আলোকচিত্র: নরেশ গুহর ক্যামেরায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ কৈশোর-পেরোনো ছেলেটির বিড়ম্বিত দশা আর সহকারী সুধাকান্তের ভ্রুকুটিময় মূর্তি দেখে মজা পাচ্ছিলেন। সুধাকান্ত রায়চৌধুরী বুঝতে পারছেন না, শান্তিনিকেতনের ‘উদীচী’ বাড়ির দোতলার এই ঘরে ছেলেটি কী করে পৌঁছল! পৌষ মাসের পড়ন্ত বেলার শীত। কবির গায়ে সাদা উলের মস্ত ঝোলা আংরাখা। বারান্দায় পায়চারি করছিলেন। তখনই খেয়াল করলেন, সিঁড়ি বেয়ে অপরিচিত এক সদ্য-যুবা ধীর পায়ে উঠে আসছে। তাকে দেখে তিনি ঘরে ঢুকে জানালার পাশে চৌকিতে বসলেন।
দুজনের মধ্যে কিছু কথা হতে না-হতেই সুধাকান্তবাবু সেখানে উপস্থিত। তাঁকে দেখে ভীত হল ছেলেটি। সে তখন যেন পালানোর পথ খুঁজছে। রবীন্দ্রনাথের প্রসন্ন হাসিটির মধ্যে একটু প্রশ্রয় ছিল। কথা বললে কবি আরও কথা বলতেন, কিন্তু ছেলেটি তার আগেই বিদায় নিয়ে নিয়েছে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে শুনলেন গুরুদেবের বিষণ্ণ স্বগতোক্তি: ‘এবার তোরা আমাকে মুক্তি দে, বড় ক্লান্ত আমি!’
সুধাকান্তবাবু জানতেন না, নরেশ গুহ নামের ওই কলেজপড়ুয়া উদীচী বাড়ির প্রধান প্রবেশপথ দিয়ে ঢোকেনি আদৌ। তার কবির কাছে পৌঁছনোর এই অভিযানটি রীতিমতো রোমহর্ষক। উত্তরায়ণ আর রতনকুঠির মাঝখান দিয়ে যে রাস্তাটি শ্যামবাটীর দিকে চলে গিয়েছে, সেই পথে মনমরা হয়ে ঘুরছিল নরেশ। সে দিনই সে শান্তিনিকেতনে এসেছে কলকাতা থেকে। প্রায় পায়ে হেঁটে। সঙ্গে বন্ধু শৈলেন। তাঁর পদবিও গুহ। তখন ১৯৩৯-এর পৌষ মাস। কবিকে এক বার দেখার ইচ্ছে পূর্ববঙ্গ থেকে সদ্য কলকাতায় আসা নরেশের। রিপন কলেজে প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছে। তখন সে নিজেও জানত না, এই কলেজেই এর পর সে বুদ্ধদেব বসুর সান্নিধ্য পাবে। জানত না, ‘কবিতা’ পত্রিকা থেকে শুরু করে ‘দুরন্ত দুপুর’ কাব্যগ্রন্থের রোমান্টিকতা পেরিয়ে তাকে পড়াতে হবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে, অধ্যক্ষ পদ নিতে হবে শান্তিনিকেতনেরই রবীন্দ্রভবনে! তখন কোথায় কী! প্রথম বর্ষের ছাত্র নরেশের তখন একটাই ইচ্ছে— অন্যদের মতো ট্রেনে চেপে বোলপুর যাত্রা নয়! অনেকটাই তীর্থযাত্রীদের মতো করে পদব্রজে শান্তিনিকেতনে যেতে হবে, সারতে হবে রবিপ্রণাম।
নরেশ গুহর এই পায়ে হেঁটে শান্তিনিকেতনে আসার সংবাদ আশ্রমে ছড়িয়ে গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথও শুনেছিলেন। কবি অসুস্থ, তাই লোকসাক্ষাৎ নিষেধ জেনে মনমরা নরেশ একা একা হাঁটছিল উদীচী বাড়ির পাশ দিয়ে। ওখানেই তো কবি আছেন। যদি এক বার দেখা যায়! হঠাৎ তার নজরে পড়ল, কাঁটাগাছের বেড়ার এক দিকে অনেকটা গর্ত হয়ে আছে। সারমেয়দের কীর্তি। আশেপাশে কাউকে দেখতে না পেয়ে কুকুর-যাতায়াতের ওই ছোট গর্ত দিয়েই শরীর গলিয়ে দিল ছেলেটি। পরনের জামা একটু ছিঁড়ে গেল, তা উপেক্ষা করেই সে কবি-সমীপে।
‘‘তুমিই সেই ছেলে, যে কলকাতা থেকে পায়ে হেঁটে এখানে এসেছ?’’— গুরুদেবের প্রশ্ন কানে গেলেও তাঁকে দেখে বিস্ময়াভিভূত নরেশের মুখে কথা সরে না। আরও কিছু কথার পর কবির কাছে ছেলেটির প্রস্তাব: ‘‘একটা ফটো নেব। নিজের হাতে। আপনি যদি রাজি হন…’’, কথাটা শেষ না হতেই রবীন্দ্রনাথ জানতে চাইলেন: ‘‘ক্যামেরা হাতে সব জায়গায় ঘুরে বেড়াও বুঝি?’’ এক আত্মীয়ের কাছ থেকে উপহার পাওয়া বেবি ব্রাউনি ক্যামেরাটি গুরুদেবের ছবি তোলার আশায় নরেশ-সঙ্গী। রবীন্দ্রনাথ সব শুনে বললেন: ‘‘আচ্ছা কালকে এসো। সকালে কলকাতা যাচ্ছি। ট্রেনের সময় জেনে নিয়ে আগেই চলে এসো।’’
গুরুদেবের এই মৌখিক অনুমতির কথা সুধাকান্তবাবু শোনেননি। আশ্রমের নিয়ম, টাকা জমা দিয়ে কবির স্বাক্ষর অথবা ছবি সংগ্রহ করতে হয়। তাই পরের দিন সকালবেলা গুরুদেবের অনুমতির কথা জানালেও সুধাকান্ত রায়চৌধুরী কঠিন স্বরে বলে দিলেন ‘‘হবে না।’’ কবিকে স্টেশনে নিয়ে যেতে তাঁর হাম্বার গাড়িটি উদীচীর সামনে উপস্থিত। ঢাকা থেকে এসেছেন বিখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক জন ছাত্র এবং এক জন পেশাদার ক্যামেরাম্যান। ভদ্রলোক তাঁর অতিকায় ক্যামেরাটি উঠোনে বসিয়ে ছবি তোলার আয়োজন করছেন। কাঙ্ক্ষিত সেই ফ্রেমে থাকবেন রবীন্দ্রনাথ, শহীদুল্লাহ ও ছাত্রদল। উদীচীর সিঁড়ি দিয়ে তাঁরা নেমে আসছেন। ঠিক তখুনি সুধাকান্তবাবুর ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে, ছোট ক্যামেরাটি নিয়ে এক ছুটে নরেশ উপস্থিত কবির সম্মুখে। ‘‘পেশাদার আলোকচিত্রীটিকে অশোভনভাবে পাশ কাটিয়ে রবীন্দ্রনাথের আরো সমীপবর্তী হ’তে হ’লো আমাকে, নয়তো আকারে ক্ষুদ্র বেবী ব্রাউনী ক্যামেরার সাহায্যে সুস্পষ্ট কোনো ছবিই বোধ করি তোলা যেত না’’— নরেশ গুহর ‘তীর্থভ্রমণ’-এর দিনলিপিতে আছে এই স্বীকারোক্তি।
ছবি উঠেছিল। প্রায় বছর ঘুরে যাওয়ার পর ঈষৎ অপ্রস্তুত শ্রান্ত দৃষ্টি কবির সেই ছবিতে রবীন্দ্রনাথ নিজে হাতে অটোগ্রাফও করে দিয়েছিলেন। তবে ঢাকার অতিথিদের মহাআয়োজনের সেই ছবি বহু পরে বহু সন্ধানেও নজরে পড়েনি নরেশ গুহর। তাঁর স্মৃতিতে বরং উজ্জ্বল ছিল চিত্রশিকারের পৌষপ্রাতে বেপরোয়া ছাত্রটির প্রতি কবির সতর্কবাণী। গাড়িতে ওঠার সময় মৃদু হেসে রবীন্দ্রনাথ বলে উঠেছিলেন: ‘‘গাড়ি চাপা পড়বে নাকি গো?’’
কৃতজ্ঞতা: সুচরিতা গুহ, অরিন্দম সাহা সরদার
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy