অমিতাভ চন্দ্র
এনাকে বলেছিলাম ওকে নিয়ে আমি দার্জিলিং আসব। ও বলেছিল, “ধ্যাত, কে যাবে দার্জিলিং! আমি তো সুইস আল্পস যেতে চাই!” ওর ব্যাপারই আলাদা। আমি সুইস আল্পস গিয়েছি। খুব সুন্দর। কিন্তু তাতে দার্জিলিঙের সৌন্দর্য কমে না একটুও। এখানে আসার আনন্দও কমে না এক ফোঁটা।
আমি দেখেছি, সাধারণ ভাবে বিদেশ যাওয়া নিয়ে অনেকের মধ্যে একটা চাপা হ্যাংলামো থাকে। দেখলে গা-পিত্তি জ্বলে যায় আমার। এনারও ওটা ছিল। রাগ হলেও আমি সেটা মেনে নিতাম। আসলে প্রেমে পড়লে মানুষ অনেক কিছু মেনে নেয়, যা এমনি সময়ে সে কিছুতেই মানতে চায় না।
শিলিগুড়ি থেকে গাড়ি করেই এসেছি আমরা। না, এখানে আর ওই পাবলিক ট্রান্সপোর্টের
ভরসা করিনি।
ওই দীর্ঘ পাক খাওয়া পথ, লম্বা লম্বা পাইন গাছের সারি, সরু সরু বাঁশের ঝাড়, আরও কত যে গাছ, আচমকা ছিটকে যাওয়া পাহাড়ি ঝোরা, গাড়ির গা ঘেঁষে সরে যাওয়া, নীচের দিকে নেমে যাওয়া মেঘ, আচমকা সামনে খুলে যাওয়া আল্ট্রামেরিন ব্লু আকাশ, পাশ দিয়ে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলতে খেলতে যাওয়া টয় ট্রেনের লাইন— দার্জিলিং আমার অল টাইম ফেভারিট।
“কী দাদা, বেড়াতে বেরোবে না?” সুদীপ্ত এসে দাঁড়াল পাশে।
আমি বললাম, “তোর স্নান হয়ে গেল?”
“হ্যাঁ। সারা ক্ষণ গরম জল আছে। অসুবিধে নেই,” বলল সুদীপ্ত।
“চল তা হলে...” আমি সামনের দিকে
পা বাড়ালাম।
সুদীপ্ত বলল, “ছাতা নিলাম দুটো। আসলে এটা তো ঠিক টুরিস্ট সিজ়ন নয়। বর্ষায় ক’টা লোকই বা আসে। ল্যান্ডস্লাইড হওয়ার চান্স থাকে। পাহাড়ে বৃষ্টিরও কোনও ভরসা নেই। তাই না!”
আমি হেসে বললাম, “তুই তো পুরো রাজু গাইড! খুব ঘুরিস না আজকাল?”
সুদীপ্ত লজ্জা পেল সামান্য। বলল, “আসলে আমি একটা স্কুটি কিনেছি। সেটা করে মাঝে মাঝেই কাছে-পিঠে ঘুরতে চলে আসি।”
আমি আর কথা না বাড়িয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। সামান্য একটা ঠান্ডা ভাব রয়েছে। খাদের ধারের রাস্তাটা আমার প্রিয়। বড় বড় পাইন গাছ আছে এখানটায়। তার পাতা পড়ে রাস্তাটা বেশ সবুজ হয়ে আছে। ভরা বর্ষা বলে চার দিকের সবটাই সবুজ। আজ সকালেও খুব বৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু এখন বৃষ্টি নেই। তবে মেঘ আছে। যে কোনও সময়ে নামবে। নামুক। আমার কী! আমার মনে হয় বৃষ্টির সময়ের পাহাড়ের মতো সুন্দর আর কিছু নয়।
রাস্তাটা এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে চৌরাস্তার দিকে। সামান্য উঁচু ওই জায়গাটাই ছোট্ট দার্জিলিং শহরের প্রাণকেন্দ্র।
সুদীপ্ত বলল, “দাদা, তুমি মোবাইল ইউজ় করছ না কেন?”
আমি ওর দিকে তাকিয়ে হাসলাম সামান্য। আগে সুদীপ্ত ক্লিন শেভ করত। এখন চাপ দাড়ি রাখে। চোখে চশমা।
আমি ওকে বললাম, “তুই এমন লুক চেঞ্জ করলি কেন বল।”
সুদীপ্ত কিছু বলতে গিয়েও হাসল। তার পর বলল, “বাদ দাও।”
ছত্রিশ দিন হল। এ বার বাদ দিতে চাই, সত্যি। মনে মনে বলে আমি চোয়াল শক্ত করলাম। চৌরাস্তা থেকে ডান দিকে একটা রাস্তা সামান্য নেমে গিয়েছে। আমরা ওই দিকে এগোলাম।
এখন বিকেল চারটে বাজে প্রায়। সকালে ব্রেকফাস্টের পরে আর কিছু খাওয়া হয়নি। গ্লেনারিজ়ে যাব এ বার। দার্জিলিং-এ এসে এখানে না খেলে মনে হয় কী যেন একটা করিনি।
রাস্তায় ভিড় প্রায় নেই। আমার ভিড় অসহ্য লাগে। ফাঁকায় ফাঁকায় ভাল লাগছে বেশ। সুদীপ্ত চুপচাপ ছেলে। নিজে থেকে খুব একটা বেশি কথা বলে না।
আমি বললাম, “তোর কি এটাই ফাইনাল ইয়ার?”
“হ্যাঁ,” মাথা নাড়ল ও, তার পর বলল, “কাকিমাকে জানিয়েছ যে, ভাল ভাবে পৌঁছে গিয়েছ?”
আমি মাথা নাড়লাম। কী করে জানাব আর! ফোন নেই যে!
সুদীপ্ত নিজের মোবাইল আনলক করে আমার হাতে দিয়ে গম্ভীর ভাবে বলল, “কল করো।
এখনই করো।”
ছেলে ছোট, কিন্তু পার্সোনালিটি আছে।
আমি মাকে কল করলাম। দু’বার রিং হতেই মা ধরল ফোনটা, “পৌঁছে গিয়েছিস? এটা কার নাম্বার? কী খেয়েছিস? ফুল সোয়েটার পরেছিস তো? আর ওয়াটারপ্রুফ? শোন, যা বলেছি মনে আছে তো? পাহাড়ি মেয়ে কিন্তু আমি মেনে নেব না! এটা কি কোনও
মেয়ের নাম্বার?”
আমি কান থেকে ফোনটা সরিয়ে এক বার ফোনটা দেখলাম। সত্যি মানুষ কেমন কেমন সব বাঁশ আবিষ্কার করে! নাও এখন এ সবের উত্তর দাও।
“কী রে, চুপ করে কেন? মেয়েটা পাশেই আছে, না? এর জন্য কি তোর মনখারাপ ছিল? তাই কি গিয়েছিস ওর সঙ্গে দেখা করতে?” মা আবার
প্রশ্ন করল।
“মা!” আমি সামান্য চেঁচিয়েই উঠলাম, “কী হয়েছে তোমার! এটা সুদীপ্তর নাম্বার। ও বলল তোমায় ফোন করে জানাতে যে সেফলি এসে গিয়েছি! আর কোন পাহাড়ি মেয়ে! আমি কাউকে তেমন চিনিই না এখানে! কী সব বলছ তুমি?”
মা থমকাল খানিক ক্ষণ। তার পর বলল, “তাও বলে রাখলাম। ঠান্ডা লাগাবি না। ওয়াটারবেরিস কম্পাউন্ড কিনে নে। রোজ শোওয়ার আগে এক চামচ খেয়ে নিবি।”
“বাবা ঠিক আছে?” আমি মায়ের কথার উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
“হ্যাঁ, আছে। তুই ঠিক মতো খাবি কেমন? আর শোন, সাবু এসেছিল। ওকে বলিসনি যে, তুই দার্জিলিং যাচ্ছিস? মেয়েটার সঙ্গে এমন দুর্ব্যবহার করছিস কেন বল তো! এক সময় তো...”
“আমি রাখছি মা। টাওয়ারে গোলমাল হচ্ছে। পরে ফোন করব,” মাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে ফোনটা কেটে দিলাম।
সুদীপ্ত হাসল আমার দিকে তাকিয়ে। তার পর নিজের ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে বলল, “এই দু’দিন সব ভুলে যাও দাদা। কে আমাদের কী বলল! কে কী করল! কে কী করল না! কে পিঠে ছুরি মারল! কে আমাদের টেকেন ফর গ্রান্টেড নিল! কে আমাদের ইউজ় করল! সব ভুলে যাও। লেট’স চিল।”
গ্লেনারিজ়-এর খোলামেলা বসার জায়গায় আমরা বসলাম। সুদীপ্ত বলল, “আমি হট চকোলেট খাব। সঙ্গে চিকেন স্যান্ডউইচ। দাদা তুমি?”
আমি কিছু বলার আগেই পাশ থেকে কেউ বলে উঠল, “জো দিল চাহে অর্ডার করো। টাকার চিন্তা
না করে।”
গলাটা শুনে চমকে গেলাম। তাকিয়ে দেখলাম, চন্দন সিং! এখানে? দার্জিলিং-এ! কী করে সম্ভব!
সুদীপ্ত ঘাবড়ে গিয়ে তাকাল আমার দিকে। আমি হাত তুলে ওকে আশ্বস্ত করলাম।
চন্দন চেয়ার টেনে বসল আমার পাশে।
আমার অফিসের কথা মনে পড়ে গেল। সে দিন ব্যাটাকে প্রায় ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বার করে দিয়েছিলাম অফিস থেকে। একটা কথাও বলতে দিইনি। অনেক কাকুতি মিনতি করেছিল। কিন্তু এটা কী করে হল! এ ভাবে একদম দার্জিলিং-এ! জানল কী করে যে আমি এখানে আছি!
মুখটা তেতো হয়ে গেল আমার। মেঘ ভেঙে সূর্য বেরচ্ছে এখন। গ্লেনারিজ়-এর বারান্দায় কত রকমের যে আলো! নীচে ছড়িয়ে আছে ছবির মতো শহর! সেখানে এই মূর্তিমান শয়তানটা কী করছে!
“অবাক হচ্ছেন?” চন্দন মুচকি হাসল।
আমি কিছু না বলে তাকিয়ে থাকলাম। কী বিশাল বড় মুখ লোকটার! একটা গাল কামাতেই তো একটা ব্লেড লেগে যায়! চশমার ও পারের কুতকুতে চোখগুলো দেখলেই বোঝা যায় লোকটা ভাল নয়।
আমি চোয়াল শক্ত করে বললাম, “আমি এখানে জানলেন কী করে?”
“এটা আর শক্ত কী!” চন্দন হাসল, “অফিসে ফোন করলাম যে আপনি কোথায়। জানলাম এখানে এসেছেন। আমিও প্লেন ধরে চলে এলাম।”
“দেখুন, আমি এখানে ছুটিতে এসেছি। কাজে নয়। সো প্লিজ় লিভ মি অ্যালোন।” কেটে-কেটে বললাম আমি।
“আরে বিজ়নেস ইজ় বিজ়নেস! সারা ক্ষণ আমাদের সঙ্গে থাকে। সেখান থেকে ছুটি নেওয়া যায় না। সে দিন আমায় অপমান করে তাড়িয়ে দিলেন। আমি কি রাগ করেছি? করিনি! বিজ়নেস ডাজ়ন্ট অ্যালাও মি টু। এই যে এখানে এসেছি, তাতে আমার লাভ আছে, আপনারও! বুঝলেন?”
“মানে?” আমি ভুরু কুঁচকে তাকালাম।
সুদীপ্ত বলল, “দাদা, তোমরা কথা বলো।
আমি বরং...”
আমি বললাম, “কোথাও যাবি না। তুই বোস।” তার পর চন্দনের দিকে তাকিয়ে বললাম, “আপনি বাংলা বলেন ভাল। কিন্তু বোঝেন না বোধহয়! আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী নই।”
চন্দন পাত্তা না দিয়ে বলল, “আপনার ছোটকাকা রাজারহাটে একটা বড় ডুপ্লে বুক করেছে, জানেন?”
আমি থমকে গেলাম। ছোটকা! রাজারহাটে!
“জানেন না তো!” চন্দন হাসল, “বিজ়নেস আপনাদের তিনটে শেয়ারের। কিন্তু সবটা কি ফেয়ার হয় না কি? আপনার জেঠু পাশাপাশি গোয়ায় হোটেলের বিজ়নেসে ইনভেস্ট করছেন। এটাও তো জানেন না! আর আপনার পিতাজি অসুস্থ হয়ে বিছানায়!”
আমি কী বলব বুঝতে না পেরে শুধু
তাকিয়ে রইলাম।
চন্দন সামনে রাখা একটা পেপার টাওয়েল ভাঁজ করতে করতে বলল, “এভরিবডি ইজ় মিল্কিং ইয়োর বিজ়নেস, বাট ইউ পিপল। লাস্ট ইয়ার একটা বড় কাজ পাননি আপনারা। রেলের। আপনার ছোটকাকা লিকড ইয়োর প্রাইস টু ইয়োর কম্পিটিটর। হি গট হিজ় রিওয়ার্ড।”
আমার মাথা ঘুরছে। এ সব কী বলে যাচ্ছে লোকটা! ছোটকা! জেঠু! এরা এ রকম! এ
সব সত্যি!
চন্দন আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। তার পর বলল, “আপনি ইয়াং। আপনি বুঝবেন। আমরা তো রোজগার করতে নেমেছি। নাথিং ইজ় ব্যাড অর ইমমরাল। এভরিথিং ইজ় বিজ়নেস। বাগালের কাজে আপনাদের প্রাইসটা জাস্ট আমায় জানিয়ে দিন। আপনি এক কোটি টাকা পেয়ে যাবেন। সঙ্গে ইওরোপ টুর করিয়ে দেব আপনাকে উইথ এ প্রিটি কম্প্যানিয়ন। দ্য মানি উইল বি ইয়োর্স। নট ইয়োর ফাদার্স। নট ইয়োর আঙ্কেলস। বাট ইয়োর্স। আপনি ‘না’ করলে আমি যাব আপনার ছোটকাকার কাছে। উনি কিন্তু ফেরাবেন না। কী বলেন!”
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।
চন্দন হাসল। চোখ টিপে বলল, “আরে টেনশন নেবেন না। আপনি তো দু’দিন আছেন। টাইম নিন। ইজ়ি থাকুন। উঠেছেন কোথায়? একটা কথা বলি? মেফেয়ারে আমি থাকার বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি। প্লাস এই বয়স। আরও কিছু বন্দোবস্ত করে দেব। মন অর শরীর ঠান্ডা হো তো, ডিসিশান লেনে মে আসানি হোতি হ্যায়!”
কোনও মতে বললাম, “আপনি প্লিজ় আসুন।”
চন্দন হাসল আবার। তার পর বলল, “আমি এত দূরে আপনাকে ফলো করে এসেছি, এমনি নয়। আমি তো আসব ঠিকই। কিন্তু এই অপরচুনিটি আর আসবে না। এক কোটি টাকা নেগোশিয়েবেল। আপনি কী চান সেটা বলুন। কেমন? লাইফে অপরচুনিটি মিস করবেন না জুনিয়ার বস। এত টাকা এই বাজারে মিস করবেন না। এই প্রজেক্ট দুটো আমায় দিয়ে দিন। আমি ঝাড়খণ্ডে আপনাকে ভাল প্রজেক্ট ধরে দেব। প্রমিস। বিজ়নেস শিখুন। নিজেরটা বুঝুন। কেমন? ফির মিলতে হ্যায়। বাই!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy