ছবি: কুনাল বর্মণ।
প্রথম সন্ধ্যা
সময়
বিকেল বিদায় নিল টুক করে। পাহাড়ের আবডালে সূর্যাস্ত হওয়ার অপেক্ষা। তার পরই ঝাঁপিয়ে অন্ধকার নেমে এল পাহাড়ি গ্রামে।
স্থান
উত্তরাখণ্ডের মুন্সিয়ারি। দিনের অলোয় স্পষ্ট দেখা যায় হিমালয়ের পাঁচটি শৃঙ্গ। নাম পঞ্চচুল্লি। এখন সন্ধ্যারাতের গাঢ় অন্ধকারে বোঝার উপায় নেই যে এটা হিমালয়, না আট বাই দুই গোবিন্দ সেন লেন।
পাত্র
শিক্ষামূলক ভ্রমণের অন্য নাম হওয়া উচিত বন্ধুবর্গ ভ্রমণ। শিক্ষার ব্রত নিয়ে সমগোত্রীয় এক দঙ্গল ছেলেমেয়ের এক সঙ্গে ঘোরা যেন স্বর্গীয় আনন্দের ভিন্ন নাম। কৈশোর পেরনো প্রাক্যৌবনের হিল্লোল যখন কুঁড়ি হয়ে ফোটে, তখন এক সঙ্গে তেত্রিশ জন ছাত্রছাত্রীর ভ্রমণ এক অসামান্য আনন্দের অভিজ্ঞতা। আজ সারা দিন তারা চষে বেড়িয়েছে মুন্সিয়ারি। ফিরে এসে মেতে রয়েছে নিজেদের মধ্যে নানা খেলা, আড্ডা, ঠাট্টা, গল্প, গান, প্যারডিতে।
সঙ্গ
কলকাতার কলেজ থেকে গাইড হিসেবে এসেছেন চার জন। সারা দিন তাঁদের সঙ্গেই ঘুরেছে ছেলেমেয়েরা। এখন অবসর। কিন্তু সময় কাটছে না গাইডদের। যাঁরা এসেছেন তাঁদের দু’জন পুরুষ, দু’জন মহিলা। মহিলা দু’জনের এক জন উদ্ভিদবিদ্যা, অন্য জন ভূগোলের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর। পুরুষদের এক জন প্রাণিবিদ্যার। অন্য জন ওই কলেজের শিক্ষকই নন। আসলে লোক পাওয়া যাচ্ছিল না শিক্ষামূলক ভ্রমণে সঙ্গ দেওয়ার। শিক্ষকদের প্রত্যেকেই তুমুল ব্যস্ত। অগত্যা ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের অনুরোধে এক জন কনসালট্যান্ট হিসেবে যোগ দিয়েছেন বল্লালবাবু। চার জনেরই বয়স তিরিশের কোঠায়।
প্রসঙ্গ
সন্ধ্যা নামতেই দোতলা গেস্ট হাউসটা আলো-আঁধারিতে ভরে গেল। ছেলেমেয়েরা রয়েছে এক তলায়। এক তলার ঘরগুলোর মাঝখানে বড় একটা ডাইনিং। পাশেই বাগান। সে দিকে কাচের দেওয়াল। দু’দিকে ঘর। বাঁদিকের ছ’টা ঘরে তেইশ জন মেয়ে থাকছে। ডান দিকের তিনটে ঘরে ছেলেরা দশ জন। এক তলার মতোই দোতলা। বড় ডাইনিং। ঢাউস কাচের দেওয়াল। দু’দিকে সার সার ঘর। আধা সরকারি গেস্ট হাউসে এই দল ছাড়া আপাতত অন্য কোনও পর্যটক নেই। কিন্তু দোতলায় এই চার জনও ঠিক জমাটি আড্ডার পরিস্থিতিতে নেই। প্রাণিবিদ্যার শিক্ষক জীবেশ দু’-এক পাত্র সুরাপান করে ঘরবন্দি। উদ্ভিদবিদ্যার গরিমার এখানে নাকি কোন আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে। সে গেছে তার সঙ্গে দেখা করতে।
বিরক্তি
এখন ঘরে একা বসে সময় আর কাটছিল না তমার। এমনিতে বেড়াতে এসে দারুণ কাটছিল সময়, কিন্তু এই মুহূর্তে হঠাৎ ঝপ করে বিদ্যুতের গ্রিড বসে যাওয়ার মতো ফাঁকা লাগছে। গরিমা চলে যেতে এই ফাঁকা লাগাটা একাকিত্বে পরিণত হল৷ জীবেশদার দরজা বন্ধ। সহকর্মী জীবেশ কেমন সে ভালই জানে। এমনিতে হাসিখুশি। কিন্তু পেটে সামান্য সুরা গেলেই বর্ণালীর সঙ্গে ওর বিবাহবিচ্ছেদের যাবতীয় দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণার মেঘ এসে ঘিরে ধরে তাকে। সে তখন কারও সঙ্গে মিশতে পারে না। তমার সন্দেহ, রাতে খাবার সময় এ বিষয়ে দু’-চারটে কথা বললেই সে হয়তো কেঁদে গড়িয়ে পড়বে। আগেও এক বার তেমনটাই হয়েছিল। অন্য যে ভদ্রলোক বল্লালবাবু এসেছেন, তাকে সে এ বারই প্রথম দেখল। এই ভদ্রলোক অচেনা হলেও হাসিখুশি, আর রসবোধসম্পন্ন। দীর্ঘ যাত্রাপথ আর এই ক’দিনের ঘুরে বেড়ানোয় টুকটাক কথা হয়েছে।
সম্বোধন
বাইরের অন্ধকার এত ঘন যে, জানলার কাচে নিজের ছায়া ছাড়া কিছুই দেখতে পেল না তমা। জানলার কপাট খুলে আবার বন্ধ করে দিতে হল। এই মধ্য-অক্টোবরেই বাইরে বেশ হিমেল বাতাস। ব্যাগে দু’খানা গল্পের বই রয়েছে, কিন্তু পড়তে ইচ্ছে করছে না। মোবাইলের মেমরি কার্ডে গোটা আটেক ফিল্ম আছে। সব ক’টাই তার পছন্দের। কিন্তু ইচ্ছে করছে না দেখতে। এখানে কেনাকাটা করা দুঃস্বপ্ন। বাইরে দু’-চারটে পান, চা, খাবারের দোকান ছাড়া কোনও বিপণি নেই। এমন চরম বিরক্তির সময়ে দরজায় কে টোকা দিল! দরজার পাল্লা খুলে বাইরে বেরিয়ে তমা দেখল, বল্লালবাবু হাসিমুখে দাঁড়িয়ে। তাঁর দু’হাতে দু’খানা ধোঁয়া-ওঠা কফির কাপ। ভদ্রলোক বললেন, “কফি নিয়ে এলাম। আপনি ঘরে বসেও খেতে পারেন। আর তেমন কাজ না থাকলে ডাইনিংয়ে বসে গল্প করতে করতেও খেতে পারেন।”
ডাইনিং
সরু করিডরের পর ডাইনিং। হালকা আলো জ্বলছে। সার সার চেয়ার-টেবিল সাজানো। যখন অনেক পর্যটক থাকে তখন হয়তো গমগম করে এই ঘর, এখন যেমন এক তলার ডাইনিং আড্ডার স্রোতে সরগরম। এই দোতলায় ডাইনিংয়ের শেষ প্রান্তে কাচের বড়, উঁচু দেওয়ালের ঠিক পাশে মুখোমুখি দুটো চেয়ারে এসে বসল দু’জনে। সঙ্গে কফি। সঙ্গে ঠান্ডা পরিবেশ। মাঝে মাঝে নীচের তলা থেকে গান, আড্ডার আওয়াজ ভেসে আসছে।
তার পর
কফিতে চুমুক দিয়ে কথা শুরু করলেন বল্লাল।
“কোনও কাজ করছিলেন না কি তমা ম্যাডাম? ডেকে বিরক্ত করলাম না তো!”
“দূর! ঘরে বসে বসেই বিরক্ত হচ্ছিলাম। সময় তো কাটছেই না।”
“আমারও তা-ই মনে হল। তাই ভাবলাম, একা বিরক্ত হওয়ার থেকে অন্যকে বিরক্ত করা ভাল।”
“সত্যি, একা বিরক্ত হওয়ার থেকে খারাপ আর কিছু নেই। মনে হচ্ছিল যেন ঘরে বন্দি হয়ে রয়েছি। বেড়াতে এসেছি, কিন্তু লোক নেই, জন নেই, মানুষের সাড়াশব্দ নেই... যেন নির্বান্ধব পুরীতে বসে রয়েছি। আপনি ডেকে বাঁচালেন। ধন্যবাদ।”
“আগে ধন্যবাদ দেবেন না তমা। অনেক সময় লোকের সঙ্গে কথা বলার পর মনে হয় এর চেয়ে বিরক্তিকর আর কিছু নেই। দেখুন, হয়তো একটু পরেই তাই মনে হবে।”
“মনে হলে হবে। আর আপনি মোটেই বিরক্তিকর লোক নন। দু’দিন ধরে তো দেখছি, দারুণ মজা করতে পারেন আপনি। ওই যে, গরিমার গলা ব্যথা শুনে বললেন, সকালে আধ ঘণ্টা, বিকেলে আধ ঘণ্টা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত চর্চা করতে! আমরা তো ঘরেও সে কথা মনে করে হেসে গড়িয়ে পড়ছিলাম।”
“আর গড়িয়ে কী হবে! তিনি তো চলে গেলেন!”
“দুঃখ হচ্ছে না কি আপনার?”
“আর দুঃখ হয় না তমাদেবী। আমার কথায় আজ পর্যন্ত ছাপ্পান্ন জন মহিলা খুব হেসেছেন, আর তার পর অন্য জনকে বেছে নিয়েছেন!”
“অ্যাঁ! ছাপ্পান্ন জন! আপনি গুনেও রাখেন?”
“রাখতাম। এখন আর রাখি না। জানি এটাই ভবিতব্য। তাই লোককে শুধু বিরক্ত করার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাই। এখন যেমন আপনাকে বিরক্ত করার পরিকল্পনা।”
“বাঃ! মন্দ নয়। সত্যি বলছি, এ রকম বলে-কয়ে কেউ কোনও দিন বিরক্ত করেনি আমায়। তা বলুন, কী ভাবে, কী ভাষায় বিরক্ত করবেন?”
“আপাতত কিছু প্রশ্ন করতে চাই। এই যেমন, ধরুন, আপনার ভাল লাগা-খারাপ লাগা নিয়ে।”
“বেশ। প্রশ্ন করুন।”
“আপনার সব থেকে অপছন্দের খাবার কী?”
“এ মা, এটায় বিরক্তির কিছু তো নেই!”
“আছে, আছে। প্রশ্ন চলুক, এগোক, দেখবেন দেওয়াল থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে বিরক্তি নামছে।”
“ঢ্যাঁড়শ সেদ্ধ। জঘন্য লাগে খেতে। যে দিন হয়, সে দিন গলা দিয়ে ভাত নামতে চায় না।”
“কিন্তু সেদ্ধ ঢ্যাঁড়শ তো চট করে খাবারটা নামিয়ে দেয়, একদম পাকস্থলির রান্নাঘরে।”
“একটু বিরক্তি লাফিয়ে এল দেওয়াল থেকে।”
“আসবে, আসবে, আরও আসবে। এ বার বলুন, সব থেকে অপছন্দের লোক কে?”
“আপনি তো সাঙ্ঘাতিক মানুষ! পেট থেকে সব কথা বার করে নিতে চাইছেন!”
“কার কথা মনে পড়লে মুখ তেতো হয়ে যায়?”
“উত্তর দেওয়া যাবে না। অন্য প্রশ্ন দিন।”
“আচ্ছা বাদ দিলাম। এমন একটা অনুভূতির কথা বলুন, যখন মনে হয়েছিল লটারি পেয়েছেন।”
“আমি লটারির টিকিট কাটিই না!”
“এড়িয়ে যাওয়ার মতো প্রশ্ন কিন্তু এটা ছিল না। বলুন, এটা বললে আর এক কাপ কফি বলব।”
“আপনি পারেনও যত্তসব উদ্ভট প্রশ্ন করতে! মনে পড়ছে না, তেমন কোনও ঘটনা। নেইও।”
“মনে করুন, ঠিক মনে পড়বে।”
“কিন্তু এ সব কি ঠিক হচ্ছে, শুধু আপনি প্রশ্ন করে যাচ্ছেন!”
“আপনি যখন পূর্ণ বিরক্ত হয়ে যাবেন, তখন প্রশ্ন করবেন আপনি। আমি সব উত্তর দেব। একটাও ব্যক্তিগত বলে এড়িয়ে যাব না।”
“আচ্ছা, একটা ঘটনা বলতে পারি। খুবই তুচ্ছ ঘটনা। কলেজে সবে ভর্তি হয়েছি। বরাবর গার্লস স্কুলে পড়ার পর কো-এড কলেজ, প্রবল উৎসাহ। সে বার প্রথম আমরা কলেজ কেটে সিনেমা দেখতে গেছি। কলেজে অভিরূপ বলে একটা ছেলে পড়ত আমাদের সঙ্গে। একেবারে সিনেমার নায়কের মতো দেখতে। টকটকে ফরসা, গালে রেশমের মতো হালকা দাড়ি, ঠোঁট দুটো যেন টুকটুকে লাল গোলাপের পাপড়ি। মনে মনে সবার ইচ্ছে ওর পাশের সিটে বসে। কিন্তু কেউই বলতে পারছে না! আমাদের দলের পাণ্ডা ছিল শ্রীলা। ও সব টিকিট প্রথমে এলোমেলো করে দিল। তার পর এক-এক জনকে একটা করে টিকিট ধরিয়ে দিল। জনা দশ-বারো ছেলেমেয়ে ছিলাম। কী হল জানেন, আমার পাশেই বসল সেই রাজপুত্র! সে দিন মনে হয়েছিল লটারির পুরস্কার জিতেছি!”
“তার পর? রাজপুত্রের সঙ্গে রূপকথাটা আর এগোল না?”
“এগোনোর কথা তো ছিল না বল্লাল সেন।”
“আমি সেন নই, বোস। বল্লাল বোস।”
“উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করলে আপনাকে বল্লাল সেন বরাট, জল্লাদ সেন এই সব নামেই ডাকা হবে।”
“তার মানে একটু ব্যথা ছিল ম্যাডাম। তবে বলতে না চাইলে থাক, কফি বলি?”
“কোনও ব্যথা ছিল না স্যর। ছোট বেলায় খুব সুন্দর কাউকে দেখলে যেমন হয়, তেমনই।”
“ছোটবেলায় কেন, আমার তো এখনও হয়!”
“আপনার হোকগে, আমার হয় না। পরে তো সুন্দর ছেলেদের দেখে রাগ হত। রোদে পুড়বে না, বৃষ্টি গায়ে লাগলে গলে যাবে... ওদের জঘন্য লাগে, সে ছেলে হোক বা মেয়ে! মনে হয় এদের চকলেটের প্রলেপ দিয়ে দোকানে সাজিয়ে রাখাই ভাল।”
“কফি বলি আর এক বার?”
“থাক না, একটু পরে বলুন। গরিমা আসুক, এক সঙ্গে খাওয়া যাবে।”
“আপনার গরিমা এখন আসছে না। ঠিক আছে, পরেই না হয় খাওয়া যাবে।”
“গরিমা এখন আসছে না, কেন বললেন?”
“মনে হল, বললাম। উনি কিছু বলেননি।”
“আশ্চর্য! আপনার এ রকম এমনিই মনে হয়?”
“মনে হয়। আমি তখন দেখতেও পাই।”
“তাই? এখন কী দেখতে পাচ্ছেন?”
“দেখতে পাচ্ছি এক জন শিক্ষিকা তাঁর বেদম বিরক্তি চেপে রেখে তার সহকর্মীর ফেরার জন্য ভিতরে ভিতরে উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছেন।”
“আপনি তো সাঙ্ঘাতিক লোক মশাই! আমি মোটেই বিরক্ত হচ্ছি না।”
“কিন্তু গরিমা ম্যাডামের পায়ের শব্দ শোনার জন্য তো অপেক্ষা করে আছেন!”
“মোটেই তা নয়।”
“আপনি এত ক্ষণে পাঁচ বার বাইরে থেকে ভিতরে আসার রাস্তার দিকে তাকিয়েছেন।”
“বাবা! আপনি এটাও লক্ষ করেছেন!”
“আপনাকে বললাম যে, উনি এখন আসবেন না। হয়তো আজ আসবেনই না!”
“উঃ! কত কিছু দেখতে পান আপনি! আচ্ছা, বলুন তো গরিমা এখন কী করছে?”
“যার সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা ছিল, তার সঙ্গে বসে কফি খাচ্ছে।”
“বল্লাল সেন সত্যিই সাঙ্ঘাতিক লোক! কফির জন্য এত কিছু আপনাকে দেখতে হবে না। এই পরিবেশে কফির বিকল্প নেই, বার বার চলে। ও এলে না-হয় আর এক বার হবে। বলে দিন দু’কাপ।”
“তা হলে কফিটা বিরক্তির নয় বলুন।”
“বিরক্তির নয়, বিপজ্জনক! কফি নয়, কথাটা আপনাকে বললাম বল্লাল সেন।”
“আমি বিপজ্জনক? কী এমন বিপদ ঘটালাম তমা ম্যাডাম?”
“এই যে দূর দূর থেকেও লোককে দেখতে শুরু করে দিচ্ছেন! আমরা তাও ঠিক আছি, আপনার স্ত্রীর অবস্থা কিন্তু শোচনীয়!”
“এই রে! আমার যে স্ত্রী নেই।”
“ও! একজন অন্তত বেঁচেছে। তা হলে আপনার বান্ধবীর অবস্থা শোচনীয়।”
“আমার তেমন বান্ধবীও নেই। আসলে আমি মানুষটা একটু একঘেয়ে তো!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy