Advertisement
২১ ডিসেম্বর ২০২৪
Smaranjit Chakrabarty

চুয়ান্ন

এ জীবন কী? শূন্যতায় গড়া এক খণ্ড সময়? মনে হল, এত ক্ষণে ওরা নিশ্চয়ই কোনও কাফে বা রেস্তরাঁয় গিয়ে বসেছে! মেকআপ কিস-ও কি হয়ে গিয়েছে?

ছবি: অমিতাভ চন্দ্র।

ছবি: অমিতাভ চন্দ্র।

স্মরণজিৎ চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০২১ ০০:৫২
Share: Save:

এ মেয়ে তো গড়িয়াহাটে শপিং করতে বেরিয়েছে! এই দোকান পছন্দ নয় তো চলো অন্যটায়!

এনা বলেছিল, “তুই শিয়োর তা হলে যে, ও আমায় সত্যি ভালবাসে, রাইট?”

আমি শুধু বলেছিলাম, “না হলে ক্লিঙি হত?”

সে দিনের পর আজ সকালে আবার ফোন করেছিল এনা। তখন বাড়িতে একটু টেনস অবস্থা। তাই প্রথমে ধরতে পারিনি। আসলে তখন দিদির সঙ্গে কথা হচ্ছিল আমার।

গতকাল দিদি খুব আনন্দে ছিল। দীপ্যদা নাকি আবার যোগাযোগ করেছে। বলেছে, টেম্পোরারি একটা স্ট্রেসের জন্য ও সব ব্রেকআপ-টাপ বলে ফেলেছে। কিন্তু মলিকেই নাকি আসলে ভালবাসে!

আমি সারা রাত চিন্তা করেছিলাম আমার কী করা উচিত এ ব্যাপারে। তার পর ঠিক করেছিলাম, এ বার সময় এসেছে সত্যিটা বলে দেওয়ার।

দিদির কাছে তাই সকালেই গিয়েছিলাম আমি।

দিদি আমায় দেখে একটু অবাকই হয়েছিল। আমি দিদির সঙ্গে খুব একটা কথা বলি না। আর ইদানীং তো একদমই বলছিলাম না।

“কিছু বলবি?” দিদির গলাটা উজ্জ্বল শোনাচ্ছিল।

আমি একটু সময় নিয়ে বলেছিলাম, “দিদি, একটা কথা বলার ছিল। দীপ্যদাকে নিয়ে।”

“দীপ্য!” আমার কথা বলার মধ্যে কি কিছু ছিল! দিদি সচকিত হয়ে উঠেছিল।

আমি বলেছিলাম, “সরি ফর বিয়িং আ মুড স্পয়লার। কিন্তু দীপ্যদাকে না বলে দে।”

“বিকজ়...” দিদি ভুরু তুলেছিল।

“বিকজ় হি ইজ় আ লায়ার অ্যান্ড আ ডিসিভার।”

“মানে?” দিদি তাকিয়েছিল আমার দিকে।

আমি বসেছিলাম দিদির সামনে। তার পর গুছিয়ে সব বলেছিলাম। মানে সেই চুমু থেকে লাস্ট দিনের সেই কাফের ঘটনা। সব। দিদি একদম থমকে গিয়েছিল। কী বলবে বুঝতে পারছিল না। আমি বুঝেছিলাম, দিদি বিশ্বাস করতে পারছে না কিছু। আমি আমার মোবাইলের মেসেজ বক্স খুলে ওর হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, “সব রেখে দিয়েছি। পড়। পড়ে দেখ।”

দিদি তাকিয়েছিল আমার দিকে। তার পর আস্তে করে হাতটা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলেছিল, “দেখে কী করব সাবু! আমি বিশ্বাস করি তোকে।”

আমি বলেছিলাম, “দিদি ইউ ডিজ়ার্ভ বেটার। এটাই বলার ছিল তোকে। এর পরও যদি তুই কন্টিনিউ করতে চাস তো... মানে আফটার অল ইট্স ইয়োর লাইফ!”

দিদি হেসেছিল। বিষণ্ণ হাসি। সেই তরতাজা ভাবটা নেই। বলেছিল, “তোর কী মনে হয়, এর পর আমি কী করব?”

আমি হেসেছিলাম। তার পর ওকে সামান্য ঠেলে বলেছিলাম, “আরও ছেলেদের মাথা খাবি। আর সেই নিয়ে আমরা দু’জনে আড্ডা দেব আর খিল্লি করব! রাইট!”

দিদি চোখ নামিয়ে হেসেছিল। তার পর চোখ তুলে বলেছিল, “ট্রু টু দ্য হিল্ট সিস।”

আমি বলেছিলাম, “মনখারাপ করবি না।”

দিদি মাথা নেড়েছিল। তার পর বলেছিল, “যাস না নর্থ বেঙ্গল! থেকে যা কলকাতায়!”

কলকাতা! কলকাতা, আমি কেন থাকব তোমার কাছে? কী হবে থেকে? আমি কাজ করে যাব এক দিকে, আর অন্য দিকে পুঁটি এনার সঙ্গে... না! কেন থাকব তোমার কাছে কলকাতা?

আমি নাকতলা পেরোতে পেরোতে দেখলাম ঘড়িতে চারটে বাজে প্রায়। ওরা কি দু’জনেই রাসবিহারী মোড় পৌঁছে গিয়েছে? নিশ্চয়ই গিয়েছে। আমার সারা শরীর কেমন করে উঠল। মনে হল উল্টো দিক থেকে আসা বড় বাসটাকে সোজা হেড অন গিয়ে মারি আমার ছোট্ট স্কুটিটা দিয়ে! কেন এনা, কেন? আমি তো তোর কোনও ক্ষতি করিনি। কেন তুই সকালে ফোন করলি আমায়! সারা দিনটা নষ্ট করে দিলি? জীবনটা নষ্ট করে দিলি?

দিদির ঘর থেকে এসে আমি এনাকে ফোন করেছিলাম। ভেবেছিলাম, ভালই হল। ওর জিনিসগুলো ওকে ফেরত দিতে হবে। সেটা আবার বলব।

কিন্তু আমার ফোন রিসিভ করে এনা আমাকে কোনও কথা বলারই সুযোগ দেয়নি। ও ঝরঝর করে ঝরে পড়া ঝরনার মতো বলেছিল, “আজ চারটের সময় আমি আর পুঁটি রাসবিহারী মোড়ের বড় জুতোর দোকানটার সামনে দেখা করব। আমি ফোন করেছিলাম। তবে আমি গ্র্যাভিটি নিয়েই কথা বলেছি। ও বলেছে আসবে। আই উইল টেল হিম যে আই মিসড হিম। উই উইল বি টুগেদার আগেন! সাবু, আয়াম সো এক্সাইটেড! সত্যি।”

আমার হাত অবশ হয়ে গিয়েছিল। এটা আমি আশা করিনি! এনা এটা কী বলল! আর পুঁটিও রাজি হয়ে গেল! এত দিন ধরে মেয়েটা ওকে ইগনোর করল। অপমান করল। সব ভুলে গেল! এক বার ডাকল মেয়েটা, আর অমনি জিভ বের করে চলে যাবে!

আমার মনে হচ্ছিল বুকের ভেতরটা ভেঙে যাবে একেবারে। মনে হচ্ছিল এক্ষুনি চলে যাই নর্থ বেঙ্গল। কিন্তু সেখানে এখনই এ ভাবে যেতে পারব না। তাই ঠিক করেছিলাম বিকেলে আমি লামাদাদুর বাড়িতে চলে যাব। ওই সময়টা পার করতে লামাদাদুকে আমার খুব দরকার।

লামাদাদুর বাড়িতে যখন পৌঁছলাম, ঘড়ির কাঁটা চারটে পেরিয়ে বেশ কিছুটা গড়িয়ে গিয়েছে। আমার বুকের মধ্যে কেমন একটা লম্বা শুকনো কুয়ো ঢুকে গিয়েছে যেন। কষ্ট হলে সব কিছুই অনর্থক লাগে। আমার আবার মনে হল, এ জীবন কী? শূন্যতায় গড়া এক খণ্ড সময়? মনে হল, এত ক্ষণে ওরা নিশ্চয়ই কোনও কাফে বা রেস্তরাঁয় গিয়ে বসেছে! মেকআপ কিস-ও কি হয়ে গিয়েছে?

স্কুটিটা পার্ক করলাম বাগানের এক পাশে। বাগানটা সেই বিপাশাদি আর ওর স্বামী এসে সুন্দর করে গুছিয়ে দিয়ে গিয়েছে।

দেখলাম পাড়ার কয়েকটা অল্পবয়সি ছেলে আর লেবুদা, লামাদাদুর বাগানের এক পাশে শর্ট হ্যান্ড ক্রিকেট খেলছে। ওরা আমায় চেনে। আমিও ওদের সঙ্গে মাঝে মাঝে খেলি।

আজও আমায় দেখে, “দিদি, খেলবে?” বলে হাত তুলে ডাকল।

আমি মাথা নাড়লাম। আর তখনই বুঝলাম আমার চোখ দিয়ে জল পড়ছে। এ কী, আমি কাঁদছি! আমার আচমকা নিজের জন্য কষ্ট হল। ইস, এ কী করছি আমি? দ্রুত হাতে চোখ মুছে আমি নিজেকে ঠিক করা চেষ্টা করলাম। নিজের জন্য কষ্ট পাওয়ার থেকে খারাপ আর কিছু হয় না। এ ভাবে কেন পাচ্ছি কষ্ট! আমার কি কোনও মানসম্মান নেই!

না, নেই মানসম্মান! কী করব কষ্ট হলে? কান্না পেলে? আমি টারজান না কি? নাকি ব্রুস ওয়েন? আমার কষ্ট হয়। হচ্ছে। কী করব? পুঁটি কেন এমন করল!

আমি কোনও দিকে না তাকিয়ে দৌড়ে বাড়ির ভিতরে গেলাম। তার পর ভূতে পাওয়া মানুষের মতো দোতলায় উঠলাম দু’টো করে সিঁড়ি টপকে। ভুলে গেলাম এখনও পুরো ঠিক হয়নি আমার চোট!

আমার পায়ের শব্দে লামাদাদু বেরিয়ে এল ঘর থেকে। তার পর আমায় দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আমি কোনও দিকে না তাকিয়ে সোজা গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম লামাদাদুকে। আর সমস্ত ‘আমি’-টা কান্না হয়ে ঝরে পড়ল লামাদাদুর বুকে।

লামাদাদু আমার মাথায় হাত দিল। নরম গলায় বলল, “কী হয়েছে রে? কী হয়েছে তোর, পাগলি?”

আমি কথা বলতে পারছি না। চোখের জলের তলায় পায়ে পাথর বাঁধা মানুষের মতো হাঁসফাঁস করছে কথারা। ভেসে উঠতে চাইছে কিন্তু পারছে না! দম আটকে আসছে যেন।

লামা দাদু আমার কানে কানে বলল, “কী হয়েছে সেটা বুঝেছি। কিন্তু নিজের কান্না না থামালে তুই আসল জিনিসটা শুনবি কী করে? কান্না থামা। তার পর শোন।”

আমি কিছু না বুঝে মুখ তুললাম।

লামাদাদু অদৃশ্য সুদর্শন চক্র হাতে নেওয়ার মতো করে বলল, “লিস্‌ন!”

আমি অবাক হয়ে ওপরের দিকে তাকালাম। তার পর শুনলাম শব্দ! হাতুড়ির! ছাদের দিক থেকে আসছে। আমি তাকালাম লামাদাদুর দিকে।

লামা দাদু হাসল, মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ। যেখানে যাওয়ার, দেখা করার, পাখি সেখানে যায়নি! দাঁড়ে ফিরে এসে বসেছে!”

আমি লামাদাদুকে ছেড়ে এ বার ছাদের দিকে গেলাম। কিসের শব্দ ওটা? কী হচ্ছে ছাদে? আর যায়নি মানে? কে যায়নি? দেখা করেনি মানে? কে দেখা করেনি? পাখি? কোন পাখি?

আমি ছাদের দরজার কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। দেখলাম, পাখিদের বসার জায়গাগুলো প্রায় ঠিক হয়ে গিয়েছে। আর ওর সামনে হাতুড়ি নিয়ে, একটা ছেঁড়া-ফাটা, গোল গলা টি-শার্ট আর শর্টস পরে ঘেমে-নেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে পুঁটি!

আমার পায়ের শব্দে ও মুখ ফিরিয়ে তাকাল।

আমি চোখে জল নিয়ে তার মধ্যে দিয়ে লেন্সে আলো পড়া ছবির মতো দেখতে লাগলাম পুঁটিকে। অস্ফুটে জিজ্ঞেস করলাম, “তুই এনার সঙ্গে দেখা করতে যাসনি! না দেখা করে এখানে কী করছিস?”

পুঁটি আমার প্রশ্নটাকে পাত্তা না দিয়ে ভুরু কুঁচকে বলল, “যার-তার সঙ্গে আমি দেখা করি না। আর তুই নাকি নর্থ বেঙ্গল চলে যাচ্ছিস? ইয়ার্কি পেয়েছিস! আর আমার মেসেজের রিপ্লাই করিসনি কেন?”

আমি কোনও কথা বললাম না। শুধু মনে মনে বললাম, বেশ করেছি রিপ্লাই করিনি। বেশ করেছি! আরও করব না! কোনও দিন করব না! কোনও দিন না! আর চোখে জল নিয়েই সোজা দৌড়ে গেলাম ওর দিকে। তার পর...

না ব্যস, আর তার পর নয়। এর পরের ব্যাপারটা আর আপনাদের জন্য নয়! কারও জন্যই নয়। শুধু এটুকু বলতে পারি পুঁটি ঘামলেও কী সুন্দর গন্ধ থাকে ওর গায়ে!

আর এটাও বলতে পারি, পুঁটি যখন একটু কথা বলার স্কোপ পেয়েছিল তখন শুধু বলেছিল, “তুই যাবি না কিন্তু কলকাতা ছেড়ে! বুঝেছিস?”

আর আমি বুঝেছিলাম, এ জীবন আসলে কী!

আসলে এ জীবন ভালবাসায়, ভরসায় আর বিশ্বাসে, প্রিয় মানুষের পাশে থেকে, তার সঙ্গে কাটানোর মতো এক উপহার! এ জীবন যুক্তিহীন ভাবে অদ্ভুত! রূপকথার মতো অবিশ্বাস্য! এ জীবন অমূল্য! এ জীবন টুলুর দেওয়া গুলমোহর

আর বকুলফুল!

শেষটুকু

কিন্তু প্রভা কে? সেই প্রথম দিকে লামার গল্পে শোনা প্রভা যে সাবুর ঠাকুমা, সেটা তো বোঝা গেল। কিন্তু তার গল্পটা কী? লামার সঙ্গে তার সম্পর্কটাই বা কী! সে সব তো জানা হল না! লামা হাসল। ভাবল, থাক। সব গল্প সবার জেনে কাজ নেই। জীবনে কিছু রহস্য থাকা ভাল। না হলে জীবন তার গুরুত্ব হারায়।

লামা সিঁড়ি দিয়ে নীচের দিকে নামতে লাগল। পাখিরা কথা বলছে ছাদে। বলুক। অনেক ক্ষণ ধরে বলুক। ওদের একটু নিরিবিলি থাকতে দেওয়া দরকার। শহরে পাখিদের নিজেদের মতো করে কথা বলার জায়গার বড্ড অভাব!

লামা বাগানে নেমে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমায় নিবি তোরা ক্রিকেটে?”

বাচ্চারা কিছু বলার আগেই লেবু বলে উঠল, “চলে এস। বলে বলে আউট করব তোমায়। আজ আমি বচ্চন নই, রোনাল্ডো!”

লামা হাসল খুব। তার পর পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল ওদের দিকে। ভাবল, সত্যি তো, আজ এমন খুশির দিনে রোনাল্ডো ক্রিকেট খেলবে না তো কি ফুটবল খেলবে!

(টুলুর দেওয়া গুলমোহর আর বকুলফুল ছাড়া এই গল্পের আর সব কিছু বানানো।)

অন্য বিষয়গুলি:

Smaranjit Chakrabarty Novel
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy