এ
কা ঘরে নিজের কপালে সজোরে একটা চাপড় মারলেন ডক্টর সমর্থ। সেই কবেকার কথা। মেডিক্যাল কলেজ থেকে ইন্টার্নশিপ পেরিয়ে সদ্য প্র্যাক্টিস শুরু করেছেন। এক ধনী রক্ষণশীল সিন্ধি পরিবারের ছেলের বৌ। আত্মহত্যা করেছিল গলায় দড়ি দিয়ে। যথেষ্ট সন্দেহজনক ব্যাপার। ইয়া মোটা মোটা কয়েকটা নোটের বান্ডিল পকেটস্থ করে ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিয়েছিলেন সমর্থ। এ দিকে বৌটার বাপের বাড়িও নামী ব্যবসায়ী পরিবার। অগাধ পয়সাওয়ালা। মামলা টেনে নিয়ে গেছিল হাইকোর্ট অবধি। ডক্টর সমর্থের মেডিক্যাল কেরিয়ার যখন প্রায় খতম হওয়ার মুখে, প্র্যাক্টিশনার লাইসেন্স ক্যানসেল হয় হয়, সেই সময় ডাক্তার-বন্ধুদের মধ্যেই কেউ এক জন ওঁকে কর্পোরেটর বাবুরাও পাতিলের কথাটা বলেছিল। যোগাযোগও করিয়ে দিয়েছিল সেই বন্ধুই। ডোংরি মহল্লার ডন উসমান কালিয়াকে মেয়েটার বাপের বাড়িতে পাঠিয়েছিল বাবুরাও। পরিবারের কর্তার কপালে পিস্তল ঠেকিয়েছিল উসমানের ছোকরারা। সুড়সুড় করে তুলে নেওয়া হয়েছিল মামলা। বিনিময়ে বৌটার সসুরাল থেকে বড়সড় একটা অ্যাটাচি কেস পাঠানো হয়েছিল বৌটার বাপের বাড়িতে। মামলাটা সাল্টে দিয়ে বাবুরাও আর উসমানের পকেটে কত ঢুকেছিল সেটা জানা নেই, তবে ডাক্তারি লাইসেন্সটা
বেঁচে গেছিল ডাক্তারবাবুর। একই সঙ্গে ‘শয়তানের থেকে ধার নিলে শয়তানকেই সেটা
শোধ করতে হয়’— অন্ধকার জগতের পুরনো এই প্রবাদটা সম্ভবত জানতেন না ডক্টর সমর্থ।
ঘটনার কিছু দিন পর থেকেই একের পর এক ফরমায়েশ আসতে থাকে ডাক্তারের কাছে। যেগুলো চরম বিপজ্জনক, আর সর্বোপরি ভয়ঙ্কর রকম বেআইনি তো বটেই। কখনও কোনও মহিলার গর্ভস্থ ভ্রূণের জেন্ডার ডিটেকশন, কখনও ম্যাচিয়োর স্টেজে কোন সেলেব্রিটির ঝুঁকিপূর্ণ গোপন অ্যাবরশন, আবার কখনও গ্যাংওয়ার বা পুলিশি এনকাউন্টারে মারাত্মক রকম আহত কোনও গ্যাংস্টারের অপারেশন। কখনও বাবুরাও, কখনও উসমান— অন্যায় ফরমায়েশ আসা বন্ধই হল না। এর সঙ্গে গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো বছরখানেক হল যোগ হয়েছে এই কাজটা। যেটাকে বাকি কাজগুলোর তুলনায় আরও অনেক বেশি খতরনাক বলে মনে হয়েছে ডক্টর সমর্থের, একই সঙ্গে প্রচণ্ড মানসিক চাপেরও। বাট নাথিং ডুইং! শয়তানের কাছে ধার নিলে সে ধার তো শোধ করতেই হবে! সিস্টার ডিসুজ়াকে খবরটা দেওয়া দরকার, যাতে তৈরি থাকে। টেবিলের কোণে রাখা কলিং বেলটায় চাপ দিলেন ডাক্তার।
অবিনাশ কবিরাজ রোয়ে নিজের বাড়ির দোতলায় একদম কোণের দিকে একটা ছোট ঘর। ছিমছাম পরিপাটি। ঘরে আসবাবপত্র বলতে তেমন কিছু নেই। একদম মাঝখানে ধবধবে পরিষ্কার চাদর পাতা একটা খাট। পুরনো ডিজ়াইনের। খাটের ওপর একটা মখমলি তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসা কৌশল্যা সিং। সামনে দুটো চেয়ারে বসা চম্পা আর হামিদা। চম্পা, বয়স বছর পঁয়তাল্লিশ। সেই কবে নেপাল থেকে ওকে কিনে এনেছিল কৌশল্যা। ইদানীং ধান্দা ছেড়ে দিয়ে দিল্লি, মুম্বই, পুণে সব জায়গায় নেপালি মেয়েদের নিয়ে যায় কৌশল্যার হয়ে। বাংলাদেশি মেয়েদের বেলায় ওই একই কাজ করে হামিদা। চম্পারই বয়সি। ও নিজেও খুব ছোটবেলায় নোয়াখালির কোন প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এসে ঢুকেছিল এই ডেরায়। এ ধান্দায় এই খাটটার মতোই চারটে পায়া কৌশল্যা বাড়িওয়ালির। কিষান, চম্পা, হামিদা আর ও নিজে। এদের তিন জনকে নিজের চেয়েও বেশি বিশ্বাস করে কৌশল্যা।
ঘরের চার দেয়ালে অসংখ্য দেবদেবীর ছবি। খাট থেকে নেমে ঘরের চার দিক ঘুরে ঘুরে ছবিগুলোকে অনেক ক্ষণ ধরে প্রণাম করল কৌশল্যা। তার পর ফের খাটিয়ায় এসে বসে তাকাল চম্পার দিকে, “আজ রাত কা ট্রেন, সদানন্দ আর বৈজু ভাড়ুয়া, দু’জনে দুটো চালান নিয়ে এসেছে। মাল কিষানের জিম্মায় জমা আছে। বহোত কিমতি চিজ় হ্যায়। একদম সামহাল কে লে জানা হ্যায়, অওর উধার, ভি টি ইসটেসন মে কালিয়া উসমান কা এক ছোকরা আয়গা তুঝে লেনে কে লিয়ে, সমঝি?” বলতে বলতে কোমর থেকে একটা চাবির গোছা টেনে বের করে চম্পার দিকে ছুড়ে দিল কৌশল্যা, “রুপিয়া অওর আজ শামকা তিনঠো থিরি টায়ার এসিকা টিকট রাখখা হুয়া হ্যায় তিজোরি মে, মুম্বই কে লিয়ে। খোল কে লে লে।”
চাবিটা লুফে নিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠল চম্পা। দেয়ালের গায়ে দেবদেবীর ছবিগুলোর মধ্যে একটাকে সরাতেই পিছনে দেয়ালে গাঁথা ছোট লোহার সিন্দুক দেখা গেল। চাবি ঘুরিয়ে খুলতেই অনেকগুলো গয়নার বাক্স আর দড়ি-বাঁধা ছোট ছোট পুঁটুলি। সেগুলোর সামনে একটা মোটা নোটের বান্ডিল চাপা দেওয়া একটা ট্রেনের টিকিট। টিকিট আর বান্ডিলটা বের করে নিয়ে সিন্দুক বন্ধ করল চম্পা। ফের এসে দাঁড়াল কৌশল্যার সামনে।
কৌশল্যা বলল, “দুপুরে খেয়েই চলে যা কিষানের ওখানে। শ্যামবাজার তক পয়দল জানা। উঁহা সে ট্যাক্সি পকড় লেনা। মহল্লা মে কিসিকো কোই ভনক তকভি নেহি লগনি চাহিয়ে। সমঝি?”
“জি মালকিন,” কৌশল্যার কথায় ঘাড় নেড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল চম্পা।
রিপন স্ট্রিট ঘেঁষা সরু সরু বেশ কয়েকটা লেন আর বাই লেন পেরিয়ে হাতের ডান দিকে সিমেন্টের প্রলেপহীন, লাল ইটের দাঁত বার করা চারতলা বাড়িটা। এ মহল্লার ভাষায়, ‘আনলিগ্যাল’। সন্ধে সাড়ে সাতটা মতো হবে। কম পাওয়ারের একটা সিএফএল লাইট জ্বলছে বাড়ির ছাদে। ছাদের মাঝখানে জায়নামাজের ছোট আসনটা পেতে ইশার নমাজ পড়ছিলেন রফিকমিয়াঁ। একটু দূরে দুটো প্লাস্টিকের চেয়ারে নীরবে অপেক্ষরত দু’জন, রুদ্র আর মজিদসাহেব। একমনে বসে ভাবছিল রুদ্র। কত দিন পর দেখা হল রফিকমিয়াঁর সঙ্গে। দেখামাত্র মনের মধ্যে অনেক স্মৃতির লাবডুব। এক সময় কলকাতার আন্ডারওয়ার্ল্ডে যে ক’জন খলিফার নাম খুব ইজ্জতের সঙ্গে উচ্চারণ করা হত, রফিক তাদের অন্যতম। পুলিশের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে অপরাধজগতের বহু পুরনো একটা চিরকেলে সম্পর্ক। বহু জটিল কেসের রহস্য সমাধানে ক্রিমিনালদের থেকে সাহায্য, মানে ইনফর্মেশন নিতেই হয় সব তদন্তকারী অফিসারদের। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অপরাধীরা ইনফর্মেশন দেয় খানিকটা ভয়ে, খানিকটা ভক্তিতে। নইলেই পুরনো কোন কেস কবর খুঁড়ে বের করবে। নয়তো এক গাদা উল্টোপাল্টা কেস কানেকশন দিয়ে লম্বা মেয়াদে ভেতরে পাঠিয়ে দেবে। কিন্তু রুদ্রর সঙ্গে প্রথম থেকেই একটা অন্য রকম সম্পর্ক রফিকের। বহু জটিল কেসের মোড় ঘুরে গেছে রফিকের দেওয়া এক-একটা ইনফরমেশনে। তবে এর জন্য অন্য অনেক অফিসারদের মতো কোনও দিন ওকে কোনও রকম ব্ল্যাকমেল করেনি রুদ্র। চাপ দেয়নি এতটুকু। নিজের বুদ্ধি আর আন্দাজমতো কাজ করতে দিয়েছে রফিকমিয়াঁকে। ফলে ভয় পেয়ে বা চাপে পড়ে কাজ করেনি রফিক, করেছে ভালবেসে। আর এটাই বার বার সাফল্য এনে দিয়েছে রুদ্রকে। আর সব শেষে ওই অন্বেষা মিত্র মার্ডার কেসটায় রফিকের অবদান তো ভোলার নয়। সে সময় আন্ডারওয়ার্ল্ড থেকে অবসর নিয়ে পুরোদস্তুর পাঁচ ওয়াক্তের নমাজি বনে গেছিল ও। কালা ধান্দাকে তওবা করে দিয়েছিল বরাবরের মতো। রিপন স্ট্রিটের ওপর একটা খাবার হোটেল চালিয়ে দিন গুজরান করত। তবু শুধুমাত্র রুদ্রর কথায় ওই কেসটায় সাহায্য করতে রাজি হয়েছিল রফিকমিয়াঁ। শহরের কালো দুনিয়ার তাবড় তাবড় খিলাড়িকে এনে জড়ো করেছিল ওর হোটেলে। কথা একটাই, এই কেসটার ব্যাপারে যে যা খবর পাবে, সেই সব ইনফর্মেশন রুদ্রস্যরকে দিতে হবে। আর সেই টিপ্সের ওপর নির্ভর করেই আসল অপরাধীদের কাছে পৌঁছতে পেরেছিল রুদ্র। মজিদসাহেব বলেছেন, ওর সেই হোটেলের জিম্মাদারিও ছেলেদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে রফিকমিয়াঁ। বলতে গেলে বাড়িতেই থাকে সব সময়। কিন্তু কানাঘুষোয় শোনা যায়, এখনও অন্ধকার জগতের এক সে বড়কর এক খলিফারা বড় ধরনের কোনও সমস্যায় পড়লেই ছুটে আসে রফিকের কাছে। তা সে প্যাঁচালো রকম পুলিশ কেস অথবা হিস্সার ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে দুই গ্যাংয়ের মধ্যে মারামারি, যা-ই হোক না কেন।
নমাজ পড়া শেষ করে উঠে দাঁড়াল রফিকমিয়াঁ। সযত্নে চার ভাঁজ করে গুটিয়ে রাখল জায়নামাজের আসনটা। সঙ্গে সঙ্গে একটা ছেলে, বছর পঁচিশ-ছাব্বিশ, দ্রুত এসে আসনটা নিয়ে নিল রফিকের হাত থেকে। সসম্ভ্রমে সরে দাঁড়াল এক পাশে।
“অওর একঠো কুর্সি লা রে শামিম, অওর তেরা চাচিকো বোল চায় ভেজনে কে লিয়ে,” ছেলেটাকে নির্দেশ দিয়ে সামনে এগিয়ে এল রফিকমিয়াঁ। বেশ কয়েক বছর হল ষাট পেরনো শরীর এখনও ছিপছিপে, টানটান। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির সঙ্গে মিশে রয়েছে একটা চাপা অসন্তোষ। তত ক্ষণে আর একটা চেয়ার এনে সামনে রেখেছে ছেলেটা।
“আপনি ফির কেন লওট এলেন স্যর?” চেয়ারে বসেই প্রথম প্রশ্নটা করল রফিক, সরাসরি রুদ্রর চোখে চোখ রেখে। অসন্তোষটা কথায়ও প্রকাশ পাচ্ছে এই মুহূর্তে। দৃশ্যতই একটু অবাক রুদ্র।
“এলাম, সময় ডাকল তাই,” চটজলদি নিজেকে সামলে নিয়ে উত্তর দিল একই রকম মুচকি হেসে। তবুও কুঁচকে থাকা ভুরুজোড়া যেন ঠিক সোজা হল না রফিকের। “বোলিয়ে স্যর, কিস কাম কে লিয়ে আপ আয়ে হ্যায় মেরে পাস?”
ইতিমধ্যে চা এসে গেছে। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে মিনিটদশেক ধরে সংক্ষেপে পুরো ঘটনাটা বলল রুদ্র।
“হুম!” অসন্তোষের সঙ্গে এ বার বেশ খানিকটা উদ্বেগ রফিকের চোখেমুখে, “দেখিয়ে স্যর, ইয়ে আপকা কাম হ্যায়। অলগ সে কুছু বোলতে হোবে না। মেরা পুরা সোর্স অওর ফোর্স লাগা দেঙ্গে ইস কাম কে পিছে। লেকিন আপনি সাবধানে থাকবেন।” শঙ্কাটা পুরোপুরি ধরা পড়ল গলায়। জবাবে বেশ খানিকটা বিরক্ত ভাবেই রফিকের দিকে তাকাল রুদ্র।
“হঠাৎ এ কথা কেন বলছ বলো তো রফিকমিয়াঁ? আগে তো কোনও দিন এ ভাবে বলতে শুনিনি।”
জবাবে ভারী ম্লান মুখে হাসল একদা শহরের দোর্দণ্ডপ্রতাপ বাহুবলী, “ইস লিয়ে, কি পহলে কভি অ্যায়সা সপনা ভি নেহি দেখা ম্যায়নে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy