Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
Smaranjeet Chakraborty

চুয়ান্ন

মা আর দিদি ক্রমশ ইম্পসিবল হয়ে উঠছে। দীপ্যদা সারা ক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করছে। তাও সব মেনে নিয়ে থাকতাম, যদি পুঁটিটা আমার পাশে থাকত।

স্মরণজিৎ চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

চন্দন সিং মাথা নামিয়ে দ্রুত পায়ে রাস্তা পেরিয়ে ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল। আমি তাকিয়ে দেখলাম। মনে মনে ছোটকাকে ধন্যবাদ দিলাম।

বাবাকে যেমন বলেছিলাম, তেমনই ছোটকাকেও আমি চন্দন সিং-এর পুরো ব্যাপারটা বলেছিলাম।

ছোটকা সবটা শুনে আমায় বলেছিল, “এক দিন টাইম দে। আমি ওই কোম্পানির সবটা তোর সামনে ডিটেলে এনে দিচ্ছি।”

এক দিনই সময় নিয়েছিল ছোটকা। পেপার কাটিং থেকে ইন্টারনেট নিউজ় এর প্রিন্টআউট সবটা আমার হাতে দিয়ে বলেছিল, “বাগালেকে দিস এগুলো। বলিস, কাকে আমাদের কম্পিটিটর বানিয়েছেন দেখুন।”

আমি হেসেছিলাম।

ছোটকা বলেছিল, “তবে কাউকে বলিস না যে আমি এগুলো তোকে দিয়েছি। গোটা প্রজেক্টটা তুই হ্যান্ডেল করছিস। এটাও তুই করলি। বুঝেছিস?”

ছোটবেলায় আমরা বন্ধুরা যখন ক্রিকেট খেলতাম, ছোটকাও আমাদের সঙ্গে মাঝে মাঝে খেলায় যোগ দিত। আর আমি ব্যাট করার সময় ছোটকার দিকে ক্যাচ তুললে, ছোটকা অবধারিত ভাবে ফেলে দিত

সেই ক্যাচ!

সে দিনও তাই করেছিল ছোটকা। আমাদের যারা সত্যি ভালবাসে, তারা কিছুতেই চায় না আমরা তাড়াতাড়ি আউট হয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে যাই! তারা আমাদের খেলার মাঠেই দেখতে চায়।

আমি বইয়ের দোকানে গিয়ে ঢুকলাম এ বার। মনে হল কত দিন পরে নিজের জায়গায় এলাম।

সার দেওয়া র‌্যাকে কত রকমের বই। আমি চারটে বই বেছে নিলাম। কাউন্টারে গিয়ে দাম মিটিয়ে দিলাম। তার পর বেরিয়ে এলাম দোকান থেকে। আর ঠিক তখনই এনাকে দেখতে পেলাম।

দূরে রাস্তার উল্টো ফুটে ওর প্রেমিকের সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছে। একটা সাদা শার্ট আর জিন্স। চুলগুলো খোলা। আমি তাকিয়ে রইলাম কিছু ক্ষণ। এনা হাঁটতে হাঁটতে হবি সেন্টারের দিকে চলে গেল। দু’জনেই সামান্য উত্তেজিত হয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল যেন।

আমি পুরোটা দেখলাম। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমার আর কিছু মনে হল না। যেমন আর পাঁচটা মানুষকে দেখি সে ভাবেই দেখলাম ওদের। বরং কেমন একটা হাসি পেল। না, ওদের নিয়ে নয়, নিজেকে নিয়ে!

আমি জানি না, ঠিক কোন বিন্দু থেকে এক জন মানুষ অন্য এক জনকে ভালবাসতে শুরু করে, আর ঠিক কোন বিন্দু থেকে তার সেই ভালবাসা আচমকা চলে যায়! কিন্তু যখন যায়, তখন একেবারেই যায়।

যে আমি সাবুর পাঠানো ছবিটা দেখে কষ্ট পেয়েছিলাম, সেই আমার আজকে আর কিছু মনে হচ্ছে না! কেন মনে হচ্ছে না, জানি না। জানতেও চাই না! হয়তো দীর্ঘ দিন কষ্ট পেতে পেতে আমাদের মন সেখান থেকে বেরোতে চায়। তাই এক দিন সেই কালো চাদরটা সরে গিয়ে ফটফটে রোদ ওঠে। ছোট্ট এরোপ্লেন চকখড়ির দাগ টানতে টানতে চলে যায় আকাশের ব্লু-বোর্ড দিয়ে। বা হয়তো অন্য কোনও কারণ থাকে! আমি জানি না। আমি শুধু জানি যে, আমায় এই মনটা ধরে রাখতে হবে। আমি অন্ধকার গুহাটা দেখেছি। আর আমি সেখানে ফিরে যেতে চাই না।

সে দিন সাবুর বাড়িতে আমি গিয়েছিলাম খুব কষ্ট পেয়েই। না, এনা অন্যকে চুমু খাচ্ছে সেই কষ্টটা ঠিক নয়, আমি গিয়েছিলাম এই ভেবে যে, সাবু আমায় এটা এ ভাবে লুকিয়ে পাঠাল! ও তো আমায় সোজাসাপটা বলতেই পারত। দেখাতেই পারত ছবিটা। সেটা না করে কেন এমন লুকোচুরি! আমার মনে হয়েছিল কেবল একটা মেয়ের জন্য আমি

কি এতটাই সবার থেকে দূরে হয়ে গেলাম যে, সবাইকে আমার কাছে পৌঁছতে এমন লুকোছাপা করতে হচ্ছে!

সাবু কোনও কথা বলেনি। শুধু হাত বাড়িয়ে আমার হাতটা ধরে মাথা নিচু করেছিল। টপটপ করে জল পড়ছিল ওর চোখ দিয়ে। আমরা দু’জন চুপচাপ মাথা নিচু করে বসেছিলাম। কেউ কথা বলছিলাম না কোনও। যেন আমাদের মধ্যে আর কোনও কথা অবশিষ্ট ছিল না।

শুধু ফ্যানের আওয়াজ আসছিল। বাইরে বৃষ্টির আওয়াজ আসছিল। মনখারাপ রঙের একটা আলো ঘুরছিল ঘরে।

আমি কিছু খাইনি সে দিন। খেতে ইচ্ছে করছিল না। চলে আসার আগে আমি এগিয়ে গিয়ে সাবুর চোখদুটো মুছিয়ে দিয়েছিলাম। আর সাবু আচমকা আমায় দুই হাত দিয়ে টেনে জড়িয়ে ধরেছিল। আমার বুক আর পেটের মাঝে নিজের মুখটা গুঁজে আরও জোরে কেঁদে উঠেছিল।

আমি কী করব বুঝতে পারিনি। শুধু একটা কথা বুঝতে পেরেছিলাম, যখন কেউ কাঁদে এমন ভাবে তখন তাকে আটকাতে নেই। কান্নার মধ্য দিয়ে মনের কষ্ট আর অন্ধকারগুলো বেরিয়ে যেতে দিতে হয়।

আমি ফুটপাত ধরে কিছুটা হাঁটলাম। লোকজন চার দিকে। কেউ ব্যস্ত, কেউ হাসিখুশি, কেউ আবার গম্ভীর। আকাশে রোদ হেলে পড়েছে অনেকটা। এ সবের মধ্যে আমার নিজেকে ওই ছোট্ট এরোপ্লেনটার মতো মনে হল। মুক্ত!

না, আজ আর মেট্রো ধরব না। আজ ট্যাক্সি।

মোবাইল নেই আমার কাছে যে, ক্যাব বুক করব। কিছু ক্ষণের চেষ্টায় একটা হলুদ ট্যাক্সি পেলাম।

বয়স্ক হিন্দিভাষী ড্রাইভার। মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা। এক বার বলাতেই মাথা নেড়ে রাজি হলেন নিয়ে যেতে।

আমি পিছনের সিটে ছেড়ে দিলাম নিজেকে। আজ কত দিন পরে যে আমি ট্যাক্সিতে উঠলাম!

পিছনে ছিটকে যাচ্ছে কলকাতার পথঘাট। হাওয়া এসে এলোমেলো হয়ে লাগছে মুখেচোখে। কেন যে এত ভাল লাগছে শহরটাকে! এর ভাঙাচোরা মানুষগুলোকে! আমি আকাশের দিকে তাকালাম। ওই দূরে সার বেঁধে পাখি

উড়ে যাচ্ছে। আমি কত দিন ঠিকমতো পাখি দেখিনি! আরে, লামাদাদুর পাখিদের বসার জায়গাটা তো ভেঙে গিয়েছে! সেটা তো ঠিক করে দিতে হবে! আমি কত দিন লামাদাদুর বাড়িতে যাইনি! জগন্নাথদার হাতে তৈরি ডিম-পাউরুটি ভাজা খাইনি! লেবুদার থেকে অমিতাভ বচ্চনের নাচ দেখিনি! আমার যে কত কিছু করা বাকি রয়ে গিয়েছে!

এনা আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার আটচল্লিশতম দিন আজ! জীবন থেকে আটচল্লিশটা দিন কী ভাবে যে বেরিয়ে গেল! আমি এটা কী করলাম!

বাড়ির সামনে ট্যাক্সি থেকে নেমে আমি ভাড়া মিটিয়ে দিলাম। তার পর এক দৌড়ে ওপরে উঠে গেলাম।

ওপরে উঠেই দেখি, তিতি বসে ছিল মায়ের সামনে। আমি ছোট্ট করে ওর চুলটা টানলাম।

তিতিও ঘুরে আমার দিকে একটা থাপ্পড় চালাল। আমি কাটিয়ে গেলাম সেটা। তার পর বইগুলো ওর দিকে ছুড়ে দিয়ে বললাম, “ক্যাচ!”

তিতির হাত থেকে বইগুলো বিছানায় পড়ে গেল। ও রেগেমেগে বলল, “তুই আমার চুল টানলি কেন? জানিস না, মেয়েদের চুলে হাত দিতে নেই। মনে নেই, দ্রৌপদীর চুলে হাত দিয়েছিল বলে দুঃশাসনের কী হয়েছিল!”

আমি বললাম, “আমি কী করে জানব কী হয়েছিল। আমি তখন প্রেজ়েন্ট ছিলাম না কি!”

মা আমায় দেখল। চোখেমুখে অবাক ভাব।

“কী হয়েছে রে তোর?” মা জিজ্ঞেস করল, “শরীর খারাপ!”

“না তো!” আমি মাথা নাড়লাম।

“তা হলে? কী হয়েছে?” মা জিজ্ঞেস করল।

আমি শুধু হেসে বললাম, “এরোপ্লেন!”

আমি ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে শুনলাম মা তিতিকে বলছে, “নেশাটেশা করল না কি রে? মদের গন্ধ তো পেলাম না। গাঁজা খায় না কি? আচ্ছা তিতি, গাঁজা খেলে কি গন্ধ বেরোয়?”

আমি নিজের ঘরে এলাম। ঘড়িটা খুলে রাখলাম। তার পর পকেট থেকে পেনটা বের করে ড্রয়ার টানলাম। দেখলাম ভেতরে ছোট্ট কালো কষ্টি পাথরের মতো পড়ে আছে আমার মোবাইল ফোন। ঠান্ডা, নিথর। যেন শীতঘুমে পড়ে আছে বহু কাল!

আমি পেনটা রাখলাম। তার পর বার করলাম মোবাইলটা। ড্রয়ারের পিছন থেকে নিলাম গুটিয়ে রাখা চার্জার।

চার্জারের প্যাঁচানো তারটা খুললাম। তার পর মোবাইলে গুঁজে চার্জারটা লাগিয়ে দিলাম প্লাগে। আর বিদ্যুৎ-স্পর্শে বহু দিন পরে চমকে, জেগে উঠল আমার মোবাইল।

আর আমিও জেগে উঠে মনখারাপের শীতঘুম থেকে, সাধারণ জীবনে ফিরলাম।

১৬

সাবু

মাঝে মাঝে মনে হয় এই শহরটা আমার কে? এখানে কী করতে পড়ে আছি আমি? কার জন্য এখানে থাকব? বাবার জন্য? কিন্তু বাবাও তো বলল, আমি যদি নর্থ বেঙ্গল যেতে চাই তা হলে যেতে পারি। মা আর দিদি ক্রমশ ইম্পসিবল হয়ে উঠছে। দীপ্যদা সারা ক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করছে। তাও সব মেনে নিয়ে থাকতাম, যদি পুঁটিটা আমার পাশে থাকত।

কিন্তু আমারই ভুল। সব ভুল আমার। এখানে কেউ নেই আমার। এই শহরটা আমার নয়।

“ম্যাডাম, আসুন।”

ছেলেটার বয়স বেশ অল্প। এখনও ঠিক করে গোঁফের রেখা ধরেনি। এই বয়স থেকেই পার্টি করা শুরু করেছে! অবশ্য তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। আমি শুনেছি এটা নাকি হয়েই থাকে।

“ম্যাডাম, আসুন। দাদা ওয়েট করছেন।” ছেলেটা আবার বলল।

আমি উঠলাম। পায়ে এখনও চোট আছে। তবে খুব কিছু না। ফোলা কমেছে অনেকটাই। আরও দু’-তিন দিন রেস্ট নিলে হত। কিন্তু বাড়িতে বসে থাকলে আমি বোর হয়ে এ বার মরে যেতাম!

আমি উঠে সামান্য খুঁড়িয়ে সামনের অ্যালুমিনিয়াম ফ্রেমওয়ালা কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম।

কচিদা বসে আছে। সঙ্গে আরও কিছু ছেলেপিলে। সবাই ঘুরে তাকাল আমার দিকে। কচিদাকে কেউ নিশ্চয় লাফটার শোয়ের জাজ-এর পদ থেকে বাদ দিয়েছে। লোকটার ভুরু একদম সেকেন্ড ব্র্যাকেট হয়ে আছে। চোয়াল নড়া দেখে বুঝলাম পান চিবোচ্ছে।

আমি যেতেই একটা ছেলে উঠে আমায় চেয়ার ছেড়ে দিল। আমি বসলাম না। বললাম, “আমায় ডাকলেন কেন? এত আর্জেন্সির কী আছে!”

কচিদা থামল একটু। ঢোঁক গেলা দেখে বুঝলাম পানের পিক গিলে নিল।

কচিদা বলল, “এটা আপনারা ঠিক করলেন!”

“মানে?” আমি অবাক হলাম।

“মানে আপনি জানেন না?”

আমি সত্যি জানি না। আসলে কোথায় কী হচ্ছে, সেটা জানব কেমন করে!

“আপনাদের অরগানাইজ়েশন, আর আপনি কিছু জানেন না! এটা বিশ্বাস করতে বলছেন!” কচিদার সেকেন্ড ব্র্যাকেট আরও ঘন হচ্ছে।

আমি চোয়াল শক্ত করে বললাম, “দেখুন, আমি কাজে থাকি। সারা ক্ষণ এ দিক-ও দিক যেতে হয়। সঙ্গে আরও নানা ব্যাপার থাকে। এ ভাবে অর্ধেক কথা না বলে কী বলতে চাইছেন একটু খুলে বলুন।”

কচিদা বলল, “আপনাদের জিনা ব্যানার্জির সঙ্গে কথা বলেছিলাম আমি। উনি আমাদের হাই কম্যান্ডে গিয়ে আমার নামে লাগিয়েছেন! আমি নাকি ওকে থ্রেট দিয়েছি! জোর করেছি! এ সবের কী মানে!”

আমি বললাম, “এ সব আমায় বলছেন কেন? আমি কি আছি এ সবের মধ্যে! আপনি জিনাদিকে কী বলেছেন আপনি জানেন!”

“আরে আমি কী বলেছি! একটু জোর দিয়ে বলেছি যে, আমাদের যেন আপনাদের কাজে যোগ দিতে দেন। জিনা ম্যাডাম এখানে বসে যে, আমার কথা রেকর্ড করবেন সেটা আমি বুঝব কী করে?”

আমি অবাক হলাম। এ সব আমি জানিই না কিছু। জিনাদি আমায় কিছুই বলেনি। অবশ্য বলবেই বা কেন! এ সব অ্যাবাভ মাই পে গ্রেড।

আমি বললাম, “তো এখন আপনার বক্তব্য কী? কী চাইছেন?”

“না মানে...” কচিদা থতমত খেল। “না মানে আপনাকে বললাম আর কী। আপনি জিনাদিকে বলুন যেন হাইকম্যান্ডে গিয়ে আমার সম্বন্ধে বলা কথাগুলো মেরামত করে দেয়। আমি এমন কিছুই বলিনি। আর একটা কথা ভেবে দেখুন, আমাদের ছেলেরা যদি আপনাদের কাজে নানা বাধা দেয়, হাই কম্যান্ড অত দূরে বসে কিছু করতে পারবে? জিনা ম্যাডাম সেসব কিছু ভাবলেন না!”

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, “আপনি এবার থ্রেট করছেন আমায়!”

“আরে!” কচিদা বিব্রত মুখে বলল, “থ্রেট আবার কোথায় করলাম!”

“করলেন তো!” আমি চোয়াল শক্ত করলাম। মাথাটা আচমকা গরম হয়ে গেল আমার। মুহূর্তের মধ্যে মনে হল আমার সামনে কচিদা বসে নেই। বসে আছে আমার দিদি, মা, দীপ্যদা!

অন্য বিষয়গুলি:

Smaranjeet Chakraborty Novel
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy