Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
Short story

novel: মায়াডোর

উঠতি রাজনৈতিক প্রতিভা এবং কেন্দ্রীয় সরকারি শাসক দলের মাস্টারমাইন্ড... অনেক ঝড়ের পূর্বাভাস নিয়ে কাছাকাছি এসে পড়ল তারা। 

ছবি: বৈশালী সরকার

ছবি: বৈশালী সরকার

অভিনন্দন সরকার
শেষ আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৯:২৯
Share: Save:

ুটুল স্যর বলেছিলেন, “দর্পণ, তুমি খুব অ্যাকমপ্লিশড ব্যাটসম্যান, কিন্তু যুগটা খুব কঠিন। বিশ্বের বেশির ভাগ যুদ্ধই এই জায়গাটা দিয়ে জিততে হয়।”

টুটুল স্যার তর্জনী রেখেছিলেন নিজের মাথায়, “মাইন্ড ইজ় দ্য মোস্ট প্রেশাস ওয়েপন। ব্যাটিং-এর সময়ে বাকি সব ভুলে যেতে হবে। যখন বোলারের হাত থেকে লাল গোলাটা তোমার দিকে ধেয়ে আসবে, তখন বাবা, মা, ভাই, বোন কেউ থাকবে না, শুধু তুমি থাকবে আর তোমার সঙ্গে তোমার ব্যাট।”

ডাম্বো কেঁপে গিয়েছিল। তার সমস্যাটা ধরে ফেলেছেন টুটুল স্যর। সে দিন বাড়ি ফেরার পথে ডাম্বো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল, আগামী মাসে ফাইনাল টিম সিলেকশন, টুটুল স্যরের হাত ধরে এক বার শেষ চেষ্টা করে দেখবে ডাম্বো।

“কী হলটা কী? ছটফট করছ কেন? ঘুম আসছে না?” কড়া গলায় বলল মঞ্জীরা।

প্রবল ট্রেনিংয়ের ধকলে ডাম্বোর কোমর আর পা যেন ভেঙে পড়তে চাইছে, কিন্তু এ কথা তো মাকে বলা যায় না, সে আদুরে গলায় বলল, “একটু মাথায় আরাম করে দেবে মা? ঘুমিয়ে পড়ব।”

মঞ্জীরা ছেলের দিকে পাশ ফিরে আধশোয়া হল। হালকা বিলি কেটে দিচ্ছে ছেলের মাথায়।

অল্প সময়েই ডাম্বোর নিঃশ্বাস গভীর হয়ে এসেছে, সে ঘুম-জড়ানো স্বরে বলল, “নেক্সট টুর্নামেন্টে তুমি ব্যাটসম্যান দর্পণ গাঙ্গুলির এক নতুন রূপ দেখবে মা।”

মঞ্জীরা হেসে উঠেছে নীরবে, প্রশ্রয়ের ধমক দিল ছেলেকে, “সেশনাল পরীক্ষার গ্রেড নেমে গেলে তুমিও মায়ের একটা নতুন রূপ দেখবে ডাম্বো।”

ডাম্বো ঘুমিয়ে পড়লে অনেক ক্ষণ এ পাশ-ও পাশ করল মঞ্জীরা। ঘুম আসছে না। গায়ে গায়ে ফ্ল্যাট। পাশের ফ্ল্যাটে কোনও একটা পারিবারিক সিরিয়াল চলছে। সিরিয়ালে পরিবারের সদস্যরা অত্যন্ত কুৎসিত ভাবে ঝগড়া করে চলেছে। টিভিও চলছে যথাসম্ভব উচ্চগ্রামে।

মঞ্জীরা উঠে পড়ল। তাদের ঘর থেকে বেরিয়ে করিডর, ডান দিকে মিহিকার ঘর। সেই ঘরের আলো এখন নিভে গেছে, নিচু শব্দে গান শুনছে মেয়ে। মঞ্জীরা বসার ঘরের সোফায় এসে বসল। অন্ধকারে একা বসে থাকলে এলোমেলো চিন্তা আসে। আজও ডাম্বোকে গণেশমূর্তির কথাটা জিজ্ঞেস করা হল না। কোথায় লুকিয়ে রেখেছে ডাম্বো? মঞ্জীরা জানতে না চাইলে কি নিজে থেকে কখনও উচ্চবাচ্য করবে না ছেলেটা?

মোবাইল ফোনে চোখ রাখল মঞ্জীরা। রাত হয়েছে, উৎসাহবশে উত্তীয়র খোঁজ করল এক বার, উত্তীয়র নামের পাশে সবুজ আলো, এখনও অনলাইন। প্রায়ই রাত করে শুতে যেত উত্তীয়, একটা দুটো বেজে যেত। সকালে উঠতে অবধারিত গড়িমসি, অতঃপর অফিসে লেট মার্ক।

বলে বলেও এই স্বভাব পাল্টাতে পারেনি মঞ্জীরা। আর এখন তো সম্ভবত বলারও কেউ নেই। যথেচ্ছাচার চলুক, মদ গিলে ডিনার না করে শুয়ে থাকুক, কেউ দেখতে যাবে না। অন্ধকারে এক আশ্চর্য বিষাদ ঘিরে ধরল মঞ্জীরাকে।

যে দিন উত্তীয়র জন্য শখ করে খিচুড়ি রেঁধেছিল মঞ্জীরা, সে দিনও লেট করেছিল উত্তীয়। অফিস যাওয়ার পথে বাধ্য হয়ে তাই তার ফ্ল্যাটে বড়সড় টিফিনবক্স নামিয়ে দিতে গেছিল মঞ্জীরা।

উত্তীয়র ফ্ল্যাটের নীচ থেকে ফোন করেছিল, যেন বৃষ্টিধারা ভেদ করে শব্দ এসেছিল, “আমি স্নান করছি মঞ্জীরা, প্লিজ় একটু আমার ফ্ল্যাটে এসো। এসে দিয়ে যাও।”

অগত্যা মঞ্জীরা অ্যাপক্যাব দাঁড় করিয়ে উত্তীয়র ফ্ল্যাটে গিয়েছিল। ভিজে গায়ে, জল গড়ানো চুলে, একটা টাওয়েল জড়িয়ে দরজা খুলেছিল উত্তীয়, “এসো, ভিতরে এসো।”

মঞ্জীরা ফ্ল্যাটের ভিতরে পা রাখামাত্র এক ভয়াবহ ব্যাপার ঘটে গেছিল।

মঞ্জীরা টিফিনবাক্সটা টেবিলে রাখার পরই দেখেছিল তার থেকে ঠিক দশ হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে বিকটদর্শন এক ডালমেশিয়ান। সাদা গায়ে কালো ববি ববি ছোপ, আকারে বড়সড় বাছুরের মতো। মুখেচোখে তীব্র অসন্তোষ, মঞ্জীরার উপস্থিতি সে পছন্দ করেনি।

মঞ্জীরা আঁতকে উঠে উত্তীয়র পিছনে দাঁড়িয়েছিল, “কী এটা? তোমার কুকুর আছে বলোনি তো?”

“আরে, ও তো রোমিয়ো। আমার না। পাশের ফ্ল্যাটের। মাঝে মাঝে আসে আমার কাছে।”

মঞ্জীরা সিঁটিয়ে গেল। কোনও অজ্ঞাত কারণে এই প্রাণীটির প্রতি ছোটবেলা থেকেই তার ভয়। মঞ্জীরা দু’হাতে উত্তীয়র কাঁধ খিমচে ধরল, “প্লিজ় ওটাকে সরাও। ওই দেখো...ওই দেখো... এগিয়ে আসছে!” প্রায় আর্তনাদ করে উঠেছিল সে।

কথায় কথায় মঞ্জীরা খেয়াল করেনি, সৌজন্যমূলক দূরত্বটুকু ঘুচে গেছে অনেক ক্ষণ। তার দিকে ফিরে তাকিয়েছিল উত্তীয়। তার চোখে অন্য ইঙ্গিত। মোহিত চোখে মঞ্জীরার দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে তার কপালে নেমে আসা চুলের গোছ সরিয়ে দিয়েছিল উত্তীয় আর তার পর কাছে টেনে নিয়েছিল তাকে, আবিষ্ট স্বরে বলেছিল, “কিস মি।”

মঞ্জীরার চোখ বড় বড় হয়ে গেছিল, সে মুখ সরিয়ে নিয়েছিল, “নো ওয়ে।”

উত্তীয়র দু’চোখে তখন দুষ্টুমির হাসি, “আমি রোমিয়োকে ডাকব?”

“অ্যাই না, একদম না!” প্রায় আর্তনাদ করে উঠেছিল মঞ্জীরা।

এই সময়েই রোমিয়ো গরগর শব্দ করে এগিয়ে এসেছিল, আর সেই মুহূর্তে উত্তীয়র ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিয়েছিল মঞ্জীরা।

সেই চুম্বন সহজে ফুরোয়নি। উত্তীয়র বিশাল বুকে যেন পিষে যাচ্ছিল মঞ্জীরা। নিজের অজান্তেই তার হাত ঘুরছিল উত্তীয়র নগ্ন পিঠে, আঁকড়ে ধরছিল বার বার।

নিজের সব প্রতিরোধের শেষ সীমা পেরিয়ে যাওয়ার আগের মুহূর্তে অস্ফুটে বলেছিল মঞ্জীরা, “প্লিজ় স্টপ, প্লিজ়।”

এই পরিস্থিতি থেকে ফিরে আসা পুরুষের পক্ষে সহজ কাজ নয়, কিন্তু মঞ্জীরা বুঝেছিল উত্তীয় থেমে গেছে। মুখ সরিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে, মুখে সেই দুষ্টু হাসি।

নিজেকে সামলে মঞ্জীরা দেখেছিল তাদের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে রোমিয়ো। তার রাগের অভিব্যক্তি উধাও, মুখেচোখে চরম বিভ্রান্তি। কুঁইকুঁই করতে করতে ভিতরের ঘরে ঢুকে গিয়েছিল।

দাঁড়ায়নি মঞ্জীরাও। ভয় উৎকণ্ঠা ছাপিয়ে লজ্জা আর কুণ্ঠা ঘিরে ফেলেছিল তাকে। চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে কয়েক মুহূর্তে নীচে অ্যাপক্যাবের সিটে বসে চোখ বন্ধ করেছিল সে। বুকের ভিতর তার সাঁজোয়া গাড়ির মিছিল। মন জুড়ে হাজার পদাতিক সৈন্যের মার্চ।

উত্তীয়র শরীরের ঘ্রাণ তার চেতনা ভরিয়ে রেখেছিল। দু’হাতে মুখ ঢেকে হঠাৎই সলাজ এক হাসিতে ভরে গেছিল মঞ্জীরা। তার ভিতরেও উত্তীয়র মতোই এক দুষ্টু মঞ্জীরা বলে উঠেছিল, ‘চলে এলি কেন রে পোড়ারমুখী! এই অবস্থা থেকে ফিরে আসতে আছে!’

গোটা ঘটনাটা ঘটতে মিনিট পাঁচেক সময় লেগেছিল বড়জোর। কিন্তু ওই পাঁচ মিনিটের স্মৃতি সে সারা জীবনেও ভুলতে পারবে না।

আশ্চর্য! এখনই কেন মনে পড়ে গেল কথাটা?

অন্ধকার ড্রয়িংরুমের সোফায় একটু ঘামতে লাগল মঞ্জীরা। নিঃশ্বাস গরম হচ্ছে, হালকা বুক ধড়ফড়। তার মনে হচ্ছে সদ্যস্নাত পুরুষের দেহগন্ধে এই ঘর ভরে যাচ্ছে। তবে সেই আবেশ বেশি ক্ষণ স্থায়ী হল না। তার জায়গা নিয়েছে এক তীব্র বিতৃষ্ণা। উত্তীয়র যে দু’চোখে অনুরাগের মেঘ দেখতে অভ্যস্ত মঞ্জীরা, প্রবল দায়ভারযুক্ত এক বিয়েতে কয়েক দিনের পর সেই চোখে অনুযোগ সইতে পারবে না সে। এটুকু বুঝল না উত্তীয়? বন্ধুত্বের সূত্রটুকুও খুলে নিল? তাকে ছাড়া কেমন ভাবে বেঁচে আছে মঞ্জীরা, এক বারও মনে হয় না তার?

সবাই স্বার্থপর, সব্বাই। মন বিদ্রোহ করে ওঠে মঞ্জীরার। দামি শো-পিস ছুড়ে দিতে ইচ্ছে হয় দেওয়ালের গায়ে, ডালের বাটি মেঝেয় আছড়ে ফেলতে মন চায়। মনে হয় ভেঙে চুরমার হয়ে যাক সাজানো গৃহিণীপনার অহঙ্কার। এ সময় ডাক ছেড়ে কাঁদতে পারলে ভাল লাগত। মন হালকা হয়ে যেত, নিরন্তর অভিযোজন কিছুটা সহনীয় ঠেকত। অথচ কান্না পেলেও মঞ্জীরা আবিষ্কার করল, শত চেষ্টাতেও সে কাঁদতে পারছে না, গোঙানির মতো শব্দ বেরোচ্ছে শুধু মুখ থেকে। তার বিতৃষ্ণা কেটে গেল, সেই জায়গা নিল এক তুমুল বিস্ময়। কবে সে পেরিয়ে এল কেঁদে হালকা হওয়ার সেই একলা রাতগুলো? কখন শুকিয়ে গেল চোখের কোল, কখন স্তিমিত হল অশ্রুর সেই অপার তরঙ্গের দল!

যাওয়ার সময় কি তার চোখের জলটুকুও নিয়ে গেল উত্তীয়?

চোখের জল এক আশ্চর্য পবিত্র ব্যাপার। নির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই কখনও গাল ভিজিয়ে দেয়, কখনও বা প্রবল ব্যথায় কাতর হলেও এক ফোঁটা জল আসে না চোখে।

মঞ্জীরা একলা পথে হাঁটছে। কয়েক দিন আগে এক রাতে অন্ধকার ঘরে বসে তার স্থির ধারণা হয়েছিল যে, তার চোখের জল পুরোপুরি শুকিয়ে গিয়েছে। কোনও কিছুতেই সে আর বিচলিত হবে না, কিন্তু এখন, এই চেনা চেনা গলিঘুঁজি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে খুব চেনা এক বিষণ্ণতা ফিরে ফিরে আসছে তার কাছে।

আশ্চর্য! আজকাল এই পাড়ায় আসাই হয় না তার, বড়জোর বছরে দু’-তিন বার। তবু এই পথঘাট যেন কত চেনা। বাস রাস্তা থেকে গলিতে গিয়ে কতটা পথ পেরিয়ে ডানে বাঁকতে হবে, নামকরা মিষ্টির দোকানের মালিক ঠিক কোন চেয়ারটায় বসে থাকবেন, কোন বহুতলের ছাদে জাহাজ আকৃতির জলের ট্যাঙ্ক... সব কিছু যেন চোখ বন্ধ করেও বলে দিতে পারে মঞ্জীরা।

কেন সব কিছু ভুলে যাওয়া যায় না? সেই বিস্মৃতি যে আশীর্বাদ হতে পারত তার জীবনে। সে শুনেছিল মানুষ সেটাই মনে রাখে, যেটা সে মনে রাখতে চায়। কথাটা কতটা ঠিক? যে বাড়ির, যে পাড়ার, যে মানুষগুলোর সঙ্গে তার অপার ব্যথার স্মৃতি জড়িত, কেন সেই মানুষগুলো আর সেই লোকালয়ের প্রতিটি জিনিস মঞ্জীরা ভুলতে পারে না?

এমন সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘিয়ে রঙের ওপর ভায়োলেট বর্ডার দেওয়া তিন তলা বাড়িটার সামনে এসে ডোরবেল বাজিয়েছে মঞ্জীরা।

লোপামুদ্রার শোওয়ার ঘরটা তিন তলায়। স্বামী জগন্ময় গাঙ্গুলি মারা যাওয়ার পর থেকে বড় ঘর ছেড়ে তিনি এই ঘরে উঠে এসেছেন। বাড়ির বাইরে তেমন পা রাখা হয় না। তার ওপর হাঁটুর বারোটা বেজে গেছে, ঠাকুরঘরের পাশের ছোট ঘরটাই এ সময় সুবিধেজনক মনে হয়েছিল তাঁর কাছে। আগের ঘরটা মন্দ ছিল না। তবে সিঁড়ির পাশে হওয়ায় ছেলেদের সংসারের কিচিরমিচির বড় বেশি ভেসে আসত সেই ঘরে, ভাল লাগত না লোপামুদ্রার।

আগামী সেপ্টেম্বরে সত্তর ছোঁবেন তিনি, এই বয়সে বেশি দৌড়ঝাঁপের দরকার নেই। দরকার ছিল শুধু ঠাকুরের কাছাকাছি থাকা, আর তাঁর কাছে যাওয়ার দিনের অপেক্ষা করা। তা ছাড়া জগন্ময় চলে যাওয়ার পরে অত বড় ঘর আর ভালও লাগছিল না।

মঞ্জীরা পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকল। কয়েক মুহূর্ত থমকে গেছে ঘরে পা রেখেই। ইজ়িচেয়ারে শুয়ে কাগজ পড়ছিলেন লোপামুদ্রা, কখন যেন চোখ লেগে এসেছে, ঘাড় এক দিকে কাত হয়ে আছে, চশমা নেমে এসেছে নাকের ডগায়।

এ বার বেশ কয়েক মাস পরে এল মঞ্জীরা। যে ভাবে এক দিন এ বাড়ি ছেড়ে চলে গেছিল মঞ্জীরা, তাতে সে যে আবার ফিরে আসতে পারে, এ কথা কেউ ভাবতে পারেনি। মঞ্জীরা অবশ্য নিজে থেকে শ্বশুরবাড়ি ফেরেনি আর, কিন্তু মাঝে মাঝেই লোপামুদ্রা ডেকে পাঠিয়েছেন তাকে।

পুরনো দিনের লোক, বয়সের ভারে কিছুটা ন্যুব্জ, কিন্তু অবুঝ নন। বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর এক বারও মঞ্জীরাকে ফিরে আসার কথা বলেননি। শুধু মাঝে মাঝে মঞ্জীরার ফোন বেজে উঠত, কাতর গলায় এক বার এ বাড়ি ঘুরে যেতে অনুরোধ করতেন লোপামুদ্রা। প্রথম প্রথম পাত্তা দেয়নি মঞ্জীরা। সময়ের সঙ্গে বরফ গলেছে, মঞ্জীরা এখন দু’-তিন মাসে এক বার হলেও এ বাড়িতে আসছে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে উঠে পড়ে। লোপামুদ্রার সঙ্গে কুশল বিনিময় হয়, ডাম্বোর কথাই হয় বেশি। মঞ্জীরার মোবাইলে ডাম্বোর ছবি দেখে মায়াভরা হাত বোলান স্ক্রিনে, কখনও মঞ্জীরার হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে চোখ ভিজে আসে লোপামুদ্রার।

মঞ্জীরাকে দেখে আজও আবেগ গোপন করতে পারলেন না বৃদ্ধা। প্রণাম সেরে উঠে মঞ্জীরা দেখল, তাঁর চোখ দিয়ে অঝোরে জলের ধারা নেমেছে।

লোপামুদ্রা মঞ্জীরাকে কাছে টেনে নিলেন। লোপামুদ্রার সংযম হারানোর কারণ আছে। নিজে পছন্দ করে, মঞ্জীরার বাবার সঙ্গে অনেক আলোচনার পর এই মেয়েকে নিজের বাড়ির বৌ করে এনেছিলেন তিনি। তখন আকাশদীপের বাবাও জীবিত, সংসারে লোপামুদ্রার আলাদা দাপট। ছোট ছেলের জন্য তাই বছর দশেকের ছোট মেয়ে আনায় ট্যাঁ-ফোঁ করতে পারেনি কেউ। আর তা ছাড়া সদ্য কুড়ি পেরনো মঞ্জীরাকে দেখামাত্র এক কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিল বাড়ির সবাই।

বিয়ে পাকা হতেও সময় লাগেনি। যে দিন বড় ছেলে আর বৌমাকে নিয়ে লোপামুদ্রা মঞ্জীরাদের বাড়ি গিয়েছিলেন, সে দিনই প্রায় বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করে এসেছিলেন তাঁরা। লোপামুদ্রা দেখেছিলেন আশ্চর্য শান্ত, সুন্দর আর নম্র একটি মেয়েকে। যে মেয়ে নিজের বাবার কথায় নিজের লেখাপড়ার সময়ে হঠাৎ বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়তে পারে, এমন মেয়েই চেয়েছিলেন লোপা। সে দিন মঞ্জীরার বাবাকে বলে ফেলেছিলেন, “আমার ছোট ছেলেরও আপনার মেয়ের মতোই ধাত। মায়ের কথা সে ফেলতে পারে না।”

মায়ের কথা ফেলেনি আকাশদীপ। বিয়ের প্রথম দিকে লোপা খেয়াল করেছিলেন, একটু যেন সংসারে মতিও এসেছিল তাঁর উড়নচণ্ডী ছেলের।

কলেজ জীবন থেকে ইউনিয়ন করলেও একটু সৃষ্টিছাড়া রাজনীতির ব্যাপার ছিল তার মধ্যে। এই শহরে প্রায় অপ্রাসঙ্গিক এক রাজনৈতিক দলের হয়ে দীর্ঘ দিন লড়ে গেছিল আকাশদীপ, হাওয়াটা পাল্টাল দিল্লির মসনদে সেই দল আসীন হওয়ার পর থেকে।

রাজ্য রাজনীতিতে তখন আকাশদীপের মতো লোকেদের মরা গাঙে জোয়ার আসার মতো ব্যাপার। দিল্লি থেকে বন্যার মতো টাকা আসছে, যেন তেন মূল্যে রাজ্যের দখল পেতেই হবে। দিনে দিনে পেশিশক্তি বাড়ছিল আকাশদীপদের।

আর তারই সঙ্গে বাড়ছিল আকাশদীপের মতো তরতাজা নেতাদের চাহিদা। ওর মতো উজ্জ্বল, শিক্ষিত ভূমিপুত্রের প্রয়োজন ছিল পার্টির।

এই সময় নাগাদ আকাশদীপের জীবনে দু’জন নতুন মানুষ এসেছিল, ডাম্বো তাদের এক জন। কয়েক দিন ছেলে ছেলে করে মেতে থেকে ফের দেশোদ্ধারে মন দিয়েছিল আকাশদীপ।

কিন্তু দ্বিতীয় জনকে এত সহজে ঝেড়ে ফেলা গেল না। অন্তরা শর্মা সেই দ্বিতীয় ব্যক্তি। সেন্ট্রাল রুলিং পার্টির স্পেশাল এজেন্ট অন্তরা শর্মার রাজনৈতিক উত্থান ছিল উল্কার গতিতে। রাজ্য রাজনীতিতে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা বাড়াতে স্পেশাল টাস্ক ফোর্সের অংশ হয়ে কলকাতায় এসেছিল অন্তরা। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই আকাশদীপ চোখে পড়ে গেল অন্তরার। অন্তরা অভিজ্ঞ মহিলা, আকাশদীপের মধ্যেকার স্পার্ক চিনে নিতে সময় লাগেনি তার। দুর্ঘটনার সূত্রপাত সেখানেই। দু’জনের সম্পর্ক যদি শুধুমাত্র পেশাগত ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকত, তবে পৃথিবীতে কিছু বিপর্যয় অন্তত কম ঘটত। কিন্তু প্রকৃতি স্থিতাবস্থা পছন্দ করে না। ক্রমশ ঘনিষ্ঠতা বাড়ল আকাশদীপ-অন্তরার। উঠতি রাজনৈতিক প্রতিভা এবং কেন্দ্রীয় সরকারি শাসক দলের মাস্টারমাইন্ড... অনেক ঝড়ের পূর্বাভাস নিয়ে কাছাকাছি এসে পড়ল তারা।

মঞ্জীরার এই সমস্যাটা প্রতি বারই হয়। শাশুড়ি ডাকলে মুখের উপর ‘না’ বলে দিতেও পারে না, অথচ এই বাড়িতে এলেও মন পালাই-পালাই করে। লোপামুদ্রাকেও ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারে না মঞ্জীরা। খুব নতুন কিছু যে ঘটে সে এলে তা-ও নয়, লোপাও যে খুব বেশি কথা বলেন তা-ও নয়, তবু মাঝে মাঝেই পুত্রবধূকে ডেকে আনা চাই।

ক্রমশ

অন্য বিষয়গুলি:

Short story
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy