টিপ মিলা মেরেকো, চামড়ে কে ধান্দে কে বারেমে সব কুছ পতা চল গয়া হ্যায় ডি ডি অওর ক্রাইম ব্রাঞ্চমে। তুরন্ত ভাগনা পড়েগা হাম সবকো।”
বলেই দ্রুত ঘরের কোণের আলমারিটার দিকে এগিয়ে গেল উসমান। আলমারির দ্বিতীয় র্যাকটার তলায় একটা গোপন খোপ। থাকে থাকে সাজানো নোটের বান্ডিল। বেশ কিছু বান্ডিল টেবিলের দিকে ছুড়ে দিল উসমান। বাকিগুলো দ্রুত ভরে ফেলল একটা কিটব্যাগে। তার পর ঘুরে তাকাল হানিফের দিকে, “ইয়ে রুপিয়া গ্যাংকা বাকি ছোকরালোগোঁমে বাঁট দে অওর সব কো বোল আবভি মুম্বাই ছোড়কে ইউ পি অওর নেপাল আন্ডারগ্রাউন্ড হো যানে কে লিয়ে।”
টেবিলের ওপর নোটের বান্ডিলগুলোর দিকে ইশারা করল উসমান। তার পর পকেট থেকে মোবাইল বার করে নম্বর ডায়াল করতে শুরু করল দ্রুতহাতে। এখনই ফোন লাগাতে হবে দুবাইয়ে। যেন এখনই একটা তাগড়া স্পিডবোট পাঠায় গুজরাত দরিয়ার ওই খাঁড়ি এলাকাটায়। ছোট বোট। এখান থেকে ওর সঙ্গে মাত্র তিন জন যাবে। হানিফ, আফসর আর টিড্ডি ফরিদ। লাইনের ও পারে রিংটোনের শব্দ। ফোনটা কানে তুলে নিল উসমান।
হ্যাঁচকা টানে গ্যারাজের রোলিং শাটারটা টেনে তুলল টিড্ডি ফরিদ। ভিতরে মার্সিডিজ বেঞ্জ, জাগুয়ার আর বি এম ডব্লু-র পাশে এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা মলিন রংচটা একটা মারুতি ওমনি ভ্যান। গ্যারেজটা উসমানের ডেরার পেছন দিকটায়। এক দিক বন্ধ গলিটা অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি নির্জন ডোংরি মহল্লার সদা হই-হট্টগোলের তুলনায়। দ্রুত এক বার চার দিকে নজর বুলিয়ে নিল ফরিদ। নাঃ, কেউ নেই আশপাশে। মোবাইল বার করে একটা নম্বর ডায়াল করল ফরিদ।
“হাঁ, বোল ফরিদ,” ও প্রান্তে ফোন ধরলেন এ সি পি শিন্ডে।
“সালাম সাহাব, উসমান কালিয়া দুবাই ভাগ রহা, আজ হি। গুজরাত খাঁড়ি মে বোট আয়গা। হাম, আফসর অওর হানিফ রহেঙ্গে উসকে সাথ,” দ্রুত কথা শেষ করে লাইনটা কেটে দিল ফরিদ। তার পর মারুতির গেট খুলে স্টার্ট দিল ইঞ্জিনে।
ডেরার সামনে হানিফ আর আফসরকে নিয়ে অপেক্ষা করছিল উসমান। তত ক্ষণে জনি এসে গেছে। উসমানের খাস ড্রাইভার। জনিকে দেখেই ড্রাইভারের সিট ছেড়ে দিল ফরিদ। ঝটিতি গাড়ির মধ্যে সেঁধিয়ে গেল বাকি সবাই। ঝড়ের গতিতে এলাকা ছেড়ে বেরিয়ে গেল মারুতি ওমনি।
হাইওয়ে ধরে তিরগতিতে গুজরাত খাঁড়ির দিকে ছুটছিল মুম্বই পুলিশের আটখানা কোয়ালিস ভ্যান। শহরের সীমানা শেষ হয়ে দু’পাশে ফাঁকা মাঠ। লাইনের দ্বিতীয় গাড়িটায় ড্রাইভারের পাশে বসা সাব-ইনস্পেক্টর রবিন ডিসুজ়া। পিছনে সুনীল, সঙ্গে আরও চার কনস্টেবল। সুনীলের পাশে বসা হরিভাউ কাম্বলে। ক্রাইম ব্রাঞ্চে বহু দিনের দক্ষ এবং অভিজ্ঞ কনস্টেবল, হঠাৎই আঙুল তুলে দেখাল দূরে উল্টো দিক থেকে আসা একটা পুরনো মারুতি ওমনি ভ্যানের দিকে, বলল, “সাব, ওহ গাড়ি কালিয়া উসমানকা হ্যায়!”
“তুম শিওর হো কাম্বলে?” শোনামাত্র সামনে ড্রাইভারের পাশের সিট থেকে ঘাড় ঘূরিয়ে ভীষণ উত্তেজিত গলায় প্রশ্ন করল রবিন ডিসুজ়া।
“হান্ড্রেড পারসেন্ট স্যর!”
কাম্বলের উত্তরটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ঝটিতি ড্রাইভারের দিকে তাকাল ডিসুজ়া। “সামনেওয়ালা গাড়িকো ওভারটেক করো ইমিডিয়েটলি! ওহ মারুতিকো রোকনা হোগা।” বাকি গাড়িগুলোকে নির্দেশ দেওয়ার জন্য ড্যাশবোর্ডের এক পাশে আটকানো ওয়াকিটকিটা তুলে নিল রবিন।
গুজরাত খাঁড়িতে উসমানদের নামিয়ে দিয়ে ফিরছিল জনি। আজ রাতেই ভাগতে হবে শালা মুম্বই ছেড়ে। ঠিক এই সময় চোখে পড়ল উল্টো দিক থেকে আসা মুম্বই পুলিশের কনভয়টাকে। আন্ডারওয়ার্ল্ডে দীর্ঘ কালের অভিজ্ঞতা থেকে মুহূর্তের মধ্যে বুঝে ফেলতে অসুবিধে হল না, কোথায় যাচ্ছে গাড়িগুলো। পিছনের গাড়িগুলোর সঙ্গে অ্যাক্সিডেন্টের বিপদকে উপেক্ষা করেই ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক ভাবে হেয়ার-পিন বেন্ড ইউ টার্ন করাল মারুতিটাকে। ডিভাইডার টপকে প্রায় পাল্টি খেতে খেতে উল্টো দিকের লেনে পড়ে কোনও মতে সোজা হয়ে দাঁড়াল গাড়িটা। ওই অবস্থাতেও একটুও স্পিড না কমিয়ে ছুটতে লাগল সামনে।
গাড়ির উইন্ডস্ক্রিন থেকে মারুতিটাকে ও রকম দুঃসাহসিক ভাবে ডিভাইডার টপকাতে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছে ডিসুজ়ার মতো ঘাঘু পোড় খাওয়া অফিসারও! পরমুহূর্তেই বিস্ময়ের ঝটকা কাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল ডিসুজ়া, “স্পিড বাড়াও!”
মুহূর্তে টপ গিয়ারে কোয়ালিস ভ্যান! স্পিডোমিটারের কাঁটা লাফিয়ে একশো কুড়ি! অনেকটা আগেই লেন টপকানোয় অন্তত দেড়শো মিটার সামনে ছুটছে মারুতিটা। তত ক্ষণে সব ক’টা গাড়িতে পৌঁছে গেছে ওয়্যারলেস মেসেজ। সবাই মিলে ধাওয়া করেছে মারুতিটাকে। ছুটে যাওয়া ঝাঁকে ঝাঁকে বুলেটের মধ্যে দুটো গিয়ে লাগল গাড়িটার সামনে আর পিছনের দুটো টায়ারে।
টায়ার ফাটার বিকট শব্দ! তার পরই তিনটে পাক খেয়ে রাস্তা ছেড়ে খোলা মাঠের মধ্যে গিয়ে পড়ল মারুতি। গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে এল সবাই।
“হামকো মত মারিয়ে সাব!” কাতর আর্তনাদ ভেসে আসছে মারুতির ভিতর থেকে। ছুটে গিয়ে উল্টোনো গাড়ির মধ্যে থেকে জনিকে টেনে বের করল দু’-তিন জন কনস্টেবল। সারা শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে। কপালে ইঞ্চিখানেক গভীর একটা ক্ষত। ডান পা-টা ভেঙে লটপট করছে। দ্রুত গিয়ে ওর সামনে ঝুঁকে পড়ল রবিন ডিসুজ়া।
“কাঁহা সে আ রহা থা?”
“গুজরাত খাঁড়ি,” নিভন্ত চোখের দৃষ্টি। ক্ষীণগলায় উত্তর দিল জনি।
“কিঁউ গয়া থা উঁহা?” ফের প্রশ্ন করল রবিন।
“উসমানভাই, হানিফ অওর টিড্ডিকো ছোড়নে কে লিয়ে। দুবাইসে এক শিপ আয়েগা উঁহা…” বলতে বলতেই জ্ঞান হারাল জনি। তত ক্ষণে রুদ্রকে নিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন এ সি পি শিন্ডে।
“হ্যাজ় হি টোল্ড এনিথিং?” প্রশ্ন করলেন ডিসুজ়াকে। উত্তর শোনার পর চোখে উদ্বেগ নিয়ে তাকালেন রুদ্রর দিকে।
“হু নোজ়? বোটটা এত ক্ষণ ওদের নিয়ে পালিয়েছে কি না!” কাঁধ ঝাঁকালেন শিন্ডে। “আর কিছু কনফেস করার আগেই তো জ্ঞান হারাল ছেলেটা। এনিওয়ে আমি হেডকোয়ার্টারে ফোন করে কাস্টম্স আর কোস্টগার্ডদের অ্যালার্ট করে দিতে বলছি ইমিডিয়েটলি।”
তত ক্ষণে ঘটনাস্থলে এসে গেছে একটা রোড প্যাট্রলিং ভ্যান। তাকে ‘আভি হসপিটাল লেকে যানা পড়েগা ইনকো’ নির্দেশ দিয়ে ফের গুজরাত খাঁড়ির দিকে ছুটল কনভয়। জনিকে গাড়িতে তুলে হাসপাতালের দিকে রওনা দিল পেট্রলিং ভ্যান।
পড়ন্ত বিকেলের আরব সাগর। উথালপাথাল ঢেউয়ের সারি একের পর এক এসে ভীমনাদে আছড়ে পড়ছে পাড়ে। তীক্ষ্ণ আওয়াজে আকাশ চিরে দিয়ে মাথার ওপর অনেক উঁচুতে ক্রমাগত পাক মেরে চলেছে একটা শঙ্খচিল। শেষবেলায় কিছু শিকার জোটার আশায়। একটা দীর্ঘ নোনাজলের খাঁড়ি। ঘন ম্যানগ্রোভ জঙ্গলে ঢাকা, কে জানে কোত্থেকে এসে সোজা মিশে গেছে সমুদ্রের জলে।
জল থেকে মাথা উঁচিয়ে ওঠা পাশাপাশি দুটো গরান গাছের ওপর কোনও মতে পা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল কালিয়া উসমান, হানিফ আর টিড্ডি ফরিদ। গুজরাতের এই ম্যানগ্রোভ খাঁড়ি এলাকাটাকে অনেক দিন ধরে সোনা আর হিরে স্মাগলিংয়ের রুট হিসেবে ব্যবহার করে কালিয়া উসমানের গ্যাং। দুবাই থেকে আরব পার্টিদের মোটরবোটগুলো গোল্ড বিস্কিট আর ফিনিশড কাটিং ডায়মন্ড নিয়ে এসে দাঁড়ায় খাঁড়ি থেকে আধ কিলোমিটার দুরে। তার পর ছোট ছোট ডিঙিতে তুলে মাল এসে পৌঁছয় ম্যানগ্রোভ খাঁড়ির সামনে। সেখানে মালের জিম্মা নিয়ে নেয় উসমানের গ্যাংয়ের হ্যান্ডলাররা। তার পর হাঁটু, বুক বা কোমর সমান জল ঠেলে ঠেলে হাড়ভাঙা ক্লান্তিকর মাইলদেড়েক এক যাত্রা পাড়ের দিকে। পাড়ে পৌঁছনোমাত্র প্রাইভেট গাড়িতে চাপিয়ে সিধে উসমানের ডেরা অথবা জাভেরিবাজারের জুয়েলার্স মার্কেটে, বড় বড় কারবারিদের কাছে। কিন্তু এ বারের মামলাটা একটু বেয়াড়া রকম। মাল খালাস করা নয়, উল্টে উসমানকেই পালাতে হচ্ছে মুলুক ছেড়ে। দুবাইয়ের ভাইদের সঙ্গে কথা হয়েছে ফোনে। মোটরবোট নয়, একটা দুর্দান্ত স্পিডবোট পাঠাচ্ছে ওরা। ঝড়ের মতো এসে সোজা দাঁড়িয়ে পড়বে একেবারে খাঁড়ির গায়ে, মাঝসমুদ্রে নয়। মাত্র মিটারপঞ্চাশেক জোরে জল ঠেলে গিয়ে লাফিয়ে উঠে পড়ার ওয়াস্তা। ব্যস! তা হলেই ড্রেসওয়ালা মামুদের নাগালের বাইরে। আলবিদা ইন্ডিয়া!
কব্জি উল্টে হাতের ঘড়িটায় টাইম দেখল উসমান। ছ’টা বাজতে পাঁচ। যদিও মুম্বইয়ে সন্ধে নামে অনেকটাই দেরি করে, তবুও এই মুহূর্তে ধোঁয়াটে অন্ধকার ঘন ম্যানগ্রোভ বনের ভেতরে। দুবাইওয়ালারা টাইম বলেছে সাতটা থেকে সাড়ে সাতটা। তার মানে কম সে কম এক থেকে দেড় ঘণ্টা ইন্তেজার করতে হবে বোটের জন্য। নিম্নাঙ্গ সপসপে ভিজে। মনের মধ্যে তীব্র আতঙ্ক আর উত্তেজনা! পায়ের বুড়ো আঙুল বেয়ে উঠে আসা কনকনে ঠান্ডা ভাব ক্রমশ গোটা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। ঘাড় ঘুরিয়ে দুই শাগরেদের দিকে তাকাল উসমান। ওদের অবস্থাও একই রকম। পাঠান স্যুটের পকেট থেকে স্কচের মেটাল নিপটা বার করে আনল উসমান। বড় বড় দু’-তিনটে ঢোঁক মেরে এগিয়ে দিল শাগরেদদের দিকে, “দো-চার ঘুঁট মার লে, বদন গরম রাখেগা।”
সন্ধে সাতটা চল্লিশ। চার দিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। জঙ্গলের মধ্যে জানা-অজানা নানা ধরনের সব পোকামাকড়ের ডাক। দূরে কালো সমুদ্রের জলে একটা ছোট আলোর ফুটকি। একটু একটু করে বড় হচ্ছে ফুটকিটা। ক্রমশ সামনে এগিয়ে আসছে বোটটা। বোট আর ম্যানগ্রোভের মধ্যে দূরত্ব যখন আর একশো গজের মতো, গাছের ডাল থেকে জলে লাফ দিয়ে নামল উসমান। “জলদি চল সব!” শাগরেদদের দিকে চেয়ে বলে উঠল ফিসফিসিয়ে। আর ঠিক তখনই সার্চলাইটের আলোয় আলোয় দিন হয়ে গেল ম্যানগ্রোভ জঙ্গল।
লাউড স্পিকারে এ সি পি শিন্ডের গলা, “ভাগনে কা কোশিশ মত করো উসমান! তুমলোগোকোঁ চারো তরফ সে ঘের লিয়া গিয়া।”
শোনামাত্র মাঝসমুদ্রে মুখ ঘুরিয়ে নিল স্পিডবোটটা। গতি বাড়িয়ে মিলিয়ে গেল আরব সাগরের নিকষকালো অন্ধকারে।
এতটা কাছে এসেও… হতাশায় উন্মাদ হয়ে গেল উসমান! এক ঝটকায় কোমর থেকে টেনে বার করে আনল সর্বক্ষণের সঙ্গী নাইন এমএম অস্ট্রিয়ান গ্লোক পিস্তলটা। আর ঠিক তখনই পিছন থেকে ঠিক যেন জল আর অন্ধকার ফুঁড়ে উঠে দাঁড়াল একটা লোক। ছ’ফুটের কাছাকাছি হাইট। হাতের মুঠোয় উদ্যত সার্ভিস মাউজ়ার।
উসমান পিস্তল আনলক করার আগেই রুদ্রর মাউজ়ারের বুলেট ওর বাহুমূলে ইঞ্চিখানেক গভীর ফুটো করে দিল একটা। তীব্র আর্তনাদ করে হাত চেপে বসে পড়ল কালিয়া উসমান।
“হ্যান্ডস আপ!” পরমুহূর্তেই ক্ষিপ্ত বাঘের মতো গর্জে উঠল রুদ্র।
কথা না শুনে রুদ্রকে লক্ষ করে হাতে রিভলভারের ট্রিগারে চাপ দিল হানিফ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy