কেমন হল বিতর্কিত ছবি ‘ইমার্জেন্সি’? ছবি: সংগৃহীত।
কঙ্গনা রনৌতের পক্ষে ‘ইন্দিরা’ হয়ে ওঠাই কঠিন। আর তিনি চেষ্টা করলেন ‘ইন্ডিয়া’ হয়ে উঠতে!
কোনও ছবি ইতিহাস নির্ভর হলে সাধারণত দায় বেশি থাকে পরিচালকের। তা পরিচিত কোনও ব্যক্তির জীবনী-ভিত্তিক হলে তো বটেই। নিরপেক্ষ ভাবে ইতিহাস বলা কষ্টসাধ্য কাজ। কঙ্গনা অবশ্য এমন একটা সময় বেছে নিয়েছিলেন ‘ইমার্জেন্সি’ ছবির জন্য, তাতে কষ্ট কম থাকার কথা। কারণ, সেটি এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত সময়ের মধ্যে অন্যতম। ঘটনাবহুল। গল্প বলতে গেলে বেশি সাজাতে-গোছাতে হওয়ার কথা নয়। গণমাধ্যমের উপর শাসন থেকে গণবন্ধ্যত্বকরণের প্রকল্প, বস্তি উচ্ছেদ থেকে আটক-ধরপাকড়— সে সময়ে ঘটা যা কিছু নিয়ে বলা হবে, তা-ই শোনার মতো, দেখার যোগ্য, জানা প্রয়োজন।
কিন্তু গোল বাধল অন্য ক্ষেত্রে। পরিচালক কঙ্গনা এই কাহিনির লেখকও। নিজের মতো করে গল্প বলতে গিয়ে অনেকটা বেশি দায়িত্ব নিয়ে নিলেন নিজের কাঁধে। যখন দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর চরিত্রে অভিনয় করতে করতে উচ্চারণ করলেন, ‘ইন্দিরা ইজ় ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়া ইজ় ইন্দিরা’, তখন যেন প্রায় বার্তা দিয়ে ফেললেন, তাঁর গল্পের কথক খাস ইন্ডিয়া, অর্থাৎ, ভারত! একটি দেশই যেন এক প্রধানমন্ত্রীর জীবনের কাহিনি বলছে।
তা করতে গিয়ে যা হওয়ার, তা-ই হল। স্তরে স্তরে বেরিয়ে এল ইতিহাসকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভঙ্গিতে সাজানোর বার্তা। ১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থার সময়ে ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের যে নিন্দা হয়েছে, তা তো জানা কথা। ঘটনাগুলি দেখালেই যথেষ্ট। কিন্তু তার সঙ্গে কঙ্গনা ইন্দিরার মনের ভিতরে প্রবেশ করে গল্পের ঘুঁটি সাজানোর চেষ্টা করলেন। আয়নার সামনে দাঁড় করালেন ইন্দিরাকে। নিজেই ইন্দিরার চরিত্রে অভিনয় করেছেন, আর তাঁকে খানিকটা ভিরু, বিভ্রান্ত, বিবেচনাহীন ভাবে তুলে ধরেছেন। তাতে অসুবিধা ছিল না, যদি অভিনয় বলিষ্ঠ হত। অভিনয়ও যেন খানিক দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ল মাঝেমধ্যে। এত কিছুর পরে তবু কঙ্গনাই থাকলেন নজরে, কারণ, বাকি কোনও চরিত্রই গড়ে উঠল না ঋতেশ শাহের করা চিত্রনাট্যে। পর্দায় দেখা গেল জওহরলাল নেহরু থেকে শুরু করে সঞ্জয় গান্ধী, অটলবিহারী বাজপেয়ী, জয়প্রকাশ নারায়ণের মতো ব্যক্তিত্বকে। কিন্তু অভিনয়ের সুযোগ নেই জয়প্রকাশ রূপে অনুপম খের কিংবা অটলবিহারীর চরিত্রে শ্রেয়স তলপড়ের মতো অভিনেতারও। ঋতেশের লেখা সংলাপও দুর্বল। দুর্বল বিভিন্ন চরিত্রের চলন। ফলে ‘ইমার্জেন্সি’-র মতো সময় নিয়ে তৈরি ছবি রয়ে গেল কঙ্গনার ভাবনায় ইন্দিরার অন্তরের যাত্রা হয়ে। কখনও শেক্সপিয়রের লেডি ম্যাকবেথের মতো নিজেকে দেখে আঁতকে উঠলেন ইন্দিরা, আর বাকি সময়ে কথায় কথায় কান্না পেল তাঁর। বড়ই এক তরফা গল্প বলে চলল ছবিটি। তার মধ্যে মূল চরিত্রের প্রায় কোনও রকম উত্তরণ না ঘটায় একটি সময়ে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য হয়— দুর্বল ইন্দিরা, নাকি দুর্বল গল্পটি?
এ ভাবে দেখতে দেখতে ক্লান্তি এলে বিস্ময়কর নয়। তবে মাঝেমধ্যে আশা জাগায় ছবির চিত্রগ্রহণ। বিশেষ করে বাংলাদেশ যুদ্ধের সময়কার কিছু মুহূর্ত রীতিমতো মনে রাখার মতো করে ফুটিয়ে তুলেছেন জাপানের সিনেমাটোগ্রাফার তেতসুয়ো নাগাতা। দেশপ্রেম ফুটিয়ে তোলার মতো সঙ্গীতানুসঙ্গও ঘটল এই ছবিতে। ‘সিংহাসন খালি করো’ এবং ‘এয় মেরি যান’-এর গমগমে চরিত্র ধরে রাখে গল্পের আবহ। দেশভক্তিও জাগিয়ে তোলার ক্ষমতা রাখে।
তবু শেষমেশ পেরে ওঠে না। কারণ, কোনও ঘটনার কোনও কারণ বা বিবরণ প্রায় নেই। যেমন বাংলাদেশ প্রসঙ্গ যখন ওঠে, তখন তা দেখানোর কারণ সমকালীন বাংলাদেশের পরিস্থিতি ছাড়া আর কিছুই বলে ব্যাখ্যা করা যায় না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত তথা ইন্দিরা-সরকারের ঐতিহাসিক গুরুত্ব যিনি জানেন না, তিনি এই ছবি দেখে বিভ্রান্ত হবেন মাত্র। কঙ্গনার ছবি জরুরি অবস্থার ‘ক্র্যাশ কোর্স’ দেওয়ার চেষ্টা দেখিয়েছে। যাঁরা সে সময়টি সম্পর্কে জানেন, তাঁরা বুঝতে পারবেন কী কী বলা হল না। কোথায় ফাঁক থেকে গেল। আর যাঁরা জানেন না, তাঁরা বুঝতেও পারবেন না কেনই বা ইন্দিরা জরুরি অবস্থার ব্যবস্থা করলেন, কেন সঞ্জয় গান্ধীকে বেশি গুরুত্ব দিলেন, কেনই বা পরে সঞ্জয়-ইন্দিরার দূরত্ব তৈরি হল, আর কেন দ্বিতীয় বার আবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারলেন ইন্দিরা। তবে একটি কথা বেশ স্পষ্ট করে বুঝতে বলা হল পর্দায়, ইন্দিরার ‘খামখেয়ালিপনায়’ এ দেশ যখন জর্জরিত, তখনই জনতা পার্টির গঠনকাল। পরিবারগত রাজনীতি নয়, জনতার সরকার চায় সে দল এবং ইন্দিরা যে ফের শাসকের আসনে ফিরলেন, তা হল জনতা পার্টির জয়প্রকাশের পরামর্শ পালন করার পরে। যিনি কিনা সেই বালিকাবেলা থেকে ইন্দিরাকে দেখেছেন এবং তাঁকে গুড়িয়া বলে ডেকেছেন। পথ দেখিয়েছেন।
দেশের একমাত্র নারী প্রধানমন্ত্রীকে যে পদে পদে পুরুষশাসিত সমাজের বিদ্রুপের শিকার হতে হয়েছে, যেমন মেয়েদের হয়, তা দেখাতে ভোলেননি কঙ্গনা। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন থেকে ভারতের সেনাপ্রধান স্যাম মানেকশ— নানা সময়ে প্রধানমন্ত্রী নারী হওয়ার কারণে তাঁকে অসম্মান করেছেন বলে দেখানো হয়। সময়ে সময়ে সে সবের বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর দিতে দেখা যায় পর্দার ইন্দিরাকে। সে সব দৃশ্য মন্দও নয়। তবু ১৯৮০ সালে ইন্দিরা নিজের ক্ষমতায় যেন ফেরেন না শাসকের কেদারায়। থেকে যান ‘গুড়িয়া’ অর্থাৎ, পুতুল হয়ে। তা-ও আবার জনতা পার্টির এক সদস্যের। আর যখন যখন তিনি গুড়িয়াসুলভ আচরণ করেননি, নিজের মতো করে দেশের জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তখনই দেশ রসাতলে যাওয়ার জোগাড় হয়েছে। জরুরি অবস্থার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। মেয়েদের যেমন মাতৃত্ব অন্ধ করে দেয়, কঙ্গনার চিত্রনাট্যের এই শাসককেও করেছে। তাই যেন সঞ্জয়ের কথা শুনেছেন, ভুল করেছেন, আগুনে পুড়েছেন চিত্রনাট্যের ইন্দিরা। অর্থাৎ, পর্দার ইন্দিরা চরিত্রের সব ভুলই প্রায় থেকে গেল নারীত্বের সীমাবদ্ধতা হিসাবে।
যে প্রধানমন্ত্রীর আমলে জরুরি অবস্থার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়, সেই সময়ের রাজনৈতিক সমীকরণ কি এতটাই সরল হতে পারে? এত কোমল কি হয় একশো কোটির দেশের রাজনীতি? ব্যক্তি ইন্দিরার সময়ে নানা সীমাবদ্ধতা ছিল তো নিশ্চয়ই, যেমন বহু বহু শাসকের ক্ষেত্রে থেকেছে। কিন্তু গল্প বলার সীমাবদ্ধতা আরও বেশি হয়ে রয়ে গেল। এক অর্থে সময়টাকে পরিপূর্ণ ভাবে দেখা গেল না ছবিতে। যদিও ছবির শিরোনাম সময়টাকেই দেখানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
তবে কঙ্গনার রূপটান দেখার মতো। রূপটানশিল্পী ডেনিস মালিনোস্কির নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য এই ছবিতে। কঙ্গনাকে পর্দায় এক ঝলক দেখলে মনে হবে যেন সাক্ষাৎ ইন্দিরা বসে রয়েছেন। কিন্তু ওই পর্যন্তই। অভিনয় দুর্বল। না ধরা পড়ল এ দেশের একমাত্র নারী প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিত্ব, না বোঝা গেল তাঁর চরিত্রের গুরুত্ব বা আসল গলদ।
ছবির একেবারে শেষপ্রান্তে একটিই বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে ‘ইমার্জেন্সি’। ইন্দিরা ও তাঁর পরিবার-পরিজনেদের পুরনো বহু ছবি দেখানো হয়েছে। অন্তত আসলের সঙ্গে পর্দার ইন্দিরার ব্যক্তিত্বের যে ফারাক বিস্তর, সেটুকু দেখতে চাইলে দেখা যায় তাতে। উচ্চারণ না করেও বাস্তব ও সিনেমার মধ্যের দূরত্বটুকুর কথা বলে দেওয়া হয়েছে এ ভাবে।
অথচ এতটা দূরত্ব থাকত না যদি জরুরি অবস্থার সময়ে এ দেশের পরিস্থিতি, তখনকার সাধারণের জীবন, অনিশ্চয়তার কথা আর একটু বুঝিয়ে বলা হত। সময়টা কেন ছবিতে তুলে ধরা জরুরি, সেটুকুতেই ধরা থাকত। কিছু কিছু ঘটনার যে আলাদা করে নিন্দা করতে লাগে না, বাস্তবতাকে তুলে ধরাই যথেষ্ট। জরুরি অবস্থা তেমনই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy