Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
শব্দদানব তছনছ করে দিল আশপাশের সকলের কানের পর্দা। অথচ এমন মারাত্মক শব্দে হর্ন-বাদন কিন্তু সভ্য দেশের রীতি নয়।
noise pollution

Noise pollution: হর্নধ্বনি তব বাজিল রে

গাড়িতে জায়গায় জায়গায় আয়না লাগানোর কী দরকার!

অম্লানকুসুম চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০২১ ০৮:৫৫
Share: Save:

পুজোর সপ্তাহখানেক আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় যানজট। শহরের প্রায় সর্বত্র। এখন লকডাউন বা বিধিনিষেধের কড়াকড়ি প্রায় নেই। ফলে পুজো বাজারের জন্য রাস্তাঘাটে সেই পুরনো জনস্রোত। তৃতীয় ঢেউ? দূর মশাই! গায়ে ভ্যাকসিন ঠুসেছি না! যাঁরা রাস্তার ঝামেলা এড়ানোর জন্য পাতালপ্রবেশ করে ফেলেন, তাঁরা ভাগ্যবান। কিন্তু মর্ত্যভূমে বিচরণ ভিন্ন যাঁদের গতি নেই, তাঁরা বোঝেন ওপরটা ঠিক কেমন।

তবে শুধু প্রি-পুজো ভিড়ভাট্টাকে দোষ দিলে হবে না। সারা বছরই ভিড়ে বা ব্যস্ততায় এমন দৃশ্য চোখে পড়ে। তবে চোখে পড়ে না বলে কানে ঢোকে বললে ব্যাপারটা আর একটু ঠিক হয়। ট্রাফিক সিগন্যাল লাল হয়ে ছিল অনেক ক্ষণ। একদম সামনের সারিতে থাকা একটি গাড়ি হর্ন দিল। একটি গাড়ি হর্ন দিল বলে তার পাশের গাড়িও হর্ন দিল। তার পাশের গাড়িও। এ বারে পিছনের সারিতে থাকা গাড়িগুলোও হর্ন দেওয়া শুরু করল ক্রমাগত। যেন হর্ন দিলেই লাল সিগন্যাল সবুজ হবে জলদি। ফল হল, কয়েকশো গাড়ির তারস্বরে হর্ন। সিগন্যাল খুলে যাওয়ার পরে আগে যাওয়ার জন্য ফের হর্ন। ব্যস্ত সিগন্যালের পাশে থাকা গাছগুলো জানে, চব্বিশ ঘণ্টা তীব্র শব্দ থেকে তাদের নিস্তার নেই। রাস্তার ধার-ঘেঁষা বাড়িগুলোর হতভাগ্য বাসিন্দারা জানেন, নৈঃশব্দ্য বলে কোনও শব্দ অভিধানে থাকতে নেই।

স্টিয়ারিং-মানুষ হর্ন দেয় কেন? এক ট্রাকচালককে বলতে শুনেছিলাম, “এ তো অদ্ভুত বোকা বোকা প্রশ্ন দাদা। হর্ন না দিলে গাড়ি চলবে কী করে? হিন্দুস্তানে যত ট্রাক চলতে দেখবেন, তার নব্বই শতাংশের পেছনে নানা রঙের কালিতে জ্বলজ্বল করে— ‘ব্লো হর্ন’। কিংবা ‘আওয়াজ মারো’। এই কথাটা পড়েও পিছনের চালক যদি হর্ন না বাজান, তা হলে তিনি মস্ত ভুল করবেন। এ দেশের রাস্তায় চলতে গেলে তীব্র শব্দে হর্ন মারার কোনও বিকল্প নেই, হর্ন মারতে হবে পেয়ারসে।

ভিনদেশি পর্যটকরা ভারত ঘুরে ফেরার পর যখন ভ্রমণকাহিনি লেখেন, এ দেশের দারিদ্র আর উপচে পড়া জনসংখ্যার পাশাপাশি যে কথাটা তাঁদের রোমন্থনে উঠে আসে বার বার, তা হল ভারতের গাড়িগুলোর অনিয়ন্ত্রিত হর্ন। যে ভিনদেশিরা তাঁদের শান্ত রাস্তা দেখে কাটিয়ে দিলেন জীবনভর, এ দেশের মাটিতে পা দেওয়ার পর গাড়ির হর্ন তাঁদের কানে বোমার মতো লাগে। আন্তর্জালে খোঁজ নিলে দেখা যায়, তাঁদের অনেকেই বলছেন, “এতই যদি হর্ন দিতে হয়, তা হলে গাড়ির সাইডভিউ মিররগুলোর দরকার কী?” তাঁদের অবাক প্রশ্ন, “গাড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থারা যখন এই কাচগুলো লাগিয়ে দেয় গাড়ির শরীরে, তারা নিশ্চয়ই ভাবে চালকদের গাড়ি চালানোর ব্যাকরণ মেনে চলার কথা। ভাবে, ব্যাকরণ মেনে গাড়ি চালিয়ে তাঁরা নিশ্চয়ই যথাসাধ্য কম হর্ন দেওয়ার চেষ্টা করবেন।” ‘বাধ্য’ ড্রাইভাররা বলে থাকেন, দু’পাশের কাচ দিয়ে পাশের গাড়ির গতিবিধি বুঝে নিয়ে দিব্যি চালনা করা যায় নিজের গাড়ির স্টিয়ারিং। সত্যি কথা হল, ঠিকঠাক গাড়ি চালানোর জন্য অযথা হর্ন দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। শান্ত থেকেও মাইলের পর মাইল দিব্যি পাড়ি দিতে পারে গাড়ি। তবে কে শোনে কার কথা!

বিশ্বের উন্নত দেশগুলো পথ চলার যে ভদ্রতাকে স্বীকৃতি দিয়েছে, সেই ভদ্রতাবোধকে আমরা সম্মিলিত ভাবে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাই। ভারতফেরত এক জার্মান পর্যটক তাঁর ব্লগে লিখেছিলেন, ‘লোক চলাচলের জন্য রাস্তায় মোড়ে যে অনিয়ন্ত্রিত ক্রসিংগুলো আছে, তা নিয়ে এ দেশে গাড়ির চালক আর পথচারীদের মধ্যে এক অদ্ভুত খেলা চলে। দূর থেকে কোনও মানুষকে রাস্তা পার হতে দেখলে পৃথিবীর অন্য দেশের গাড়ির চালকরা গতি কমিয়ে দেন। মানুষটি যেন নির্ভয়ে রাস্তা পার হয়ে যেতে পারেন, তা নিশ্চিত করেন গাড়িচালকরা। ইন্ডিয়ার ব্যাপার আলাদা! লোক দেখলে গাড়ি গতি কমায় না, বরং তীব্র হর্ন দেয়। রাস্তা পার হওয়া লোকটি মাথার উপরে একটা হাত তুলে দেন। এ র মানে হল, থেমে থাক। আর গাড়ির চালক সেই হাতকে দুয়ো দেন প্রবল হর্নে। এই বেঁচে থাকার যুদ্ধে কেউ কপালজোরে রাস্তা পার হয়ে যেতে পারেন, কেউ ধাক্কা খান।’ সেই রসিক জার্মান লিখেছিলেন, ‘ধাক্কা মানে কি শুধু গাড়ির বডির সঙ্গে লোকের বডির ঠোকাঠুকি? গতি কমাতে বাধ্য হওয়া, প্রবল অপমানিত ভারতীয় চালকদের মুখ দিয়ে যে সব গালিগালাজ বেরিয়ে আসে পাইপের জলের মতো, তার ধাক্কাই বা কম কী!’

একটি সমীক্ষা বলছে, ভারতের বড় শহরগুলোয় শব্দদূষণের জন্য ৭০ ভাগ দায়ী গাড়ির এই আগ্রাসী হর্ন-নাদ। সদাব্যস্ত পাঁচমাথা কিংবা তিনমাথার মোড়ে দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে ডিউটি করেন যে ট্রাফিক সার্জেন্ট কিংবা সিভিক পুলিশ, মাথা ঠান্ডা রাখার কলাকৌশল তাঁদের থেকে শিখতে ইচ্ছে করে খুব। দিনে আট দশ ঘণ্টা এই প্রবল, অনিয়ন্ত্রিত শব্দের মধ্যে থেকেও বাড়ি ফেরার পরে তাঁদের মধ্যে কেউ হয়তো গান করেন, কেউ সন্তানকে পড়ান, কেউ হয়তো আবৃত্তির তালিম নেন। কোন জাদুতে তাঁরা তা সম্ভব করেন জানা নেই। হর্নের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে কত কথা বলেন চিকিৎসকেরা। তাঁদের মতে, তীব্র হর্নের ধ্বনিতে সবার প্রথমে মনে উদয় হয় প্রবল বিরক্তি। বিরক্তি থেকে মানসিক চাপ। আর এই চাপ পাথর হয়ে বসে যখন, তা রূপ নিতে পারে অবসাদে। আর অবসাদের শরীর থেকে যে আঁকশিগুলো বেরোতে চায় সব সময়, তাদের গায়ে লেপ্টে থাকে তীক্ষ্ণমুখ কাঁটা।

চিকিৎসকেরা বলেন, ১২০ ডেসিবেলের হর্নের সামনে ২০ সেকেন্ড কান পেতে থাকলেই মজাটা টের পাওয়া যায়। এই শব্দ এবং সময়ের যুগলবন্দি নাকি সাময়িক ভাবে শ্রবণশক্তি খোয়ানোর জন্য যথেষ্ট। অত্যধিক আওয়াজ আঘাত করতে পারে হৃদ্‌যন্ত্রেও। বাসের, বিশেষত দূরপাল্লার বাসের চালকরা যখন অর্ধোন্মাদের মতো হর্ন দেন, তাঁদের হৃদ্‌মাঝারে কী চলে, খুব জানতে ইচ্ছে করে। মনোবিদদের একাংশ বলে থাকেন, “কী চলে জানেন? গভীর হতাশা।” মানুষের মনের গ্লানির বহিঃপ্রকাশ কি হর্নের সময়কালের সঙ্গে সমানুপাতিক? বেশি বিরক্তি মানে কি আরও বেশি সময় ধরে হর্ন? মনের এক ডাক্তারবাবুকে বলতে শুনেছিলাম, “মন খারাপ ও হর্নের সম্পর্কটা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়।” মনের ক্ষোভ উথলে পড়ে যখন, বিরক্তির লকগেট বাধ্য হয়ে খুলে যায় যখন, তখন আমরা প্রবল আক্রোশে কেন চেপে ধরি হর্ন দেওয়ার বোতাম? বেশি জোরে চেপে ধরা মানে তো হর্নের বেশি আওয়াজ নয়। তা হলে? মনের আর্তনাদই কি হর্ন হয়ে বেরিয়ে আসতে চায়?

হর্নধ্বনি কমানোর জন্য বহু মানুষ এগিয়ে আসছেন আস্তে আস্তে। উদ্যোগ নিচ্ছে বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। রাস্তার মোড়ে মোড়ে লিফলেট বিলি হচ্ছে। কচিকাঁচারা হাতে প্ল্যাকার্ড ধরে দাঁড়িয়ে থাকছে ব্যস্ত রাস্তার পাশে। তাতে লেখা থাকছে, ‘আমার কষ্ট হয়, হর্ন দিয়ো না প্লিজ়।’ অনেকে আবার সাইকেল চেপে পাড়ি দিচ্ছেন শহরের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত। কিংবা এ শহর থেকে অন্য শহর। সাইকেলের অন্তরে-অন্দরে আঁকিবুকি করে বোঝানো থাকছে বেশি হর্নের বিপদ-আপদ। শব্দের অত্যাচার নিয়ে মাথা ঘামান যাঁরা, তাঁরা হাতজোড় করে মনে করিয়ে দিতে চান ‘নো হর্ন জ়োন’-এর কথা। নো হর্ন জ়োন মানে শহরের যেখানে হর্ন দেওয়া বারণ। এমন বোর্ড আমরা দেখেছি হাসপাতালের সামনে, কিংবা স্কুলের পাঁচিলের পাশে। এ ধরনের বোর্ড দেখার পরে এক জনকে বলতে শুনেছিলাম, “কার সঙ্গে এর তুলনা করা যেতে পারে ভাই? অনাথ, গোবেচারা এক শিশু, না কি কোনও দুয়োরানি? কার কষ্ট বেশি?” উত্তর দিতে পারিনি। শব্দসচেতন মানুষরা বার বার বলেন, “পুরো শহর না হয় হোক, অন্তত নো হর্ন জ়োনের সামনেও কি আমরা এই যান্ত্রিক তারস্বর থেকে খানিক বিরত হতে পারি না?” প্রশ্নগুলো যেন হর্নের তীব্র শব্দে চাপা পড়ে যায়।

কয়েক বছর ধরে দেশের বিভিন্ন শহর তাদের নিজেদের মতো করে পালন করা শুরু করেছে ‘নো হর্ন ডে’। হর্নমুক্ত দিবস। সে দিন সবাইকে অনুরোধ করা হচ্ছে যত কম সম্ভব হর্ন ব্যবহার করার কথা। দুঃখের কথা হল, প্রতীকী এই দিনটি প্রতীকী হয়েই থেকে যাচ্ছে। এই প্রতীকের মধ্যে নিহিত থাকে আরও কম শব্দে বেঁচে থাকার, পথ চলার যে সদিচ্ছা, তা সার্বিকভাবে পূরণ হতে এখনও ঢের দেরি।

কিছু মানুষকে বলতে শোনা গিয়েছিল, শব্দের এই দূষণকে আলপনা, মানে শ্রুতিমধুর করে দিলে কেমন হয়? গাড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলোকে চিঠি লিখে বলা যায় না, তীব্র শব্দের বি-ই-ই-প বা প্যাঁ পোঁ-কে বদলে দাও সেতার কিংবা সরোদের ধ্বনিতে? গাড়ি হর্ন দেবে। মনে হবে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আসর বসেছে রাস্তায়! হর্নের চিরাচরিত কান ঝালাপালা করা শব্দের চেয়ে এই ধ্বনি তো অনেক কোমল, সুখকরও বটে। এই খবরটি এক ট্রাকচালককে শোনানোর পরে তিনি যা উপহার দিলেন, তা হল অট্টহাসি। পরতে পরতে মিশে ছিল ব্যঙ্গ। বললেন, “গাড়ির পিছনে যে ‘আওয়াজ মারো’ লেখা রয়েছে, তা এই মিনমিনে ধ্বনিতে পোষাবে তো মশাই?... চলিয়ে, মজা লিজিয়ে!” বলে সোল্লাসে ফের টিপে ধরলেন হর্নের সুইচ। বললেন, “এই আওয়াজেই জান্নাত হ্যায়।”

অন্য বিষয়গুলি:

noise pollution
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy